Smaranjeet Chakravorty

চুয়ান্ন

অত দাম দিয়ে রোজ-রোজ কারা খাবে কফি! যেখানে পাঁচ টাকার চা আর একটা লেড়ো বিস্কুট দিয়ে মানুষের বিকেলের খিদেকে মেরে দেওয়া যায়! আমি বসলাম। দীপ্যদা গিয়ে দুটো কফি আর স্যান্ডউইচ বলে এল। তার পর আমার সামনে বসে আবার হাসার চেষ্টা করল।

Advertisement

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share:

আমি বললাম, “শুনুন সুশান্তবাবু, এ সব থ্রেট করে কিছু হবে না। আপনারা কী সে সবাই জানে। কিছু গরিব মানুষ সামান্য কিছু খাবার আনন্দ করে খাবে, সেটাও আপনাদের সহ্য হচ্ছে না। সারাক্ষণ সব গাছে মই লাগাতে চান কেন? খালি ক্ষমতার লোভ! খালি দাদাগিরি! রাজনীতিটাকে একদম চিপ রংবাজিতে নামিয়ে এনেছেন আপনারা। বেশ করেছে জিনাদি আপনার নামে বলেছে। এ সব বলার জন্য আর্জেন্ট বলে আমায় ডেকে এনেছেন! জিনাদিকে এটাও বলব আমি। কোনও দিন নিজের ধান্দা ছাড়া আর কারও জন্য কিছু করেছেন? আমরা একটা কাজ করছি মানুষের জন্য, আর সেখানে বলছেন নিজের পোষা গুন্ডা দিয়ে সেই কাজ পণ্ড করবেন!”

Advertisement

“আরে, আরে, আপনি তো খুব রেগে গেলেন!” কচিদা নিজের সিট থেকে উঠে এল আমার দিকে।

আমি বললাম, “নিজে শুনেছেন কী বলেছেন?”

Advertisement

কচিদা বলল, “ম্যাডাম, সামনের বাই ইলেকশনে পার্টির থেকে একটা টিকিটের চেষ্টা করছি। প্লিজ় বুঝুন। রাজনীতি আমার পেশা। সেখানে এমন ড্যামেজিং রিপোর্ট গেলে কেমন লাগে বলুন তো! আমার কাজ পার্টির শ্রীবৃদ্ধি করা। সেটা করতে গিয়ে মাঝে মাঝে একটু এ দিক-ও দিক কথা বেরিয়ে যায়। সেই নিয়ে কেউ ও ভাবে বড় মাথাদের কান ভাঙায়! আর আপনাকে যা বললাম, সেটা উত্তেজিত হয়ে বলে ফেলেছি। মিন করিনি।”

আমি বললাম, “আর কিছু বলবেন? না আমি যাব?”

“আপনি আবার এ সব গিয়ে বলবেন না। ঠিক আছে, একটা কথা শুনুন। আপনাদের কাজে আমায় একটু যেতে দিন। না কোনও পার্টির ফ্ল্যাগ, ব্যানার, ফেস্টুন নেব না। আমি একা যাব। একটু দাঁড়াব। ছবি তুলব। একটু। নো পার্টি প্রোমোশন!”

আমি মাথা নাড়লাম, “দিস ইজ় নট মাই কল। আপনি বুঝুন, আমার কিছু করার নেই।”

“তাও জিনাম্যাডামকে একটু বলবেন। মানে আমার কেসটা যেন বিলা না হয়ে যায়! আমাদের লাইনেও খুব কম্পিটিশন। সামনের সপ্তায় পার্টির হেড অফিস থেকে প্রার্থীতালিকা বার করবে। তার আগে যদি যদি জিনাম্যাডাম একটু বলেন। মানে ওঁর যে বিশাল হোল্ড, আমি বুঝে গিয়েছি।”

আমি মাথা নাড়লাম। একে আমি আর কী বলব! এই কথা বলতে এত আমড়াগাছি করার কী আছে, সেটাই বুঝতে পারলাম না।

কচিদা একটা ছেলেকে বলল, “ম্যাডামকে গাড়ি করে বাড়ি দিয়ে আয়।”

আমি বললাম, “না, তার দরকার নেই। আমি স্কুটি এনেছি। চলে যাব।”

কচিদা এ বার হাসল। সেই খয়েরি দাঁতের সারি। বলল, “কিছু মনে রাখবেন না। আমি সব সময় আছি। কাউকে টাইট দিতে হলে বলবেন। সেটাও দিয়ে দেব। কেমন?”

টাইট দিতে তো অনেককেই হবে। কিন্তু সেটা আমি নিজেই দিতে পারব। আমি নিজের কাজ অন্যকে দিয়ে করাই না।

পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে আমি ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে তিনটে বাজে। লিন্ডসে স্ট্রিটে যেতে হবে আমায়। দীপ্যদা অপেক্ষা করবে।

স্কুটিটা ঠিক হয়ে গিয়েছে। মা আজ বারণ করছিল স্কুটি নিয়ে বেরতে। বলছিল একটা পা তো এখনও জখম আছে। আমি চালাব কী করে স্কুটি! বলছিল, “আবার একটা কাণ্ড ঘটাবি জানি। সারাক্ষণ ধিঙ্গিপনা! আমার যে তোকে নিয়ে কী চিন্তা হয়!”

আমি পাত্তা দিইনি। অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার থাকলে বাড়িতে বসেও মাথায় পাখা ভেঙে পড়তে পারে!

আমি স্কুটিতে উঠে স্টার্ট দিয়ে কলকাতার কাটাকুটি আর হিজিবিজি ভিড়ে ঝাঁপ দিলাম।

দীপ্যদা কাল রাতেও আমায় ফোন করেছিল। সামান্য নেশা জড়ানো গলায় কথা বলছিল। আমার যে কী বিরক্ত লাগছিল, কী বলব। আমার দিদির সঙ্গে যার সম্পর্ক, সে আমায় ভালবাসে! এ ভাবে হয় না কি! আমাকেও তো তার জন্য কিছু ফিল করতে হবে! কী আশ্চর্য রে বাবা! ধরে বেঁধে প্রেম হয় না কি!

আমি বেশ কড়া গলায় বলেছিলাম, “এ ভাবে রাতে ফোন করে আমায় বিরক্ত কোরো না। বলেছি না, আমার অন্য এক জনকে পছন্দ! তা হলে? আর কিছু বলতে হলে দেখা করে বোলো। আমারও কিছু বলার আছে।”

“আমার আসলে তোমায় এত আদর করতে ইচ্ছে করছে... আমি নিজেকে রেজ়িস্ট করতে পারছি না। প্লিজ় আমায় এক বার তোমায়...”

“হোয়াট দা ফাক দীপ্যদা!” আমি চাপা কিন্তু ধারালো গলায় বলেছিলাম, “আর ইউ সিরিয়াস! প্লিজ় ডোন্ট মেক মি সে ব্যাড থিংস টু ইউ।”

দীপ্যদা নিজেকে সামলেছিল, “কাল দেখা করবে? লিন্ডসেতে আমার নতুন অফিসের পাশেই একটা কাফে আছে। চারটে নাগাদ দেখা করবে?”

আমি বলেছিলাম, “ঠিকানা আর লোকেশনটা টেক্সট কোরো। আমি চলে যাব।”

দীপ্যদা ফোনটা রাখার আগে বলেছিল, “আমার কথাটা ভেবো, সাবু। তোমার কাউকে ভাল লাগলে আমি তার সঙ্গেও কথা বলতে রাজি। প্লাস আমি কিন্তু নেক্সট উইক বাবা-মা’কে বলব।”

আমি কিছু না বলে কেটে দিয়েছিলাম ফোন।

সামনের সিগন্যালে দাঁড়ালাম আমি। চারদিকে নানা রকম গাড়িতে গিজগিজ করছে। আকাশে আজ খুব রোদ! গা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। বাঁ দিকে টিপু সুলতান মসজিদ। সামনে অনেক দোকান। এখানে সিগন্যালটা লম্বা হয়। নানা হকার ঘোরাফেরা করছে। কত কী যে ফিরি হচ্ছে!

দীপ্যদার ওখান থেকে বেরিয়ে এক বার যাব অফিসে। রাতে ছ’টা জায়গা থেকে খাবার তোলার ব্যাপার আছে। ছেলেপুলেদের বুঝিয়ে দিতে হবে। একটা নতুন মেয়েও জয়েন করেছে আমাদের এখানে। ইলোরা নাম। ওকেও কাজ বুঝিয়ে দিতে হবে। কারণ আমায় চলে যেতে হবে যে!

হ্যাঁ, কাল বিকেলেই জিনাদির ই-মেল এসেছিল। আমি মোবাইলে দেখে নিয়েছি। সেপ্টেম্বর থেকে আমায় জয়েন করতে হবে নর্থ বেঙ্গলে। আর আমি যদি যেতে না চাই, তা হলে ফিফটিন্থ অগস্টের মধ্যে সেটা জানাতে হবে।

বাবাকে বলেছি আমি। এ ছাড়া আর কাউকে কিছু বলার নেই আমার।

পুঁটিকেও কি কিছু বলার নেই? আমার নিজের মনেই প্রশ্ন এল। তার পরেই ভাবলাম, না, নেই। কেন বলব! আমি দেখাতেই চাই না যে, পুঁটির জন্য আমার কষ্ট হয়! ভালবাসা পাওয়ার জন্য আমি ভিক্ষে করতে পারব না! এত দিন দেখেও পুঁটি যদি না বোঝে আমায়, তবে আর বুঝতে হবে না। ওকে এনার অমন ছবি পাঠিয়েছে বলে ও আমায় কথা শোনাতে এল! কিন্তু বুঝল না, আমি কেন এমন করলাম। ও আমায় এত দিন চেনে, কোনও দিনও কি আমায় আউট অব দ্য লাইন কিছু করতে দেখেছে! সেখানে আমি অমন একটা জিনিস কেন করলাম, সেটা এক বারও ভাবল না? কোনও কিছুই কি বোঝে না! ও নির্বোধ না অন্ধ! সে দিন অত কাঁদলাম ওকে জড়িয়ে ধরে। তার পরেও কিছু বলল না! আর শুধু তা-ই নয়, সে দিনের পরে এক বারও জিজ্ঞেস করেনি কেমন আছি আমি।

আসলে সবাই নিজেরটা নিয়েই ব্যস্ত। ঠিক আছে। ভিক্ষে করে প্রেম আমার চাই না।

দীপ্যদা দাঁড়িয়েছিল রাস্তায়। আমাকে দেখে এগিয়ে এল। হাতে একটা সিগারেট। দেখেই আমার আবার সেই তামাক আর পুরনো পেতল মেশানো গন্ধটা মনে পড়ে গেল। নাক কুঁচকে গেল অজান্তেই!

আমি নামলাম স্কুটি থেকে। তার পর সেটাকে পাশে স্ট্যান্ড করিয়ে হেলমেট খুলে সিটের নীচে ঢুকিয়ে রাখলাম।

“চলো বসি...” দীপ্যদা আমার হাতটা আলতো করে ধরতে গেল।

আমি সরে গেলাম। বললাম, “বসতেই হবে?”

“প্লিজ়,” দীপ্যদা সামান্য হাসার চেষ্টা করল।

দোকানটা ভালই। বেশ সাজানো। আজকাল কলকাতায় কফির দোকান এত বেড়ে গিয়েছে! মাঝে মাঝেই নতুন নতুন দোকান গজিয়ে উঠতে দেখি এখানে-ওখানে। তবে দেখি কিছু দিন পর পরই সে সব আবার বন্ধও হয়ে যায়। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। অত দাম দিয়ে রোজ-রোজ কারা খাবে কফি! যেখানে পাঁচ টাকার চা আর একটা লেড়ো বিস্কুট দিয়ে মানুষের বিকেলের খিদেকে মেরে দেওয়া যায়!

আমি বসলাম। দীপ্যদা গিয়ে দুটো কফি আর স্যান্ডউইচ বলে এল। তার পর আমার সামনে বসে আবার হাসার চেষ্টা করল।

আমি যতটা সম্ভব নির্বিকার থাকলাম। সেটা লক্ষ্য করেই দীপ্যদা একটু যেন টসকে গেল।

আমি বললাম, “বলো। আমায় যেতে হবে। কাজ আছে।”

দীপ্যদা বলল, “তুমি কিছু বললে না আমায়? সত্যি তোমার অন্য কাউকে ভাল লাগে?”

আমি তাকালাম। কী বলি একে! কোথা থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল কে জানে!

বললাম, “হ্যাঁ। মিথ্যে বলব কেন? দেখো, আমার কিছু বলার নেই।”

“ও সব ভাললাগাগুলো সাময়িক। আমার মতো কি প্রতিষ্ঠিত সেই ছেলেটা? ও সব ভুলে যাও সাবু। শোনো, আমি বাবা-মা’কে বলে দিই। তোমার বাবা-মা’কেও বলতে হবে। আমি জানি ইট উইল টার্ন আগলি। মলি এটাকে ভাল ভাবে নেবে না। কিন্তু আমায় একটা ডিসিশন তো নিতেই হবে। নেক্সট ইয়ার আমায় ট্রান্সফার করে দিচ্ছে লুসার্নে! ভাল একটা রাইজ় পাচ্ছি। প্রোমোশন। সঙ্গে সুইৎজ়ারল্যান্ড। ইউ ক্যান গেস হাউ এক্সাইটেড আয়্যাম। আমি চাই তোমায় নিয়ে যেতে। ইট উইল বি আ ফেয়ারি টেল! কাল মলি বিকেলে ফোন করেছিল। ও কিছুতেই ব্রেক আপ করতে চাইছে না। বিয়ে করতে চাইছে। বলছে, না করলে পুলিশে যাবে। আমি নাকি বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাস করেছি! ইয়ার্কি আর কী!”

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কিন্তু কিছু বলার আগেই কাউন্টার থেকে ডাক পড়ল এ বার। দীপ্যদা, “এক মিনিট,” বলে উঠে গেল খাবার আনতে।

কফির কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে। স্যান্ডউইচ থেকে চিজ় গড়িয়ে পড়ছে আয়তাকার প্লেটে।

দীপ্যদা কফির কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে তাকাল আমার দিকে। চোখে প্রশ্ন।

আমি প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে হাতটা মুছলাম। তার পর জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার কী মনে হয়, ভগবান আছে?”

“ভগবান!” দীপ্যদা কী বলবে বুঝতে পারল না!

আমি বললাম, “আছে নিশ্চয়ই। তবে সে খুব মিসচিভিয়াস, জানো। মানুষের পিছনে লেগে, তাকে বিপাকে ফেলে খুব আরাম পায়।”

দীপ্যদা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। মানে আমি কী বলছি, কেন বলছি সব বাউন্সার যাচ্ছে ওর।

আমি বললাম, “দিদির তোমায় পছন্দ। তোমার আমায় পছন্দ। আমার পুঁটিকে পছন্দ। পুঁটির এনাকে পছন্দ। আর এনার পছন্দ রণজিৎকে। কেসটা বুঝলে?”

“মানে?” দীপ্যদার ঠোঁটের ওপর কফির একটা সরু রেখা লেগে আছে।

“মানে মালগাড়ির মতো আমরা সবাই। এক জন অন্য জনের পেছনে লাইন দিয়ে আছে। সবাই অস্বস্তিতে আছে। খারাপ লাগায় আছে। কিন্তু কিছু করার নেই।”

দীপ্যদা হাত তুলে বলল, “এক মিনিট, এক মিনিট। পুঁটি? তা হলে সেই... কিন্তু সে দিন চুমুটা...”

আমি বললাম, “সেটা তুমি খেয়েছ। আচমকা। জোর করে এক রকম। আই নেভার কিস্ড ইউ ব্যাক! আমি অমন মেয়ে নই যে, নিজে থেকে তোমায় জড়িয়ে চুমু খেয়ে, ‘তোমায় ভালবাসি’ টাইপের একটা ইম্প্রেশন দিয়ে, তোমার থেকে যতটা পারা যায় ফুটেজ খেয়ে, তোমার মনোযোগ নিয়ে আত্মশ্লাঘা অনুভব করে তার পর সরে যাব।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement