Smaranjit Chakrabarty

চুয়ান্ন

এনা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে চুয়ান্ন দিন আগে। আর এই চুয়ান্ন দিনে আমি মনখারাপ পেরিয়ে এসেছি। পেরিয়ে এসেছি কাজ। ফ্যামিলি ক্রাইসিস। আর পেরিয়ে এসেছি নিজেকে। এই নিজেকে পেরিয়ে আসাটা হল এই চুয়ান্ন দিনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ!

Advertisement

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share:

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র।

দীপ্যদা যেন বিশ্বাস করতে পারছে না আমার কথা, অবাক হওয়া গলায় বলল, “মানে... তুমি আমায়... ইউ নো হাউ মাচ আই আর্ন! সেটল করব ইন সুইটজ়ারল্যান্ড। দ্য প্যারাডাইস! আর ইউ নাটস! পুঁটি?”

Advertisement

“আমি কি দোকানে বিক্রির জন্য রাখা জিনিস না কি যে, এ সব দেখিয়ে কিনে নেবে?” আমার আবার মাথা গরম হয়ে গেল, “জানি অনেকে আছে, যাদের বিদেশ যাওয়ার কথা শুনলেই জিভ দিয়ে জল গড়ায়। তারা যেন-তেন-প্রকারেণ বিদেশ যেতে চায়। বাট আই ফাকিং হেট দ্য আইডিয়া। হেট দ্যাট কাইন্ড অব ল্যাল্যাগিরি, ছোঁচামো। আই ডোন্ট লাভ ইউ। তুমি আমার কাছে জাস্ট এক জন দাদা, যে দিদির প্রেমে পড়েছিলে! আর কিছু নও। প্লিজ় ব্যাপারটা জটিল কোরো না। লেট’স স্টপ দিস পিসফুলি।”

দীপ্যদা চশমা খুলে মাথায় হাত দিয়ে বসল। কান লাল হয়ে গিয়েছে। যেন কী করবে বুঝতে পারছে না।

Advertisement

আমি উঠে দাঁড়ালাম, “আমি আসি। আমার খাবারটার দাম...”

দীপ্যদা আর তাকাল না আমার দিকে। মাথা নিচু করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ডোন্ট ইনসাল্ট মি। জাস্ট লিভ।”

বাইরে সারা কলকাতা ঘামছে। মনে হচ্ছে, এই শহরটা বিশাল একটা সওনা যেন! তবে আমার খারাপ লাগছে না। দীপ্যদাকে ঝেড়ে ফেলতে পারে বেশ একটা হালকা লাগছে।

আমি সিটের নীচ থেকে হেলমেট বার করে মাথায় পরে স্কুটিটায় বসে দেখলাম, দোকানের কাচ দিয়ে দীপ্যদা আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়ামাত্র চট করে মাথা ঘুরিয়ে নিল।

আমার হাসি পেল খুব। দীপ্যদা বাচ্চাদের মতো করল একদম। কিছু কিছু ব্যাপারে আমরা কোনও দিনই বড় হই না।

স্কুটি স্টার্ট দিতে যাব। কিন্তু তখনই ফোনটা নড়ে উঠল। কে আবার! পকেট থেকে বার করে দেখলাম— এনা।

যাক, আমিই ওকে ফোন করতাম আজ। খুব দরকার ছিল। ওকে জিনিসগুলো পৌঁছে দিতে হবে। সেখানে ও নিজেই ফোন করল।

আমি ফোনটা কানে দিয়ে বললাম, “আমি তোকে আজই ফোন করতাম। শোন না, তোর জিনিসগুলো ফেরত দিয়ে গিয়েছে পুঁটি। আমি এর মধ্যেই তোকে...”

এনা আমায় শেষ করতে না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সাবু, সত্যি করে একটা কথা বলবি?”

আমি থমকে গেলাম। এনার গলাটা এমন শোনাচ্ছে কেন!

আমি বললাম, “হ্যাঁ। কী হয়েছে?”

এনা সময় নিল একটু। তার পর বলল, “পুঁটি কি সত্যি আমায় ভালবাসে? মানে মুখে যতটা বলে, ততটাই কি ভালবাসে? সত্যি করে বল আমায়। লুকোবি না প্লিজ়!”

১৭

পুঁটি (দিন: ৫৪)

চুয়ান্ন হল জেননের অ্যাটমিক নাম্বার। চুয়ান্ন ডিগ্রির ‘সাইন’-এর মান হল গোল্ডেন রেশিয়োর অর্ধেক। গলফে সাধারণ ভাবে বলা হয় যে, চুয়ান্ন হল পারফেক্ট রাউন্ড। রুবিক্স কিউবে চুয়ান্নটা ছোট

ছোট চতুষ্কোণ থাকে। ‘প্লাস চুয়ান্ন’ হল লিয়োনেল মেসির দেশের ইন্টারন্যাশনাল টেলিফোন কোড। চুয়ান্ন নামে একটা ফিল্মে অভিনয় করেছিলেন সালমা হায়েক। তাসের প্যাকে দুটো জোকার

নিয়ে চুয়ান্নটা কার্ড থাকে। আফ্রিকা মহাদেশে

মোট দেশের সংখ্যা চুয়ান্ন। ‘এ’ কে এক, ‘বি’ কে

দুই ধরে, যদি কেউ ইংরেজি LOVE শব্দটির প্রতিটি অক্ষরকে যোগ করে, তা হলে দেখা যাবে তাদের যোগফল হল চুয়ান্ন!

ধরে নিন এটা একটা ক্লোজ়িং স্টেটমেন্ট। কারণ এই গল্প এ বার শেষ হয়ে এসেছে! অন্তত আমার দিক থেকে তো বটেই।

এনা আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে চুয়ান্ন দিন আগে। আর এই চুয়ান্ন দিনে আমি মনখারাপ পেরিয়ে এসেছি। পেরিয়ে এসেছি কাজ। ফ্যামিলি ক্রাইসিস। আর পেরিয়ে এসেছি নিজেকে। এই নিজেকে পেরিয়ে আসাটা হল এই চুয়ান্ন দিনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ!

এনা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে যা-ই করি না কেন, সারা ক্ষণ এনার কথাই মনে পড়ত আমার। আর শরীরের মধ্যে কেমন যেন ঝিঁঝিঁ ডাকত। আপনারা ইলেক্ট্রিকের সাব-স্টেশন দেখেছেন নিশ্চয়ই। পাশ দিয়ে গেলেই শুনবেন কেমন একটা ঝিঁইইইই করে শব্দ হয়! আমার শরীরের মধ্যে সে রকম একটা ফিলিং হত সারা ক্ষণ। খেতে ইচ্ছে করত না। মাথার ভেতর কটকট করে নাম-না-জানা একটা পোকা কামড়াত। কাউকে ভাল লাগত না। মুখের মধ্যে কেমন একটা

উচ্ছে চিবোনোর মতো স্বাদ লেগে থাকত সারাক্ষণ। নিজেকে মাঝে মাঝে দেখলে মনে হত কোন না কোন গ্রহ থেকে যেন নেমে এসেছি আমি!

মাঝে নিজেকে ঠিক করার চেষ্টা যে করিনি তা নয়, কিন্তু সত্যি বলতে কী, ধরে রাখতে পারিনি। কখনও এটাও মনে হয়েছে যে, যাক আমি পেরিয়ে

আসতে পেরেছি এই কষ্ট। কিন্তু তার কিছু পরেই আবার দেখেছি ডালপালা বার করে আরও সৈন্যসামন্ত জুটিয়ে মনোকষ্টটি দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছে আমার কাছে।

কিন্তু তার পর আচমকাই এক দিন আমি সেরে উঠলাম। এত আলো যে পৃথিবীতে ছিল, আবার যেন নতুন করে বুঝতে পারলাম। এনার মুখটা মনে করলে আগে যেমন অদ্ভুত একটা নুনছাল উঠে যেত শরীরের কোথায় যেন, সেটা আর হল না। বরং এনাকে মনে হল পাশের বাড়ির বুল্টির দিদি বা নবদ্বীপের ঘাটে দেখা কোনও আবছা মুখের মেয়ে! চুয়ান্নটা দিন পেরিয়ে বুঝতে পারলাম, আমি সত্যি সেরে উঠেছি। বুঝতে পারলাম আমার আর কিছু বলার নেই। নিজের কষ্টকে বড় করে দেখানোর নেই। বরং আমিও আর পাঁচটা মানুষের মতোই জীবনের এই স্রোতে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যাব। দুঃখ কষ্ট যা আসবে সামলাব। মনখারাপ করে পড়ে গেলেও আবার উঠে দাঁড়াব। এবং আর একটা জিনিস করব। নিজের ভাল থাকার চাবিকাঠি কখনও অন্যের হাতে দেব না।

“কী কাকা, একা একা কী লিখছিস?”

আমি চমকে উঠে খাতাটা চট করে বন্ধ করে তাকালাম। দেখলাম আমার কাঁধের ওপর দিয়ে ঝুঁকে উঁকি মেরে আমি কী লিখছি সেটা দেখার চেষ্টা করছে রিজু।

আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, “তাতে তোর কী?”

রিজু হেসে বলল, “ক’টা বাজে দেখ। সাড়ে পাঁচটা। অফিস তো বন্ধ হবে এ বার। এখনও এত কাজ! আচ্ছা, আজকাল মাঝে মাঝেই কী লিখিস বল তো! গপ্পো লিখছিস না কি? ইঞ্জিনিয়াররা আজকাল সবাই দেখছি গপ্পো লিখছে! তুইও কি সেই দলে লেটেস্ট যোগ হলি?”

আমি খাতাটা ভাঁজ করে ঢুকিয়ে রাখলাম ড্রয়ারে। তার পর চাবি দিয়ে বন্ধ করে দিলাম সেটা। বললাম, “এত কৌতূহল কেন?”

রিজু বলল, “সে তো প্রথম থেকেই তোর খাতার দিকে কৌতূহল আমার। পরীক্ষায় দেখিসনি?”

“এখন তো বড় হয়ে গেছিস! এখনও!” আমি সামান্য অবাক হলাম।

রিজু মাথা নাড়ল। বলল, “বড়! পাগল তুই? আমরা কেউ বড় হইনি! কেউ বড় হই না। সবাই বড়র মতো মুখ করে ঘুরে বেড়াই। সবার ভেতরে খেলনা চেয়ে না-পাওয়া একটা অভিমানী বাচ্চা মটমট করছে! শক্তি চাটুজ্যে পড়িসনি! লিখতে হলে পড়তে হয়! তোরা লিখবি কিন্তু পড়বি না! এটা হয়!”

“বাবা! তুই অনেক জানিস তো! কিন্তু একটুও অহঙ্কার নেই!” আমি সামান্য খোঁচা দিলাম।

রিজু গায়ে মাখল না। বলল, “না, অহঙ্কার আছে। তবে তোর বোঝার মতো বোধ নেই! তা কী লিখছিস? ঐতিহাসিক উপন্যাস?”

আমি অবাক হলাম, “মানে?”

রিজু হাসল, বলল, “আজকাল তো দেখছি সবাই ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখা হচ্ছে কি না,

সেটা নিয়ে খুব চিন্তিত। যেন বাকি সব লেখা ফালতু আর বেকার!”

“কী হয়েছে তোর আজ?” আমি অবাক হলাম, “তুই রিজু তো?”

“না, বল না,” রিজু আমার দিকে নিজের চেয়ারটা টেনে আনল, “কী লিখছিস?”

“আমি ও সব কিছু লিখছি না রে বাবা। যে যা পারে লিখুক, বলুক। তাতে আমার কী! তোরই বা কী! বাদ দে না। যাদের কাজকম্ম নেই, তারা এ সব নিয়ে পেঁয়াজি করে। তোরও কি কাজকম্ম নেই!”

“আছে তো!” রিজু হাসল, “আসলে আমি একটু টেন্‌সড। বুঝছিস তো কেন? তুই ভুলে যাসনি তো?”

আমি হাসলাম, “না, ভুলে যাইনি।”

আসলে ভুলব কী করে! রিজু সারা ক্ষণ মনে করাচ্ছে যে! আজ ও আমায় ইলোরার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে।

রিজু বলল, “তুই ফোনটা আবার চালু করে ভাল করেছিস। দেখ তো লাইফ আবার কত সিম্পল হয়ে গেছে। বেকার কমপ্লিকেশন বাড়িয়ে কী লাভ!”

আমি ওর কথা শুনে মোবাইলটা দেখলাম।

না, এখনও সাবু আমার পাঠানো মেসেজটা রিড করেনি। ব্লু টিক হয়নি। গতকাল রাতে ‘সরি’

লিখে পাঠিয়েছি! আর এখনও রিড করেনি, কেন? আমার মনের মধ্যে একটা মাইক্রোস্কোপিক অস্বস্তি শুরু হয়েছে।

আমি মোবাইলটা সরিয়ে রেখে রিজুকে বললাম, “কিন্তু তুই তো কমপ্লিকেশন শুরু করলি। ইলোরা! প্রথম প্রথম সব ঠিক থাকে। আর যেই এক জন বেশি ভালবাসতে শুরু করে, অমনি অন্য জন তাকে টেকেন ফর গ্রান্টেড নিতে থাকে। আর সোশ্যাল মিডিয়ায় তো লোভী, হ্যাংলা আর পেছনে পিনিক দেওয়ার লোকেরা আছেই। তারা, তোর পছন্দের মানুষের আপলোড করা ছবি, কবিতা, গানে নানা গ্যাস খাইয়ে কমেন্ট করে, লাইক দিয়ে তার ইগো বাড়িয়ে দেবে। মিথ্যে প্রশংসা করে মাথা ঘেঁটে দেবে! ম্যাক্সিমাম মানুষই ইম্পর্ট্যান্স পেতে এত ভালবাসে যে, কেউ ভাল বললে সেটা সত্যি না মিথ্যে, সেটা যাচাই না করেই গলে জলে হয়ে যায়! হাতের কাছে ট্রুথফুল যে মানুষটা আছে, তাকে লাথি মারে! মানুষ মিথ্যে চাকচিক্যটাই পছন্দ করে। বুঝলি?”

রিজু মন দিয়ে শুনল। তার পর পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে বলল, “আর এক বার বলবি? রেকর্ড করে নেব ভাই! ইলোরাকে বেশি ভালবাসতে ইচ্ছে করলেই চালিয়ে শুনব। মানে নিজেকে চেক করার জন্য আর কী! এমন ডিমোটিভেশনাল স্পিচ তো সচরাচর পাওয়া যায় না!”

“ভাগ শালা!” বলে আমি হেসে রিজুকে মারার ভঙ্গি করলাম।

দরজা খুলে বিনয়কাকা ঢুকল। আমাদের হাসাহাসি করতে দেখে বলল, “হাসছ? হাসো। ও দিকে তিন সাহেব এক হয়েছে আজ। পুঁটিবাবু তোমায় ডাকছে। দাদার ঘরে যাও।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement