Novel

Novel:মায়াডোর

ডাম্বোরা কিট গুছিয়ে বেরোতে যাবে, তখনই তার কাঁধে বিপুল থাবা রেখেছিলেন টুটুল স্যর। চমকে ঘুরে তাকিয়েছিল ডাম্বো।

Advertisement

অভিনন্দন সরকার

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২২ ০৮:৩৩
Share:

ছবি: বৈশালী সরকার

Advertisement

িহিকার স্বপ্নটা আজকের নয়। কত বছর ধরে যে এই স্বপ্নটাকে সযত্নে লালন করে আসছে সে! তার নিজস্ব কাফে হবে। একটা নয়, দুটো নয়... গোটা শহর ছেয়ে যাবে তার কাফেটেরিয়ার শাখায়। এক দিন গোটা দেশে, এমনকি দেশের বাইরেও কাফেটেরিয়ার ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি দেবে সে। নামী বিজ়নেস ম্যাগাজ়িনের প্রচ্ছদে বুকের সামনে আড়াআড়ি হাত রেখে থ্রি-পিস স্যুটে দাঁড়িয়ে থাকবে মিহিকা। সেই স্বপ্নের অট্টালিকার ভিতপুজো আজ হয়েই গেল!

Advertisement

যুবক মিহিকার কাছে এসে দাঁড়াল, “মিস চ্যাটার্জি, এই কর্নারটা কিচেনের জন্য সেপারেট রাখলে ভাল, আর বাকি জায়গাটায় ছ’টা টেবিল, আর ওই কোণে এগজ়িটের ডান দিকে ক্যাশ কাউন্টার। আপনি ভেবে দেখুন। ইন্টিরিয়রের ছেলেগুলো নেক্সট উইক থেকে কাজ শুরু করবে।”

দেখা গেল, বিপ্লব ঘোষ এমনিতে হাসিখুশি হলেও লেনদেনের ব্যাপারে বেশ পারদর্শী। প্রথমে ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি ভাড়া কম করতে বলায় হাসিমুখে এড়িয়ে গেলেন। তার পর জায়গার অপ্রতুলতা, জায়গাটা ঠিক প্রাইম লোকেশনে নয়... ইত্যাদি বলার পরে এবং শেষমেশ যুবকটি নিজের লেদার ব্যাগ থেকে ভাড়ার বাজার-চলতি লিস্টের চার্ট বার করে দেখাল যে, এই ভাড়ার থেকে বেশি ভাড়া বিপ্লব ঘোষ নিজের জায়গার জন্য আর পাবেন না।

বিপ্লব ঘোষ নরম হলেন। শুধু তা-ই নয়, ব্যাঙ্কের যুবকের অনুরোধে চব্বিশ মাসের টেন্যান্সি এগ্রিমেন্টে পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলেন।

মিহিকা বিমুগ্ধ চোখে যুবকের দিকে তাকাল। যে ভাবে একটু আগে যুবকটি তার প্রোজেক্ট ভিসুয়ালাইজ় করছিল আর এখন এমন ভাবে প্রোজেক্ট নিয়ে ডিল করছে, মিহিকার মনে হচ্ছে সে পুকুরপাড়ে এক হিজল গাছের ছায়ায় বসে আছে। তাকে কিচ্ছুটি করতে হচ্ছে না, অথচ কাজ থেমে নেই। ইন্টিরিয়র-এর কাজের ডেট ফাইনাল করে ওরা তিন জন বেরিয়ে পড়ল কেয়াতলা লেন থেকে।

আজকাল শহরে অফিস টাইম বলে আলাদা করে কিছু নেই। প্রচুর গাড়ি বেড়েছে গত কুড়ি বছরে, রাত বারোটাতেও হালকা ভিড় থাকে পথেঘাটে। ট্রাফিক সিগনালে স্টপেজ টাইম থাকে প্রায় এক মিনিটের কাছাকাছি।

হাজরার সিগনালে দাঁড়িয়ে ছিল ওদের গাড়ি। মিহিকা যুবকের দিকে তাকাল। সামনের কাচ দিয়ে আলো আসছে। যুবকের নিঁখুত শেভ করা গালে হালকা সবুজাভ ভাব, শার্টের বুকের বোতাম খুলে রাখা, আশ্চর্য এক আঁধারের পূর্বাভাস সেখানে।

গাড়ির অন্দর একটা মিঠেকড়া, জংলা বৃষ্টির গন্ধে ভরে আছে। পলাশবাবুর কেবিনে যুবকটি ঢোকামাত্র এই গন্ধটাই পেয়েছিল মিহিকা। সে চোখ সরিয়ে নিয়ে নরম স্বরে বলল, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, কিন্তু এ ভাবে এতটা সময় আমায় দিলেন, আপনার অফিসে ক্ষতি হবে না তো?”

যুবক হাসল, “সে হয়তো হবে, কিন্তু প্রায়োরিটি বলেও তো একটা ব্যাপার আছে।”

“মানে?” মিহিকা চোখ ছোট করে তাকিয়েছে যুবকের দিকে।

“আর বলবেন না। সারা দিন কাপড়ের দোকান আর মোবাইল শো-রুমের লোন মঞ্জুর করতে করতে কেটে যায়। আপনার মতো ইয়ং ছেলেমেয়ের তো দেখাই পাওয়া যায় না। সবাই চাকরি-চাকরি করে হেদিয়ে মরছে। তাই আপনার মতো লোকেদের যদি একটু কাজে আসতে পারি, সেটা তো আমার নিজের কাছেও এক মস্ত পাওয়া।”

মিহিকা যথেষ্ট গদগদ হয়ে তাকাল যুবকের দিকে। ভুরু কুঁচকে দৃশ্যটা দেখল জীয়ন। তার বুকের মধ্যে অজস্র শুঁয়োপোকার মুনওয়াক চলছে। চলার পথে যেন ছড়িয়ে যাচ্ছে অসংখ্য কাঁটা।

পলাশের অফিসের সামনে যখন যুবক গাড়ি দাঁড় করাল, তখন বেলা পড়ে এসেছে। মিহিকা আর জীয়ন গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে যুবক বলল, “মিস চ্যাটার্জি, খুব তাড়াতাড়ি ইন্টিরিয়র-এর কাজ শুরু করে দিতে হবে। তখন আবার দেখা হবে। চলি। বাই জিয়ান।”

যুবক হাসল, হাসলে তার গালে টোল পড়ে, মিহিকার বুকের ভিতর ধক করে উঠল।

দু’জন বাইক স্ট্যান্ডের দিকে এগোচ্ছিল। জীয়ন নীরবে হাঁটছে, মিহিকা কলকল করে চলেছে অবিরাম, “কী অদ্ভুত লোক না? এ ভাবে কেউ সার্ভিস দেয় কাস্টমারদের? আমার পিএসইউ ব্যাঙ্কগুলো সম্পর্কে ধারণাই পাল্টে গেল আজ।”

জীয়ন আর চুপ থাকতে পারল না, “দেখ, প্রোমোশনের ব্যাপার আছে হয়তো। আজকাল গভর্নমেন্ট সেক্টরেও হেবি কম্পিটিশন।”

মিহিকা থমকে গেল, উত্তরটা মনঃপূত হয়নি তার, “ধুস কী যে বলিস! অমন এফিশিয়েন্ট এক জন মানুষের আবার প্রোমোশনের চিন্তা!”

জীয়নের অস্বস্তি হচ্ছে। যে ভাবে মিহিকা লোকটার দিকে বার বার তাকাচ্ছিল, সেটা ভুলতে পারছে না সে। দৃশ্যটা মনে পড়তেই চিড়বিড়
করে উঠল জীয়ন, “এত আগে থেকে শিয়োর হোস না। হয়তো দু’-তিন দিন পরে ঠারেঠোরে কমিশনের কথা তুলবে।”

মিহিকার মুখ গম্ভীর হল, আজ পর্যন্ত যাকেই সে নিজের প্রোজেক্টের গল্প শুনিয়েছে সবাই নিরস্ত করতে চেয়েছে তাকে, অথচ এই যুবকের কথা শুনে মনে হয়েছে, যেন আজ থেকে তিনি নিজেও মিহিকার স্বপ্নের একটা অংশ হয়ে গেছেন। জীয়নের কথা তাকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলল।

সে প্রসঙ্গ পাল্টাল, লঘু স্বরে বলল, “সে যা-ই বলিস, কী ড্যাশিং, তাই না? ফিজ়িকটা দেখেছিস! স্পোর্টসম্যান ছিলেন শিয়োর!”

জীয়ন ভেবেছিল প্রতিক্রিয়া দেখাবে না, কিন্তু তার বুকের শুঁয়োপোকার দল তাকে চুপ করে থাকতে দিল না, “ছাই ফিজ়িক! কেমিস্ট্রি অনার্সের ঋচীক এর থেকে অনেক স্টাউট, এই লোকটা তো ডান পা-টা একটু টেনে হাঁটে মনে হল। আর তা ছাড়া আমার নামটাই উচ্চারণ করতে পারল না ঠিকঠাক সারা দিনে।”

হঠাৎ যেন চঞ্চল হয়ে উঠল মিহিকা, “ইশ, তাই তো! ভদ্রলোকের নামই তো জানা হল না। ফোন নম্বরটাও নেওয়া হয়নি!” মিহিকার গলার স্বরে রীতিমতো হতাশা।

“দরকার নেই। যা মাখো-মাখো কেস দেখলাম, আমার ধারণা লোকটা নিজেই তোকে ফোন করবে দু’-এক দিনের মধ্যে,” জীয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “আর নাম? ল্যান্ডলর্ডকে নিজের নাম বলছিল, খেয়াল করিসনি তুই। উত্তীয় মজুমদার। আর কখনও ভুলবি না নিশ্চয়ই?”

মিহিকা সলাজ হাসল, হালকা কিল মেরেছে জীয়নের পিঠে। জীয়নের গা জ্বলে গেল। এই কথায় লাজুক ভাবে হাসার কী হল! মিহিকাকে আগে কখনও লজ্জা পেতে দেখেনি সে, সে তেতো গলায় বলল, “যা নামের বাহার! গোবিন্দমাণিক্য... হরিহর... চিন্তামণি টাইপের মধ্যযুগীয় নাম যার, সে জীয়ন নামের মর্যাদা কী বুঝবে?”

কথা শেষ করে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল জীয়ন।

বাইকে বাড়ি ফেরার পথে দু’জনে কোনও কথা বলল না। রাস্তায় এক বার শুধু একটা ওষুধের দোকানে নামল মিহিকা। ডাম্বোটা ক্রিকেট ক্যাম্প থেকে কপাল কেটে এসেছে ক’দিন আগে, তার জন্য আর এক টিউব অয়েন্টমেন্ট নিতে হবে।

তাদের আবাসনের সামনে বাইক থামতেই লাফিয়ে নামল মিহিকা, “চলি বস, থ্যাঙ্কস ফর দ্য লিফ্‌ট।”

জীয়নের পিঠ চাপড়ে দিয়ে হাঁটা দিয়েছে আবাসনের গেটের দিকে, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আবাসনের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেছে মিহিকা।

জীয়ন সহসা চলে গেল না। যত ক্ষণ দেখা যায়, দু’চোখ ভরে মিহিকার চলে যাওয়াটা দেখল সে। তার পর একটা সিগারেট ধরাল। মিহিকা চলে যাওয়ার পরমুহূর্ত থেকেই বেঁচে থাকা অর্থহীন মনে হতে শুরু করে, হৃদয়ের অলিগলিতে ভরা জোয়ারের মতো কুলকুলিয়ে ঢুকে আসে বিষাদজল।

গত বছর দুয়েক মিহিকার সুখে-দুঃখে পাশে থেকেছে সে। আজ হঠাৎ এক জন আউটসাইডার এসে মিহিকার জীবনে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট হয়ে যাবে আর জীয়ন মুখার্জি সেটা ভোম্বলের মতো দেখে যাবে, সেটা হতে দেওয়া যায় না। আর কেউ জানে না, মিহিকা নিজেও না, তবু জীয়ন তো জানে, মিহিকা শুধুই তার। কোনও উত্তীয় মজুমদার গাড়ি চড়িয়ে প্রোজেক্টের কাজে কিছু হেল্প করে দিয়ে রাতারাতি মিহিকাকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। সিগারেটে একটা বড় টান দিয়ে ছুড়ে ফেলে জীয়ন বাইকে স্টার্ট দিল। সন্ধ্যার নির্জন আঁধার কেঁপে উঠল যন্ত্রযানের গর্জনে।

আজ এ বাড়িতে রাতের খাওয়াদাওয়ার পাট বেশ তাড়াতাড়ি মিটে গেল। সচরাচর রাত এগারোটা, সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। তার পরও অবশ্য কাজ থাকে মঞ্জীরার। বাসন কিছু মেজে নিতে হয় নিজেকেই, পরের দিনের রান্নার জোগাড়যন্ত্র করে রাখতে হয় রান্নার মাসির জন্য, ফ্রিজে তুলে রাখে অবশিষ্ট খাবার... এ সব সেরে মঞ্জীরা যখন বিছানায় আসে, তখন ঘড়ির কাঁটায় প্রায় মধ্যরাত্রি।

খেতে দেরি হওয়ার কারণ আছে। একটা নয়, দুটো। মিহিকা টিউশন সেরে ফেরে অনেকটা রাত করে, তার পর সে স্নানে ঢোকে। এই স্নানে অনেকটা সময় যায়। তার পর ধীর গম্ভীর গমনে সে আসবে ডাইনিং টেবিলে। ডাম্বোটাও জেদাজেদি করে, ‘মিমি’ না এলে সেও খেতে বসবে না।

মঞ্জীরার সমস্যাটা এখানেই। দু’জনের কাউকেই সে শাসন করতে পারে না। এক জনের বাবা থেকেও নেই, আর এক জন স্কুলের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতে বাবা-মা দু’জনকেই হারিয়েছে। এদের কড়া কথা বলার আগে অনেক বার ভাবতে হয়। মাঝে মাঝে হাসিও পায় মঞ্জীরার। তার নিজের যেন সব কিছু আছে! তার যেন কোনও কষ্ট নেই! অথচ সময়ের ফেরে সে এখন হেড অব দ্য ফ্যামিলি!

সারা দিন পর দুই বোনের দেখা হয় খাওয়ার সময়। কথাবার্তা হয় না বিশেষ। মাথা নিচু করে খাওয়া সারে মঞ্জীরা, মাঝে মাঝে ডাম্বোকে তাড়া লাগায়। মিহিকার চোখ খাবারের প্লেটের পাশে রাখা মুঠোফোনে আঠা দিয়ে লাগানো থাকে এই সময়টায়। সামনে বসা মানুষের দুঃখ-কষ্টের প্রতি এরা উদাসীন, অথচ অজানা অর্ধপরিচিত মানুষ কোন রেস্তরাঁয় খেতে গেল সে কথা জানার এদের অপার আগ্রহ... আশ্চর্য একটা প্রজন্ম। সেই মিহিকা আজকাল মাঝে মাঝেই সন্ধে হতে না হতে বাড়ি ফিরে আসছে। আগে মুখ হাঁড়ি করে নিজের ঘরে বসে থাকত, আজকাল তার মেজাজ ফুরফুরে। ডাম্বোর সঙ্গে খুনসুটি চলে পুরোদমে, মাঝে মাঝে রাত বাড়লে তার ঘর থেকে নরম মিউজ়িক ভেসে আসে।

মঞ্জীরার ভাল লাগে। কাজের জায়গাটুকু ছাড়া বাকি পৃথিবীর সঙ্গে সব রকম সংযোগ এক রকম ছিন্ন করে বসে আছে মঞ্জীরা। যাদের মুখ চেয়ে উত্তীয়কে পর্যন্ত ফিরিয়ে দিয়েছে, তারা একটু ভাল থাকবে, আনন্দে থাকবে, এ ছাড়া আর কী-ই বা চাওয়ার আছে তার!

এরই মধ্যে এক এক দিন ঝড় বয়ে যায় মঞ্জীরার উপর দিয়ে। অফিসেই ফোনটা পেয়েছিল সে। কোনও মতে একটা ট্যাক্সি ধরে মঞ্জীরা উদ্্‌ভ্রান্তের মতো ডাম্বোর ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পে পৌঁছেছিল। ডাম্বো অবশ্য তত ক্ষণে সামলে নিয়েছে। ক্যাম্প থেকেই এক জন ফিজ়িশিয়ান ডাকা হয়েছিল, তিনি কপালটা ড্রেসিং করে দিয়েছেন। প্রারম্ভিক ঝটকা কাটিয়ে উঠে ডাম্বোও বেশ ভালই বোধ করছিল।

ক্যাম্পের ডাক্তার বলেছিলেন, ফ্র্যাকচার বা ক্র্যাক হয়নি, তাই ভয়ের কিছু নেই। তবুও ক্যাম্প-ফেরত ছেলেকে নিয়ে পাড়ার ডাক্তারকাকুর চেম্বারে ঢুঁ মেরেছিল মঞ্জীরা। ডাক্তারকাকু তাদের ফ্যামিলি ফিজ়িশিয়ান। বাবা, মা, ছোট্টবেলা থেকে মঞ্জীরা-মিহিকাকেও দেখেছেন। তিনি ভাল করে এগজ়ামিন করে বললেন, “না রে, চিন্তার কিছু নেই। তবে দিন দুয়েক বাড়ি থেকে বেরোতে দিস না, একটু চোখে চোখে রাখিস। বমি-বমি ভাব, ড্রাউজ়িনেস, ডাবল ভিশন... এ রকম সিম্পটম দেখলেই আগে সিটি স্ক্যান করিয়ে আমার কাছে নিয়ে আসবি। আর সাত দিন নো ক্রিকেট, বুঝলে ডাম্বোবাবু?”

ডাম্বো এগজ়ামিনেশন বেডে বসে পা দোলাতে দোলাতে বলেছিল, “তার বেশি রেস্ট নিতে পারবও না আমি। টিম সিলেকশন আছে।”

ডাক্তার কাকু মুগ্ধ চোখে ডাম্বোর দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিলেন, “ব্রেভ বয়! দ্যাট’স দ্য স্পিরিট!” কিন্তু মঞ্জীরা ঠিক করে ফেলেছিল, খুব তাড়াতাড়ি আর ছেলেকে ক্রিকেট কোচিংয়ে পাঠাবে না সে।

ভেবেছিল এবং যথারীতি সেই ভাবনা কাজে রূপান্তরিত করতে পারেনি। ডাম্বোর জেদের কাছে প্রতিবারের মতো নতি স্বীকার করতে হয়েছে তাকে। পরের শনিবার বিকেলেই কাঁধে ক্রিকেট-কফিন নিয়ে জাগরণী ক্লাবের দিকে হাঁটা দিয়েছিল ডাম্বো।

আজ ডাম্বো খাওয়া সেরে সুড়ুত করে বিছানায়। মঞ্জীরা হাতের কাজ সারল, তালা দিল ফ্ল্যাটের দরজায়, তার পর একে একে আলোগুলো নিভিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল।

ঢোকার আগে এক বার মিহিকার ঘরে উঁকি দিল, আলো জ্বলছে এখনও, বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে মোবাইল ঘাঁটছে মিহিকা। পা ভাঁজ করে দোলাচ্ছে, নাইটি উঠে গেছে হাঁটুর ওপর। ষাঁড়াষাঁড়ি বানের মতো বেপরোয়া যৌবন এসেছে তার শরীরে। মঞ্জীরা পর্দা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেল।

মা থাকলে চিন্তা অনেক কম থাকত তার। সারা দিন এই মেয়ে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়, কী করে, কোথায় যায়, কোনও খবরই রাখে না মঞ্জীরা। কখন যে বোন ধীরে ধীরে একটা বরফের প্রাচীর তুলে দিয়েছে নিজের চার পাশে! যখন বুঝেছে মঞ্জীরা, তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। উচ্চতা বাড়তে বাড়তে সেই প্রাচীর আজ দুর্লঙ্ঘ্য।

ডাম্বোর চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে, তবু সে মায়ের কাছ ঘেঁষে এল। দু’দিন হল তার পেনকিলারের কোর্স শেষ হয়েছে। শরীরে অন্য কোনও অসুবিধেও নেই, কপালের ডান দিকে দু’ইঞ্চির একটা কাটা দাগ আছে, তা থাক। ও নিয়ে ভাবিত নয় ডাম্বো।

“ডাম্বো, ঘুম পাচ্ছে বলে সাত তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলে, এখন ঘুমের দেখা নেই!”

“ঘুম পাচ্ছে তো। টুটুল স্যর এত খাটায়, মনে হয় মাঠেই অজ্ঞান হয়ে যাব।”

মঞ্জীরা শিউরে উঠল, “ও আবার কী কথা? টুটুল স্যরটা আবার কে?”

“নতুন স্যর, মা। কয়েক দিন হল অ্যাকাডেমি জয়েন করেছেন।”

“কেন? পুলিন স্যর ট্রেনিং করাচ্ছেন না এখন?”

“পুলিন স্যরও আছেন, তবে ব্যাচ ভাগ হয়ে গেছে। আমি টুটুল স্যরের ব্যাচে। টুটুল স্যর আমায় খুব ভালবাসে, মা।”

মঞ্জীরা খুশি হতে পারল না। খেলার নামে এ ভাবে ছেলে নিজের সবটুকু মাঠে ময়দানে বিলিয়ে দিয়ে আসবে, এ কেমন কথা? পড়াশোনাটা করবে কখন তা হলে?

ডাম্বো কথা বাড়াল না, চুপচাপ শুয়ে আছে মাকে জড়িয়ে। সামান্য কথোপকথনে তার কাছে এটুকু পরিষ্কার যে, টুটুল স্যরের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা মা ভাল চোখে দেখেনি।

প্রথম দু’-তিন দিন কি ডাম্বোই খুশি হয়েছিল! আগে তাদের ক্লাবের মস্ত মাঠে সে আট পাক দৌড়ত, টুটুল স্যর এসে সেটা বারো পাক করেছেন। তার সঙ্গে বেড়েছে ডাম্বোর অন্য ট্রেনিংয়ের তীব্রতাও।

ডাম্বো দেখেছে, সাধারণ ট্রেনিংকে টুটুল স্যর তেমন পাত্তা দেন না। তিনি বলেন, “শরীর যখন হাল ছেড়ে দেয়, যখন মনে হয় আর পারছি না, তখনই আসল ট্রেনিং শুরু হয়। নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার ট্রেনিং, এক লেভেল থেকে পরের লেভেলে উত্তরণের ট্রেনিং, যেমন মোবাইল গেমসে একটার পর একটা লেভেল আসে, ঠিক তেমন করে শরীর নিংড়ে যেতে হবে ফিটনেসের পরের লেভেলে।”

অল্প সময়েই ডাম্বো সাফল্যের এই বীজমন্ত্র বুঝে নিয়েছে, কিন্তু সমস্যা হল তার এগারো বছরের শরীর এখনও মানিয়ে নিতে পারেনি সেই অমানুষিক ট্রেনিংয়ের সঙ্গে। ফলস্বরূপ স্কুলে গিয়ে গত দু’দিন বার বার চোখ লেগে এসেছে তার। সোশ্যাল সায়েন্সের ক্লাসে রীতিমতো ঝিমিয়েছে সে, প্রিয়াংশু তাকে ঠেলে না দিলে ধরা পড়ে যেত স্যরের কাছে।

শুধু কি তা-ই? তার ব্যাটিং টেকনিকের গোড়া ধরেও কি ঝাঁকিয়ে দেননি টুটুল স্যর? এই তো সে দিন, সন্ধে নামছিল, প্র্যাকটিস নেট খুলে নেওয়া হয়েছিল আর মালিরা জল দিতে শুরু করেছিল সারাদিনের রোদে ফুটিফাটা পিচে। ডাম্বোরা কিট গুছিয়ে বেরোতে যাবে, তখনই তার কাঁধে বিপুল থাবা রেখেছিলেন টুটুল স্যর। চমকে ঘুরে তাকিয়েছিল ডাম্বো।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement