ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
পূর্বানুবৃত্তি: দার্জিলিংয়ে এসেও পুঁটির মনে পড়ে এনার কথা। সুদীপ্ত অনেকটাই সঙ্গ দেয়, সামলে রাখে ওকে। সুদীপ্তকে সঙ্গে নিয়ে গ্লেনারিজ়-এ খেতে যায় পুঁটি। সেখানেও গিয়ে পৌঁছয় চন্দন সিং। সে পুঁটিকে জানায়, ওদের ফ্যামিলি বিজ়নেসেও পুঁটির কাকা আর জেঠু ওর বাবাকে ঠকিয়ে আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। সরাসরি অফার দেয়, বাগালের কাজের প্রাইসটা চন্দনকে জানিয়ে দিলে পুঁটি এক কোটি টাকা পাবে। সঙ্গে সুন্দরী সঙ্গিনীর সঙ্গে ইউরোপ টুরের সুযোগ।
চন্দন হেসে চলে গেল। আমি দেখলাম, মেঘ এসে আবার ঢেকে দিয়েছে সূর্য। দু’-এক ফোঁটা করে বৃষ্টি শুরু হল। এই খোলা জায়গায় আর বসা যাবে না, ভিতরে কোথাও বসতে হবে। আমরা উঠে পড়লাম।
সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করল, “দাদা, কী করবে তুমি?”
আমি তাকালাম ওর দিকে। আমার ডব্লিউ জি গ্রেসের কথা মনে পড়ল। টস জিতলে উনি যা করতে বলতেন, সে কথা সৎ থাকার ব্যাপারেও প্রযোজ্য।
১২
সাবু
গাড়ি থেকে খাবারের ড্রাম আর ক্রেটগুলো নামাতেই এক জন পুলিশ এগিয়ে এল। রাস্তাটা একটু সরু, ঘুপচি মতো। তারই এক পাশে আমাদের ভ্যানটা দাঁড় করিয়ে রেখেছি।
লামাদাদুর বাড়ির কাছে একটা জন্মদিনের অনুষ্ঠান ছিল। খুব বৃষ্টি হওয়ায় অনেক লোক আসেনি। অনেক খাবার বেঁচে গিয়েছে। তাই লামাদাদু খবর দিয়েছিল আমায়।
আজ নেপালদা নেই। শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে। অফিসের বাকি ছেলেপুলেদের আরও নানা জায়গা থেকে খাবার তোলার ব্যাপার ছিল। আর কেউ নেই। তাই কী আর করি, গাড়ির ড্রাইভার নুরভাইকে নিয়ে আমিই বেরিয়ে পড়েছিলাম। লামাদাদু বলেছিল, “তুই আয়। আমি যাব তোর সঙ্গে।”
হ্যাঁ, আজ লামাদাদু এসেছে আমার সঙ্গে।
আমাদের খাবার প্যাক করার বন্দোবস্ত থাকে। অনুষ্ঠান বাড়িতেই আমি, নুরভাই আর লামাদাদু মিলে খাবার প্যাক করে নিয়েছিলাম।
তার পর সব খাবার নিয়ে এসে রাসবিহারীর কাছে সর্দার শঙ্কর রোডের গলিতে গাড়িটা দাঁড় করিয়েছি। আশপাশে অনেক ফুটপাতবাসী মানুষ থাকেন। সবাই যে একদম অনাহারী তা নয়, কিন্তু অনেকে আছেন যাদের অন্ন সংস্থানে সমস্যা হয়।
আমি এখানে মাঝে মাঝে খাবার নিয়ে আসি। বেশ কিছু চেনা মুখ চার দিকে। তার মধ্যে টুলু নামে একটা বাচ্চা মেয়ে আছে। সাত-আট বছর বয়স। সামান্য চাপা রং। ছোট্ট নাক আর ইয়া বড় বড় দুর্গাঠাকুরের মতো চোখ! সারা ক্ষণ হাসে মেয়েটা। ছেঁড়া ফ্রক। ঠিক মতো খাবার নেই। বাবা কিছু করে না। মা সামান্য কাজ করে লোকের বাড়িতে। আরও তিন ভাইবোন আছে। আনন্দের কিছুই নেই টুলুর জীবনে। তাও কী সুন্দর হাসে সব সময়! হেসে গড়িয়ে পড়ে একদম! রাস্তা থেকে জড়ো করে আনে গুলমোহর আর বকুলফুল! আমার হাতে দিয়ে বলে, “তোমার হাত দুটো কী সুন্দর গো, দিদি! এই নাও এগুলো তোমার!”
আমার টুলুকে দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়! জীবনের যা যা চোখের বালি, গলার কাঁটা, জুতোর পেরেক, সব মন থেকে মুছে যায়! মনে হয়, বড় হয়ে আমি টুলুর মতো হব!
আমি খাবার নিয়ে এলেই টুলু সবার আগে চলে আসে। দূর থেকে ও আমাদের লাল-নীল রং করা ভ্যানটা চিনে যায়।
কাছে এসে খাবারের দিকে যায় না কিন্তু। বরং আমার ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বার করে নেয়। তার পর এক কোণে বসে গেম খেলতে থাকে। সবাইকে খাবার দেওয়ার পর আমি ওদের পরিবারের জন্য খাবার দিই।
আজও এর অন্যথা হয়নি। আমি গাড়ি দাঁড় করানোমাত্র টুলু এসে মোবাইল নিয়ে গিয়েছে। এখন সামান্য দূরে একটা গাছের বাঁধানো গোড়ায় বসে আমার মোবাইল নিয়ে গেম খেলছে টুলু।
আর আমি দাঁড়িয়ে আছি পুলিশের সামনে! পাশে রাখা খাবারের ক্রেট।
পুলিশটার বয়স অল্প। ফর্সা। লম্বা। দেখতে ভাল। গালে হাল্কা চাপ দাড়ি।
এখন দেখি সবাই কেমন গালে দাড়ি রাখে। কেন রাখে, সেটা যদিও আমি জানি না। যারা রাখে তারাও বোধহয় জানে না!
আমি পুলিশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার?”
“আপনি এ সব কী করছেন?” ছেলেটি গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল।
“কী করছি?” আমি অবাক হলাম।
“এ ভাবে খাবার ডিস্ট্রিবিউট করছেন!”
“কেন, কোনও বাধা আছে না কি?” আমি সামান্য বিরক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম।
ছেলেটি কী বলবে যেন বুঝতে পারল না সামান্য সময়। তার পর বলল, “এ ভাবে রাস্তার মধ্যে কেঅস করছেন!”
“মানে?” আমার রাগ হয়ে গেল এ বার, “খাবার দিতে আসা কেঅস করা না কি? কী সব বলছেন!”
ছেলেটি বলল, “ট্র্যাফিকের সমস্যা হবে! এ ভাবে রাস্তায় খাবার বিলি করলে কত ভিড় হয় জানেন না?”
আমি কিছু বলার আগে এ বার লামাদাদু এগিয়ে এল, “কী হয়েছে ভাই! অসুবিধে কোথায়!”
লামাদাদুর চেহারা আর বয়স দেখে ছেলেটা একটু থমকাল। তার পর বলল, “না, এ ভাবে আপনারা এখানে খাবার ডিস্ট্রিবিউট করলে ট্র্যাফিক জ্যাম লেগে যাবে। এটা এখানে না করে অন্য কোথাও করুন। সামনেই মেন রোড। একদম জ্যাম হয়ে যাবে।”
“এটা তো গলি ভাই,” লামাদাদু শান্ত গলায় বলল, “দুপুরে একদম ফাঁকা থাকে। এখনও আছে। আমাদের খুব বেশি হলে আধ ঘণ্টা লাগবে।”
“না তাও,” ছেলেটা বলল, “এ ভাবে করা ঠিক নয়। দেখুন এর মধ্যেই কত ভিড় লেগে গিয়েছে!”
স্বাভাবিক। ভিড় তো হবেই। অনেকেই থালা-বাটি নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
আমি বললাম, “আচ্ছা, আপনি এ রকম করছেন কেন?”
“ম্যাডাম, আমি কিছু করছি না। জাস্ট বলছি অন্য জায়গায় সরে গিয়ে করুন। সামনেই বড় রাস্তার মোড়। ট্র্যাফিক জ্যাম হচ্ছে। লোকজনের অসুবিধে হচ্ছে।”
“আপনি আমাদের হেল্প করুন না,” লামাদাদু ছেলেটির দিকে তাকাল।
“মানে!” ছেলেটা অবাক হয়ে তাকাল।
“এত লোক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আপনি একটু ওদের লাইন করিয়ে দিন না।”
ছেলেটি অমনি ভুরু তুলে বলল, “আমি? এটা আমার কাজ?”
আমি বললাম, “হিউম্যানিটি কাজ হয় না। লামাদাদু ঠিকই বলেছে। আপনি প্লিজ় ওদের একটু রাস্তার ধার ঘেঁষে লাইন করিয়ে দিন। রাস্তাও ফাঁকা হয়ে যাবে। আপনার ট্র্যাফিকও হিন্ডারড হবে না। তাই না!”
ছেলেটি আমতা আমতা করে আমার মুখের দিকে তাকাল। আমি এ বার হাসলাম।
“ঠিক আছে, ঠিক আছে,” ছেলেটাও হাসল। তার পর ভিড়ের দিকে তাকিয়ে তাদের লাইন করে দাঁড়াতে বলে তদারকি শুরু করল।
খাবার দিতে আমাদের পঁচিশ মিনিট মতো লাগল। সবার শেষে টুলুকে খাবার গুছিয়ে দিলাম। তার পর আমার ব্যাগ থেকে একটা বড় চকলেট বার করে ওর হাতে দিয়ে বললাম, “এটা তোর।”
টুলু খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, “আমার নয়, আমাদের।”
“মানে?” আমি অবাক হলাম।
টুলু বলল, “আমার বন্ধু আছে না, শ্যামা, বুঁচি, পাকু, হরি আর মাধো। সবাই মিলে খাব।”
আমি বললাম, “তুই তো কিছুই পাবি না।”
টুলু এমন করে হেসে গড়িয়ে পড়ল যেন কত্ত মজার কথা বলেছি। ও বলল, “আরে তাতে কী! সবার সঙ্গে ভাগ করে খেলেই না মজা!”
আমি হাঁটু গেড়ে বসে ওকে ধরলাম। বললাম, “তুই বড় হয়ে কী হবি টুলু?”
“আমি?” টুলু এ দিক-ও দিক তাকাল, ভাবল একটু। তার পর বলল, “আমি তোমার মতো
দিদি হব!”
আমি আলতো করে জড়িয়ে ধরলাম ওকে। ও আমার মতো হবে! আর আমি ওর মতো!
আমার চোখ জ্বালা করে উঠল হঠাৎ। আমি এদের জন্য কিছু করতে পারি না! মনে হল, টুলুর মতো মনের মানুষই এখন আমাদের দরকার। চার দিকে তো স্বার্থপর মানুষজনের নৃত্য দেখতে হয় সারা ক্ষণ! মাঝে মাঝে মনে হয় নরকে আছি। দিন দিন অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। তার মধ্যে থেকে কী ভাবে যে আবার সব ঠিক হবে বুঝি না। আসলে ভাল মানুষদের মার্জিনালাইজ়ড করে দিচ্ছে খারাপ মানুষজন। সেখান থেকে আবার সব ঠিক করতে হলে এমন টুলুদের বাঁচাতে হবে। ওদের সমাজে দরকার খুব।
গাড়িতে উঠে চলে যাওয়ার আগে টুলুকে আবার একটু আদর করে দিলাম।
লামাদাদু বলল, “আমি আর যাচ্ছি না রে। তুই তো নর্থে যাবি। আমি বাড়ি চলে যাই।”
“ঠিক আছে।” আমি মাথা নাড়লাম।
লামাদাদু জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে, কেসটা কী বল তো?”
আমি অবাক হলাম, “কী!”
“মাসখানেকের বেশি হয়ে গিয়েছে, পুঁটির কী খবর! হয়েছেটা কী! কোনও পাত্তা নেই!”
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। ও দার্জিলিং গেছে, সেটা কাকিমার কাছ থেকে শুনেছি আমি। তার বেশি কিছু জানি না।
আমি মাথা নিচু করে নিলাম। কাকিমা মানে পুঁটির মা সে দিন এমন কান্নাকাটি করছিল যে বলার নয়। আমি তো ঘাবড়েই গিয়েছিলাম।
পুঁটির কাছে এমনিই গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু গিয়ে দেখি ও নেই। আমায় দেখে কাকিমা টানতে টানতে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। ওদের জয়েন্ট ফ্যামিলি। সবাই এক সঙ্গেই থাকে। যা কথা হয় সবার সামনেই হয়। সেখানে এমন আচমকা আমাকে কেন যে টেনে ঘরে নিয়ে গেল কাকিমা সেটা আমি বুঝতে পারিনি।
“কী হয়েছে!” জিজ্ঞেস করেছিলাম।
“আমার ছেলেটার কিছু একটা হয়েছে! তুই নিশ্চয়ই জানিস। আমায় বল।” কাকিমা আমার দু’হাত ধরে আকুল হয়ে তাকিয়েছিল আমার দিকে।
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না।
এনাকে কাকিমা দেখেছে কয়েক বার। তাতে কাকিমার একটুও ভাল লাগেনি ওকে। আপস্টার্ট আর অহঙ্কারী মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, এ বাড়িতে এসে সবার সঙ্গে মানিয়ে গুছিয়ে থাকতে পারবে না।
আমি জানি এখনকার দিনে যারাই প্রেম করে, মানে স্যরি, প্রেম করে না, রিলেশনশিপে থাকে, তারা হয়তো বিয়ের কথা ভাবে না। কিন্তু কাকিমারা যে জেনারেশনের, তাতে তারা ভাবে এ সব। তাই পুঁটি যা ভাবেনি, সেটা কাকিমা ভেবে বসে আছে।
আমি কাকিমার দিকে তাকিয়ে কেটে কেটে বলেছিলাম, “আমি ঠিক জানি না গো। আমাকে আজকাল এড়িয়ে যায় সব সময়। সামনে থাকলেও কেমন একটা রুড বিহেভ করে।”
কাকিমা বলেছিল, “নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। কষ্ট পেয়েছে। না হলে কেন এমনটা হবে! ছেলে গাড়ি ইউজ় করছে না। মোবাইল ছেড়ে দিয়েছে। কারও সঙ্গে কথা বলছে না! দুম করে পাহাড়ে চলে গেল!”