পূর্বানুবৃত্তি: বল্লালের ও রকম দেহরাদূন চলে যাওয়ায় মনখারাপ হল তমার। বাড়িতে থাকতে না পেরে ডে অফ হওয়া সত্ত্বেও সে চলে এল কলেজে। কথা হল গরিমার সঙ্গে। গরিমা স্বামীকে ছেড়ে আসার কথা সরাসরি বলতে পারছে না, আবার তার কাছে থেকে যাওয়ার কথাও ভাবতে পারছে না। গরিমার দোলাচল অনুভব করল তমা। হঠাৎই বল্লালের কাছে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে তীব্র হল তার। কলেজ ছুটি নিয়ে তৎকালে দেহরাদূনের টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে পড়ল সে।
দেরি হোক, আমার তাড়া নেই। আমি মোড়ের চায়ের দোকানে বসছি। দেখা হলে দুটো কথা বলে চলে যাব। আজ আগেই অফিস ছুটি হয়ে গেছে, ফিরব তো সেই মেসে। তুই তোর মতো আয়।”
“আমি আজ ফিরব না বিপ্লব, কালও নয়। আমি অনেক দূরে চলে এসেছি...” কথাটা বলে নিজের কানেই কেমন যেন ঠেকল তমার। সে সযত্নে স্থানের নাম এড়িয়ে যাচ্ছে, নিজের এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রবণতাটা তমা নিজেও খেয়াল করল। তমার কথা শুনে বিপ্লব কেবল বলল, “তাই?”
তমা স্পষ্ট বুঝতে পারল, গভীর হতাশা, খারাপ লাগার অনুভূতি যেন হাজার মাইল দূর থেকে ওই শব্দটার সঙ্গে এসে পৌঁছল তার কানে। কোন মেঘদূত এ সব পৌঁছে দেয়, কে জানে!
তমা তখন উসখুস করছে ফোনটা রাখার জন্য। তার মনঃসংযোগের বেশিটা যখন খরচ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসা মানুষগুলোর কেউ সেই বিশেষ মানুষ কি না দেখার জন্য, শ্রুতির সামান্যতম সংযোগে তখন বহু দূর থেকে কেউ যেন তার সরু সুতোগুলোয় টান দিচ্ছে।
বিপ্লব বলল, “আসলে কাল থেকে তোকে ফোনে পাচ্ছি না। নেটওয়ার্ক তো তোকে ‘আউট অব রিচ’ দূরত্বে পাঠিয়ে দিয়েছে। ভাবলাম আবার জ্বরটর বাঁধিয়ে ফোন বন্ধ করে ঘরে শুয়ে আছিস কি না! আচ্ছা রাখলাম। ও, আর একটা কথা, অন্য একটা ফ্ল্যাট দেখলাম। তোর পছন্দ হবে। এটা অনেকটা তোর ফ্ল্যাটের মতো।”
বিপ্লবের সুরটা ঠিক ধরতে পারে না তমা। ধরতে না পেরে থতমত খেয়ে বলে, “মানে?”
দুঃখের সঙ্গে কিঞ্চিৎ ব্যঙ্গ মিশিয়ে বিপ্লব তখন বলছে, “ওই, একটা বসার জায়গা, সেখান থেকে যাওয়া যায় খাওয়ার জায়গায়, রান্নার জায়গায়, সেখানে একটা বেসিন, তার পর শোবার ঘর, কিন্তু সেখানে যাওয়া যায় না। রাখি রে, ভাল থাকিস,” বলে ফোন রাখল।
হাতঘড়িটা দেখে তমা। কলকাতা থেকে এখানে সন্ধ্যা দেরিতে নামে। অথচ সময় একই। বিপ্লব এখন পায়ে পায়ে ফিরে যাচ্ছে। এখন সেখানে অন্ধকার নেমেছে। এখানে তমা অন্য কারও প্রতীক্ষায়। এখানে এখনও পরিচ্ছন্ন দিনের আলো। একই ঘড়ি এখন সন্ধ্যা নামিয়ে এনেছে বিপ্লবের ফেরায়, কিন্তু তমার প্রত্যাবর্তনে অন্ধকার নামেনি। ভুরু কুঁচকে যেন বিপ্লবের ফেরা দেখতে থাকে তমা। দেখে রাগ হয়। সে চালাক নয়। সরল। কিন্তু তার চোখ কান খোলা। নিজের অভিজ্ঞতায় তমা দেখেছিল বিপ্লবের বলে যাওয়া কথা অনেক সময় মেলেনি। পরে মাথায়, স্মৃতিতে ঘুরতে ঘুরতে ঠোক্কর খেয়েছে। মনে হয়েছে সেই কথায় ছিল কিছু স্ববিরোধ। তৈরি হয়েছে সন্দেহজাল। একটু একটু করে বিশ্বাসের বাঁধ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে। সেই কষ্টিপাথরে এখনও পাশ বল্লাল বোস। যা বলেছে, পরে তা কখনও অজুহাত দিয়ে পোক্ত করতে হয়নি। তাই বিশ্বাসের ইটেই দৃঢ় হয়েছে তার ভিত, দৃঢ় হয়েছে তার আর বিপ্লবের মধ্যবর্তী পাঁচিল।
আনমনা ভাবতে ভাবতে দূরে দেখা এক জনের অবয়ব চেনা চেনা লাগে তমার। চেনা লাগে তার হাঁটা। বুকের রক্ত চলকে ওঠে। ওই তো, বল্লাল আসছে হেঁটে হেঁটে। এক বার মনে হয় সটান গিয়ে দাঁড়ায় তার সামনে। তার পর মনে হয়, আরও একটু সময় যাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা থেকে বেরিয়ে ডান দিকের ফুটপাত দিয়ে একা হাঁটছে বল্লাল। এটাই তা হলে তার প্রতিদিন। একটু দূরত্ব রেখে তমাও ওঠে। সামনে তাকিয়ে দেখে কানে ফোন তুলল বল্লাল। কৌতূহল হয়, কাকে ফোন করছে বাউন্ডুলে? তাকে পরম আশ্বস্ত করে বেজে ওঠে তার ব্যাগ। সে দূরত্ব আরও একটু বাড়িয়ে ফোন ধরে।
“কী করছিলে তমা?”
“তোমার ফোনের প্রতীক্ষা।”
“একটু আটকে পড়েছিলাম। অনেকগুলো কাজ জমে গিয়েছিল। সব সেরে বেরোলাম।”
“কিছু খাবে তো এখন?”
“এখন খাব না, বাড়ি গিয়ে আগে স্নান করতে হবে, তার পর। তোমার কথা শুনে বাইরের খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি।”
“কী ভাল ছেলে! বাউন্ডুলেরা এত ভাল হয়, আমি ভাবতেই পারছি না।”
“ঘর গিয়েছে ভুলে, তাই তো বাউন্ডুলে। আবার ঘর যখন থিতু হতে ডাকবে, তখন আমি ভাল ছেলে। তুমি কী করছ বলো।”
“আমি পুঁটিকে সামলাচ্ছি। বড্ড জ্বালায় পুঁটি।”
“পুঁটির বাবা এখন দেরাদুনের রাস্তায় তার জন্য খেলনা কিনতে বেরিয়েছে।”
“তোমার রাস্তায় কি অনেক খেলনার দোকান?”
“না গো পুঁটির মা। রাস্তাটা বড্ড ফাঁকা। একটা দোকানও নেই। অনেক অনেক রডোডেনড্রন। তার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচিল। তার পর আবারও গাছ। আমার বাঁ দিকে রাস্তা। রাস্তার ওপাশেও ফুটপাত।”
“তুমি এমন ভাবে বলছ, আমার মনে হচ্ছে আমি কলকাতা থেকে দেরাদুনে পৌঁছে তোমার সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটছি।”
“হাঁটছই তো। এই যে দেখো সামনে একটা পার্ক। বিনোদন পার্ক। তার সামনে রুটির দোকান। শুকনো পাতায় ছাওয়া। সামনে কাঠ দিয়ে আনাড়ি হাতে তৈরি একটা বেঞ্চ। লোকজন প্রায় নেই। পার্ক ফাঁকা হয়ে যায় বিকেলে। আগে হানু একা এই দোকান চালাত। এখন ওর বৌও কাজে হাত লাগায়। এই পেরিয়ে গেলাম দোকানটা। ওরা এখন দোকানের জিনিসপত্র বাধাছাঁদা করছে। দেখতে পাচ্ছ তুমি?”
“হানু একটা ব্যাগে গুছিয়ে গুছিয়ে দোকানের বিস্কুটগুলো তুলছে। ওর বৌ একটু ক্লান্ত। সে সামনে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে।”
“ঠিক বলেছ! তুমি কী করে বলতে পারলে?”
“তুমিই তো শিখিয়েছ দূরের জিনিস দেখতে, ভবিষ্যৎ দেখতে, অতীত দেখতে। মেয়েরা আরও বেশি কিছু পারে বল্লাল। আমার মনে হয় হানুর বৌ আসন্নপ্রসবা। হয়তো কয়েক দিন পর ও আর দোকানে আসবে না।”
“ও তখন বাসায় বসে ডানা দিয়ে রোদ আড়াল করে খাওয়াবে ছানাদের। সামলাবে ওদের পুঁটিকে।”
“হানু তার পর এসে বলবে, ‘পুঁটির মা, ছানারা কেমন আছে?’”
“হানুর স্ত্রী বলবে, ‘চলো, আমরা একটু ডানা মেলে উড়ি।’”
“একটু একটু উড়লে কি বাউন্ডুলে হয় তমা?”
“হলে হোক না! কে শাসন করছে? পুঁটিকে স্কুলে দিয়ে আমরাও ডানা মেলব বল্লাল।”
“আর পুঁটির ছুটি পড়লে ওকে নিয়ে যাব দূর-দূরান্তে। ওর হাতেখড়ি হবে শিশু-বাউন্ডুলেপনায়।”
“তুমি কখন বাড়ি ফিরবে বল্লাল?”
“আমার আর ফিরতে ইচ্ছে করছে না তমা।”
“কেন ইচ্ছে করছে না বল্লাল?”
“আমার মন খারাপ হচ্ছে। ভিজে যাচ্ছে মন। মনে হচ্ছে তুমি দরজা খুললে তবে বাড়িটা ঘর হয়। তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তমা।”
“কী বললে তুমি বল্লাল?”
“আমি কি ছেলেমানুষি করছি?”
“আমি তো ছেলেমানুষ বল্লালকেই চাই!”
“আমি তোমায় মিস করছি। যে বাড়িতে তুমি কখনও আসোনি, সেখানে তোমায় ভাবছি প্রতি মুহূর্তে। রাস্তায়ও মনে হচ্ছে তুমি হাঁটছ আমার সঙ্গে সঙ্গে। আমি তোমায় বড্ড ভালবাসি তমা।”
“আমিও তো তোমায় পাগলের মতো
ভালবাসি বল্লাল।”
“তোমায় দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।”
“সত্যিই ইচ্ছে করছে, বল্লাল?”
“সত্যি, সত্যি, সত্যি! মনে হচ্ছে এখানেই চোখ বন্ধ করি আর গিয়ে পড়ি সেই নিমতলার ঘাটে। মনে হচ্ছে মুন্সিয়ারির সেই গেস্ট হাউসে তোমার সামনে গিয়ে হাজির হই। অথবা এমন কোথাও, যেখানে তুমি থাকবে।”
“তা হলে আমরা সেই চেষ্টাটাই করি না কেন বল্লাল? আমরা চোখ বুজে সেই জায়গাটাকে ভাবি, আর চোখ খুলে যেন দেখতে পাই দু’জন দু’জনকে?”
“তা হলে এখন আমরা কোথায় দেখা
করব তমা?”
“তুমি বলো, কোথায়?”
“মুন্সিয়ারি। যেখানে আমাদের প্রথম কাছে আসা, আমাদের প্রথম চেনা। সেই মুন্সিয়ারি।”
“হাঁটা থামাও বল্লাল। চোখ বোজো।”
“বুজলাম।”
“এ বার ভাবো তুমি আছ মুন্সিয়ারিতে। শেষ বিকেলের আলো লেগে আছে গাছের পাতায় পাতায়। পাথর বাঁধানো সরু পথ খাড়া ভাবে উঠে গেছে। দু’পাশে রডোডেনড্রনের সারি।”
“এই তো আমাদের মুন্সিয়ারি, তমা। এই তো পাথর-বাঁধানো রাস্তা। এই তো রডোডেনড্রন। এই তো শেষ বিকেল আমার চোখের সামনে। কিন্তু তুমি কোথায় প্রিয়তমা?”
“দাঁড়াও, আমিও তো এই পৌঁছলাম! এই তো আমি হাঁটছি বল্লাল।”
“আমি তো তোমায় দেখতে পাচ্ছি না, তমা। দূর, তা হলে আমি চলে যাব দেরাদুন, আর হাঁটব না।”
“রাগ করে না, এই তো আমি দেখতে পাচ্ছি তোমায়। সাদা জামা পরেছ। কাঁধে ব্যাগ নিয়েছ। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছ।”
“কিন্তু তুমি কোথায় তমা? তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।”
“তা হলে পিছন ফেরো।”
“কী বললে?”
“তুমি কি রাস্তায় হাঁটছ? তোমার ডান কাঁধের ব্যাগটা কি বাঁ কাঁধে নিলে এই মাত্র?”
“হ্যাঁ! কিন্তু তুমি কী করে জানলে?”
“হনহন করে হাঁটাটা থামাও এক বার। দয়া করে এক বার পিছন ফেরো লক্ষ্মীটি!”
“তুমি! এ তো সত্যি তুমি! কী করে তমা?”
বিশ হাতের ব্যবধান তিন সেকেন্ডে অতিক্রম করে ছুটে আসে বল্লাল। এসে তমার হাত দুটো নিজের মুঠোয় নেয়। তার চোখে অবিশ্বাস। তার অভিব্যক্তিতে উচ্ছ্বাস। তার ভঙ্গি-ভাষায় আনন্দ অন্তহীন। তমা নিজের মধ্যেও খুশি, আনন্দ, উচ্ছ্বাস টের পায়। সব মিলিয়ে এত ভাল লাগা সে শেষ কবে পেয়েছিল? মনে হয় সে যেন সমগ্র সত্তা দিয়ে হাসছে। তখনই টের পায়, দেহরাদূনের আকাশে এত ক্ষণে পৌঁছেছে অন্ধকার। এত ক্ষণে পাখিরা ফিরতে শুরু করল ঘরে। এত ক্ষণে জ্বলে উঠল দূর দোকানের আলো। এত ক্ষণে পৌঁছল রাতের নিমন্ত্রণ। আচ্ছা, ভাল লাগাটাই কি ভালবাসা? সে প্রশ্ন মীমাংসার আগেই টের পেল বল্লাল ডান হাতের মুঠোয় তার মুঠোখানা নিয়ে হনহন হাঁটতে শুরু করেছে।
তমা তাকে বলে, “কী হচ্ছে কী পুঁটির বাবা? এত জোরে হাঁটছ কেন? কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমায়?”
বল্লাল গম্ভীর গলায় বলে, “জগুর চায়ের দোকানে।”
“কেন, সেখানে কী?”
“আমার মতে, এটা দেরাদুনের প্রথম ও প্রধান দ্রষ্টব্য। কিন্তু আমি যখন তোমায় বলেছিলাম, তুমি তখন মুচকি হেসেছিলে...” একই রকম ভাবে তাকে হনহন করে টানতে টানতে বলে বল্লাল।
তমা আতঙ্কিত গলায় বলে, “মুচকি হাসি তো ভাল পুঁটির বাপ!”
বল্লাল কপট রাগে বলে, “মুচকি হাসি ব্যঙ্গের!”
বলতে বলতে একটা দোকানের সামনে এসে তারা দাঁড়ায়। সেখানে অপেক্ষারত আরও কয়েক জন। তারা নির্বিকার চিত্তে জগুর দিকে তাকিয়ে। জগুর গায়ের রং ফর্সা। বাহুতে কালো রঙের উল্কি। জগু একমনে একটা বড় হাতলওলা ডেকচি বিচিত্র কায়দায় নাড়িয়ে নাড়িয়ে গরম করে। এক হাতে তমাকে ধরে বল্লাল পরীক্ষার ফল জানার মতো একাগ্রতায়, উদ্বেগে তাকিয়ে থাকে। ক্রমে চা হয়। হাতে হাতে পৌঁছয়। এক সময় শেষ হয় চা পান।
অধীর কৌতূহলে বল্লাল তমার দিকে তাকিয়ে বলে, “কী, ঠিক বলিনি?”
তমা মুচকি হাসে। বল্লাল বলে, “কী হল, বলো?”
তমা বলে, “এটা তোমার দেরাদুনের প্রথম দ্রষ্টব্য?”
বল্লাল বলে, “কেন, নয়?”
তমা বলে, “না, দ্বিতীয়।”
বল্লাল বলে, “যাচ্চলে! তা হলে প্রথম?”
তমা রহস্যহাসি হেসে বলে, “তুমি!”
বল্লাল হেসে বলে, “আমি এখন আর দ্রষ্টব্য নই পুঁটির মা! আমি হলাম তোমাকে লেখা ছোট্ট একটা চিঠির পর এক পাতা ধরে লেখা বিশেষ দ্রষ্টব্য!”
ক্ষুদ্রতম রাত
তার পর তারা দীর্ঘ ক্ষণ ধরে খুনসুটি করল শহরের রাস্তায়। তমাকে শুধু বলার কথাই জমে ছিল না বল্লালের, দেখানোরও ছিল অনেক কিছু। ফাঁকা রাস্তা পেরিয়ে গলিঘুঁজি ধরে তারা কখন যেন গিয়ে পড়ল ঘিঞ্জি, ব্যস্ত, মোটরসাইকেলে ভরা, কোলাহলময় দেহরাদূনে। সেখানে একটা গলির মুখে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে তমাকে দাঁড়াতে হল বল্লালের আবদার শুনে। বল্লাল বলল, “এ বার ঘাড়টা নব্বই ডিগ্রি ঘুরিয়ে তাকাও গলির দিকে।”
তমা তাকিয়ে দেখল, বাড়ি, বারান্দা, দোকান, ভিড়। অভিনব কিছু তো নেই।
বল্লাল বলল, “কিছু বুঝতে পারছ?”
তমা মাথা নাড়ল দু’দিকে। বল্লাল বলল, “দেখো, একটা দোকানের সাইনবোর্ড বাংলায়
লেখা, শাড়িঘর।”
তমা খুঁজে পেল, বল্লাল বলল, “তার ওপরের ঝুলবারান্দার রেলিংটা দেখেছ? দেখো, করবী গাছ উঠে গেছে একতলা থেকে দোতলায়। গত পরশুই আবিষ্কার করলাম।”
তমা তাকিয়ে দেখল, ঝুলবারান্দার রেলিং অবিকল তার ফ্ল্যাটবাড়িটার মতো। তার মানে এখানে এই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে এই বাউন্ডুলে একটা দিনের জন্য হলেও তাকে ভেবেছে, ভেবেছে তার বই-খাতা-বাড়ির অনুষঙ্গ নিয়ে! এক পলকের জন্য হলেও অনুভব করেছে শূন্যতা! ঠিক সেই মুহূর্তে কিছু বলতে পারল না তমা, মনে হল, সে-ও নেহাত ফেলনা নয়, অন্তত এই শহরের একটা বিন্দুতে তো লেখা থাকল তার নাম! ভেবে কোনও কথা না বলে বল্লালের গালটা টিপে দিল সে। দিয়েই বলল, “এ বাবা, তুমি তো এ শহরের অধ্যাপক! এমন করাটা কি ঠিক হল?”
বল্লাল কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তার পর ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল, “খুব ঠিক হল। আমার ক’টা ছেলেমেয়ে দেরাদুনের? সব বাইরের। আর তারা এখন এ দিকে ঘুরছেও না। সব বই মুখে করে বসে আছে। বাবা! কী যে পড়ুয়া হয় এরা!”
আবার সমগ্র সত্তা দিয়ে ভাল লাগার অনুভূতিটা ফেরত এল। মুখে কোনও কথা বলল না সে, কিন্তু তার প্রচণ্ড ইচ্ছে করল এখানে, এই ব্যস্ত জনপদে, ভিড়ের হট্টমেলাতেই বল্লালকে জাপটে ধরে গভীর, গভীরতর, গভীরতম চুম্বনে কাছে টেনে নিতে। ইচ্ছে হল ভুস করে ওর মধ্যে ডুবে যেতে।
বল্লাল এই তমার চোখের সামনে দুটো আঙুল নেড়ে তার এক দৃষ্টির একাগ্রতা ভেঙে জিজ্ঞেস করল, “কী হল?” সে বলল, “দুটো বক।”
বল্লাল বলল, “কোথায়?”
সে বলল, “আকাশে।”
বল্লাল আকাশের বদলে তার চোখের তারাবিন্দুতে চোখ রেখে বলল, “তার পর?”
তমা বলল, “তার পর তারা ডানা মেলল। ডানায় ডানায় তারা বুঝে নিল আকাশ চরাচর।”
তার পর সেই ডানা মেলা বক ভেলপুরি খেল, খেল কুলপি-মালাই। মেয়েদের সাজের দোকান থেকে কিছু চুড়ি কিনল তমা। তার পর তারা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছল বল্লালের বাসস্থানে। বল্লালের বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো তার থাকার জায়গাও বেশ নিরিবিলি, শূন্য শূন্য জায়গায়। একটা তিনতলা বাড়ির দোতলাটার অর্ধেক তার।