ছবি: কুনাল বর্মণ।
চমকে উঠে তমা বলে, “বল্লাল!”
বল্লাল বলে চলে, “বাঘ এক্সপ্রেস কোথাও বেশি সময়ের জন্য থামে। ফের সেই সঙ্গীহীন চন্দনাকে দেখা যায়। বাঘ এক্সপ্রেস তার গন্তব্যে পৌঁছয়। সেখানেও তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে সামান্য দূরত্ব রেখে চলতে থাকে সে। তীর্থযাত্রীরা কোথাও ডেরা বাঁধে। সরাইখানায় মাথা গোঁজে। সেখান থেকে একটু দূরের অন্য কোনও সরাইখানায় আশ্রয় নেয় চন্দনপুরুষ।”
“থামুন বল্লাল! দয়া করে থামুন!”
“আপনিও জানতেন?”
“আমার সঙ্গে গরিমার বন্ধুত্বটা গভীর। ওর সব কথা আমি জানি, আমার সব কথাও জানে ও।
“দিদি জামাইবাবুর কথাটা যে ভুয়ো, তাও জানতেন।”
“জানতাম। কিন্তু আমি ধারণাও করতে পারিনি যে, আপনি বুঝতে পেরেছেন! আমি নিশ্চিত, আপনার থেকে কেউ এ কথা জানবে না।”
“কী করে নিশ্চিত হলেন?”
“যে বলে, ভরসা করতে পারলে বন্ধু ভাবতে, তার প্রতি এটুকু ভরসা করতে পারব না?”
“আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”
“কিন্তু আপনি বুঝলেন কী করে? আপনার কি অলৌকিক কোনও ক্ষমতা আছে? আপনি কি মন্ত্র-তন্ত্র জানা জাদুকর?”
“না তমা। আমি চোখ-কান খোলা রাখি আর মানুষের ভঙ্গির ভাষা পড়ার চেষ্টা করি। যে আপনার প্রগাঢ় বন্ধু, সে যখন প্রায় অপরিচিত কোনও লোকের সামনে এসে বলে ‘কাল রাতে থাকব না, ম্যানেজ করে নিস’ তখন বোঝা যায়। আর আমি ট্রেন থেকেই ভদ্রলোককে এবং আপনার বান্ধবীকে দেখেছি লুকিয়ে কথা বলতে। মুন্সিয়ারিতেও আমার চোখে পড়েছে।”
“ভদ্রলোকের নাম তমাল। তাকেও সওদাগর বলতে পারেন।”
“চন্দনা পাখি কি বন্দি?”
“শুধু পায়ে বেড়ি পরালেই কি মানুষকে বন্দি করা যায় বল্লালবাবু? পাখিকে মুক্ত করে তার আকাশ যদি কালো ধোঁয়ায় ঢেকে দেওয়া হয়, তা হলে সেটা কি বন্দিত্ব নয়? গরিমা নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করেছিল, বাবা-মার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। সে জন্য বাড়িতে কম অশান্তি হয়নি ওর। কিন্তু এক সঙ্গে থাকতে থাকতে দেখেছে স্নেহময় রেগে গেলে হয়ে যায় অন্য মানুষ। সেই মুহূর্তে ওর চোখ, মুখ, গলার শিরা, কণ্ঠস্বরে যেন ভর করে অপদেবতা। কুৎসিত, নোংরা কথার ফুলঝুরি বেরোয় কান ফাটানো শব্দে। একটু পরেই স্নেহময়ের রাগ পড়ে যায়। ও তখন সব ভুলে যায়। আর মনে করে বাকিরাও ভুলে গেছে। গরিমা এ সব সহ্য করতে করতে কেমন একটা হয়ে গিয়েছিল। কলেজ সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে যেন শ্বাস নিতে পারল। চাকরি নেওয়া নিয়েও আপত্তি ছিল স্নেহময়ের। পরীক্ষা দিয়ে কলেজে চাকরিটা পেয়ে যেতেই সমস্যা শুরু হল। বাকি সব সমস্যা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায়, যদি আসল খুঁটি ঠিক থাকে। কিন্তু গরিমা দেখল, সেটাই সবচেয়ে বেশি টলমল করছে।”
“তা হলে আলাদা হয়ে যাচ্ছে না কেন? ডিভোর্স করে দিক। নিজের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করা অথবা অপছন্দের লোককে বাতিল করার হক তো সবার আছে।”
“দাঁড়ান, মশাই দাঁড়ান! সে সব কথা বল্লাল সেনের সময়ে ভাবা যেত, যখন রাজার কথাই আইন, রাজার ইচ্ছেই নিয়ম। এখন আইনই শেষ কথা। পরিস্থিতি যখন অসহনীয় হয়ে উঠবে, তখন ওই বাড়ি ছাড়বে গরিমা। এখন ও মধ্যপথে রয়েছে।”
“তা হলে সমস্যা কোথায়?”
“সমস্যা এটাই যে, সব কথা মুখে বলা যায় না বল্লালবাবু। এক আকাশের নীচে, এক ছাদের তলায় যার সঙ্গে বিন্দু বিন্দু করে ও সংসার সাজিয়েছে, সেটা ভাঙার জন্যও তো মনকে সময় দিতে হয়। মন তো যন্ত্র নয়। গরিমার মন যদি একটা গাছ হয়, তা হলে তার শিকড় এখনও স্নেহময়ের মাটিতে। আর নিত্যদিন অশান্তি করে স্নেহময় একটা একটা করে শিকড় ছিঁড়ে চলেছে। গরিমা ওর সামনে অনেক চেষ্টা করেও ডিভোর্সের কথা পাড়তে পারেনি এখনও। অন্য দিকে তমালের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে গাঢ় হয়েছে। আমার সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব ও কলেজে আসার পর। ক্রমশ তা গভীর আস্থায় পরিণত হয়েছে। আপনি যা বললেন, তা আমি জানতাম। কিন্তু সেটা কি আপনাকে বলা যেত, বলুন? তবে আপনার সঙ্গে আমার এই নতুন বন্ধুত্বের কথা ও জানে না। আসলে এই ক’দিন ও কথা বলার সময় পাচ্ছে কোথায়!”
“আপনার ঘুম পাচ্ছে না, তমা? ক’টা বাজে দেখেছেন?”
“যত ইচ্ছে বাজুক। আমার ঘুম পাচ্ছে না। আপনার ঘুম পাচ্ছে, তাই না?”
“আমারও ঘুম পাচ্ছে না। আমার রাত জাগা অভ্যেস আছে।”
“আমি তো আপনার কথা কিছুই জানি
না বল্লালবাবু।”
“আমার পরিচয় তো সকলের জানা।”
“সকলের জানা? আমি তো জানি না।”
“আমি বল্লাল। আমি এক জন রাজা। হতাশগড়ের রাজা। কিন্তু আমার সবটাই উল্টো। আমি রোম্যান্টিক কথা বললে লোকে ভিরমি খায়। সিরিয়াস কথা বললে লোকে ভাবে হাসির কথা। গম্ভীর ভাবে কিছু বলতে গেলে লোকে বুঝতেই পারে না কী বলছি!”
“বল্লালবাবু!”
“আপনিও বুঝতে পারলেন না তো!”
“বল্লাল, সামনে তাকান। দেখুন!”
মধ্যরাতে চন্দ্রোদয়
কালো কুচকুচে আকাশপটে তখন লাজুক মুখ দেখিয়েছে খণ্ড চন্দ্র। কিছু কিছু বিষয় আছে যা স্বাভাবিক ভাবে ঘটলে চোখেও পড়ে না। কিন্তু কোনও গুণিজনের বর্ণনায় তা-ই হয়ে ওঠে দর্শনীয়। তার প্রতিটি দৃষ্টিকোণ দেখে-শুনে লোকে তখন শিহরিত হয়। এখনও ঠিক সেটাই হল। একা ঘরে নিদ্রামগ্ন তমা যদি ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর জানলা দিয়ে চাঁদ দেখেও, তা হলেও সে তার পর অন্য পাশ ফিরে ঘুমিয়েই পড়ে। কিন্তু আজ এই শৈলশহরে, এই গাঢ় কৃষ্ণবর্ণের আকাশের বুকে ওই চাঁদখণ্ড তমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলল। সে শিকার ধরার মতো সন্তর্পণে চেয়ার ছেড়ে গিয়ে দাঁড়াল কাচের প্রাকারের সামনে। নাক ঠেকাল কাচে। বেশ ঠান্ডা। তার পর সে তার সমগ্র সত্তা, মনঃসংযোগ নিয়ে তাকিয়ে থাকল চাঁদের দিকে। তার পাশে তখন এসে দাঁড়িয়েছে বল্লাল। পূর্ণিমার চাঁদের মতো ঔজ্জ্বল্য নেই এই চাঁদের। কিন্তু তার মৃদু, লজ্জিত জ্যোৎস্না যেন এক অন্য পৃথিবীর আবহ নিয়ে এসেছে। সেই আলোয় একটু একটু করে ফুটে উঠছে বরফে ঢাকা পর্বতশৃঙ্গের রূপ। খুব পলকা সেই দৃশ্য। যেন নেই। কিন্তু আছে। সামান্য সাদাটে। তাতে একটু হলদে ছোপ। আস্তে আস্তে স্পষ্ট হচ্ছে অবয়ব। বল্লাল নিচু গলায় বলল, “দেখতে পাচ্ছেন?”
তমা ফিসফিস স্বরে বলে, “পাচ্ছি।”
বল্লাল বলল, “একটা গল্প আছে জানেন? গল্প নয়, জনশ্রুতি!”
তমা বলল, “কী গল্প?”
বল্লাল বলল, “মহাভারতের কথা। পাণ্ডবরা যখন ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন তারা এখানেও এসেছিল। তাদের রান্নার যে উনুন, সেগুলোই নাকি ওই পাঁচশৃঙ্গ। তাই নাম পঞ্চচুল্লি। যদি কখনও ভোরের ব্রাহ্ম মুহূর্তে সূর্যের প্রথম রশ্মিকে এই পাহাড়চুড়োয় এসে পড়তে দেখেন, তা হলে
মনে হবে আগুন জ্বলছে পাহাড়শীর্ষে। কোনও এক দিন দেখবেন!”
তমা তেমনই প্রায় অশ্রুত স্বরে বলল, “এক দিন দেখব, কথা দিলাম আপনাকে,” তার পর একটু থেমে বলল, “আপনার জন্যই আজ এই অমূল্য দৃশ্য দেখছি বল্লালবাবু।”
সামনের বরফমোড়া অভ্রভেদী পাঁচ শৃঙ্গে তখন ঝরে পড়ছে স্বর্গীয় জ্যোৎস্না। আর তার রঙে, রূপে, লাবণ্যে যেন দৃশ্য-অদৃশ্য, সম্ভব-অসম্ভবের মাঝামাঝি রূপ ধরে ভেসে উঠছে শৃঙ্গপঞ্চক। সে দিকে তাকিয়ে চোখ জলে ভরে গেল তমার। পাশে তাকিয়ে দেখল, বল্লালও তার পাশে দাঁড়িয়ে অপলক তাকিয়ে আছে সামনে।
তমা বলল, “আপনি আমাকে এই অপরূপ উপহার দিলেন। আপনাকে কী ভাবে ধন্যবাদ জানাব?” বল্লালকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে সে সরে গেল তার দিকে। নিজের মাথাটা রাখল তার বুকে। বল্লাল তার এক হাত এক বার তমার মাথায় রাখল, তার পর কাঁধে রাখল। তমা তখন ধীরে, খুব ধীরে বল্লালের মাথাটা ধরে নামিয়ে আনল। তার পর ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করল তার ঠোঁট। গভীর, গভীরতম চুম্বনে শুষে নিল তার ওষ্ঠ, অধরোষ্ঠ। দীর্ঘ চুম্বন শেষে আর একটা কথাও না বলে নিজের ঘরে চলে গেল তমা। মধ্যরাতের ম্লান জ্যোৎস্না তখন আরও একটু উজ্জ্বল হয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে মুন্সিয়ারিকে।
অর্ধবৃত্ত
একটি বৃত্তের দু’টি বিন্দুর মধ্যে দূরত্ব কখন সব থেকে বেশি হয়? যখন তারা কোনও ব্যাসের দুই প্রান্ত বিন্দুতে অবস্থান করে। ছাত্রছাত্রীদের শৈলনগর মুন্সিয়ারিতে এসে হাত-পা ছড়িয়ে বসা এবং আবার জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেরার জন্য রওনা দেওয়া যেন সেই দূরত্ব রচনা করল। পরের দিন সকালে তারা ব্যাগ গোছাল, মনখারাপ করা অভিব্যক্তি আর ভারাক্রান্ত মুখে বিদায় জানাল পঞ্চচুল্লিকে। আসার সময় তারা নৈনিতালে থেকেছিল, এ বার সটান যাত্রা কাঠগোদাম রেল স্টেশনে। দীর্ঘ পথ। পথে একটা বাঁক থেকে শেষ বার স্পষ্ট দেখা গেল পঞ্চচুল্লিকে। পথে একটা অসম্ভব কোণ থেকে গাঢ় নীল নির্মেঘ আকাশে দেখা গেল মহিমাময় শৃঙ্গ অন্নপূর্ণা, দেখা গেল ত্রিশূল। যাত্রা শুরুর আগে কাকভোরেই গেস্ট হাউসে ফিরে এসেছিল গরিমা। তার পর থেকে কপোত-কপোতীর মতো প্রকাশ্যে, নিভৃতে প্রায় সর্বক্ষণই কথা বলে চলেছে গরিমা ও তমা। এটা নতুন নয়, এটাই বরাবর দেখা দৃশ্য। কিন্তু তমা এক বারও কথা বলল না বল্লালের সঙ্গে। কথা বলল না, তাকাল না, মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনাও এড়িয়ে গেল সযত্নে। জনশূন্য বাস-রাস্তায় মন্দির দেখে হইহই করে নেমে পড়ল ছাত্রছাত্রীরা। বল্লাল, জীবেশ নেমে কোমর ছাড়াল। গরিমাও নেমে চায়ের ব্যর্থ খোঁজ করল। তমা নামলই না। বাসে বসে দূরের পর্বতপ্রান্তে তার হারিয়ে যাওয়া দৃষ্টিকে ছড়িয়ে দিল। পথে ভীমতাল দেখে নেমে ছবি তুলতে শুরু করল ছেলেমেয়েরা। সবাই নামল না, দু’-এক জন বসে থাকল। বল্লাল নামেনি দেখে তমা নেমে ঘুরে দেখল। তার পর স্টেশন। দীর্ঘতম ট্রেন যাত্রা। মাঝপথে আবার উড়ে এল চন্দনা পাখি। উড়ে এল বার বার। তমা সব দায়িত্ব পালন করল। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অন্তাক্ষরীও খেলল, আড্ডাও দিল। সযত্নে এড়িয়ে গেল এক জনকে। একটা শব্দ নয়, চোখাচোখি পর্যন্ত নয়। তার মনে পড়ল, আসার সময় বল্লাল হাওড়া নয়, মাঝখানের কোথাও থেকে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। ফেরার সময়ও তেমনই কোথাও উধাও হয়ে গেল। উধাও হয়ে গেল তমার চন্দনা পাখি। না কি দস্যু বাজ? না কি ভিনদলের দলছুট পতঙ্গ? কে জানে! সে যত ক্ষণ ছিল, তার সঙ্গে একটা কথাও বলেনি তমা। সে যখন উধাও হল, তখন আর কারও সঙ্গেই আর কথা বলল না সে। মুন্সিয়ারির মধ্যরাতের আঁধারই হয়তো ছুঁয়ে থাকল তার মুখ, চোখ, কথা বলা, চিন্তাসূত্রকে।
অবতরণের ক্ষণ
একটি বিমান যখন তার উচ্চতা কমাতে কমাতে মাটির কাছে চলে আসে, তখন মাটিও যেন টেনে, আঁকড়ে তাকে আপন করে নেয়। ঘুরে বেড়ানোর পেলব চলায় ইতি টেনে সে তখন একটু একটু করে নভশ্চর থেকে পায়ে চলা পথিক হয়ে ওঠে। দীর্ঘ ট্রেনযাত্রায় তমাও একটু একটু করে ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করল। এই যাত্রা তার কাছে শুধু পার্বত্য উপত্যকা থেকে সমতলে অবতরণ নয়, তার থেকে অনেক বেশি কিছু। ভ্রমণের এই দিনগুলোয় সে চেষ্টা করেছিল সমতলের জীবনকে ভুলে থাকতে, এবং পেরেছিল। সে তার আধা-সাংসারিক জীবনের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখার পরীক্ষায় সফল হয়েছিল। এখন সমতলে পৌঁছনোর পথে সেই সব যোগাযোগ, স্মৃতি, সংক্রমণ একটু একটু করে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। যেন চেতনানাশক ওষুধের প্রভাব ক্রমে ক্রমে হালকা হতে শুরু করে যন্ত্রণার বিন্দুকে জাগ্রত হতে দেখা।
সমতলে নামার পর ফেরার সময় সব যেন ভাঙা হাট। ছাত্রছাত্রীদের উচ্ছ্বাস কমে গেল। একটু দূরে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীকে কথা বলতেও দেখা গেল। তমা বিশেষ কথা বলল না কারও সঙ্গে। জানলার দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে সে চোখ পেতে রাখল দূরে। কখনও তার ছায়াদৃশ্যে বিপ্লব চলে এল, কখনও ছায়াদৃশ্যের পর্দা জুড়ে বল্লাল এল, দাঁড়াল, মৃদু হাসল আর বলল, ‘বিরক্ত হবেন নাকি একটু?’ চা, কফি হেঁকে হেঁকে চলে গেল। সে সাড়া দিল না। ট্রেন ক্রমশ সমতলে গতি কমাল, বাড়াল। তার পর হেঁটে চলার মতো শ্লথ, ধীর গতিতে হাওড়ার দীর্ঘ উঠোনে এসে দাঁড়াল। ছাত্রছাত্রীদের রওনা করিয়ে প্রিপেড ট্যাক্সিতে উঠল তমা। সে জানত, গরিমাকে নিতে তার বর স্নেহময় আসবে গাড়ি নিয়ে। এসেও ছিল। তাকে নামিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবও আসত, সে জানে। সুযোগ দেবে না বলেই সে দ্রুত পা চালাল। জীবেশ গেল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের দিকে।
তমা যত বার দূরপাল্লার ভ্রমণ সেরে হাওড়ায় ফেরে, তত বারই আগে উঁকি দিয়ে বাইরের ব্রিজটা একবার দেখে নেয়। যেন কেউ সেটা চুরি করে নিয়ে গেল কি না দেখার জন্য। ছোটবেলাতেও করত, এখনও করে। অথচ কোথাও যাওয়ার সময় যখন শহর পেরিয়ে হাওড়ার পোলে ওঠে, তখন খেয়ালও করে না তাকে। আজও স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে সেতুর দিকে তাকাল সে। সেতুর পিছনের আকাশে মেঘ করেছে। ধূসর মেঘের সামনে ইস্পাতের সেতুটা বড় মানানসই লাগে তার চোখে। সেই সেতুর পিছনে তার শহর। তার প্রিয়তম। প্রিয়তম না প্রিয়তমা? এই শহর তার কাছে নারী, পুরুষ না লিঙ্গচিহ্নের ঊর্ধ্বে? প্রশ্নটার মীমাংসা হল না। তার আগেই ‘প্রিয়তমা’ শব্দটা তাকে টেনে নিয়ে ফেলল মুন্সিয়ারিতে। লোকটা কি মজা করে বলল? না কোনও ইঙ্গিত আছে তার মধ্যে? কিন্তু তমা নিজে সচেতনভাবেই বিষয়টায় ঢুকল না। তার যান সামনের গাড়ি টপকে দ্রুত গতিতে শহরে পা রাখল।
শিশুদের অভ্যেস, খুব চেনা মানুষকেও কিছু দিন না দেখলে একটু দূরে সরিয়ে রাখা। দেখেও না দেখা, চিনেও না চেনা। অভিমান দেখানো। মুখ ঘুরিয়ে রাখা। তমার মনে হয় কলকাতাও যেন তার ওপর অভিমান করে। সে ক’দিন পর ফিরলে যেন তাকে আপন করে নেয় না সহজে। যেন সে এলোমেলো পায়ে না হাঁটলে, যেন তার অলিতে-গলিতে গিয়ে নিঃশ্বাস না নিলে তার অভিমান ভাঙবে না। তমার মনে হয় কলকাতার অভিমান হয়, বিপ্লবের হয় না। সে দায়িত্ববান মানুষ। সে অতিমানব, সে যন্ত্রমানব। নামটা মনে পড়তেই শরীরে কেমন একটা অস্বস্তি ফিরে আসে তার। হয়তো এরই নাম নগরযন্ত্রণা। নাকি নাগরযন্ত্রণা? নাগরই বটে! বাঙালি এখনও বিয়ে ছাড়া একসঙ্গে থাকাকে ওই শব্দেই চেনে।
পুরুষ কয় প্রকার
ছোটবেলা থেকে মা, বাবার সঙ্গে কম বেড়ায়নি তমা। প্রতিবারই যাওয়ার সময় উৎসাহে টগবগ করত। আর ফেরার পর ক্লান্তিতে, পরিশ্রমে বিছানা নিত। নিজের পায়ে দাঁড়াবার পর থেকে ছবিটা বদলে গেছে। কাজের চাপে যখন সে হাঁসফাস করে, তখন মনে হয় তাকে এক ঝলক মুক্তির স্বাদ এনে দিতে পারে কোথাও বেড়িয়ে আসা।