ছবি: কুনাল বর্মণ।
আমি খুব নিরীহ মুখে ওদের সঙ্গে গুলতানি করতাম। তাতে অনেক সময় আমার ইয়ার্কি ওরা বিশ্বাস করে ফেলত। সেই মেয়েটার নাম মেঘা। বড় বড় চোখ। ছোট ছোট চুল। হাসিখুশি মুখ। এক দিন এসে গল্প করল, তার দিদির বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ের গল্প যত করত, তার থেকে বেশি করত জামাইবাবুর গল্প। তিনি বড় সুপুরুষ। খুব আন্তরিক। তিনি বিয়ের আগে বাইরে রেস্তরাঁয় খেতে ভাবী গিন্নির সঙ্গে শালিকেও আমন্ত্রণ জানান! সবাই চুপচাপই শোনে। কেউ বিয়ের ভোজের মেনু জানতে চায়। আমি এক দিন গম্ভীরমুখে নিচু গলায় ওকে বললাম, একটা খবর আছে। গোপন খবর, পাকা খবর। ও বলল ‘কী রে?’ আমি বললাম, বল, কাউকে জানাবি না! ও বলল, ‘তোকে কথা দিলাম।’ আমি বললাম, তোর দিদি চুটিয়ে প্রেম করে একটা চ্যাংড়া ছেলের সঙ্গে। ও বলল, ‘অসম্ভব! আমার দিদি আমায় সব বলে, আর এটা বলবে না! তা ছাড়া দিদির বিয়ে তো সামনে!’ আমি বললাম, ছেলেটা নতুন বাজারে পচা মাছ বিক্রি করে। মেঘা বলল, ‘বাবা কিছুতেই মানবে না।’ আমি বললাম, তাই তো ওরা একটা সাঙ্ঘাতিক পরিকল্পনা করেছে। মেঘা ভয়-ভয় চোখে ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী সেটা?’ আমি বললাম, ওরা পালাবে। বিয়ের রাতেই পালাবে! শুনে মেঘার মুখ কাঁদো-কাঁদো হয়ে গেল। চোখে জল এসে গেল। আমায় বলল, ‘বল না, এ সব সত্যি?’ আমি বললাম, সত্যি। ও বলল, ‘তুই কী করে জানলি?’ আমি বললাম, ওরা যেখানে এগরোল খেতে খেতে পরিকল্পনা করছিল, আমি সেখানে চাউমিন খাচ্ছিলাম। মেঘা বলল, ‘কী হবে তা হলে?’ আমি বললাম, চিন্তা নেই, বৌ পালালে সবাই তোর বাবাকে বলবে, দীনেশ, তোমার ছোট মেয়ের সঙ্গে বিয়েটা দিয়ে দাও। তোর জামাইবাবু এক কথায় রাজি হবে। তুই যেন তখন না বলিস না!
তমা: এ মা! সত্যি ঘটনা না কি? আপনি এমন ভাবে বলেন যে, মিথ্যেটাও সত্যি আর সত্যিটা ঠাট্টা বলে মনে হয়। তার পর কী হল?
বল্লাল: শুনে মেঘার চিন্তা একটু কমল। তখন রোজ আমার সঙ্গে ফিসফিস করে কথা হত। কলেজের বন্ধুরা বলত, কী এত গোপন কথা বল তো তোদের? আমি বলতাম, প্রেম করছি। বন্ধুরা বলত, তাতে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুরের কী আছে? মেঘা ঝাঁঝিয়ে বলত, বাড়ি থেকে ওর সঙ্গে পালাব তার প্ল্যান করছি, তোদের আপত্তি আছে? আমি বলতাম, মেঘার সঙ্গে পালিয়ে বিয়েটা এমনি বিয়ের থেকে বেশি জমবে, তাই না? ওরা টিপ্পনী কাটত, আমরা বরযাত্রী হব না কনেযাত্রী? আমি বলতাম, ছুটতে পারবি? পালাতে পারবি? তা হলে তোরাও হবি অভিযাত্রী। মেঘা বলত, আগে তো দিদির বিয়েতে এসে উদ্ধার কর!
তমা: মেঘা মেয়েটা ভাল। আপনি জঘন্য। তার পর কী হল বলুন, আমার তর সইছে না।
বল্লাল: এই করতে করতে বিয়ের দিন চলে এল। মেঘা তো জামাইবাবুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। খালি আমায় জিজ্ঞেস করে, তোর খবর পাকা তো? আমি ওর হাত ধরে বলতাম, তোকে ছুঁয়ে বলছি। ওর মুখ আশায় ভরে যেত।
তমা: ও বল্লালবাবু, ঘটনাটা সত্যি তো? ওর দিদি পালাবে তো? না হলে কিন্তু আমি আপনাকে জল্লাদ বলেই ডাকব।
বল্লাল: তার পর কী হল শুনুন না। একটু একটু করে বিয়ের দিনও চলে এল। আমরা কলেজের সব বন্ধুবান্ধব এক সঙ্গে সেজেগুজে গিয়ে হাজির হলাম সেই বিয়ের আসরে। কী সুন্দর সে দিন সেজেছিল মেঘা। আমরা যেতেই ও ছুটে এসে আমায় একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলল, তুই ঠিক বলেছিস, দিদিকে খুব অন্যমনস্ক দেখছি! আমি বললাম, জামাইবাবুকে পছন্দ তো! তখন এক গাল হেসে বলল, না হলে তো তুই আছিস! বিশ্বাস করবেন না তমা, আমার মনটাও তখন নেচে উঠল। সাতপাঁচ ভেবে ভোজটা আগেই সেরে নিলাম। ও মা, সেখানেও আমায় খুঁজে খুঁজে মেঘা এসে বলল, বর এসে গেছে। এ বার পালাবে বল! আমি মাংস চিবোতে চিবোতে বললাম, হুঁ। তুই খেয়ে নিবি? ও লাজুক হাসি হেসে বলল, ইশ! আমি তো উপোস করে আছি!
তমা: আপনি হাড়বজ্জাত ছিলেন। ওই রকম সময়ে আপনি হাড় চিবোচ্ছিলেন কী বলে? আপনার চিন্তা হচ্ছিল না? তার পর বলুন, কী হল? পালাল দিদি? বিয়েতে রাজি হল জামাইবাবু?
বল্লাল: আরে, শুনুনই না। সবাই হইহট্টগোল করছে, কিন্তু দিদি তো আর পালাচ্ছেই না। মেঘার মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে! আমায় এসে বলল, এই, কখন পালাবে? আমি বললাম, পালাবে, পালাবে! পালানোরও লগ্ন হয়। তার পর দিব্যি দিদিকে বিবাহসভায় নিয়ে আসা হল! মেঘা চোখ লাল করে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, কী হবে? দিদি তো পালালই না! ওর তখন চোখে জল। বড় বড় চোখগুলো অশ্রুর ভারে লাল হয়ে আছে। আমি বললাম, ছেলেটা কী ভাবে তোর দিদিকে ঠকাল ভাব তো! ও বলল, কিন্তু দিদি তো হাসছে। আমি বললাম, তুই বলছিলি না, জামাইবাবু খুব ভাল! তা হলে কী শেষ মুহূর্তে তোর দিদি মত বদলাল? সিনেমায় যেমন হয়! মেঘা তখন মুহূর্তের মধ্যে ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, মানে? আমি ওকে শান্ত করার জন্য বললাম, ভাব, তোর দিদি তো সুখী হবে! ও আরও ঝাঁঝিয়ে বলল, আর আমার কী হবে? আমার কথাটা এক বার ভাব!
তমা: আহা রে বেচারা! তার পর?
বল্লাল: তখন আমি সামনে বুক চিতিয়ে বললাম, তোর জন্য আমি তো আছি। চল, আমার সঙ্গে পালাবি চল! যাবি? তা হলে আগে খেয়ে নে, সারা দিন উপোস করে আছিস!
তমা: তার পর? কী হল? সে চলে এল আপনার সঙ্গে? আপনারা বিয়ে করলেন?
বল্লা : তার পর একটা ঠাস করে আওয়াজ হল! আমায় একটা চড় কষিয়ে মুখ ফুলিয়ে চলে গেল সে বিবাহসভায়। তার পর আর কোনও দিন আমার সঙ্গে কথা বলেনি।
তমা: ঠিক করেছে। কী সাঙ্ঘাতিক লোক আপনি! আচ্ছা, সত্যিই কি চাউমিন খেতে গিয়ে আপনি শুনেছিলেন ওদের কথা?
বল্লাল: অত দিনের কথা কি আর মনে আছে? তবে মনে হয়েছিল এ রকম কিছু হলেও হতে পারে, তাই বলেছিলাম।
তমা: আচ্ছা, গরিমার কথাটা কী ভাবে মিলিয়ে দিলেন? এটা কাকতালীয় হতে পারে না।
বল্লাল: সেটা না-হয় পরে বলব, এখন এক বার ঘড়ির দিকে তাকান! এখন ডিনার না সারলে সকালে উঠতে পারবেন না।
উপান্ত
দিন শুরু হয় শুভেচ্ছা জানিয়ে। পরের সকালে সেই ডাইনিং-এ এসে পড়ল দেবভূমির স্বর্গীয় রোদ। সোনালি রোদ পড়ে ঝলসে গেল পঞ্চচুল্লির পঞ্চশৃঙ্গ। পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ডাইনিং-এ এসে দাঁড়িয়ে বল্লাল দেখলেন, এর মধ্যেই স্নান সেরে নিয়েছে তমা। বোতলে জল ভরতে সেও তখন ডাইনিং-এ। বল্লাল বললেন, “সুপ্রভাত! কেমন কাটল রাতটা?”
তমা বলল, “কী বলব বলুন! সারা রাত মাথায় ঘুরেছে বিয়ে, দিদির বিয়ে, দিদি পালাচ্ছে না, জামাইবাবু রাজি হচ্ছে না, কনে তাড়া দিচ্ছে, কী হল, পালা, পালা! ঘুম আর হল কোথায়! কী বিরক্তিকর!”
দ্বিতীয় সন্ধ্যা
সেই সকাল
যে প্রকৃতি রাতের কালিঝুলি মেখে নিশাচরদের সঙ্গে নিয়ে ঘাপটি মেরে মড়ার মতো পড়ে থাকে, সকালের স্পষ্ট ও উজ্জ্বল আলোয় সেই প্রকৃতিই রঙে, ঔজ্জ্বল্যে বিয়ের কনের মতো সেজে ওঠে। প্রকৃতির সন্তান মানুষও কোনও গুপ্ত গহ্বরে তার ক্লেদ, গ্লানি, অপদার্থতা মুছে ফেলে। পরের দিন জলখাবার খাওয়া হতে না হতেই গেস্ট হাউসের প্রাঙ্গণ ভরে গেল তেত্রিশ জন কলেজ পড়ুয়ার রঙিন ও ছটফটে উপস্থিতিতে। ব্যস্ত হয়ে তাদের হাঁকডাক করতে শুরু করলেন জীবেশস্যর। স্নান সেরেছেন। প্যান্টে জামা গুঁজে পরেছেন। পায়ে স্নিকার। কামানো গালে আলো ঠিকরে পড়ছে। কে বলবে, গত সন্ধ্যায় তিনিও সূর্যের মতো অস্ত গিয়ে কোন গোপন গুহায় নিজের দুঃখ, কষ্টের ঝুলি নিয়ে লুকিয়ে ছিলেন! পিঠে ছোট ব্যাগ নিয়ে তমা, গরিমাও বেরিয়ে পড়েছে। আজ তাদের চনমনে লাগছে। গেস্ট হাউসের সামনে ঢালু বাগানে তারা প্রজাপতির ছবি তুলছিল। দূরে তখন স্পষ্ট পঞ্চচুল্লির পঞ্চশৃঙ্গের শুভ্র, সগৌরব উপস্থিতি। ছেলেমেয়েদের যে দলটা সেই অহঙ্কারী অভ্রভেদীর ছবি তুলছিল, তাদের সঙ্গেই মিশে ছিলেন বল্লাল। খানিক ক্ষণ পর তারা বেরোল ছোট একটা ট্রেকিং পথে।
দ্রুততম দিন
রাস্তা মানে পাথরের ওপর এলোমেলো পাথর বসানো রাস্তা। ঘোরা মানে জনবিরল পথে পদচারণা। বাঁ পাশে পাহাড়ের গা। ডান পাশের গভীর খাতে খরস্রোতা রামগঙ্গা। প্রবল তার স্রোত, দাপুটে তার গর্জন। পাহাড়ি গুল্ম, পাহাড়ি লতা তার ঘ্রাণ, তার সবুজ দিয়ে প্রতি বাঁকে সাজিয়ে রেখেছে ক্যালেন্ডারের ছবির মতো এক-একটা ফ্রেম। সবার ব্যাগে জলের বোতল আর নোটবই। তমা দেখল বল্লাল নিজেই এখানে গাইড। তার মানে সে অভিজ্ঞ পরামর্শদাতা, কাগুজে উপদেষ্টা নয়। অথচ হাবভাবে নিজেকে তুচ্ছ করে দেখানোর কী মরিয়া প্রচেষ্টা লোকটার। দিনে তার সঙ্গে সে ভাবে কথা হল না, কথা হল না গরিমার সঙ্গেও। সব ব্যক্তিগত সংলাপ শুষে নিল মহিমাময় দেবভূমি! প্রতি মিনিট, প্রতি সেকেন্ড মাথায় ঘুরে চলা ব্যক্তিচিন্তা, স্বার্থচিন্তা এক বারের জন্যও কাছে ঘেঁষতে পারল না। বুকের ভেতরটা যেন কত বড় বলে মনে হতে লাগল। যে সব পড়ুয়া পড়ার ক্লাসেও টুক করে কথা সেরে নেয়, মৌমাছির মতো সংলাপ চালিয়ে যায় নিরন্তর, তারাও বিমুগ্ধ হয়ে কথা ভুলে গেল। আর এ ভাবেই হুশ করে কেটে গেল দিনটা। পথ চলা রাস্তার একটা জায়গায় পাথরের মতো দাঁড়িয়ে বল্লাল বললেন, “এ বার ফেরা।”
বন্ধুর মতো পড়ুয়ারা দূরের একটা পাথর দেখিয়ে বলল, “ওইটুকু যাই?”
বল্লাল তার চেয়েও পিছনের তুষারশূন্য একটি পর্বতশীর্ষ দেখিয়ে বলল, “ওই পাহাড়ের মাথা থেকে রোদ মুছে গেলেই এখানে ঝপ করে আঁধার নেমে আসবে। এ বার ফিরতে হবে!”
এক জন বলল, “সবে তো দুপুর!”
বল্লাল বললেন, “এখানে বিকেলও হয় না, সন্ধেও হয় না, দুপুরের পরই রাত! তার আগে ফিরতে হবে!”
তখন সকলে ফেরার পথ ধরল। তাদের পিঠের ব্যাগ ভারী হয়ে উঠেছিল সংগৃহীত পাথরের খণ্ডে।
বিদায়ী বিকেল
এত ক্ষণস্থায়ী, এত তমসাচ্ছন্ন বিকেল আগে দেখেনি তমা। সব ছাত্রছাত্রী নিয়ে তারা যখন গেস্ট হাউসে ঢুকল তখনই আঁধার নেমেছে মুন্সিয়ারিতে। অসম্ভব ব্যস্ত ব্যস্ত মুখে ঝড়ের বেগে পোশাক বদলেই হোটেল থেকে চলে গেল গরিমা। দরজায় একবার নক করে জীবেশ তাকে বলে গেল, “খুব পরিশ্রম গেল, এখন দরজা এঁটে ঘুমোব। রাতে খাবার সময় ডাকিস, তার আগে কেউ আমায় জ্বালাবি না।”
তখন ঘরে একা বসে তমার মনে হল নির্জন শৈলশহরে অন্ধকারের মতো একাকিত্বও ঝপ করে নেমে আসে। দেবতাত্মা হিমালয় ভুলিয়ে দেয় যেসব যন্ত্রণা, প্রগাঢ় আঁধার ফিরিয়ে আনে তাদের। ফিরিয়ে আনে তাদের শাখা-প্রশাখা। একতলা থেকে ভেসে আসছে ছেলেমেয়েদের মৃদু সংলাপ।