ছবি: বৈশালী সরকার
সমস্যাটা ঘটল অপ্রতিমের তরফ থেকে। অকারণেই সে ইয়ং বেঙ্গলের লেগ স্পিনারকে এগিয়ে এসে ফেলতে গেল মাঠের বাইরে। মিসটাইমড হিট। সহজ ক্যাচ গেল মিড অফের হাতে।
হঠাৎ খেলায় ফিরল ইয়ং বেঙ্গল। পরের ওভারে গেল আরও দুই উইকেট। রান প্রায় উঠছেই না। নন স্ট্রাইকার এন্ডে দাঁড়িয়ে ডাম্বো যাতায়াত দেখছে বাকি ব্যাটসম্যানদের। ১৮ ওভারের শেষে জাগরণী ১০০ ছুঁল ৯ উইকেটের বিনিময়ে। শেষ ১২ বলে তাদের দরকার ৮ রান। ডাম্বোর সঙ্গে টিমের এগারো নম্বর ব্যাটসম্যান প্রিয়জিৎ, তার ব্যাটিং দক্ষতার উপর সব থেকে বেশি অবিশ্বাস তার নিজেরই, এ রকম স্পিনিং ট্র্যাকে প্রায় ঠকঠক করে কাঁপছে সে। এক বার ব্যাটিং এলে সে কোনও মতে একটা সিঙ্গল নিতে পারছে, প্রতি বলেই গেল গেল রব উঠছে জাগরণীর গ্যালারি থেকে।
ইয়ং বেঙ্গলের গ্যালারি ঠিক এর উল্টো দিকে। সেখানকার দর্শকরা অপেক্ষা করছে একটা মাত্র উইকেটের। তাদের আর তরফদার অ্যান্ড তরফদার মেমোরিয়াল কাপের মধ্যে ওই একটা উইকেটেরই ব্যবধান। প্রিয়জিৎ প্রতিটি বল সামলে দেওয়ামাত্র দীর্ঘশ্বাসের স্রোত বয়ে যাচ্ছে ইয়ং বেঙ্গলের গ্যালারি জুড়ে। তিনটে বল কোনও মতে সামলে চতুর্থ বলে এক রান নিয়ে বাঁচল প্রিয়জিৎ।
ডাম্বো প্রথম বল অনসাইডে পুশ করল, লং অন থেকে ফিল্ডার ছুটে আসার আগেই দু’টি রান সংগ্রহ করে নিয়েছে ডাম্বো। গোটা গ্যালারি উত্তেজনায় ভাষা হারিয়েছে। দুই টিমের দুই গ্যালারি শুধু নয়, উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে ডাগআউটেও।
গ্যালারিতে হাত জোড় করে ভগবানকে ডাকছে মিহিকা, মঞ্জীরা এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে মাঠের দিকে, তার চোখের পলক পড়ছে না। সাত বলে পাঁচ রান দরকার।
শেষ বলে এক রান নিয়ে ডাম্বো পরের ওভার খেলতে চাইবে, খুব স্বাভাবিক। ইয়ং বেঙ্গল তাদের ফিল্ডিং গুটিয়ে আনল। ডাম্বোর অন সাইড ঘিরে মোটামুটি ভাবে সাত জন ফিল্ডারের একটা দুর্ভেদ্য দুর্গ বানিয়ে ফেলল ইয়ং বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন।
প্রায় সবাই ডাম্বোর ব্যাটের কাছাকাছি। ডাম্বোর কাছে সে মুহূর্তে অপশন মাত্র দুটো: চুপচাপ এই বল ঠুকে দিয়ে মাথা নিচু করে পরের ওভারে
পুরোটা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া, আর না হলে এই জঘন্য পিচ উপেক্ষা করে ইনফিল্ড টপকে উঁচু শটের রিস্ক নেওয়া।
সেই মুহূর্তে মাঠে দুটো নতুন ঘটনা ঘটল। অসহ্য টেনশন সহ্য করতে না পেরে মঞ্চ থেকে নেমে বাউন্ডারি লাইনের বাইরে পায়চারি শুরু করল অভিরাজ, আর স্টেডিয়ামের এনট্রান্স দিয়ে পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে বছর তিরিশের একটা অবয়ব কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্টেডিয়ামের ভিতর ঢুকে এল। এসেই থমকে দাঁড়িয়েছে, তার চোখ চলে গেছে স্কোর বোর্ডে, জয়ের জন্য সাত বলে পাঁচ রান দরকার জাগরণীর, হাতে মাত্র একটি উইকেট।
ডাম্বো এ সবের কিছুই জানেনি। ইয়ং বেঙ্গলের ফিল্ড প্লেসমেন্ট-এর গোটা সময়টা ডাম্বো স্কোয়ার লেগের কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। তার পর এসে স্টান্স নিল সে। আম্পায়ারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মিডল স্টাম্প থেকে সরে এসে লেগ স্টাম্পে গার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছে।
মিডিয়াম পেসার বল হাতে ছুট শুরু করল, ডাম্বো বুঝল এই মুহূর্তে পৃথিবীর সমস্ত রূপ-রস-গন্ধ মুছে গেল তার সামনে থেকে। তার পৃথিবী ছোট হতে হতে শুধুমাত্র বোলারের হাতের লাল রঙের পৃথিবীতে এসে মিশে গিয়েছে।
ডাম্বো সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলল।
বোলার বল ডেলিভারি করার ঠিক আগের মুহূর্তে ডাম্বো স্টান্স পাল্টাল। শুধু তা-ই নয়, ব্যাটের গ্রিপও মুহূর্তে পালটে নিয়েছে সে। বল যত ক্ষণে ডাম্বোর নাগালে এল, তত ক্ষণে সে হয়ে উঠেছে বাঁহাতি ব্যাটসম্যান, ডাম্বো হাতের তীব্র মোচড়ে হাওয়ায় তুলে দিল বলটাকে, তার অফসাইডের দিকে, যে দিকটা আগে থেকেই পরিকল্পিত ভাবে অরক্ষিত রেখেছিল ইয়ং বেঙ্গল।
মঞ্চে বসা এক ক্রিকেটার অস্ফুটে বললেন, “সুইচ হিট! এক্সেলেন্ট!”
এগারো বছরের ছেলের কব্জিতে এই জোর নিখুঁত টাইমিং ছাড়া আসে না।
বলটা যখন প্রায় মাঠের পাশের ওয়াটার ট্যাঙ্কের মাথা ছুঁই-ছুঁই, ঠিক সেই সময় নাগাদ লং অন থেকে দৌড় শুরু করল লম্বা শরীরটা। আবেশ আগরওয়াল। ব্যাটে কিছু রান করেছে সে, বল হাতে তুলে নিয়েছে চার-চারটে উইকেট। কিছু কিছু দিন থাকে যে দিন মানুষ যা করে তাতেই সোনা ফলে। আজ আবেশের সেই দিন। আজ সে হেরে যেতে পারে না। বল আকাশ থেকে নেমে আসার আগেই মাঠের দড়ির সীমান্ত বরাবর প্রায় পঁয়ত্রিশ গজ ছুটল সে, আর তার পর নেমে আসা বল লক্ষ্য করে হাত বাড়িয়ে জীবনের সেরা হাই জাম্পটা দিল আবেশ।
ক্যাচটা তালুবন্দি হওয়া মাত্র গ্যালারির একাংশ উল্লাসে ফেটে পড়ল। এত দিনের উৎসাহ আবেগ আর তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার দোলাচল এই মুহূর্তে শেষ হল। এ বার থেকে বাকি বছর এক ক্লাব ছড়ি ঘোরাবে অন্যের ওপর। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই ক্লাবের ম্যাচের ক্লাইম্যাক্স এর থেকে বেশি উত্তেজনাপূর্ণ হওয়া
সম্ভব ছিল না।
মাটিতে পড়ে থাকা হতাশ আবেশ দেখল, তার নাগাল পেরিয়ে সীমানা ছাড়িয়েছে বলটা, আর সেই বল সীমান্ত থেকে দু’-তিন গজ বাইরে দাঁড়ানো অভিরাজ সেনের বিশ্বস্ত পাঞ্জায় ক্যাচ হয়ে জমা পড়েছে। ভাগ্য আজ শেষ বারের জন্য অধরাই রয়ে গেল আবেশের।
অভিরাজ ক্যাচ ধরা মাত্র গ্যালারিতে দু’জন নারী যেন উচ্ছ্বাসে যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছে, পাগলের মতো লাফাচ্ছে, জড়িয়ে ধরছে পরস্পরকে! অপেক্ষাকৃত কমবয়সি মেয়েটি তো ঠোঁটে হাত দিয়ে হুইসলও বাজিয়ে ফেলল এক বার।
অভিরাজের কেন যেন মনে হল, তাদের উচ্ছ্বাসের এই স্থিরচিত্র সহজে তার স্মৃতি থেকে মুছে যাবে না।
সতীর্থদের আলিঙ্গন পেরিয়ে ডাম্বো ছুটল টুটুল স্যরের দিকে। গ্যালারিতে আনন্দে ভেসে যেতে যেতে মঞ্জীরা ভাবছিল কখন ছেলেকে কাছে পাবে!
এই ডাম্বো তার অচেনা। মা মাথায় হাত না বুলিয়ে দিলে যে ছেলে ঘুমোতে পারে না, স্কুলে যাওয়া নিয়ে যে ছেলে রোজ মায়ের সঙ্গে কুস্তি করে, যে ছেলে ক্লাস টেস্টে কম নাম্বার পেলে মঞ্জীরার বকুনির ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকে, সেই ছেলে আজ একা হাতে কী অদ্ভুত দায়িত্ববান মানুষের মতো একটা টিমকে জয়ের পথে নিয়ে গেল!
খেলা তো শুধু খেলা নয়, ক্রিকেটও তো জীবনবোধ শিখিয়ে যায়, বল ছুড়ে দেওয়া আর ব্যাট হাঁকানোর আড়ালেও কতটা পরিশ্রম, শৃঙ্খলাবোধ লুকিয়ে থাকে, কত পরিকল্পনার বাস্তব রূপায়ণ হয় সবুজে সবুজে, সেই পথ চলা ডাম্বোর শুরু হয়ে গেল। মানুষ হয়ে ওঠার পথ। যে শিক্ষা স্কুল-কলেজের চার দেয়াল অনেক ক্ষেত্রেই দিতে ব্যর্থ হয়।
আবেগে কাঁপতে কাঁপতেই মঞ্জীরা আবিষ্কার করল ডাম্বো এক যুবকের কোলে লাফিয়ে উঠে তার গলা জড়িয়ে ধরল, যুবকটিও আশ্চর্য কায়দায় ডাম্বোর শরীরটা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে তাকে।
গ্যালারি থেকে মাঠের দূরত্ব খুব বেশি নয়, তবু অবিশ্বাসী চোখ সইয়ে নিতে একটু সময় লাগল মঞ্জীরার। খুব পরিচিত মানুষকেও অপরিচিত পরিবেশে দেখলে সহসা চিনে ওঠা যায় না।
মঞ্জীরা পাথর হয়ে গেল।
দুপুরের দুঃসহ তাপ কমে এসেছে অনেক ক্ষণ হল। বিকেল ফুরনোর আগেই ফুরফুরে একটা হাওয়া বইছে। নেমে আসা ধূসর আঁধারে মাঠময় দোল খাচ্ছে সেই উদাস বাতাস। তারায় তারায় আকাশ ভরে গেছে কখন যেন।
উত্তীয় অপলক মঞ্জীরার চোখের সামনে দু’হাত নাড়াল, “হ্যালো, ম্যাডাম। এ ভাবে তাকিয়ে থাকবেন না। নাহয় অনেক দিন পরেই দেখা হয়েছে, তা বলে এতটা আকুলতা!”
মঞ্জীরা তবুও চোখ সরিয়ে নিতে পারল না। তার বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই চাইছে না। এই দীর্ঘ চার-পাঁচ মাসে বহু বার নিরালায় সে এই দেখা হওয়ার মুহূর্তটার কল্পনা করেছে। একটানা দু’-তিন দিন যার অদর্শন তাকে আনমনা করে দেয়, তাকে ছেড়ে এতগুলো মাস কাটানোর মধ্যে শুধু কষ্ট নেই, আছে অভিমানও। দমচাপা, নীরব অথচ বলিষ্ঠ অভিমান।
এক বারের জন্যও তার ফোন ধরেনি উত্তীয়। এতগুলো বছরের সান্নিধ্য কিছু নয়, যে বন্ধুত্বের বাঁধন, তার প্রগাঢ়তাও কিছু নয়। শুধু ওই কফি শপে বলা সে দিনের কথাগুলোই সব!
সে ভেবে রেখেছিল উত্তীয়কে বেশ কিছু কড়া কথা শোনাবে। কিন্তু মিহিকার মুখে উত্তীয়র সব কথা শুনে কাফে ওপেনিং-এর দিনই ভিতরে ভিতরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল মঞ্জীরা। আর আজ ডাম্বোকে কাঁধে নিয়ে উত্তীয়কে মাঠে ঢুকতে দেখে তার বিস্ময়ের সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে।
উত্তীয় অবশ্য গোপন করেনি কিছু, প্রায় হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়েছে এত দিন তাকে অন্ধকারে রাখার জন্য।
মঞ্জিরা এ বার চোখ সরিয়ে নিল, কোনও রকমে অস্ফুটে বলল, “কেন?”
উত্তীয় ভেবেছিল উত্তর দেবে না, তবু সে শুনতে পেল সে বলছে, “সব কথার উত্তর কি এত সরাসরি দেওয়া যায়? তবে একটা ব্যাপার কিন্তু পরিষ্কার, তোমার যে সেট-আপটায় আমি বেমানান ছিলাম, তার বাকি মেম্বাররা কিন্তু ইদানীং আমার সঙ্গে খুব ফ্রেন্ডলি। অ্যাম আই নট গুড এনাফ টু হ্যান্ডেল
দেম, ম্যাডাম?”
উত্তীয় মঞ্জীরার চোখে গভীর ভাবে তাকাল, “আমার মতো এক সামান্য মানুষকে কি আপনার সঙ্গে জীবন কাটানোর পাসওয়ার্ডটা দেওয়া যায়? “
মঞ্জীরা বিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে, তার মুখে কথা জোগাচ্ছে না। একে নিয়ে সে কী করবে?
অদূরে ডাম্বোদের উৎসব থামার নাম নেই। ম্যাচ শেষ হয়েছে দু’ঘণ্টা হল। ইয়ং বেঙ্গল টিম, ম্যানেজমেন্ট আর সাপোর্টাররা মাঠ ছেড়েছে অনেক ক্ষণ। স্টেডিয়ামের লাগোয়া লাউঞ্জটা আজ সন্ধের জন্য ভাড়া নিয়েছে জাগরণী। কিছুটা বিজয় উৎসব টাইপের ব্যাপার।
সফট ড্রিংক্স আর স্ন্যাক্সের অঢেল আয়োজন হয়ে গেছে অচিরেই। প্লেয়ার, কর্মকর্তা, কোচ, প্লেয়ারদের রিলেটিভ, সব মিলিয়ে স্টেডিয়ামের ছোট্ট লাউঞ্জ জমজমাট। ট্রোফি ঘিরে লম্বা ফোটোসেশন সম্ভবত জাগরণী প্লেয়ারদের আজ আর শেষ হওয়ার নয়।
সেখান থেকে ডেকে ডাম্বোকে একটু আলাদা করে আনল মিহিকা, হাতের ইশারায় দেখিয়েছে মঞ্জীরা আর উত্তীয়কে, “কী দেখছিস, ডাম্বো?”
ডাম্বো অবাক গলায় বলল, “মা টুটুল স্যরের সঙ্গে কী এত কথা বলছে? খেলা-টেলা বন্ধ করে দেবে, না কি?”
মিহিকা মিষ্টি করে হাসল, “তুই সত্যিই একটা ডাম্বো। এ দিকে আয়, একটা কথা বলব।”
মঞ্জীরার মুখে তখনও কথা ফোটেনি। উত্তীয় তার দিকে তাকিয়ে আছে, তার মুখে দুষ্টুমির হাসি।
ক্লাব হাউসটাকে আলোর মালায় সাজানো হয়েছে, হয়তো রোজই এমন থাকে, আজ জাগরণীর জয়ের দিন বলেই কি এই আলো আরও বেশি উজ্জ্বল মনে হচ্ছে? সেই আলোয় মঞ্জীরার এই মুহূর্তে উত্তীয়কে পৃথিবীর সেরা পুরুষ মনে হচ্ছে। জীবন তাকে আশ্চর্য পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। জীবনের আঘাতে তার মনের জমি গ্র্যানাইট-কঠিন, তবুও এমন ভালবাসার সামনে কেন আমূল কেঁপে যাচ্ছে সে! কেন মনে হচ্ছে, এই মানুষটাকে ছেড়ে বাকি জীবন কাটানোর কোনও অর্থই নেই!
উত্তীয় কায়দা করে কাঁধ ঝাকাল, স্বভাবসুলভ নাটকীয় ঢঙে বলল, “কোনও চাপ নেই মঞ্জীরা। টেক ইয়োর সুইট টাইম। আমি অপেক্ষা করব, তবে হ্যাঁ, নিজেকে অপরিহার্য ভেবো না। এখন তুমি ছাড়াও আমার আরও দু’জন বেস্ট ফ্রেন্ডস আছে। তবে
তুমি চাইলে...”
উত্তীয়র কথা ফুরোল না, বিকট শব্দে মঞ্জীরার মোবাইল বেজে উঠল। এটা ডাম্বোর কীর্তি। মায়ের অজান্তেই মঞ্জীরার ফোনে অসহ্য সব রিংটোন সেট করে দিয়ে মজা দেখে সে। স্ক্রিনে চোখ পড়তেই মঞ্জীরার মুখ গম্ভীর, তবুও গলার স্বরে যথেষ্ট হৃদ্যতা মিশিয়ে মঞ্জীরা বলল, “হ্যালো।”
ও পারের কথা শুনতে পাচ্ছে না উত্তীয়। তবে সে দেখতে পাচ্ছে, মঞ্জীরার মুখের হাসি-হাসি ভাবটা আর নেই। উত্তীয় বুঝতে পারছে, মঞ্জীরার গভীর কালো চোখের তারায় ডুবে চার পাশের হাজার ওয়াটের আলো পলকে ঝপ করে নিভে গেল। মঞ্জীরা কোনও কথা বলছে না, নীরবে কানে ফোন ধরে আছে। চোখের পলক পড়ছে না তার। তাকে দেখাচ্ছে প্রাণহীন প্রস্তরপ্রতিমার মতো।
১১
সময় থামে না। কোনও দিন থামেনি। সময় আসলে থামতেই শেখেনি। কারও জন্য নয়। কোনও কারণেই নয়। সে কখনও বিদ্যুৎবেগে কেটে যায়, কখনও
শ্লথ গতিতে চোখের সামনে দিয়ে বেদনা বয়ে পেরোতে থাকে প্রহরের পর প্রহর। সময় মাপার প্রয়োজনও সম্ভবত পড়ত না মানুষের। যার কোনও সৃষ্টি, স্থিতি, লয়, আদি, অন্ত নেই, তাকে নিয়ে কেন অকারণ এত মাথাব্যথা!
মঞ্জীরার মনে হয়, শুধুমাত্র মানুষের পরিবর্তন আর তার পাল্টে যাওয়া পারিপার্শ্বিক বুঝে নিতেই মানুষ সময় মাপতে শিখেছিল। কী ভাবে খোলস ছাড়ায় মানুষ, কী করে একটু একটু করে দীর্ঘ সময়ের অবকাশে ধীর, নিশ্চিত ভাবে হয়ে ওঠে অন্য কেউ... তাকে কোনও একটা ফ্রেমে ধরে রাখার জন্যই সময়কে বন্দি করতে চেয়েছে সে।
ডাম্বোর ফাইনাল ম্যাচের পর কতটাই বা সময় কেটেছে? ঘড়ি বা ক্যালেন্ডারের হিসেবে হয়তো মাত্র দিন পনেরো, কিন্তু এরই মধ্যে মানুষ মঞ্জীরা যে ভিতরে ভিতরে কতখানি পাল্টে গেছে, তা কি কেউ বাইরে থেকে দেখে বলতে পারবে? এক দুঃখিনী নারীর জীবনে চলার পথের ছোট ছোট পরিবর্তন পরিমাপ করে কোন যন্ত্রগণক?
এই সূক্ষ্ম সময়ের ব্যবধানে পরিবর্তনের গল্প লেখা থাকে না কোথাও। হয়তো মঞ্জীরা নিজেই বুঝবে এক দিন। বহু, বহু বছর পরে পিছন ফিরে তাকালে সে বুঝবে, এই পনেরো দিনেই মঞ্জীরা হয়ে উঠেছিল অন্য এক মঞ্জীরা।