ছবি: বৈশালী সরকার।
গৌরগোপাল এ বার সরাসরি উত্তীয়র দিকে তাকালেন, “গত চার মাস ধরে তোমার ভাইটাল পিরিয়ড চলছে উত্তীয়। সকাল থেকে আত্মীয়ার বিজ়নেস সেট আপের নামে ফুলুক ফালুক বেরিয়ে গেছ। একটি বারের জন্যও বাধা দিয়েছি? ইয়েস অর নো?”
“নো, স্যর।”
“বেশ। তার পর, বিকেলের দিকে সপ্তাহে তিন দিন করে লেজার গোটানোর আগেই ব্যাগ কাঁধে ছুট লাগালে অজ্ঞাত কারণে। আমি নিজে কাউন্টারে বসে ক্যাশ সামলেছি মাঝে মাঝে তা তুমি জানো? আমি কোনও দিন জানতে চেয়েছি কোথায় যাচ্ছ? ইয়েস অর নো?”
“নো স্যর,” উত্তীয়র ঘাড় ঝুলে গেছে আবার।
“বেশ বেশ। আর আজ এমন একটা জরুরি ইনস্পেকশনের দিন যদি আমি চাই তুমি শেষ পর্যন্ত থাকো, তবে কি খুব অন্যায় কিছু চাওয়া হচ্ছে? আচ্ছা, তুমি কোনও দিন শুনেছ, ব্যাঙ্কে আচমকা ডিরেক্টরেট অব এনফোর্সমেন্ট-এর ইনস্পেকশন টিম এসে হাজির আর সার্ভিস ম্যানেজার হাওয়া?”
উত্তীয় চুপ করে রইল। গৌরগোপালের একটা কথাও মিথ্যে নয়। তার চার পাশটা অসহ্য লাগছে। ইনস্পেকশন টিমটাকেও আজই আসতে হল?
গৌরগোপাল মোবাইলে ডুবে গেলেন, “এটা তোমারও ব্রাঞ্চ উত্তীয়। এত কথা বলার পরও যদি তোমার মনে হয় তুমি এখনই বেরিয়ে যাবে, তুমি যেতে পারো।”
এর পর আর কথা বাড়ানোর মানে হয় না। উত্তীয় ম্যানেজারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল। শনিবারের বেলা, অফিস আওয়ার শেষ, কাস্টমার নেই লবিতে। কিন্তু কাউন্টার জুড়ে বিপুল কর্মযজ্ঞ। রীতিমতো ছুটোছুটি করছে ইনস্পেকশন টিমের ছেলেগুলো।
এই ছুটোছুটি অবান্তর নয়। মস্ত চিট ফান্ড সংস্থার এক চাঁইয়ের বেনামি অ্যাকাউন্ট পাওয়া গেছে উত্তীয়দের ব্যাঙ্কে। সরকারি উপরমহলে পর্যন্ত শোরগোল পড়ে গেছে। ইডি ছুটে এসেছে উত্তীয়দের ব্রাঞ্চে। এই পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা আগে হয়নি উত্তীয়র। সে জানে না এটা কত ক্ষণের ধাক্কা আর কোথাকার জল কত দূর গড়াতে পারে।
উত্তীয় হেড ইনস্পেক্টরের কাছে গেল। মাস্টার কম্পিউটারের সামনে ল্যাপটপ খুলে বসে আছেন প্রৌঢ় ভদ্রলোক।
উত্তীয় অধৈর্য গলায় বলল, “আপনাদের আর কত ক্ষণ লাগবে আইডিয়া দিতে পারেন?”
ভদ্রলোক চশমার ওপর দিয়ে উত্তীয়র দিকে তাকালেন, অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে বললেন,
“এ সব ইনস্পেকশনের আবার টাইম হয় না কি! সব ঠিকঠাক চললে ঘণ্টা দুই আর এক বার যদি লেজার বেগড়বাই শুরু করে তো ধরে নিন ডিনার আপনাদের সঙ্গে বসেই করব, সিম্পল।”
ভদ্রলোক কাজে ডুবে গেলেন।
উত্তীয় কাউন্টার ছেড়ে বেরিয়ে ব্যাঙ্কের বড় কাচের জানলার সামনে এসে দাঁড়াল। কাচের ও পারে শহর বয়ে যাচ্ছে নিরালা নদীর মতো, সারা দেহ জুড়ে তার সপ্তাহান্তের আলস্য।
উত্তীয় অসহায়ের মতো ঘড়ি দেখল, দুটো দশ।
আর ঠিক কুড়ি মিনিট পরে আম্পায়ারের সঙ্গে টস করতে নামবে দুই খুদে ক্রিকেটার। জাগরণী সঙ্ঘ আর ইয়ং বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন।
শুরু হয়ে যাবে তরফদার অ্যান্ড তরফদার মেমোরিয়াল কাপ।
“আরে, স্যর! আসুন, আসুন। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছে সবাই...”
অভিরাজকে গাড়ি থেকে নামতে দেখেই রাঘব ছুটে এসেছে।
বিবেকানন্দ স্পোর্টিং কমপ্লেক্সটা খুব বেশি দিন গড়ে ওঠেনি, তবু এরই মধ্যে ক্রীড়া মহলে নাম করেছে। এর আগে দক্ষিণ কলকাতায় এ রকম আধুনিক মাঠ আগে দেখা যায়নি। সবুজ গালিচা পাতা মাঠ, মাঠের মাঝখানের বাইশ গজে এত দূর থেকেও ঘাসের আভা দেখতে পাচ্ছে অভিরাজ। সেই পিচে চার জন লোক ভারী রোলার চালাচ্ছে এখনও। বাউন্ডারি দড়ি ফেলে ছোট করে দেওয়া হয়েছে, আন্ডার ফোর্টিন ম্যাচের সাইজ়ে আনা হয়েছে প্রকাণ্ড মাঠটাকে।
কিন্তু গ্যালারি তো এগিয়ে আনা যায় না, গ্যালারি আছে স্বস্থানেই। আর সেই গ্যালারি আজ কানায় কানায় পূর্ণ। অভিরাজের ভাল লাগল। আজ বেশ গরম। গত কয়েক দিন বৃষ্টি হলেও কাল থেকে ঠা ঠা রোদ, সেই রোদে পিচ শুকিয়ে উঠেছে। এর মধ্যেও এত লোক ম্যাচ দেখতে এসেছে! একটু পরেই টস হবে।
অভিরাজ দেখল মাঠের শেষ প্রান্তে বিরাট মঞ্চ। কয়েক জন বিখ্যাত খেলোয়াড়ের আসার কথা। সেই মঞ্চে অভিরাজের জন্যও একটা আসন রাখা আছে। অভিরাজ রাঘবকে এক রকম উপেক্ষা করেই মাঠের বাউন্ডারি লাইন বরাবর হাঁটতে লাগল।
এই গ্যালারি থেকে ভেসে আসা দর্শকদের শোরগোলের শব্দ, এই রোদ বিছানো মাঠ, এই ঘাসের গন্ধ, এ সবই অভিরাজের খুবই প্রিয়। নিজের জীবনের একটা বড় অংশ মাঠে ময়দানেই কেটেছে তার। আজ এখানে দাঁড়িয়ে মনটা ভাল লাগছে না অভিরাজের। ক্রিকেট সার্কিটে তার সেরা বন্ধু ছিল উত্তীয়। অথচ কতটুকু পথই বা এক সঙ্গে চলতে পেরেছিল দু’জনে! কেন যে ছেলেটা খেলাটাকে সিরিয়াসলি নিল না!
জীবনও আশ্চর্য সব খেলা দেখায়। প্রতিটি পদক্ষেপ এক সঙ্গে করা হয়ে ওঠে না প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে। এক জন পিছনে পড়ে থাকে, আর এক জন এগিয়ে যায়। এক সঙ্গে শান্তিনিকেতন থেকে ফেরাটাও কি কম আশ্চর্যের? অভিরাজ নিজেই ড্রাইভ করছিল, পাশের সিটে উত্তীয়। ট্রাকটা যখন তাদের ধাক্কা মেরেছিল, এক মুহূর্তে সব অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল অভিরাজের। জ্ঞান ফিরেছিল অনেক পরে। প্রায় তিরিশ ঘণ্টা। অথচ মামুলি কিছু প্রাথমিক চিকিৎসার পরেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল উত্তীয়কে। অভিরাজের মাথাটা সেই অপঘাতে পুরোপুরি ঘেঁটে গেলেও উত্তীয়র কোনও ক্ষতি না হওয়ায় অভিরাজ নিজে খুব খুশি হয়েছিল। উত্তীয় সে দিন বার বার বারণ করছিল একশো কিলোমিটারের ওপর স্পিড না পেরোতে, শোনেনি অভিরাজ। এইটাই মজা জীবনের। এক যাত্রা বরাবরই দুই বন্ধুর জীবনে পৃথক ফল নিয়ে এসেছে।
জুঁই এসেছে অভিরাজের জীবনে, দিব্যি সাজানো গোছানো সুখী জীবন। আর উত্তীয় এই সে দিনও ময়দানে বসে প্রেমিকার বিরহে আকাশ দেখছিল। সে দিনই অভিরাজ ভেবেছিল, এ ভাবে যেতে দেওয়া যায় না। সারা রাত উত্তীয়কে নিয়ে পড়ে ছিল সে। একে একে স্ট্র্যাটেজি বার করেছিল দলজিৎ সিংহ ট্রোফি জয়ী বেঙ্গল ক্যাপ্টেন।
এই ব্যাপারটায় অভিরাজ নিজেকেও অবাক হয়েছিল। এই ঘেঁটে যাওয়া মাথা নিয়েই নিপুণ ফিল্ড প্লেসিং, ওভার টু ওভার বোলার চেঞ্জ, ব্যাটিং অর্ডার ঠিক করার মতো সেই রাতে উত্তীয়কে আইডিয়ার পর আইডিয়া দিয়ে গেছিল সে। উত্তীয় প্রথমে ঘাবড়ে গেছিল, একটু ধাতস্থ হলে শেষতক নিজেকেও প্ল্যানের অংশ করে নিয়েছিল সে।
অভিরাজ পোক্ত স্ট্র্যাটেজিস্টের মতো বলেছিল, “রিচ আউট মিহিকা, রিচ আউট ডাম্বো। এদের লাইফে ইম্পর্ট্যান্ট হয়ে যা। জাস্ট রিমেমবার, তোকে রিজেক্ট করার মঞ্জীরার কোনও কারণ নেই। ও যদি বুঝত তুই একটা শক্তপোক্ত আশ্রয়, তবে ও তোকে ফিরিয়ে দিত না। সেই ফিলিংসটা ওকে দিতে হবে বস। এত সহজ নয়। কথাটা সে দিন মঞ্জীরা ভুল বলেনি। তুই একটা বাইশ বছরের দায়হীন মেয়েকে বিয়ে করছিস না, যাকে করছিস তার দুটো বড় অবলিগেশন, আই মিন অ্যাটাচমেন্ট আছে উত্তীয়। তুই একটা সেটআপ-এ ঢুকবি, মিহিকা আর ডাম্বো সেই সেটআপ-এর পার্ট। বি আ গেম। লড়ে যা।”
ঘণ্টাখানেক পর দুই বন্ধুর আলাপচারিতা শেষ হলে হঠাৎই চুপচাপ ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল অভিরাজ, তখন ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। বন্ধুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল উত্তীয়, “কী হল? স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে নিজেই চুপচাপ হয়ে গেলি?”
একটু চুপ করে থেকে অন্যমনস্ক স্বরে অভিরাজ বলেছিল, “একটা কথা ভাবছিলাম। তোর এটা মাথায় আসেনি কখনও?”
উত্তীয় প্রশ্নভরা চোখে তাকিয়েছিল অভিরাজের দিকে। অভিরাজ ব্যালকনির রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থেমে থেমে বলেছিল, “মঞ্জীরার হাজ়ব্যান্ড ডিভোর্স চাইলেও মঞ্জীরা দিচ্ছে না। এর কারণ কী হতে পারে উত্তীয়?”
উত্তীয় কাঁধ ঝাঁকিয়েছিল, “সে ভাবে ক্লিয়ারলি কথা হয়নি কখনও, তবে ইট’স অবভিয়াস, না? ডিভোর্স দেওয়ামাত্রই তো লোকটা অন্য মেয়েকে বিয়ে করবে।”
অভিরাজ মাথা নেড়েছিল, “আই হোপ যেন সেটাই সত্যি হয়।”
এই কথা বলে চুপ করে গিয়েছিল অভিরাজ।
উত্তীয় একটু পরে বলেছিল, “কেন? তুই
কী ভাবছিস?”
অভিরাজ বলল, “বাদ দে, সবে ইনিংস শুরু করবি ভাবছিস, এখন তোকে ডিমোটিভেট করতে চাই না।”
উত্তীয় তর্কের সুরে বলেছিল, “আমি অত সহজে ডিমোটিভেটেড হই না। বল কী ভাবছিস।”
সময় নিয়েছিল অভিরাজ। তার পর উত্তীয়র দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে বলেছিল, “ইজ় শি স্টিল ইন লাভ উইথ দ্যাট ম্যান?”
অভিরাজ ভাবল রোদে আর হাঁটাহাঁটি করবে না। আজকাল অল্পেই হাঁপ ধরে। পুরো খেলাটা দেখতেও তো হবে। মিহিকার কেস খারাপ সামলায়নি উত্তীয়, মঞ্জীরার প্রতিক্রিয়া অবশ্য জানা হয়নি। মঞ্জীরা আর উত্তীয়র শেষ দেখা হওয়ার পর থেকে মাঝে মাঝে মঞ্জীরা ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল, উত্তীয় ফোন তোলেনি। কিন্তু মিহিকার কাফে ওপেনিং-এর পর থেকে এক বারও ফোন করেনি মঞ্জীরা। উত্তীয় আশা করেছিল মঞ্জীরা ফোন করবে, কিন্তু করেনি।
চুপচাপ হয়ে গেছে উত্তীয় নিজেও।
অভিরাজ বুঝল তার শরীর ভাল লাগছে না, গত সপ্তাহে বার দুয়েক রাতের দিকে প্রেশারটা ফল করেছিল, তার পর থেকেই অন্য বারের মতো তরতাজা ভাবটা আর নেই, এত ক্ষণ রোদ্দুরে ঘোরাটা কি ঠিক হল? অভিরাজ বুঝতে পারল তার চিন্তাসূত্র বা দৃশ্যায়ন ক্ষমতা ধারাবাহিকতা হারাচ্ছে, চার পাশ ভরে যাচ্ছে অজস্র স্থিরচিত্রে।
সেই মুহূর্তে দু’টি স্থিরচিত্র তার মনে গেঁথে গেল, দর্শক কোলাহলে অভিরাজ দেখল, আম্পায়ারদের পাশে হেঁটে টস করতে মাঠের মাঝখানে যাচ্ছে দুই খুদে ক্যাপ্টেন। সে আরও দেখল জাগরণী সঙ্ঘের ডাগ আউটে বসে ছটফট করছে দর্পণ গাঙ্গুলি, বার বার তার চোখ চলে যাচ্ছে স্টেডিয়ামের এনট্রান্স গেটের দিকে।
দুটো স্থিরচিত্রই অভিরাজের চোখে লেগে রইল। সে সাজানো গোছানো মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল।
জাগরণী সঙ্ঘ টসে হেরে গেল।
টস জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নামল ইয়ং বেঙ্গল। আপাতভাবে দু’দিনের রোদ খাওয়া পাটা পিচ, প্রচুর রান আছে বাইশ গজে। প্রথমে ব্যাটিং করে রানের পাহাড় বানাও, সেই রানের চাপ পড়বে অন্য দলের উপর, তার ওপর যোগ হবে ফাইনাল ইনিংসের মানসিক চাপ। টসে জিতলে জাগরণীও ব্যাটিং নিত। কিন্তু খেলা দু’ওভার গড়াতে না গড়াতে বোঝা গেল টসে হেরে যাওয়াটা শাপে বর হয়েছে।
স্পোর্টিং কমপ্লেক্সের পিচ প্রথম বল থেকেই খামখেয়ালি আচরণ করছে। ম্যাচের তৃতীয় বল আচমকা লাফিয়ে উঠে ইয়ং বেঙ্গলের ওপেনারের হেলমেট কাঁপিয়ে দিল, সেই ওভারেরই শেষ বলে ইয়ং বেঙ্গলের সেরা ব্যাট, ওপেনার কিংশুক দাস হঠাৎ নিচু হয়ে যাওয়া ডেলিভারি সামলাতে না পেরে ক্লিন বোল্ড। পরের ওভারে ফিরে গেল
দ্বিতীয় ওপেনারও।
প্রথম চার ওভার শেষে ইয়ং বেঙ্গলের দুই ওপেনার ডাগ আউটে, রান মাত্র বারো।
কুড়ি ওভারের ইনিংস, প্রাথমিক ভরবেগ পেয়ে যাওয়া জাগরণী পাওয়ার প্লে শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল না। অফস্পিনার আর লেগস্পিনার জুটি শুভায়ন আর প্রাঞ্জলকে দুই প্রান্ত থেকে নিয়ে এল জাগরণীর ক্যাপ্টেন।
ফল হল মিশ্র। আর একটা উইকেট তুলে নিল প্রাঞ্জল, দুই ব্যাটসম্যান মরিয়া চেষ্টা করছে, তবু রানের গতি বাড়ছে না। কিন্তু তত ক্ষণে সতর্ক হয়েছে ইয়ং বেঙ্গল, তারা বুঝেছে এই পিচে দেড়শো রানের টার্গেট সেট করতে গেলে পঞ্চাশ-ষাটও পেরোবে না স্কোর। প্রথম দশ ওভারে ৪১ রানে তিন উইকেট হারানো অবস্থায় ইয়ং বেঙ্গলের ব্যাটসম্যানরা হঠাৎ ডিফেন্সিভ মোডে চলে গেল। খুচরো রানের ওপর চলছে স্কোরবোর্ড। উইকেট হাতে থাক, শেষ চার ওভারে দেখা যাবে।
ইয়ং বেঙ্গলের গেমপ্ল্যান কাজ করল। পনেরো ওভার পর্যন্ত আর একটিমাত্র উইকেট হারাল তারা। শেষ পাঁচ ওভারে পাঁচ উইকেট হাতে ওপেন অ্যাটাকে যাওয়ার পরিকল্পনা অনুযায়ী ঝাঁপিয়ে পড়ল ইয়ং বেঙ্গল। খুব লাভ হল না, তবে শেষ ওভারে তাদের দশ নম্বর ব্যাটসম্যান তিন তিনটে বাউন্ডারি মেরে বসল, না হলে ইয়ং বেঙ্গল একশো পেরোত না।
ইনিংসের শেষে বিবেকানন্দ স্পোর্টিং কমপ্লেক্সের ম্যানুয়াল স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছিল, ইয়ং বেঙ্গল: ১০৭/৮। ২০ ওভার।
জাগরণীর ইনিংস শুরু হওয়ার আগে পুলিন স্যর টিমের ব্যাটসম্যানদের নিয়ে বসলেন, খুব সাবধানী স্ট্র্যাটেজি, “লিসন বয়েজ়, এটা একদম লো স্কোরিং গেম। কিউরেটর বারোটা বাজিয়ে রেখেছে পিচের। পাকামি করতে গেলেই উইকেট যাবে। ওদের ব্যাটিংয়ের সময় টার্গেট ছিল না, কিন্তু আমাদের আছে, তাই তাড়াহুড়ো নয়। খুব সাবধানে খেলতে হবে। কিন্তু এখানে একটা টুইস্ট আছে।”
জাগরণী সঙ্ঘের খুদে প্লেয়াররা অবাক
হয়ে পুলিন স্যরের দিকে তাকাল। পুলিন স্যর বললেন, “রজত, প্যাড আপ। তুহিনের সঙ্গে জিষ্ণু নয়, রজত নামছে।”
ক্রিকেটাররা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।
রজত জাগরণীর ফাস্ট বোলার, সবেমাত্র চার ওভার বল করে দুটো উইকেট নিয়ে উঠেছে, সে শশব্যস্ত হয়ে উঠে প্যাড পরতে শুরু করল।
পুলিন স্যর বললেন, “রজত এই টিমের স্ট্রংগেস্ট ম্যান। নেটে ওর শটগুলো দেখেই প্রয়োজন পড়লে ওকে পিঞ্চ হিটার নামানোর কথা ভেবেছিলাম। ভাবিনি সত্যিই সেই সিচুয়েশন তৈরি হয়ে যাবে।”
পুলিন স্যর রজতের কাছে গিয়ে বললেন, “রজত, মনে রেখো এই টিমের দশ জন এক দিকে আর তুমি আর এক দিকে। তুমি আমার সুইসাইড বম্বার। নেমে প্রথম বল থেকে চালিয়ে খেলবে, কিচ্ছু দেখার দরকার নেই। আউট হলে হবে, কেউ বকবে না তোমায়।”
সুদীপ আর রজত ব্যাট হাতে নামলে পুলিন স্যর ভাবলেন, বেশি নয়, প্রথম ছ’ওভার রজত টিকে গেলে ম্যাচ বেরিয়ে আসবে। তিনি ফাটকা খেলেছেন, ফলাফল জানতে উদগ্রীব।
ফাটকাটা লেগে গেল। রজত প্রথম তিন ওভারে পাঁচটা বাউন্ডারি আর একটা ওভার বাউন্ডারি হাঁকাল। সেই ঝোড়ো ব্যাটিংয়ে ভর করে পাওয়ার প্লে শেষে ছ’ওভারে জাগরণীর স্কোর দাঁড়াল ৪১/১।
রজতের দমকা ব্যাটিংয়ের সামনে প্রায় দিশাহারা ইয়ং বেঙ্গল সপ্তম ওভারে দ্বিতীয় চেঞ্জ হিসেবে নিয়ে এল আবেশ আগরওয়ালকে। জয়ের গন্ধ পাওয়া রজত অবশ্য নিজের জায়গা থেকে একচুলও নড়ল না। আবেশের দ্বিতীয় বলে স্টেপ আউট করে চালাতে গিয়ে স্টাম্পড হল রজত। সেই ওভারেরই শেষ বলে উইকেটের সামনে জিষ্ণুর পা পেয়ে গেল আবেশের অফ স্পিন।
ডাগ আউট থেকে স্ট্রেচিং করতে করতে হেলমেট মাথায় খুদে ব্যাটসম্যানের অবয়ব মাঠে নামতেই গ্যালারিতে মিহিকা মঞ্জীরাকে খোঁচা দিল, “দিদি, ডাম্বো!”
মিডল স্টাম্পে গার্ড নিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ডাম্বোর চোখ আর এক বার স্টেডিয়ামের এনট্রান্সের দিকে চলে গেল, আজ টুটুল স্যরকে এক বার দেখার দরকার ছিল, আর আজই স্যর লেট। রোজই অল্প অল্প লেট হত স্যরের প্র্যাকটিসে আসতে। হাঁপাতে হাঁপাতে ধোপদুরস্ত ফর্মাল শার্ট ট্রাউজ়ার্স পালটে স্পোর্টস ড্রেস পরে ট্রেনিংয়ে ঢুকে পড়তেন। কিন্তু তা বলে আজ! যে দিন ডাম্বোর সবচেয়ে বড় পরীক্ষা? আগামী এক ঘণ্টার মধ্যে ম্যাচের নিষ্পত্তি হয়ে যাবে অথচ টুটুল স্যরেরই দেখা নেই!
খুব সাবধানে ইনিংস এগোচ্ছিল ডাম্বো আর তুহিন। তারা ছক কষে নিয়েছে। ইনিশিয়াল মোমেন্টাম রজত দিয়ে গেছে, এ বার প্রায় বলে বলে সিঙ্গল আর লুজ বল পেলে বাউন্ডারির চেষ্টা, ব্যস! খুব অসাধারণ কিছু করার দরকার ছিল না। দু’ওভার পরে তুহিনের উইকেট খোয়ালেও ডাম্বো সুন্দর করে ইনিংস এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
পিচ সুবিধের নয়, স্পিনারদের বল বনবন করে ঘুরছে। তারই মধ্যে অন সাইডে ডাম্বো বাউন্ডারি মারল দুটো। পুল করে মারা বাউন্ডারিটা দেখে অতিথিদের মঞ্চে বসা রঞ্জি দলের বাংলার বর্তমান ওপেনার হাততালি দিয়ে উঠলেন।
এই অবস্থায় আবেশ আগরওয়াল তার তৃতীয় ওভার করতে এল। সম্ভবত ম্যাচের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওভার হল সেটা। আবেশ উইকেট মেডেন নিল। শুধু মেডেন নিলে জাগরণীর পক্ষে সমস্যা হত না। কিন্তু নিঁখুত অফ স্পিনে আবেশ তুলে নিল আরও দুটো মূল্যবান উইকেট। বিনা উইকেটে চল্লিশ থেকে জাগরণী এসে পড়ল ৮১/৬।
অপ্রতিমকে সঙ্গে নিয়ে ইনিংস টানছিল ডাম্বো। কাজটা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। বেশ কিছুটা সময় ক্রিজে কাটিয়ে ফেলেছে ডাম্বো। আত্মবিশ্বাসে টগবগ করে ফুটছে সে।