Tribute to Parameswaran Thankappan Nair

কলকাতা চর্চাই ছিল তাঁর সাধনা

প্রবল শারীরিক ধকল সয়ে, ভঙ্গুর নথিপত্র ঘেঁটে তা চালিয়ে গিয়েছিলেন আজীবন। কলকাতা চষে কাঁসারিটোলার ছোট্ট ঘরে দুষ্প্রাপ্য বই-সংগ্রহ গড়ে তুলেছিলেন পরমেশ্বরন থনকাপ্পান নায়ার।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০২৪ ০৭:১৪
Share:

সংগ্রাহক: কলকাতাকে ভালবেসে তার ইতিহাস সংগ্রহ করতেন পরমেশ্বরন থনকাপ্পান নায়ার।

হঠাৎ টাউন হলে হাজির গ্রিক গবেষক মিল্টন স্পাইরো, সঙ্গে বেমক্কা প্রশ্ন, “প্যানিয়োটি ফাউন্টেন-টা কোথায় বলতে পারেন? পিটি নায়ার আমায় পাঠিয়েছেন!”

Advertisement

প্রশ্ন শুনে রীতিমতো অস্বস্তিতে সরকারি আধিকারিকেরা। লর্ড রিপনের ঘনিষ্ঠ গ্রিক রাজপুরুষ দিমিত্রিয়ুস প্যানিয়োটি। নায়ার বলে দিয়েছেন, কলকাতার ময়দানে প্যানিয়োটির নামে ফোয়ারা রয়েছে। কিন্তু ময়দানে কোথায়, ঠাহর করতে পারছিলেন না টাউন হলের তরুণ গবেষক (অধুনা অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর) শশাঙ্ক বন্দ্যোপাধ্যায়।

ঘটনাটি বছর বাইশ আগের। এর কয়েক বছর আগেই পরমেশ্বরন থনকাপ্পান নায়ার তাঁর আজীবনের সম্পদ বিপুল বই-সংগ্রহ কলকাতা পুরসভাকে বিক্রি করে দিয়েছেন। তা রাখা হয়েছে টাউন হলের আনকোরা গ্রন্থাগারেই। স্পাইরোর আবদারে খোঁজ করে কলকাতার অন্য এক বিদগ্ধ ঐতিহ্যপ্রেমীর থেকে শশাঙ্ক শুনলেন, কার্জন পার্কের ইঁদুরের গর্তের পাশের সৌধটাই গ্রিক সাহেবের নামের ফোয়ারা। দেখা গেল, ফোয়ারা বহু যুগ অকেজো থাকলেও স্থাপত্যটির গায়ে গ্রিক অক্ষর। স্পাইরো খবর পেয়ে মহানন্দে ছবি তুলে গেলেন। শশাঙ্করও মনে পড়ল, সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে এক বাদুলে বিকেলে এই সৌধের সিঁড়িতেই তুলসী চক্কোত্তি ‘পরশপাথর’ খুঁজে পেয়েছিলেন। রাত দিন কেতাবে ঘাড় গুঁজে থাকা নায়ারমশাই সম্ভবত ‘পরশপাথর’ দেখেননি। তবে গোটা কলকাতা চষে ফেলে কাঁসারিটোলার চিলতে ঘরে পরশপাথরের মতোই দুষ্প্রাপ্য বই কুড়িয়ে এনেছেন।

Advertisement

নায়ারের সংগ্রহে আদি যুগের বাঙালি অভিধানকার, কেশব সেনের ঠাকুরদা রামকমল সেনের দুষ্প্রাপ্য ইংরেজি-বাংলা অভিধান দেখে তাজ্জব সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। কোত্থেকে পেলেন? চাপাচাপিতে মিতভাষী মালয়ালি দুষ্টু হাসেন। “চোখ খোলা রাখতে হয়, ভালবাসতে হয়!”

মধ্য-পঞ্চাশে এশিয়াটিক সোসাইটির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হওয়ার আগে দীর্ঘদিন স্থায়ী উপার্জন ছিল না নায়ারের। স্ত্রী কেরলে ইস্কুলে পড়িয়ে ছেলেমেয়েদের সামলাচ্ছেন। এক বেলা স্বপাক ভাত-তরকারি আহার, সাকুল্যে খান চারেক প্যান্ট-জামার মালিক নায়ার শুধু তাঁর বইয়ের সংগ্রহ বাড়িয়ে চলেছেন। বিলাসিতা বলতে এক ফ্লাস্ক কফি আর দু’-তিনটে সিগারেট। দুধের লাইনে সময় লাগে। ষাট পেরিয়ে পড়ার সময় বাঁচাতে কফিতে দুধও বন্ধ করে দিলেন। ১৯৯৯-এ তাঁর ছোট ছেলের মৃত্যুর পরেই কলকাতাকে বিদায় জানাবেন ঠিক করেছিলেন। বইপত্র টাউন হলে বিক্রি করলেন। কিন্তু পঁচাশি বছর বয়স পর্যন্ত কলকাতার মায়া কাটাতে পারলেন না। তখনও কাঁসারিটোলা থেকে হেঁটে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে লেখাপড়া করতে যাওয়া তাঁর নিত্য রুটিন।

ভাঁড়ারে আশ্চর্য সব সংগ্রহ বইপাগল বৃদ্ধের। ‘ইকোজ় ফ্রম ওল্ড ক্যালকাটা’-র লেখক বাস্টিডের সই করা বই, ১৮৬০-এ লর্ড নেপিয়ারের সংগ্রহের আউট্রামের মূর্তি স্থাপন বিষয়ক কমিটির পুস্তিকা, ‘ক্যালকাটা গেজেট’, ‘বেঙ্গল পাস্ট অ্যান্ড প্রেজ়েন্ট’-এর সব সংখ্যা। বাড়িতে কোথায় কী বই, এবং তার ছত্রে ছত্রে কী লেখা, তা প্রায় সত্যজিতের সিধুজ্যাঠার মতোই গড়গড়িয়ে বলতে পারতেন নায়ার। শশাঙ্ক বলেন, “মুখস্থবিদ্যে নয়! এটাই সাধনা! কলকাতাকে ভালবাসারও প্রকাশ!” বৃহদায়তন ‘আ হিস্ট্রি অব ক্যালকাটা স্ট্রিটস’ ঘেঁটে তারাপদ সাঁতরা, দেবাশিস বসুরা দেখিয়েছেন, বাংলা পড়তে পারতেন না বলে কলকাতার কিছু রাস্তার নামের মানে বুঝতে ভুল হয়েছিল নায়ারের। তা বলে অসম্ভব শারীরিক ধকল সয়ে ভঙ্গুর সব নথি ঘেঁটে নোট নিয়ে তাঁর নিরলস কলকাতা-চর্চাকে খাটো করা যায় না।

‘আরে হু নোজ় দ্য হিস্ট্রি অব ক্যালকাটা’ বলে উঠে মাঝেমধ্যে ছেলেমানুষের মতো খেপে যেতেন নায়ার। বাংলা বুঝলেও উচ্চারণদোষে বলতেন না একটিও শব্দ। কিন্তু রেগে গিয়ে ‘আরে’টা বলতেন নির্ভেজাল বাঙালিসুলভ ভঙ্গিতে। ১৯৫৫-এর সেপ্টেম্বরে ট্রেনের টিটিই-কে ফাঁকি দিয়ে প্রথমবার কলকাতায় এলেন আদি শঙ্করাচার্যের জন্মস্থান কালাডির কাছে কেরলের মফস্‌সলে মুদির দোকানির পুত্র। সম্বল বলতে ম্যাট্রিকের ডিগ্রি আর রেমিংটন টাইপরাইটার। রেডিয়ো, টিভি, ইন্টারনেটের জগৎ থেকে বহু দূরে থেকেও নায়ারের দীর্ঘ দিন মনে ছিল, নিরুপা রায় তখন পর্দার নায়িকা। সিনেমাহলে ‘পথের পাঁচালী’ চলছে।

সম্ভবত ‘অ্যানথ্রপলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’য় নির্মল বসুর স্টেনোগিরি করতে করতেই কলকাতার ইতিহাসের নেশা পেড়ে ফেলে তাঁকে। ইতিমধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ডিগ্রি হাতে এসেছে। ১৯৬৬-তে বিয়ের পরে কেরলে ফিরে জেলা বা মহকুমা আদালতে প্র্যাকটিসও করতে পারতেন। তার বদলে বনের মোষ তাড়িয়ে কলকাতা-চর্চা। নায়ার নানা সময়ে বলেছেন, তাবড় ইতিহাসবিদেরা তাঁকে আমল দেননি। কলকাতার ইতিহাস-চর্চা করতে গেলে বিলেতে যেতে হবে, এটাই মনে করা হত। নায়ার অত টাকা পাবেন কোথায়! ইতিহাসের গবেষণায় শেষ কথা বলে কিছু হয় না। তবু নায়ারের জন্য সতেরো, আঠেরো, উনিশ শতকে কলকাতা বিষয়ক বিদেশিদের নথি, হাই কোর্ট, পুরসভা, পুলিশ, সংবাদমাধ্যমের আদি যুগের ইতিহাস সঙ্কলিত হয়েছে।

তবে বই থেকে রয়্যালটির কার্যত পরোয়া করতেন না নায়ার। তাঁর কয়েকটি বইয়ের প্রকাশক আদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “উনি উল্টে রামমোহন লাইব্রেরি ফাউন্ডেশনের মতো বড় জায়গায় বেশ কিছু কপি অর্ডার করিয়ে দেবেন! বইয়ের পয়সা উঠে আসবে।” কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বই কারবারি ইয়াকুবকে দিয়েও নায়ার জোব চার্নককে নিয়ে নিজের বই করিয়েছেন।

পছন্দের বইটির জন্য নায়ারের আকুলতাও কিংবদন্তিসুলভ! সুবর্ণরেখা-র ইন্দ্রনাথ মজুমদারের পুত্র তুষার কিংবা সাগ্নিক বুকস-এর আদিত্য তা টের পেয়েছেন। মুদ্রাবিশারদ নিকোলাস রোডস বইমেলায় অমুক দোকান থেকে সাংঘাতিক সব বই পেয়েছেন, শুনে ‘পজ়েসিভ’ প্রেমিকেরমতো নায়ারের অভিমান, আমায় কেন আগে খবর দেওয়া হল না!

আরও কিছু অভিমান নায়ার বহন করেছেন। ন্যাশনাল লাইব্রেরি বা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কর্তৃপক্ষ কিছু নথি নায়ারকে ফোটোকপি করতে দিতে অপারগ হন। আর মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সংশয় প্রকাশ করেন, এত বই আপনি নিজে লিখেছেন! নায়ারের বইয়ের সংগ্রহ কত দূর অমূল্য ছিল, ১৯৯৯ সালে মেয়র প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়ের আমলে দশ লক্ষ টাকা দিয়ে পুর-কর্তৃপক্ষের কিনে নেওয়াতেই তার প্রমাণ। ২০১৮-য় কলকাতা ছাড়ার সময়ে তাঁর সংগ্রহের আরও শ’আটেক বই নিখরচায় টাউন হলে দিয়ে যান নায়ার।

শশাঙ্ক বলেন, “নায়ার টাউন হলে বহু বার এলেও কখনও লাইব্রেরিতে নিজের বইগুলির মুখোমুখি হননি। হয়তো প্রিয়জন কাছছাড়া হওয়ার কষ্ট পেতেন।” এর্নাকুলামের চেন্ডামঙ্গলমে তাঁর দেহ প্রকৃতিতে মিশে গেলেও, কলকাতার বইঘরেই নায়ারের প্রাণস্পন্দন আজও শোনা যাচ্ছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement