Durga Puja 2024

‘চলো চলো গিরি, প্রতিবাদে ঘিরি’

সমাজমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে এমনই বার্তা। এ ভাবেই বারবার বাঙালির পুজোয় মিলেমিশে গিয়েছে বিক্ষোভের শিল্পিত রূপ। ঠাকুরদালানে ‘আনন্দমঠ’-এর উদ্ধৃতি কিংবা সোনালি চুলের বুট-পরা সাহেবাসুর, বীরাষ্টমীর লাঠিখেলা অথবা সরস্বতীর পায়ের কাছে ভেঙে পড়া সেনেট হল তাই বাঙালির দ্রোহের প্রকাশ।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৪:৫৯
Share:

আপনি কি অকালবোধনের পালাগান শুনছেন, কখনও?

Advertisement

…অকালবোধন ?

না, ভুল কইলাম! ঠিক অকালবোধন নয়। অকালবোধনে খালি ধর্মের জয়ের কথা! ও আর আমি গাইতে পারি না! গাইতে ভালও লাগে না। ধর্মের জয়ের গান! ধর্মের জয় তো খালি গল্পকথা, পুরাণে ঘটে! বাস্তবে ঘটে কই?

Advertisement

কথাগুলো বলেছিলেন বরুণ বিশ্বাসের বাবা জগদীশ বিশ্বাস। জীবনের মার খেয়ে ধ্বস্ত, ক্লান্ত বৃদ্ধের আর অকালবোধন গাইতে ভাল লাগত না।

এক যুগ আগের পুজোর কথা! বাইপাসের ধারে কলকাতার এক আলোকিত পুজো মণ্ডপের কিনারে বরুণের দাদা অসিত বিশ্বাসের বাড়ি। বারান্দা ঘেঁষা ঘরে পুত্রহারা বৃদ্ধ অকালবোধনের গান শোনানোর চেষ্টা করছিলেন। একাত্তরে বাংলাদেশ থেকে এ পারে এসে বনগাঁর কাছে পাঁচপোতায় শূন্য থেকে জীবন শুরু। তখন সেই গান আঁকড়েই বাঁচতেন তিনি। সেই গান আর গাইতে পারছেন না। গাইতে গেলেই খালি ছেলের কথা মনে পড়ে যায় যে!

বরুণের বাবা একটু থামলেন। ঢোঁক গিলে বললেন, “এইডা কি ধর্মের জয় হইল বলুন! এখন খালি রামায়ণের যত পুত্রশোকের গান গাই! মহীরাবণ, অহীরাবণ, তরণীসেন, বীর ইন্দ্রজিতের শোকে রাবণের গান! পুত্রহারা পিতার বেদনায় অন্ধ মুনি, দশরথের গান!”

এর পরেই রামায়ণের সিন্ধুবধের গান ধরেন বৃদ্ধ। ‘এমন পুত্র যার ছেড়ে যায়, তার বেঁচে থাকা দায়!’ তখনও বেশ সুর খেলে বৃদ্ধের গলায়। বরুণের বাবার সঙ্গে এর পরে দেখা হয়নি। জগদীশ বিশ্বাসের বয়স এখন ৯০-এর কাছাকাছি! এখনও নাকি সেই গান গুনগুন করেন। বরুণের দাদা অসিত সে-দিন বললেন, “ভাইয়ের জন্য কষ্টে দগ্ধে দগ্ধে মায়ের জ্বালা জুড়িয়েছে বছর দুই হল! বাবা তাঁর বুকের ভার নিয়ে বেঁচে!”

*****

জনজাগরণ সব সময়ে সমান ভাবে ছড়ায় না। তবে প্রতিবাদের পিছনের গল্পগুলোর মধ্যে আশ্চর্য মিল। অন্যায়ের শিকার হয় ব্যক্তি। আর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির ঘুঘুর বাসা বেআব্রু হয়। ২০১২ সালের ৫ জুলাই গোবরডাঙা স্টেশন চত্বরে প্রতিবাদী স্কুল মাস্টারকে পিছন থেকে গুলি করে আততায়ী। শুধু যে স্থানীয় দুর্বৃত্তদের নারী ধর্ষণের প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বরুণ, তা তো নয়! অনেক হোমরা-চোমরার কায়েমি স্বার্থেও ঘা দিয়ে ফেলেছিলেন মিত্র ইনস্টিটিউশনের শিক্ষক। কেউ বলেন, বেআইনি ভেড়ির দাপট বা ইছামতী সংস্কারের টাকা নয়ছয় করা নিয়ে প্রতিবাদেরই দাম দিয়েছিলেন বরুণ। সে সব কিছুই সামনে আসেনি!

এক যুগ আগের পুজোয় সুটিয়াবাজারে জুনিয়র গ্রুপের মণ্ডপে আলোয় হাসছিল বরুণের কাটআউট। সে-বছরই বাঁকুড়ায় মা সারদার জয়রামবাটির পাশের গাঁ দেশড়ায়, দেশড়াবাজার সর্বজনীনের পুজো সুভেনিরে বেরিয়েছিল এক বালকের নামে লেখা কবিতা। ক্লাস ফোরের রৌণিক পাল লিখছে, তার ক্লাস এইটের দিদিকে নিয়ে!

‘দিদিভাই তুই কেমন আছিস

দূর আকাশের পারে

জানিস আমি দেখি আকাশ

রাতে বারে বারে…’!

রৌণিকের দিদি ১৪ বছরের প্রাকৃতা পাল।

“আমার মেয়ের নামটা আলাদা করে হয়তো বেশি কারও মনে পড়বে না। ঘটনাটা নিয়ে সে-বছর পুজোতেও তেমন তোলপাড় ছিল না! পুজোর বেশ কয়েক মাস আগের ঘটনা কিনা...”, বলছিলেন প্রাকৃতা পালের বাবা ধনঞ্জয় পাল। “আর শুধু এক জনই তো মরেনি! সেও হাসপাতালেরই ঘটনা… কিন্তু গণহত্যা,” বলে চলেন তিনি। আমরি হাসপাতালে ডিসেম্বরের সেই রাত এখনও তাড়া করে কন্যাহারা ধনঞ্জয়কে। অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ে ভর্তি ১৪ বছরের মেয়ের জন্য বাবাও নীচেঅপেক্ষা করছিলেন।

অনেকেই মনে করেন, কলকাতা কিংবা ভারতের নগর-জীবনে স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে নিষ্করুণ কর্পোরেট গাফিলতির এক জ্বালাপোড়া দলিল আমরির সেই ঘটনা। আমরি-অগ্নিকাণ্ডের মামলার এক জন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীও ধনঞ্জয়। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের ফার্মাসিস্ট। “সেই রাতটা আমরিতে কী ঘটেছিল, বেসমেন্টের আগুন নিয়ে আমাদের উৎকণ্ঠা, হাসপাতালের সিকিয়োরিটি অফিসারের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি সব ছবির মতো মনে আছে! দমকলকে কেন খবর দিচ্ছেন না? কেন উপর থেকে রোগীদের বের করতে দিচ্ছেন না? বলতে বলতে সকাল হল! সব শেষ!” একটানা অনেকটা বলে ধনঞ্জয় একটু দম নিলেন! “মজার কথাটা জানেন, এত বছরেও আমার সাক্ষী দেওয়ার পালা এলই না! এখন দেখছি সুপ্রিম কোর্টে শুনানির তারিখ পিছোলেই মানুষ ফুঁসে উঠছে! ওঠাই উচিত।তবে আমি ১২ বছর ধরে খালি কোর্টে আসছিআর যাচ্ছি!”

এক যুগ আগে এমনই এক আশ্বিনে খবর লিখতে জয়রামবাটিতে মা সারদার গ্রামের পাশেই দেশড়ায় ওঁদের বাড়ি গিয়েছিলাম। নিকোনো উঠোন, তুলসীমঞ্চ, পাশেই হাঁস-চরা টলটলে পুকুর… বাংলার আবহমান গ্রাম! প্রাকৃতার ভাই দশ বছরের রৌণিক তখন ভারী ছটফটে। একটু চোখের আড়াল হলেই কম্পিউটারে দিদির ছবি খুলে দেখতে বসে। বাড়ির পাশেই পালেদের পারিবারিক শ্মশানে প্রাকৃতাকে দাহ করার জায়গাটিতে নিজের পরীক্ষার নম্বর লিখে দিদিকে জানাতে কাগজটা পাথর চাপা দিয়ে রেখে আসে ভাই! রৌণিক এখন ডাক্তার হতে চায়। ‘নিট’ জয়ের যুদ্ধে নেমেছে!

*****

জীবন থেমে থাকে না! নিজের নিয়মে বয়ে চলে। আবার পুজোর এত আলো, হাসি, গানের মধ্যে কারও কারও অদ্ভুত বেআক্কেলে চিন্তা আসে! ছোট ছেলে শমী চলে যাওয়ার পরের রাতে রবি ঠাকুরের মতোই হয়তো মনে হয়, ‘কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই।’ রবীন্দ্রনাথ রেলে আসতে আসতে বাইরের জ্যোৎস্না দেখে এ সব ভাবছিলেন! তার পরে তাঁর মনে হল, ‘সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে…’!

উৎসব, আনন্দের যৌথতায়, কর্মযজ্ঞে জীবনের জয়গানকে কে অস্বীকার করবে! কিন্তু সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে যাওয়ার বোধটাকে কি আসলে শাসক ভয় করে? তাই ‘যাও সবে নিজ নিজ কাজে’ বলার ভঙ্গিতে, অনেক হয়েছে উৎসবে ফিরুন, নিদান হাঁকতে হয়? মহানগরের ব্যস্ত উড়ালপুলে ওঠার মুখে আজ অনামা পুজো কমিটির টিজ়ারহঠাৎ চোখ মটকে হাসে! বিরাট হোর্ডিংয়ের লেখা, ‘জীবন যন্ত্রণার গল্প প্রতি সংসারেই রয়/ উৎসব হোক শুধুই আনন্দময়।’

পড়ে হাসিই পায়! আমাদের উৎসবের অন্তরাত্মা কি চিরকালই তার ভিতরের শূন্যতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্রোধ, যন্ত্রণার অশান্তি বহন করেনি? এত সহজ প্রতিবাদকে ভুলিয়ে দেওয়া! উত্তর কলকাতার চোরবাগানের রামচন্দ্র ভবনের দুর্গাদালানে দাঁড়িয়ে এ কথাই মনে হয়েছে বরাবর। রামচন্দ্র চাটুজ্জের বাড়ির পুজোর দালানে লেখা আনন্দমঠের ক’টি অমোঘ লাইন!

‘বাহুতে তুমি মা শক্তি, হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি, তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে’!

পরিবারের কর্তারা বলেন, এ লেখা স্বাধীনতার পরের। পরাধীন দেশে ঠাকুরদালানে আনন্দমঠের উদ্ধৃতি লিখে পুজো করার স্পর্ধা ব্রিটিশ সরকারের সহ্য করার কথা নয়! চোরবাগানের বাড়ির পাশেই সিমলা ব্যায়াম সমিতির মাঠ। ক্লাবঘরে প্রবীণদের আড্ডাতেও আনন্দমঠ-প্রসঙ্গ। “আজ যেমন লোকের হাতে হাতে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, আমাদের পুজোও সেই ব্রিটিশ আমলে বুক বাজিয়ে প্রদর্শনীতে পোস্টারে ছয়লাপ করত।” তাতে আনন্দমঠের লাইন তো বটেই, পাড়ার ছেলে নরেন দত্তের কোটেশনও থাকত। বড় হরফে লেখা ‘নূতন ভারত বেরুক, বেরুক লাঙল ধরে…’ বা ‘ইফ ইউ লিভ, লিভ ডেঞ্জারাসলি’! সিডিশনের পরোয়া না-করে নির্ভয়ে লেখা হত, ‘রক্তাম্বুধি আজি করিয়া মন্থন/ তুলিয়া আনিব স্বাধীনতা ধন’!

ক্লাব ঘরের পাশেই ব্যায়াম সমিতি! কুস্তির আখড়ার লম্ফঝম্প থেমেছে। তবে আজও সদা ব্যস্ত জিমন্যাসিয়াম। নিজেদের পুজোর ইতিহাস টেনে এনেই কর্মকর্তারা বলেন, “প্রতিবাদ আসলে বাঙালির পুজোর শিরায় শিরায় মিশে।”

*****

সিমলের পুজোর ক্লাবঘরের দেওয়ালেই ফ্রেমে বাঁধানো কবেকার অস্পষ্ট ছবি। মাটিতে বসে অন্নকূটে পাত পেড়ে খাচ্ছেন, দুই ভাই শরৎ আর সুভাষ! ১৯৩৭-৩৮ সালে এ ক্লাবের সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু। বাঙালির দুর্গাপুজোর ইতিহাসবিদদের কাছে অত্যন্ত জরুরি বিরল ডকুমেন্ট, এ ছবিটি। সুভাষচন্দ্র এবং পুজোয় সর্বসাধারণের জন্য অন্নকূটের আয়োজন, দুটোই গভীর তাৎপর্যবাহী। বাঙালির দুর্গাপুজোর গুরুত্ব, সে যুগের নেতারাও বুঝতেন। ১৯৩০-এর দশকের শেষার্ধ্বে ইউরোপে শরীর সারিয়ে ফেরার পরে সুভাষচন্দ্র তাই কখনও সিমলা ব্যায়াম সমিতি, কখনও কুমারটুলি সর্বজনীন, কখনও বা বাগবাজারের পুজোর সভাপতি।

বাগবাজারের পুজোর ত্রিকালদর্শী কর্তা অভয় ভট্টাচার্য বলেন, “আমাদের পুজোর প্রদর্শনীটাই হত স্বদেশি দ্রব্যের প্রসারে। একেবারে ছোট বয়সে মনে আছে, ব্যাগ ছাপ মারা স্বদেশি দেশলাই আমি আমাদের পুজোর এগজ়িবিশনেই দেখি!” সিমলের পুজোর প্রদর্শনীতেও বার বার দেখা যেত, নানা পুতুলে বুড়িবালামের তীরে বাঘা যতীনের যুদ্ধ, বা মাতঙ্গিনী হাজরার আত্মবলিদান। স্বাধীনতার পরে আজ়াদ হিন্দ ফৌজের অভিযান বা গান্ধীজির মৃত্যুবরণও প্রদর্শনীতে উঠে এসেছে।

অভয় ছোটবেলায় পাড়ার দাদুদের কাছে চারণকবি মুকুন্দ দাসের গল্পও কত শুনেছেন। বরিশাল থেকে এসে চারণকবি বাগবাজারেই ন’নম্বর গোপাল নিয়োগী লেনে আখড়া বানিয়ে থাকতেন, রিহার্সাল দিতেন। পুজোর সন্ধ্যায় মণ্ডপের অনুষ্ঠানে তাঁর গান শুনতে ভিড় উপচে পড়ত। অভয়ের মনে আছে পাড়ার বড়রা সগর্বে টেনে-টেনে বলতেন, জানিস, আমাদের পুজোয় গান গেয়ে মুকুন্দ দাস অ্যারেস্ট হয়েছেন। তবে পুলিশও নাকি গানের সময়ে তাঁকে বাধা দিত না, অপেক্ষা করত! তার পর গান শেষ হলে চারণকবিকে গ্রেফতার করত তারা। মুকুন্দ দাস হাসিমুখেই কারাবরণ করতেন।

শুনতে শুনতে মনে পড়ে গেল, বাঙালির পুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী আরও পুরনো এক সুরেলা প্রতিবাদের ইতিহাস। বঙ্গভঙ্গের উত্তাল দিনগুলিতেই প্রতিবাদের শরিক হতে অভিনব পন্থা খুঁজে নিয়েছিল হাটখোলার দত্তবাড়ি। বাড়ির কর্তা আস্তিক দত্তের কাছে শোনা গেল গল্প, বঙ্গভঙ্গের সময়ে কী ভাবে প্রতিবাদ হবে ভাবতে ভাবতে ঠিক হয়, ভাসানের পরে অভিনব শোভাযাত্রার কথা। নিমতলা ঘাটে দেবীর বিসর্জন শেষে বাড়ি ফেরার সময়ে ছেলেরা সমস্বরে গাইতেন, ‘কিসের দুঃখ কিসের দৈন্য কিসের লজ্জা কিসের ক্লেশ/ সপ্ত কোটি মিলিত কণ্ঠে ডাকে যখন আমার দেশ’! তখন আস্তিকের ঠাকুরদার ঠাকুরদা বীরেশ্বর দত্ত প্রবীণ বয়সি। আজ মেয়েরাও দত্তবাড়ির ভাসানে যাচ্ছেন। ডি এল রায়ের সেই গান তাঁদেরও ঠোঁটস্থ। প্রতিবাদ মানেই ‘যুদ্ধং দেহি’ ভাব নাও হতে পারে! বাঙালির দুর্গাপুজো সেই নির্ভয় শিল্পিত প্রতিবাদের ধারাবাহিকতায় সচল, সজীব।

*****

বারোয়ারি পুজোর স্বদেশ চেতনা বা জাতধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে কাছে টানার সত্তাও যে আসলে প্রতিবাদই ছিল, তাও হয়তো আমরা ভুলতে বসেছি। যৌবনে গড়ের মাঠে সার্কাস দেখতে গিয়ে অভব্য গোরা ঠেঙানো বাঙালি, সিমলের অতীন্দ্রনাথ বসু এই ধারার পথিকৃৎ। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র মুকুজ্জে, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, মুক্তাগাছার জমিদার জগৎকিশোর আচার্য চৌধুরীদের বড় আদরের অতীন্দ্রনাথ বর্ণময় চরিত্র। বঙ্গভঙ্গের সময়ে মহেশালয়, স্বদেশি ভান্ডার খুলে বঙ্গযুবাদের লাঠি খেলা শেখাচ্ছেন বা স্বদেশি দ্রব্যের প্রচার, প্রসারে ব্যস্ত। বাঘা যতীন, রাসবিহারী বসুদের অপারেশনে সহায়তার জন্য অতীন্দ্রনাথ এবং তাঁর বড় ছেলে অমর এক সঙ্গে জেলও খেটেছিলেন। তখন বন্দি বাপবেটার ফুর্তি দেখে এসে তাঁর মুগ্ধ বিস্ময়ের কথা লিখে গেছেন বিবেকানন্দের ছোট ভাই ভূপেন দত্ত।

মধ্যজীবনে বারোয়ারি পুজো শুরু করে অতীন্দ্রনাথই প্রথম ‘সর্বজনীন’ শব্দটিতে জোর দিলেন। বাঙালি যুবাদের মধ্যে সুস্থ সবল শরীর গড়ার মন্ত্র ঢুকিয়ে দিতে লাঠি খেলার প্রদর্শনীতে বীরাষ্টমী এবং সবাই মিলে প্রসাদ গ্রহণ ছিল এই পুজোর বৈশিষ্ট্য। অন্নকূটে সুভাষচন্দ্রের ছবিটি তারই নিদর্শন। শোনা যায়, ১৯২৬-এ পুজোর আগে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের কিছু ঘটনায় উত্তর কলকাতার ওই তল্লাট বিচলিত হয়েছিল। লাঠিচর্চার মধ্যে আত্মরক্ষার দিকটিও ছিল। তবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে এই পুজো কখনওই ভারাক্রান্ত হতে দেননি অতীন্দ্রনাথ। তেমন লোকজনকে পুজোর ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দিতেন না তিনি। বিবেকানন্দের মধ্যম ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা সাক্ষী, কলকাতার মুসলিম দর্শনার্থীরাও সেই পুজোর ঠাকুর দেখতে যেতেন। মণ্ডপে দাঁড়িয়ে অনেকেই প্রতিমার সামনে তিন বার সালাম বলে চলে যেতেন।

এ পুজোর এক সঙ্গে পঙ্‌ক্তিভোজের অনুষ্ঠানটিকে নিয়েও সে যুগে বিস্তর লেখালিখি হয়েছে। মনে রাখতে হবে, গান্ধী তখন দেশের মন্দিরে মন্দিরে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। পুরীর মন্দিরে তখনও তথাকথিত নিচু জাতের ঢোকা নিষেধ। শোনা যায়, গান্ধী তখন পুরীর মন্দিরেও ঢুকতে অস্বীকার করেছিলেন। সিমলের অতীন বোসের পুজোর মধ্যেও অনেক পত্রপত্রিকা অস্পৃশ্যতার বেড়া ভাঙতে এক ধরনের গান্ধীসদৃশ আন্দোলনের ধাঁচ দেখেছে। বাঙালির পুজোর পরবর্তী কালের থিমচর্চা এই সর্বজনীন শব্দটিরই আরও বিস্তার ঘটাবে। মাতৃ-আরাধনার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক বৈচিত্রের উদ্‌যাপনেও পুরনো ছক ভাঙবে দুর্গাপুজো।

*****

প্রতিবাদের কাজটা কোনওকালেই খুব নির্ঝঞ্ঝাট নয়। সিমলের পাশের পাড়া কাশী বোস লেনের পুজোর ছয় দশকের পুরোহিত কালীপ্রসন্ন ভট্টাচার্য ছোটবেলায় অতীন বোস, অমর বোস ছাড়াও অমরের সহোদর বীরেন (গদাদাদু), সমরেন্দ্রদের (জঙ্গলদাদু) দেখেছেন। কালীদার বাবা স্বর্গত গৌরীপ্রসাদ ভট্টাচার্য স্বদেশি আমলে কাশী বোস লেনের পুরোহিত। এ পুজোর নানা আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেও মিশে আছে সেই স্বদেশি আমলের ধারা। কালীদা বলেন, “আমাদের পুজোয় ন’জন পুরোহিত রাখার পিছনেও স্বদেশি যুগের স্মৃতি। বাবার কাছে শুনেছি, ইংরেজরা পুজো নিয়ে বাঙালির আবেগে ঘা দিতে সাহস করত না। কিন্তু সব কিছু কড়া নজরে রাখত! ওদের চোখে ধুলো দিতেই স্বাধীনতা সংগ্রামীরাও অনেকে মিলে পুরুতঠাকুর সেজে মণ্ডপে বসতেন। পুলিশ সচরাচর জুতো পায়ে সেখানে উঠত না। পুলিশের বা চরেদের সন্দেহজনক গতিবিধি দেখলেই ঘণ্টা নেড়ে বা হঠাৎ ধ্যানে বসে সঙ্কেত পাঠানোর চল ছিল। মণ্ডপে কারা ঢুকছে নজরে রাখতে পুরোহিতের সামনে আয়নারও ব্যবহার করা হত! এ সব ধারা আমরা আজও বজায় রেখেছি!”

প্রাক-বারোয়ারি যুগে বনেদি বাড়ির পুজোর সময় থেকেই পুজোর প্রতিবাদী স্ফুলিঙ্গ দানা বাঁধতে শুরু করেছে, তা হাটখোলার দত্তদের বিসর্জনের রীতিতেই পরিষ্কার। চোরবাগানের রামচন্দ্র ভবনের চাটুজ্জে-বাড়িও, স্বদেশি-আবেগেই প্রতিমার ডাকের সাজ বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। ডাকের সাজ তখন বিলেত থেকে জাহাজে আসত। বিদেশি দ্রব্য বর্জনের আবহে ডাকের সাজের বদলে দেশি বেনারসি শাড়িতে প্রতিমা সাজানোর রীতি ওঁরা চালু করলেন তৎক্ষণাৎ। আজও সেই ধারাই চলছে।

ইংরেজ-বিরোধিতা অসুরের রূপকল্পেও ছাপ ফেলেছিল। নানা হুজুগে কুমোরটুলিতে পরে ওসামা বিন লাদেন বা আজমল কাসবের আদলে অসুর সৃষ্টির হিড়িক দেখা গিয়েছে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে অন্ধ আবেগের যুগে অসুরের ধড়ে গ্রেগ চ্যাপেলের মুখও বসানো হয়। খবর পেয়ে বার বারই এ সব ঠেকিয়েছে পুলিশ। কিছু সাম্প্রদায়িক শক্তিও যুগে যুগে বিক্ষিপ্ত ভাবে অসুর নির্মাণে নানা বিদ্বেষ প্রচারের চেষ্টা করেছে। এ সবের বাইরে ভবানীপুরের চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের দে বাড়ির অসুরটিকে চিত্তাকর্ষক মনে হতে পারে। ব্যবসায়ী এই পরিবারটি উনিশ শতকের শেষ থেকে দুর্গাপুজো করছে। পরম্পরা মেনেই তাঁদের অসুরের এখনও গায়ে কোট, পায়ে বুট, চুল সোনালি। ব্রিটিশ আমল থেকেই এই সাহেবাসুরের ধারা চলে আসছে।

এই দে-বাড়ি কোনওকালে ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন কি না, জানা নেই। তবে জোড়াসাঁকোর ষড়ঙ্গী বাড়ি এক বার কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতীদের খদ্দর পরিয়ে ঘোর মুশকিলে পড়ে। ভাসানের সময়ে পুলিশ এসে সপরিবার দুগ্গাঠাকুরকে প্রায় হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়ার জোগাড়। একে ওকে ধরে শেষমেশ বিষয়টি ওঁরা সামলেনিতে পেরেছিলেন।

*****

শিল্পিত প্রতিবাদের আরও একটি গল্প না-বললে এ লেখায় ফাঁক থেকে যাবে। আজকের থিমপুজোর পূর্বসূরি অশোক গুপ্ত দৃশ্যতই তাঁর সময়ের থেকে এগিয়ে ছিলেন। আজকের নিরিখে রাজবল্লভপাড়ার জগৎ মুখার্জি পার্কে অশোকের ঠাকুর দেখতে খুব যে উপচে পড়া ভিড় হত তা বলা যায় না। তবে শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তী, ধনঞ্জয় ভটচাজের মতো বিদগ্ধজন ছিলেন অশোকের ভক্ত। অশোকদা কী করেন, তা দেখার জন্য গুটিকয়েক পুজো-রসিক, পরবর্তী সময়ের বহু নামী শিল্পীও মুখিয়ে থাকতেন।

অশোকের দুর্গা, অসুর, লক্ষ্মী, সরস্বতী… সবার বিভঙ্গেই নিছকই শিল্পীর চিত্তপট নয়, বিশ্বপটেরও আভাস মিশত। ভাস্কর বিমল কুণ্ডু বার বার বলেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হল ভাঙার বছরে অশোকদার সরস্বতীর কথা। সরস্বতীর পা ঘেঁষেই সেই সুদৃশ্য দালান, থাম ভেঙে পড়েছে। অশোকের ছায়াসঙ্গী রাজবল্লভ পাড়ার গৌতম মিত্র, ওরফে পুপাইদার কাছে ফ্যাকাশে হওয়া ছবিটাও খুঁজে পাওয়া গেল। অশোকের শিলমোহর, সে-যুগের ছক-ভাঙা প্রতিমায় সমসময়ের অভ্রান্ত চিহ্ন। তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধও চলছে। অশোকের কার্তিক কয়েক জন দশাসই সেনার সঙ্গে তিরধনুক হাতে যুদ্ধরত। আর সরস্বতীর পায়ের কাছে ভগ্নদশা সেনেট হল যেন বিধ্বস্ত শিক্ষাব্যবস্থারই প্রতীক। আজকের পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাজগৎ নিয়ে থিম তৈরির বুকের পাটা সহজে দেখা যাবে বলে মনে হয় না!

*****

পুজোর এই প্রতিবাদ নিছকই শহরের গন্ডিতেও আটকে থাকেনি। মালদহের মানিকচকের উত্তর চণ্ডীপুরের বাগদিপাড়ায় খেতমজুর বাগদিদের পুজো করতে স্থানীয় এক হাজিসাহেবই উদ্বুদ্ধ করেন। বাগদিরা মুসলিমদের খেতেই কাজ করতেন। পুজোর খরচের অনেকটা তাঁরাই জোগালেন। কোনও ব্রাহ্মণ পুরোহিত ছাড়া বাগদি বৌদের পুরোহিত রেখেই নিজস্ব উৎসবের খোঁজে দেবী অর্চনা শুরু হল। এ যদি প্রতিবাদের ভাষা না হয়, তবে প্রতিবাদ কাকে বলে?

বহু বছর আগে গালুডির কাছে পায়রাগুড়িতে বাংলাভাষী ভূমিজ সর্দার ক্ষেত্রমোহন সিংহের বাড়ির পুজো দেখার সুযোগ হয়েছিল। ক্ষেত্রমোহন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেব ফার্গুসনকে যুদ্ধে নাজেহাল করেন। তাঁর নাতির নাতি বাসন্তীপ্রসাদ গ্রামের স্কুলে ইংরেজির মাস্টার। দেখি, পুজোর দিনে তিনি গ্রাম্য উঠোনে পূর্বপুরুষের স্বপ্নাদেশ পাওয়া দু’টি তরবারি পালিশ করতে বসেছেন। দুর্গাপুজো আজও তাঁদের পারিবারিক ঐতিহ্য ও শৌর্য উদযাপনের অনুষ্ঠান।

রাঁচীর উপকণ্ঠে জগন্নাথপুরের এইচইসি কলোনিতেও রানি বাণেশ্বরীর পরিবারের সন্তান-সন্ততিদের সঙ্গে পরিচয় হয়। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের সময়ে বাণেশ্বরীর স্বামী, বড়কাগড় এস্টেটের রাজা ঠাকুর বিশ্বনাথ সিংহ সহদেওকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল ইংরেজরা। কুলদেবী মা চিন্তামণিসুদ্ধ সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে যান রানি। চিন্তামণি মা দুর্গারই রূপ। নির্বাসনে নিরন্ন দশাতেও মায়ের পুজো বন্ধ রাখেননি বাণেশ্বরী। নিজের পুরনো শাড়ি পরিয়ে মায়ের পুজো ছিল দ্রোহেরই স্মারক। আজও পুরনো শাড়ি পরিয়েই দুর্গাপুজো সারেন বাণেশ্বরী-বিশ্বনাথের উত্তরপুরুষেরা। তাঁরা এখন নিপাট মধ্যবিত্ত। বাড়ির ছেলেরা এইচইসি কলোনিতে ছোটখাটো কাজ করেন। কিন্তু পুরনো প্রজাদের আনুগত্যে ভাটা নেই। পরম্পরা মেনেই নবমীতে এ পুজোর ব্যয়ভার বহন করে গ্রামে মুসলিম প্রজাদের একটি পরিবার। আর নিজেদের পুরনো শাড়ি কেচেধুয়ে প্রতিমাকে সাজান বাড়ির বৌরা। দেশভাগের পরের শরণার্থী শিবিরেও এমন কিছু দ্রোহের পুজোর নজির মিলবে। দুর্ভাগ্যের অদৃষ্টকে পরিহাস হেনে কালো রঙের দুর্গারও পুজো হয়েছে। যিনি অবশ্যই এ কালের বিচিত্র প্রতিমাকল্পের এক আদি জননী।

*****

বাঙালির পুজো কখনও দ্রোহের, কখনও আপসের। ‘৪৩-এর মহামন্বন্তরের বছরেও পুজো হয়েছে। যদিও মণ্ডপে ক্ষুধিতের অন্নসেবার আয়োজনও রাখা হয়। খাদ্য আন্দোলনের বছরে ১৯৫৯ বা ১৯৬৬-র কলকাতারও টালমাটাল দশা। কিন্তু পুজো পুজোর মতো থেকেছে। শোনা যায়, জননেতারা তখন পুজোর উদ্বোধনী সভায় ভাষণে বলতেন, এ বড় নিষ্ঠুর পরিহাস! অন্নপূর্ণা মাতা এসেছেননিরন্ন বঙ্গদেশে।

নকশাল আমলেও অনেক পুজো নিচুতারে বাঁধা থেকেছে। কিন্তু রাজনৈতিক গোলমালে দুর্গাপুজো ভেস্তে যাওয়ার কাহিনি নেই বললেই চলে! কালীপুজোয় বরং আমহার্স্ট স্ট্রিটে পাশাপাশি পুজোর রেষারেষিতে বোমাবাজি ঘটেছে। নিরীহ প্রাণ গিয়েছে। নকশাল বনাম বাহুবলী পুজোকর্তার সংঘাতে মণ্ডপে ঠাকুর আনতেও সমস্যা হয়েছে। নকশালেরা বাধা দেবে আঁচ করে ফাটাকেষ্ট এক বার কুমোরটুলি থেকে অসমাপ্ত প্রতিমাই নির্ধারিত সময়ের আগে চুপিচুপি মণ্ডপে এনে ফেললেন। বাকি কাজ মণ্ডপেই সম্পন্ন হল।

না, কোভিডেও পুজো বন্ধ হয়নি! তবে ২০২০-তে গোষ্ঠী সংক্রমণের ভয়ে পুজোর ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো কম। খবরের কাগজ লেখে, ‘নিষ্ঠুরতম পুজোর পদধ্বনি’। এই অবস্থাটার সঙ্গে বোধহয় একমাত্র ১৯৪৬-এর সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের বছরের পুজো তুলনীয়। সে-বছর পুজো, ইদ সব উৎসবই ম্রিয়মাণ।

যখন অক্টোবরের শুরুর দিকে কার্ফুর আবহে দেবীর বোধন, তখনও বহু মানুষ ঘরছাড়া। তখনকার পত্রপত্রিকায় লেখা হয়, ‘পুজোর বাজার প্রাণহীন’। কলুটোলার রায়বাড়ির পুজো সরে গেল জোড়াসাঁকোর আত্মীয় বাড়িতে। আকাশবাণীর মহিষাসুরমর্দিনীর লাইভ অনুষ্ঠান বন্ধ রেখে রেকর্ডিং বাজানো হল।

*****

পুজো ঘিরে টানাপড়েনে তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই। বারোয়ারি পুজো-শাসক দল-সরকারের এমন সর্বগ্রাসী বাস্তুতন্ত্র আগে দেখা যায়নি। তার মানে পুজো কর্মকর্তারা চার পাশের প্রতিবাদী আঁচ থেকে একেবারে বিমুখ ভাবলেও ভুল হবে।

বাঙালির পুজোর সমাজমনস্কতা নিয়ে এ কালেই দেশবিদেশের পত্রপত্রিকায় চর্চা হচ্ছে। সম্প্রতি পাথুরিয়াঘাটা পাঁচের পল্লিতে তস্য গলির পুজো মেয়েদের ব্যবহারের মেনস্ট্রুয়েশন কাপ নিয়ে আসে মণ্ডপসজ্জায়। বিষয়, ঋতুমতী নারীর মন্দিরে ঢোকা নিয়ে গোঁড়ামির প্রতিবাদ। কাশী বোস লেনের পুজোও উৎসবের দিনে ঘর থেকে ছিটকে যাওয়া পাচারকন্যাদের নারকীয় জীবনের দগদগে ঘা মণ্ডপে টেনে আনে। আর কোভিডের বছরে লকডাউন-বিভীষিকা আর পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি নিষ্ঠুরতার লজ্জা তাঁর প্রকাণ্ড ফাইবারের প্রতিমায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন শিল্পী রিন্টু দাস। বড়িশা ক্লাবের পুজোর প্রতিমাই ঘরছাড়া শ্রমিক-জননী। শিশুকাঁখে হাঁড়িকুড়িসুদ্ধ সূদূর বিভুঁই ছেড়ে ঘরে ফিরছেন। এ নির্মাণের নেপথ্যে বিকাশ ভট্টাচার্যের একটি ছবির কথা অনেকেই বলেন। তবে রিন্টুর প্রতিমার ছবি ভাইরাল হয়। পুজোর সর্বজনীন সত্তা এ সব বিষয় ভাবনার আলোতেই আরও ধারালো হয়েছে।

মণ্ডপের দুর্গা পোটোপাড়ার কুমোরের কল্পনার দেবী না মানবীপ্রতিম ‘মান্‌ষেরি প্রতিমা’— তা নিয়ে দশকের পরে দশক তর্ক চলেছে। ক্রমে শিল্পীর ভাবনাকেই শেষ কথা মেনে নিয়ে দুর্গা বলতে সেই ফর্সা অভিজাত মাতৃমূর্তির ধারণাটারই বিনির্মাণ ঘটিয়েছে বাঙালি।

বাঙালির দুর্গাপুজোর সময়েই জঙ্গলমহল, ধলভূম, সিংভূমে সাঁওতালেরা মণ্ডপে মণ্ডপে দাশাই নাচে মাতেন। প্রাচীন লোকগাথা বলে, এই দাশাই হল দুই বোন, আয়ন আর কাজলকে খোঁজার নাচ-গান। বহিরাগতেরা দুই বোনকে অপহরণ করেছিল। তাতে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা সমাজ। শুধু ঘরের মেয়েকে বরণ নয়, হারানো মেয়ের জন্য আকুল হওয়াও তাই মনে হয় দুর্গোৎসবে বেমানান নয়।

এ বছর পুজো পরিক্রমার হিসাবের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির চোখ ও মন তাই প্রতিবাদের নির্ঘণ্টেও। বিনিদ্র উৎসব-রজনীর মতোই রাজপথে রাত দখলের স্লোগানে তার রক্তে আলোড়ন। আর জি কর হাসপাতালে কাজের সময়ে নিহত ডাক্তার-কন্যার ছায়া আজ শারদ আকাশে। হোয়াটসঅ্যাপের ‘মেসেজ অ্যালার্টে’ দেখি উৎসবের অদ্ভুত আগমনী, ‘চলো চলো গিরি, প্রতিবাদে ঘিরি/ উমাকে ওরা মেরে ফেলেছে!’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement