Freedom Fighter

কেউ মনে রাখেনি আসানসোলের হান্টারওয়ালিকে

আসল নাম বিমলপ্রতিভা দেবী। ভগত সিংহের নওজওয়ান সভা থেকে জাতীয় কংগ্রেস। স্বাধীনতার পরও শ্রমিক আন্দোলনের নেত্রী। শ্রমিকদের পাওনা, তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, খাবার, ওষুধপথ্যের ব্যবস্থাতেই কাটিয়েছেন সারা জীবন। সুশান্ত বণিকতিনি বিমলপ্রতিভা দেবী। স্বাধীনতা সংগ্রামী। দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করতে সামনে থেকে আন্দোলন করেছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০২০ ০০:১৯
Share:

স্মৃতিচিহ্ন: দামোদর নদের তীরে বিমলপ্রতিভা দেবীর বাসগৃহের ধ্বংসাবশেষ। ডান দিকে, কুইলাপুর থেকে ঢাকেশ্বরী হয়ে সূর্যনগর যাওয়ার রাস্তায় তাঁর নামফলক। ছবি: পাপন চৌধুরী

চাবুক হাতে ঘোড়ার পিঠে হান্টারওয়ালি। কখনও পাকদণ্ডী বেয়ে, আবার কখনও জঙ্গলের পথে টগবগ করে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন তিনি। এক কয়লা খাদান থেকে আর এক কয়লা খাদান। শ্রমিক শোষণের খবর পেলেই চাবুক হাতে অকুস্থলে। সাক্ষাৎ যম হয়ে দাঁড়াচ্ছেন কয়লা খাদান মালিকদের মুখোমুখি। তাঁর আশ্রয়ে নিশ্চিন্ত হচ্ছে শ্রমিকরাও। নিয়মিত শ্রমিক মহল্লায় ঘুরে ঘুরে ওষুধপথ্য দেওয়া ও শ্রমিকের ছেলেমেয়েদের পড়ানোর ব্যবস্থা করছেন তিনি। কারও কোনও প্রয়োজনে হলেই হান্টারওয়ালির শরণ। তিনিও নিজেকে ওদের সেবায় উজাড় করে দিচ্ছেন।

Advertisement

তিনি বিমলপ্রতিভা দেবী। স্বাধীনতা সংগ্রামী। দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করতে সামনে থেকে আন্দোলন করেছেন। বহু বার জেলও খেটেছেন। ১৯০১ সালের ডিসেম্বর মাসে ওড়িশার কটক শহরে তাঁর জন্ম। বাবা সুরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় স্বদেশিদের পছন্দের মানুষ ছিলেন। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর পরোক্ষ যোগাযোগ ছিল। ছোটবেলা থেকে এমন একটি ইংরেজ-বিরোধী পরিবেশেই বেড়ে ওঠেন বিমলপ্রতিভা দেবী। সঙ্গে বাবার অনুপ্রেরণা তো ছিলই। তাই আরও বেশি করে স্বাধীনতা আন্দোলনে আকৃষ্ট হন।

সবেমাত্র বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হচ্ছে, এমন সময়ই রক্ষণশীল পরিবারের ইচ্ছেয় তিনি একটি বনেদি পরিবারের গৃহবধূ হয়ে কলকাতায় চলে গেলেন।

Advertisement

কিন্তু রক্তে বিপ্লবের টান তাঁকে বেশি দিন সংসারের বেড়াজালে আটকে থাকতে দেয়নি। পরিবারের বাঁধন ছিঁড়ে তিনি স্বদেশি আন্দোলনে শামিল হলেন। শুরু হল বিভিন্ন সভা সমিতিতে যাওয়া আসা, অহিংস বৈপ্লবিক কাজকর্মও। বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরে ঘুরে স্বদেশি আন্দোলনের প্রতি সাধারণ নারীদের উদ্বুদ্ধ করার কাজও করেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি তাঁর এই অগাধ প্রেম দেখে উচ্ছ্বসিত হলেন ভগত সিংহ। এক দিন সবার অলক্ষে নিজের কাছে ডেকে পাঠালেন। তাঁর হাতে তৈরি ‘নওজওয়ান সভা’য় যোগ দেবার আহ্বানও জানালেন বিমলপ্রতিভাকে। মাসকয়েক সাধারণ কর্মী হিসেবে কাজ করার পর তাঁকে এক দিন এই সংগঠনের বাংলা প্রদেশের চেয়ারম্যান মনোনীত করা হয়। এরই মাঝে ১৯২৮ সালে তিনি কংগ্রেসের সদস্যপদ পান। নওজওয়ান সভা ও কংগ্রেস, এই দুই সংগঠনের কাজ সমান তালে চালিয়ে যেতে থাকলেন। কিন্তু মনে স্বস্তি ছিল না। আন্দোলনের গতিপ্রবাহে কোথাও কিছুর একটা অভাব বোধ করতে শুরু করলেন। ছোটবেলা থেকে ডাকাবুকো বিমলপ্রতিভা জোর করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। কংগ্রেসের সদস্য হয়েও তিনি গোপনে সশস্ত্র বিপ্লবীদের নানা ভাবে সাহায্য করতেন। তাঁদের মতাদর্শের প্রতি অনুভব করলেন গভীর আকর্ষণ। এ সময় তাঁর সঙ্গে অহিংসপন্থীদের যথেষ্ট মতপার্থক্যও হয়। তিনি বার বার বোঝানোর চেষ্টা করেন, স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে হবে। ভিক্ষা করে পাওয়া যাবে না।

নরমপন্থীরা সে কথা শুনলেন না। ফলে বিমলপ্রতিভার সঙ্গে নরমপন্থী বিপ্লবীদের সংঘাত শুরু হল। কোণঠাসা হয়ে গেলেন তিনি। শেষমেশ ১৯৪০ সালে শুরু হল নতুন অধ্যায়। দেশ জুড়ে একাধিক সশস্ত্র সংগ্রামের পুরোভাগে থেকে কাজ করার সুবাদে তিনি ক্রমশ বিপ্লবীদের চোখের মণি হয়ে উঠলেন। ইংরেজদের কাছে ত্রাস হয়ে ওঠায় তাঁকে বেশি দিন জেলের বাইরে রাখেনি ব্রিটিশ সরকার। ১৯৪১ সালের শেষের দিকে বিমলপ্রতিভা গ্রেফতার হন। বছরদেড়েক প্রেসিডেন্সি জেল, তার পরে দেশের নানা জেলে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কারাবাস। ১৯৪৫ সালের শেষের দিকে মুক্তি। ইতিমধ্যে স্বাধীনতার দিনক্ষণও ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরেরও ডঙ্কা বেজে গিয়েছে। তাই জেল থেকে মুক্তির পর সরাসরি শ্রমিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তবে এখানেও তাঁর একটি মতাদর্শ
কাজ করেছে। তখন দেশীয় শিল্পের মালিকেরা প্রায় সকলেই ব্রিটিশ। কয়লা খাদানগুলিও অধিকাংশ ব্রিটিশ মালিকানাধীন। তিনি জানতেন, এ সব শিল্প ও খাদানগুলিতে শ্রমিকদের উপরে
চূড়ান্ত শোষণ চলে। সেই শোষণের হাত থেকে শ্রমিকদের মুক্তি ও তাদের জীবনযাত্রার মানের
উন্নতির সঙ্কল্প নিয়েই বিমলপ্রতিভা শুরু করলেন নতুন আন্দোলন।

সে সময় রিভলিউশনারি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা-নেতা সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংস্পর্শে এলেন বিমলপ্রতিভা। সৌম্যেন্দ্রনাথের অতি সাধারণ জীবনযাপন ও উন্নত চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হলেন তিনি। এর পর বিমলপ্রতিভা তাঁর পার্টিতে যোগ দিলেন। দলের কাজকর্ম বুঝতে প্রাথমিক পাঠ নিতে কেটে যায় আরও কয়েক মাস। এই সময়ে কলকাতাতেই ছিলেন তিনি। প্রাথমিক পাঠ শেষ হওয়ার পর নেতৃত্বের কাছে তিনি নিজেই কয়লা খাদানের শ্রমিকদের জন্য কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। অনুমতি মেলে। সোজা চলে আসেন রানিগঞ্জ খনি এলাকায়। প্রথমে পার্টির অনুগামীদের বাড়িতে থেকে কাজ শুরু করেন। পরে অনুভব করেন, শ্রমিক বস্তির কাছাকাছি না থাকলে কাজ করতে অসুবিধে হচ্ছে। অতএব নতুন আস্তানার খোঁজ। বার্নপুরের সূর্যনগর থেকে আরও দক্ষিণে দামোদরের ধারে কয়েক বিঘা জায়গা কিনে একতলা বাড়ি তুলে বসবাস শুরু করলেন। আশেপাশে কয়েকটি শ্রমিক বস্তি। বস্তির শ্রমিকেরা কেউ কয়লা খাদানে, কেউ ইস্কো-র ইস্পাত কারখানায়, কেউ আবার ঢাকেশ্বরী কটন মিলে কাজ করেন। বিমলপ্রতিভার লক্ষ্য ছিল এ সব সংস্থায় কর্মরত শ্রমিকদের শোষণের হাত থেকে মুক্ত করা। শুরু হল তাঁর নতুন সংঘর্ষ।

আশপাশে ঘন ঝোপঝাড়, জঙ্গল। সর্বত্রই মেঠো পথ বা পাকদণ্ডী। অন্য কোনও পরিবহণ না থাকায়, যাতায়াতের সুবিধের জন্য তিনি ঘোড়ায় চড়তেন। নতুন জায়গায় ডেরা বাঁধার পরেই নিজের জন্য ঘোড়া কিনেছিলেন বলে শোনা যায়। বার্নপুর, আসানসোল, রানিগঞ্জ, কুলটি, ডিসেরগড়-সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছিল তাঁর অবাধ যাতায়াত। যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিকের মতো পোশাকে গোড়ালিবদ্ধ জুতো পরে চাবুক হাতে ঘোড়ার জিন টেনে ছুটে বেড়াতেন এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। তাঁর এই রুদ্রাণী মূর্তি ও আচরণের জন্য গোটা খনি অঞ্চলে তিনি ‘হান্টারওয়ালি’ বলে পরিচিত হলেন। কয়লা খাদান মালিকদের হাতে শ্রমিক শোষণের খবর পেলেই ছুটতেন। শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা আদায় করেই ছাড়তেন। তবে এ-ই নয়। আশপাশের শ্রমিক ধাওড়ায় ঘুরে ঘুরে শ্রমিক-সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা, অসুখ হলে ডাক্তার ও পথ্য, সবটাই করতেন নিজের হাতে। শ্রমিকেরাও আপদে-বিপদে ছুটে আসতেন তাঁর কাছে। সূর্যনগর, ঢাকেশ্বরী, দামোদর, কুইলাপুর এলাকায় বিমলপ্রতিভার কীর্তি আজও মুখে মুখে ফেরে। সূর্যনগরের বাসিন্দা তথা ঢাকেশ্বরী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালন কমিটির প্রাক্তন সভাপতি সুমঙ্গল লাহিড়ী জানালেন, তখন তাঁরা খুবই ছোট। ঢাকেশ্বরী স্কুলের ছাত্র। প্রায়ই তাঁরা দেখতেন, স্কুলের সামনের মেঠো পথ ধরে কখনও ঘোড়া ছুটিয়ে, আবার কখনও হেঁটে চলেছেন বিমলপ্রতিভা দেবী। দামোদরের তীরে তাঁর বাসভবন থেকে কিছু দূরে একটি গোয়ালাপট্টি রয়েছে। বিমলপ্রতিভার কীর্তির কথা শুনিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দারাও। পট্টিতে বসবাসকারী বর্তমান প্রজন্মের কেউই তাঁকে দেখেননি। তবে তাঁর কথা পূর্বপুরুষদের মুখ থেকে শুনেছেন। বিমলপ্রতিভা সম্বন্ধে কেউ কিছু জানতে চাইলে সেই শোনা কথাই আউড়ে যান তাঁরা।

১৯৭৮ সালে মারা গিয়েছিলেন বিমলপ্রতিভা। ২০ বছর আগে তাঁর জন্মশতবর্ষ পেরিয়ে গিয়েছে। স্বাধীন ভারতে কয়লা খাদানের শ্রমিকদের প্রাপ্য অধিকার ও ন্যায্য দাবি আদায়ের লড়াইতে নিবেদিতপ্রাণ এই মহীয়সীকে আজ আর কেউই মনে রাখেননি। ২০০১ সালে সাবেক আসানসোল পুরকর্তৃপক্ষ, সূর্যনগর ও ঢাকেশ্বরীতে দুটি স্মৃতিসৌধ বানিয়েছিল। এখন সেগুলির নিতান্তই ভগ্নদশা। কুইলাপুর মোড় থেকে ঢাকেশ্বরী হয়ে সূর্যনগর পর্যন্ত রাস্তাটি ‘বিমলপ্রতিভা দেবী সরণি’ নামকরণ করা হয়েছিল। কিন্তু অনেকেই তা জানেন না। স্থানীয়রা রাস্তাটিকে ঢাকেশ্বরী রোড বলেই জানেন। বার্নপুরের দামোদর থেকে আরও কিছুটা দক্ষিণে দামোদর নদের তীরে জঙ্গল পরিবৃত একটি পরিত্যক্ত জায়গায় এখনও বিমলপ্রতিভা দেবীর বাসভবনের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। দূর থেকে ওই স্থানটি জঙ্গলে ঘেরা টিলার মতো মনে হয়। বোঝার উপায়ই
নেই, সেখানে কোনও দালানবাড়ির ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। তাঁর স্মৃতির মতোই এই স্মৃতিচিহ্নগুলোও ক্রমশ বিলুপ্তির পথে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement