তিনি নৃত্যশিল্পী মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার। ছোটবেলা থেকেই নাচের প্রতি গভীর অনুরাগ। নানা নৃত্যশৈলীর সংমিশ্রণে গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব নাচের ভাষা।
Dance

Manjushree chaki Sarkar: মুগ্ধ নেহরু মালা পরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর গলায়

তাঁর নাচ দেখতেই অঝোর বৃষ্টি উপেক্ষা করে কানায় কানায় পূর্ণ হত প্রেক্ষাগৃহ। জীবনের সমস্ত বৃত্ত দক্ষ হাতে সামলেছিলেন এই প্রতিভাময়ী।

Advertisement

পাপিয়া রায়

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৮:৪৯
Share:

সৃজনশিল্পী: নৃত্যমঞ্চে মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার (দাঁড়িয়ে) ও রঞ্জাবতী সরকার (নীচে)।

গল্পটা শুনিয়েছিলেন ভাষাতাত্ত্বিক ও প্রবন্ধকার জ্যোতিভূষণ চাকী। চল্লিশের দশকের কাছাকাছি দিনাজপুরের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তারকাশিল্পী না আসায় দর্শকরা ক্ষুব্ধ। চেঁচামেচি, চেয়ার ছোড়াছুড়ি। উদ্যোক্তারা অসহায়। শিল্পীদের সঙ্গী ছিল বছর নয়-দশের একটি মেয়ে। নিরুপায় হয়ে এক জন মেয়েটিকে বললেন, ‘তুমি জিপসি নাচটা শুরু করে দাও।’ বাচ্চা মেয়েটি কাঁদো-কাঁদো স্বরে বলল, ‘আমার ভয় করছে।’ এক রকম জোর করেই তাকে মঞ্চে ঠেলে দেওয়া হল। মঞ্চে এসেই মেয়েটির ভয়-ডর উধাও। শুরু হল জিপসি নাচ। দর্শকরা অভিভূত। কিছু ক্ষণ পরে নাচ থামতেই দর্শকদের অনুরোধে খুদে শিল্পীকে আরও নাচতে হল। ছোট্ট মেয়েটি তিন রাউন্ড নাচল, তবু এতটুকু ক্লান্তি নেই। দর্শকরাও খুব খুশি। ঘোষণা হল, আপনারা শান্ত হোন, মঞ্জুশ্রী আবার আপনাদের নাচ দেখাবেন। দর্শকরা শান্ত।

Advertisement

পাবনায় প্রাসাদের মতো বাড়ি। একান্নবর্তী পরিবারের বিশ-পঁচিশ জন মানুষ এক সুরে বাঁধা। তাই ছোট্ট মঞ্জুর, মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার হয়ে ওঠার পরেও তাঁর কাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ তাঁর জ্যোতিকাকা।

মঞ্জু যখন হাঁটতে শিখেছে, তখনই পায়ে তাল দিয়ে হাত-পা নাড়াত। এক দিন বাড়ির এক অনুষ্ঠানে তার দিদি সন্ধ্যা আর কয়েক জন নাচছিলেন। তাঁদের দেখে আড়াই বছরের মঞ্জুর হাত-পা ঘুরিয়ে সে কী নাচ! ‘আমি ভোরের যূথিকা’, ‘সাঁঝের তারকা আমি’ ইত্যাদি গানের সঙ্গে মঞ্জু মহা উৎসাহে নাচত।

Advertisement

সব ঠিকই চলছিল, তবু হঠাৎ মঞ্জু এক দিন গৃহত্যাগী হল। কারণ, বাড়ির ছেলেদের দেওয়া হয়েছে বাগান পরিষ্কারের কাজ, আর মেয়ে বলে তার জন্য কাপ-ডিশ ধোওয়ার কাজ। সে নদীর পাড় ধরে হাঁটা শুরু করল। এত অসম্মান নিয়ে বাড়িতে থাকা যায় না। কিছু ক্ষণ চলার পরে ক্লান্ত হয়ে গাছের তলায় ঘুমিয়ে পড়াতেই বিপত্তি, বাড়ির লোক চ্যাংদোলা করে ফিরিয়ে নিয়ে এল। ক’দিন পরে বাবা বাড়ি ফিরে মেয়ের কুকীর্তির কথা শুনলেন। ন’বছরের মঞ্জুকে কাছে ডেকে আদর করে ওই সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য দিলেন একটা চকচকে টাকা। বললেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়াটা ঠিক হয়নি, অনেক বিপদ হতে পারত। বিয়ের পর এই গল্প শুনে মঞ্জুশ্রীর স্বামী পার্বতীকুমার সরকার বলেছিলেন, “হি ওয়াজ় অ্যাহেড অব হিজ় টাইম।” পার্বতীকুমারও নিজেও তা-ই ছিলেন।

পাঁচ-ছ’বছর বয়সে পাবনার স্কুলে লেখাপড়া শুরু। স্কুলে বন্ধুদের মধ্যে প্রিয় ছিল হেনা আর তার দিদি রমা (সুচিত্রা সেন)। নাচের সঙ্গে পাড়ার নাটক অভিনয়পর্ব চলত বাড়ির মস্ত বারান্দায়। ‘কেশবতী রাজকন্যা’-র নাট্যরূপ বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। রাজকন্যার ভূমিকায় সুচিত্রা সেন, রাজপুত্র মঞ্জুশ্রী চাকী, দৈত্যের ভূমিকায় খুড়তুতো ভাই নেপু। পাড়া-প্রতিবেশীরা কটাক্ষ করে বলতেন “খুকু তো একেবারে মদ্দা।” কারণ সে প্রায়ই গাছে চড়ে, ঘোড়ার গাড়ির সামনে বসে পড়ে, সাইকেল রিকশা দেখলেই বলে, “আমাকে একটু চালাতে দাও না!” তখন পাবনায় মেয়েরা সাইকেল চালাতেন না। খুকু কিন্তু ছেলেদের সাইকেল চালিয়ে ছোট ভাইদের সঙ্গে নিয়ে মাইলখানেক দূরে যাযাবরদের তাঁবুতে চলে যেত। যাযাবরদের রংবেরঙের সাজগোজ, নানাবিধ পসরা ভাল লাগত। প্রতিবেশীরা অভিযোগ করতেন খুকু খালি পায়ে ধুলো মেখে ভাইদের নিয়ে যাযাবর পাড়ায় ঘুরছে— “মেয়েকে সামলান, এ তো ভীষণ লজ্জার কথা।”

আবার স্কুলে ফার্স্ট হওয়ার জন্য অনেকের কাছে মঞ্জুর সাত খুন মাফ। পাশাপাশি নাচও চলতে লাগল সমান তালে। নানা সাংস্কৃতিক প্রচারপুস্তিকায় ছাপা হল পাবনার সর্বকনিষ্ঠ নৃত্যদুলালীর কথা। এক বার প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী মণিশঙ্কর পাবনায় এলেন অনুষ্ঠানে, ছোট্ট মঞ্জুর নাচ দেখে অভিভূত হয়ে বললেন, “তুমি কলকাতায় এস, আমি তোমায় নাচ শেখাব।” সেই সঙ্গে কিছু চলন ও নৃত্যমুদ্রা শিখিয়ে দিলেন। সেটাই মঞ্জুশ্রীর প্রথম প্রথাগত নৃত্যশিক্ষা।

কলকাতায় সপরিবার চলে আসতে হল দেশভাগের কারণে। পিছনে পড়ে রইল স্কুলে যাওয়ার পথ, নদী, সবুজশ্যামল প্রান্তর আর নীল আকাশ। তখনও তিনি জানেন না, আরও কত অজানা পথ তিনি পরিক্রমা করবেন পৃথিবীর নানা দেশে— আফ্রিকার অরণ্যাবৃত গ্রাম, আমেরিকার আলোকিত নগর, মণিপুরের পার্বত্য
সবুজ উপত্যকা।

স্বামী পার্বতীকুমার ছিলেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আফ্রিকান স্টাডিজ় বিভাগের রিডার। তিনি যখন নাইজিরিয়া যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন, মঞ্জুশ্রী গহন আফ্রিকার স্বপ্নে রোমাঞ্চে বিভোর। কাছের মানুষেরা বললেন, এ বার তা হলে মঞ্জুর নাচের পালা শেষ। দেশভাগের বিপন্নতার সময়েও পারিবারিক পরিবেশের জন্য মঞ্জুর তেমন অসুবিধে হয়নি, বরং কলকাতায় তাঁর লেখাপড়া ও নৃত্যচর্চা আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। বেলতলায় স্কুলে পড়ার সময়ে নানা আঙ্গিকের নৃত্যশিক্ষা চলতে লাগল গুরুদের কাছে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শক্তি রায়, শ্রীনৃপেন, গুরু প্রহ্লাদ দাস, গুরু মারুথাপ্পা পিল্লাই, গুরু আতম্বী সিংহ ও গুরু গোপাল পিল্লাই। কলকাতায় এস এন ব্যানার্জি রোডের ফ্ল্যাটে নাচের তালিম হত। ছোড়দা বিশাল আয়না কিনে দিয়েছিলেন মঞ্জুর নাচের প্র্যাকটিসের জন্য।

ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে উদয়শঙ্করের ‘কল্পনা’ দেখে রোমাঞ্চিত হলেন তিনি। ম্যাট্রিক পাশ করতেই অনাদিপ্রসাদের সম্প্রদায়ে ভর্তি, সেই সূত্রে নিউ এম্পায়ারে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান মঞ্চস্থ হল। এর পর বেথুন এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময়ে তিনি একই সঙ্গে মণিপুরি ও ভরতনাট্যম চর্চা করেছেন। তখন থেকেই এক আঙ্গিক থেকে অন্য আঙ্গিকে চলে যাওয়া শুরু হল সচেতন ভাবেই।

প্রেসিডেন্সিতে থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় এলিট সিনেমাহলে এক অনুষ্ঠানে দেবব্রত বিশ্বাস এলেন ‘নৃত্যের তালে তালে’ গান গাওয়ার জন্য। উনি বললেন, “শান্তিনিকেতনের মতো ভাবনৃত্য করলে আমি গাইব না।” আঙ্গিকের দুর্বলতা দেখলেই বলতেন এলেবেলে। দেবব্রত-মঞ্জুশ্রীর নৃত্য-গীতে স্টেজে নীলদিগন্তে ফুলের আগুন এক অনবদ্য চিত্রকল্প তৈরি করত।

১৯৫৭ সালে দিল্লির এক অনুষ্ঠানে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু নিজের গলার মালা খুলে মঞ্জুশ্রীর গলায় পরিয়ে বলেছিলেন, “দিস ইজ় ফর ইউ।” জর্জদা বলেছিলেন, “তুই একটা বুইড়ার মালা নিছস্।” বিয়ের রাতে সন্তোষ সেনগুপ্ত যখন পার্বতীকুমারকে জিজ্ঞেস করেন, পরের মাসে বোম্বেতে মঞ্জুশ্রীর অনুষ্ঠানের কথা, তিনি সানন্দে সম্মতি দিয়েছিলেন। পরে বলেছিলেন, “আমি আপত্তি করার কে? কনের কানে সে কথা গেলে হয়তো বিয়ের পিঁড়ি থেকেই চলে যাবেন।” এক অসাধারণ মানুষ ছিলেন পার্বতীকুমার। রবীন্দ্রভারতীর আঙিনায় প্রথম দেখেই ‘তালগাছের মতো লম্বা’ মেয়েটিকে তাঁর ভারী পছন্দ হয়েছিল। এর দু’বছর পর, ১৯৫৮-তে তাঁদের বিয়ে হয়।

বাংলা সাহিত্যে এমএ পাশ করে কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি নামী শিল্পীদের (দেবব্রত বিশ্বাস, অর্ঘ্য সেন, সন্তোষ সেনগুপ্ত, কমলা বসু) সঙ্গে নানা রাজ্যে অনুষ্ঠান করাও চলতে লাগল। নিজেকে পেশাদার নৃত্যশিল্পী ঘোষণা করায় এক বার কলেজের চাকরি চলে যায়, পরে অবশ্য অন্য কলেজে চাকরি পেয়ে যান।

স্বামীর সঙ্গে নাইজিরিয়া যাত্রা সবার কাছে নির্বাসনযাত্রা মনে হলেও মঞ্জুর জীবনে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে গেল। নাইজিরিয়ায় পাঁচ বছর প্রবাসকালে স্থানীয় সমাজে নিবিড় ভাবে মিশেছেন, অনেক বন্ধু পেয়েছেন, আর নানা অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজের নাচ, আফ্রিকান নাচ অধ্যয়ন করেছেন। আর জন্ম দিয়েছেন এক ফুটফুটে কন্যাসন্তানের। তাই নাইজিরিয়ার স্মৃতি তাঁর কাছে রত্নখনি। নাইজিরিয়া ছেড়ে আমেরিকা যেতে তাঁর কষ্ট হয়েছিল।

আমেরিকায় থাকার শুরুতে দেশটাকে বনবাস মনে হয়েছিল। পরে ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মডার্ন ডান্স’ বিভাগে নাচের ক্লাস শুরু করলেন। নাচ শেখাতে গিয়ে ক্রমশ পশ্চিমি ব্যালের সঙ্গে ভারতীয় নৃত্যের ফারাকগুলো বুঝতে পারলেন। সেই সঙ্গে মানুষ করে তুলছিলেন কন্যা রঞ্জাবতীকে। ওর কথা ভেবেই বাড়িতে একটা নাচের স্কুল শুরু হল। এই মেয়েরও ন’-দশ বছর বয়সে দেখা গেল, সব নাচ তার মুখস্থ। কিন্তু কিছুতেই মায়ের কাছে নাচ শিখতে চাইত না। মা’র কাছে মাতৃভাষা শেখা, বাবার কাছে উচ্চারণ শেখা, তার উপরে আবার নাচ! ভারী দুঃখ হত রঞ্জার! বারো-তেরো বছর বয়সে নাচে তার অনুরাগ এল। রূপে-গুণে অতুলনীয়া হয়ে উঠলেন রঞ্জাবতী— মায়ের যোগ্য নৃত্যসঙ্গিনী।

নিউইয়র্কে মার্থা গ্রাহামের অসামান্য সৃষ্টিগুলোর পাশাপাশি কার্নিংহাম নিকোলাই, পল টেলর, হোসে ইমন ও আরও অনেকের অনুষ্ঠান দেখলেন। পাশ্চাত্য মডার্ন ডান্স, নৃত্যশিল্পী ও চিন্তাবিদদের সঙ্গে যোগাযোগ এক নতুন জীবনকে উন্মোচন করল। তাঁর নৃত্যজীবন সংসারজীবনকে আরও আনন্দময় করে তুলত। নিত্যনতুন রান্না আর ঘর সাজানো নিয়ে নানা পরিকল্পনা চলত। অতিথিরা মুগ্ধ হতেন মঞ্জুশ্রীর ঘর সাজানো, উদ্যানচর্চা দেখে। এত কাজের মধ্যেই বাংলায় এমএ-র উনিশ বছর পরে কালচারাল আনথ্রপলজি-তে মাস্টার্স করলেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। নৃত্য আর নৃতত্ত্বে বিরোধ বাধল না। পিএইচডি-র জন্য অনুমতি পাওয়া গেল। ফিল্ডওয়ার্কের সময় মণিপুরকে
বেছে নিয়েছিলেন।

মণিপুরের রাজকুমারী বিনোদিনী দেবীর মুখে শুনেছি মঞ্জুশ্রীর মণিপুরবাসের গল্প। ছোট্ট রঞ্জা আর একটা সুটকেস নিয়ে মঞ্জুশ্রীর ফিল্ডওয়ার্ক শুরু হয়েছিল ইম্ফল থেকে অনেক দূরে, প্রত্যন্ত এক গ্রামে— অসম্ভব কষ্ট আর অসুবিধের মধ্যে। তারই মধ্যে কলকাতায় এসে জর্জদা এবং অর্ঘ্য সেনের গানের সঙ্গে ‘মীরা নৃত্যকথা’ ও ‘রুদ্রমধুর’ মঞ্চস্থ করে গেছেন। ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর বাঁধভাঙা বর্ষণের মধ্যেও বিদ্যামন্দির মঞ্চে দর্শকরা এসেছিলেন শুধু মঞ্জুশ্রীর নৃত্যের টানে।

তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল মণিপুরি লাইহারাওবা নৃত্যাচার ও সমাজে নারী-পুরুষের ভূমিকা। সারা দিন অজস্র কাজকর্ম ও পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকতে হত। এরই সঙ্গে সঙ্গে তৈরি করছিলেন নবনৃত্যের ব্যাকরণ। শাস্ত্রীয় নৃত্যের পাশাপাশি ময়ূরভঞ্জের ছৌ, শ্রীলঙ্কার ক্যান্তি, মণিপুরের থাং-টা ও লোকনৃত্যের বহু ভঙ্গি নবনৃত্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। শুরুতে নির্বাচন করলেন রবীন্দ্রনাথের ‘সবলা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘চণ্ডালিকা’। সমালোচনা আর তিরস্কারের পাশাপাশি পুরস্কারও অনেক পেয়েছেন— সঙ্গীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার, উদয়শঙ্কর পুরস্কার, শিরোমণি পুরস্কার। রাজ্য সরকারের সহযোগিতায় পাওয়া সল্টলেকে উনিশ কাঠা জমিতে ‘মৃত্তিকা’ নৃত্যকেন্দ্র স্থাপনের স্বপ্ন বোনা শুরু হয়।

নৃত্য তাঁর সমগ্র জীবনকে এক আশ্চর্য সম্পূর্ণতা দিয়েছিল। সবার সঙ্গে চিন্তাভাবনার আদানপ্রদানে নবনৃত্যের ভাষা সমৃদ্ধতর হয়ে উঠছিল। এরই মাঝে হঠাৎ বাতি নিভে গেল— উনচল্লিশ বছরের সব কাজের সঙ্গী পার্বতীকুমার চলে গেলেন। এই তীব্র গভীর বেদনার পথ অতিক্রম করতে নৃত্যই ছিল তাঁর সঙ্গী। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসতে লাগল আমন্ত্রণ। পুরনো ও নতুন প্রযোজনা (‘তোমারই মাটির কন্যা’, ‘চরৈবেতি’, ‘অরণ্যঅমৃতা’, ‘তাসের দেশ’ ইত্যাদি) দর্শকদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায়
ভরে উঠল।

সমস্ত ব্যক্তিগত দুঃখ কষ্টের আঘাত সামলেও এগিয়ে চলা থামাননি মঞ্জুশ্রী ও তাঁর আত্মজা। পাল্লা দিয়ে চলেছে ছাত্রছাত্রীদের রিহার্সাল, নতুন কোরিয়োগ্রাফি ভাবনা, অনুষ্ঠান। নতুন একটি কাজ শুরু হল, নবনৃত্যের ভাষার সন্ধান নিয়ে বই লেখা। তখন ডায়ালিসিস চলছে, হাত ফুলে গেছে, স্ক্রিপ্টের পাতায় রক্তের ফোঁটা পড়ছে, তবুও তিনি লিখছেন।

স্বামী ও কন্যার সঙ্গে মঞ্জুশ্রী ।

বহু ভাবনাচিন্তার পর বইয়ের নাম দিলেন ‘নৃত্যরসে চিত্ত মম’। প্রবল অসুস্থতায় মাঝে মাঝে চেতনা চলে যায়, পরিচিত ডাক্তার বুঝেছিলেন, বই লেখার কথা বললে একটু ভাল থাকেন, ডাক্তার আইসিইউ থেকে ডাকেন: “যিনি বই লেখার সঙ্গে যুক্ত, ওঁর সঙ্গে এসে কথা বলুন।” ২০০০ সালের কলকাতা বইমেলায় তীব্র যন্ত্রণা এবং ডাক্তারের আপত্তিতে বইয়ের প্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি যেতে পারলেন না, কিন্তু তাঁর আমন্ত্রণে সবাই উপস্থিত।

তিনি সে দিনও বলতে চেয়েছিলেন, “রবীন্দ্রনাথই আমার প্রেরণার উৎস। নৃত্যশিল্পীরূপে আমি তাঁর নৃত্যাদর্শ থেকে অনুপ্রেরণা পাই। কিন্তু আমি যখন নৃত্যনির্মাণ করি, সে নৃত্য হয়ে ওঠে আমারই স্বকীয় শৈল্পিক আত্মপ্রকাশ।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement