Novel Series

দৈবাদিষ্ট

রন্ধনশালার গবাক্ষ দিয়ে গৃহসংলগ্ন উদ্যানটির এক অংশ দেখা যায়। প্রথাগত ভাবে উদ্যান বলা চলে, তত প্রশস্ত নয়, তত সমৃদ্ধও নয়।

Advertisement

সৌরভ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২২ ০৬:৪৭
Share:

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

পূর্বানুবৃত্তি: মহামতি বিদুর তাঁর নিশ্ছিদ্র যুক্তিজালে বিশ্লেষণ করলেন যে, যজ্ঞসম্ভূত প্রাপ্তবয়স্ক কুমার এবং কুমারীর আবির্ভাব পূর্বপরিকল্পিত। এটি চিরশত্রু কৌরবদের বিরুদ্ধে পাঞ্চালের একটি কূটনৈতিক পদক্ষেপ বই কিছু নয়। কিন্তু ঋষি ব্রাহ্মণ এবং দৈববাণী স্বীকৃতির কারণে এই ইন্দ্রজালের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার উপায় নেই। গূঢ়পুরুষ গিরিকর্ণ জানায়, শীঘ্রই ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিয়ে সৌজন্য সাক্ষাতে হস্তিনাপুরে আসবেন দ্রুপদ। উদ্দেশ্য, আচার্য দ্রোণের কাছে কুমারের উন্নত অস্ত্রশিক্ষা।

Advertisement

তার পর প্রথম বাক্যস্ফূর্তি হয় অশ্বত্থামার। তিনি লম্ফ দিয়ে ওঠেন আসন ছেড়ে। গর্জন করে ওঠেন, “দ্রুপদ আর তার ওই পুত্র— দুটিকেই বিনাশ করব। এই সাক্ষাৎই শেষ সাক্ষাৎ হবে ওদের...”

Advertisement

বিদুর তত উত্তেজিত নন, শান্ত কণ্ঠেই বললেন, “অসামান্য এক অক্ষক্ষেপ, পাঞ্চালের— স্বীকার করতেই হবে! কিন্তু, এ অভীষ্ট তাদের সিদ্ধ হতে দেওয়া যাবে না! পাঞ্চাল-রাজকুমারকে কোনও প্রকার অস্ত্রশিক্ষা দেবেন না দ্রোণাচার্য!”

“না, তিনি দেবেন!”

চমকিত হন সকলে। ফিরে তাকান। দীর্ঘ আলোচনায় যাঁর ন্যূনতম যোগদান ছিল না, যাঁর বাক্‌যন্ত্র এত ক্ষণ নীরব ছিল ও প্রত্যঙ্গগুলি নিথর— এই প্রথম, সহসা, তাঁর ব্যক্তিত্বময় কম্বুকণ্ঠ ধ্বনিত হল। দ্রোণ বললেন, “দ্রুপদ-পুত্রকে অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া হবে। এ আমার সিদ্ধান্ত।”

কয়েক মুহূর্তের নৈঃশব্দ্য। ক্ষত্তা ও শান্তনব বিস্মিত দৃষ্টিবিনিময় করলেন। কৃপ স্তম্ভিতের মতো চেয়ে, অশ্বত্থামার চক্ষুদু’টি বিস্ফারিত বিমূঢ়।

তার পর ভীষ্ম ঈষৎ কর্তৃত্বব্যঞ্জক ভঙ্গিতে বললেন, “শত্রুরাজ্যের কুমারকে শিক্ষাদান? হস্তিনা অনুমোদন করবে না!”

“দ্রুপদ হস্তিনার শত্রু, কিন্তু আমার মিত্র— হে গাঙ্গেয়!” দ্রোণ নিষ্কম্পস্বরে উত্তর দিলেন, “হস্তিনা অনুমোদন করবে না, স্বাভাবিক। তাই আমি হস্তিনার পৃষ্ঠপোষিত আশ্রমে নয়, স্বগৃহে রেখে তাকে শিক্ষাদান করব। আশ্রমে আমি হস্তিনার বেতনবদ্ধ শিক্ষক। কিন্তু স্মর্তব্য, আশ্রমের বাইরে আমার অন্য পরিচয়। আমি অর্ধ-পাঞ্চালরাজ্যের অধিপতি! সুতরাং আমি স্বাধিকারে এই কর্ম করতে সক্ষম।”

“পিতা! আপনার কি বুদ্ধিভ্রম হল?” অশ্বত্থামা চিৎকার করে উঠলেন, “এই দ্রৌপদ, এ আদৌ পাঞ্চাল-তনয় নয়, আহরিত যোদ্ধা, আপনার ভাবী হত্যাকারী রূপে নিযুক্ত! কুচক্রী দ্রুপদ— ব্রহ্মহত্যার কলঙ্ক এড়ানোর জন্য চাতুর্যের দ্বারা এই প্রশিক্ষিত আততায়ীকে যজ্ঞোদ্ভূত বলে প্রচার করছে, এ কি আপনি বুঝতে পারছেন না? কদাপি শিক্ষা দেবেন না, আপনার শিক্ষা এই হন্তারক আপনার উপরেই প্রয়োগ করবে! আপনি এই ঘাতককে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবেন— এই আমার আবেদন!”

দ্রোণ উঠে দাঁড়ালেন। দীর্ঘ দক্ষিণ বাহুটি উচ্চে তুললেন, তর্ক থামিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিমায়। গম্ভীরস্বরে বললেন, “সবাই শুনে রাখুন, ভারদ্বাজ দ্রোণ আর কোনও শিক্ষার্থীকে প্রত্যাখ্যান করবে না কখনও। কোনও দিন নয়, কোনও পরিস্থিতিতে নয়!”

৪৫

রন্ধনশালার গবাক্ষ দিয়ে গৃহসংলগ্ন উদ্যানটির এক অংশ দেখা যায়। প্রথাগত ভাবে উদ্যান বলা চলে, তত প্রশস্ত নয়, তত সমৃদ্ধও নয়। স্বাভাবিক গৃহস্থের প্রাঙ্গণ যেমন হয়ে থাকে, তদপেক্ষা কিঞ্চিৎ বৃহদায়তন হবে বা। মৃৎপ্রাচীরের ধারে ধারে বাঁশের বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা বিবিধপ্রকার লতা বীরুৎ গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ, কোনওটিতে ফুল, কোনওটিতে কৃষিজ ফসল। সামান্য কয়েকটি নাতিউচ্চ বৃক্ষ শীতল ছায়াঞ্চল বিস্তার করেছে প্রাঙ্গণভূমির উপর। ভূমিটি প্রায় তৃণহীন। নিত্য সম্মার্জনী দিয়ে স্বহস্তে সারা আঙিনা পরিষ্কার করেন কর্ত্রী স্বয়ং। দাসদাসী আছে, হস্তিনা-রাজকোষ থেকে তাদের ব্যয় নির্বাহ হয়। কিন্তু কয়েকটি নিত্যকর্ম গৃহলক্ষ্মী স্বহস্তেই সম্পন্ন করেন। প্রভাতের মঙ্গলবারি সিঞ্চন ও সম্মার্জনী-চালনার দায়িত্ব দাসীর হাতে তিনি ন্যস্ত করেননি। ওটি তাঁরই কাজ, সংসারটি যাঁর।

যেমন, এই পাকশালার দায়িত্ব। মহামতি ভীষ্ম সেই প্রথম দিনেই পাচক পাঠিয়েছিলেন, কর্ত্রী তাকে বিদায় দিয়েছেন। গৃহকর্তা স্বয়ং হেসে বলেছিলেন, “কৃপীর হাতের অন্নব্যঞ্জন অমৃতাধিক। পাচকের সাধ্য কী?”

বস্তুতই দ্রোণপত্নী রন্ধনকলায় বড় কুশলী। পিতা শরদ্বানের গৃহেও আবাল্য দারিদ্রে কেটেছে, তার পরে দরিদ্রপত্নী। বিলাস-বাহুল্যের উপকরণ পেয়েছেনই বা কবে! সামান্য আয়োজনেই কী ভাবে অসামান্য স্বাদ আনতে হয় খাদ্যে, সেই অনুশীলনেই কেটে গিয়েছে জীবন। তা ছাড়া, রন্ধন তাঁর বড় প্রিয় কর্ম, তিনি সত্যিই রাঁধতে ভালবাসেন।

আজ কুষ্মাণ্ড-বার্তাকু-ধুন্দুল সহযোগে পূতিকাশাক রন্ধন করতে করতে কৃপী বাতায়নপথে তাকিয়ে ছিলেন। বড় মলিন, শুষ্ক দেখাচ্ছে তাঁকে। ব্যঞ্জনে জল কমে এসেছে, মৃদু দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে পাত্রতললগ্ন শাকের অংশ, তার কটু ঘ্রাণ উঠছে— কৃপীর সংবিৎ নেই সে দিকে। তিনি প্রায় নিষ্পলক চোখে চেয়ে রয়েছেন বাইরে।

উদ্যানে দ্বন্দ্বযুদ্ধের অনুশীলন চলছে। খড়্গ-হস্তে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। এক জন বৃদ্ধ, অন্য জন নবীন। বৃদ্ধের দেহ নির্মেদ ও কৃশ, তরুণের ব্যায়ামপুষ্ট বলবান পেশিগুলি স্ফীত-কঠিন। দু’জনের হাতের শাণিত শস্ত্রফলক মধ্যাহ্নরৌদ্রে ঝলসিত হচ্ছে মুহুর্মুহু।

আক্রমণ, প্রতিরক্ষা। ছিদ্রসন্ধান, হুঙ্কার, আঘাত, প্রত্যাঘাত। নানাবিধ প্রকৌশল। লম্ফন, নমন, উড্ডয়ন, উপবেশন। আগ্রাসী অগ্র-পদবিক্ষেপ, সাবধানী পশ্চাদপসরণ। দেহকে বেত্রের মতো দোলায়িত করে বিপক্ষের গতিকে বিভ্রান্ত করা। ছদ্মরন্ধ্র প্রদর্শন দ্বারা প্রতারিত করা। সুতীব্র আঘাতকে চর্মে প্রতিরোধ। গুরু শেখাচ্ছেন।

কখনও প্রায় শরীর স্পর্শ করে বিদ্যুদ্বেগে চলে যাচ্ছে খড়্গ। কখনও ঢালে প্রতিরুদ্ধ হচ্ছে, কখনও প্রতিযোদ্ধার খড়্গেই। অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছিটকে উঠছে। ধাতব সঙ্ঘর্ষ-নিনাদ ধ্বনিত হচ্ছে অবিরত।

কখনও প্রতিদ্বন্দ্বীকে বৃক্ষকাণ্ডে সবলে লগ্ন করে তার কণ্ঠে অসি চেপে ধরা, কখনও ভূতলশায়ী করে। তার নিবারণকৌশলও আছে। হয় নিজ অসি বা ঢালের এক বিপরীতমুখী বলপ্রয়োগে আক্রমণকারীকে দূরে নিক্ষেপ করা, নতুবা তার উদরে পদস্থাপন করে সজোরে আঘাত।

প্রবীণ শিক্ষা দিচ্ছেন নবীনকে।

কৃপী এমন কত দেখেছেন। আজ থেকে তো নয়, তাঁর স্বামী আযৌবন এই বৃত্তিতে। মাত্র এই কয়েক বৎসর তাঁর জন্য পৃথক শিক্ষাশ্রম নির্মাণ করে দিয়েছেন কুরুরাজ, কিন্তু তার আগে পর্যন্ত তো পাঞ্চালের সেই দীন কুটিরেই ছাত্রদেরবিদ্যাদান করতেন দ্রোণ। সেই গৃহেও একটি আঙিনা ছিল, ক্ষুদ্রতর— কিন্তু সেখানেই আসত বিদ্যার্থীরা। এমন কত সম্মুখসংগ্রামের অনুশীলনদৃশ্যদেখেছেন কৃপী। গদাযুদ্ধ, ভল্লযুদ্ধ, অসিযুদ্ধ! এক দিকে গুরু, অন্য দিকে শিষ্য! শিষ্যের অস্ত্র গুরুর অঙ্গ পর্যন্ত চলে আসছে, গুরুকে ধরাশায়ী করেছে শিষ্য, তাঁর কণ্ঠের কাছে ভল্ল বা খড়্গ স্পর্শ করিয়ে ফেলেছে, এমনকি অসাবধানতাবশত সামান্য রক্তপাত পর্যন্ত ঘটে গিয়েছে— এও তাঁর অভিজ্ঞতার বাইরে নয়।

অনুশীলনের অঙ্গ এগুলি। গুরু বাহবা দিয়ে শিষ্যের পৃষ্ঠে চপেটাঘাত করে প্রশ্রয়হাস্য হেসেছেন।

কিন্তু আজ কেন দ্রোণপত্নী এমন উন্মনা? প্রতিটি শস্ত্র-ঝনৎকারে তাঁর হৃৎপিণ্ড কয়েক পল স্তব্ধ হয়ে যেতে চাইছে কেন? নব্য শিক্ষার্থী যখনই গর্জন করে মুক্তকৃপাণে ধাবিত হচ্ছে বৃদ্ধ আচার্যের দিকে— কৃপীর শোণিতপ্রবাহ কেন শীতল হয়ে আসছে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement