ছবি: বৈশালী সরকার
স
ময় অনেকটা এগিয়ে গেছে। ডাম্বোকে মা নতুন দামি ব্যাট কিনে দিয়েছে। শুধু ব্যাট কেন, প্যাড, গ্লাভস, এলবো গার্ড, চেস্ট গার্ড-সহ আস্ত একটা ক্রিকেট কিট আছে তার। গত দু’-আড়াই বছর ধরে ক্রিকেট তার ধ্যানজ্ঞান। অভিরাজ সেনের ক্রিকেট অ্যাকাডেমির স্টুডেন্ট সে।
সবই হল, শুধু বাবা-ই আর ফিরল না। মাঝে মাঝে কিছু গিফ্ট আসে বাবার কাছ থেকে, আর জন্মদিনের সকালে ফোন করে বাবা।
কিন্তু এটুকুতে কি মন ওঠে ডাম্বোর? যে টালমাটাল অবস্থার মধ্য দিয়ে তার শৈশব যাচ্ছে, বাবা থাকলে কি সেই সব ঢেউয়ের ঝাপটা এমন ভাবে সহ্য করতে হত ডাম্বোকে?
“দর্পণ গেট রেডি, ইয়োর টার্ন...” মিলিটারি কম্যান্ডারের স্বরে হুকুম দিলেন পুলিন স্যর।
ডাম্বো তার চিন্তার জগৎ থেকে আছড়ে পড়ল বাস্তবের জমিতে। মুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়েছে। প্যাড অ্যাডজাস্ট করে তৈরি হয়ে নিয়েছে দ্রুত। হাতে গ্লাভস গলাতে গলাতে প্রায় ছুটতে ছুটতে নেটে গিয়ে মিডল স্টাম্পে স্টান্স নিয়েছে।
বোলারের সংখ্যা কম নয়। প্রথম জন মিডিয়াম পেসার, জোরের ওপর ফুল লেংথ ডেলিভারি, মাথা নিচু করে নক করল ডাম্বো।
পরের পর বল ধেয়ে আসছে তার দিকে জীবনের উত্তর না-জানা প্রশ্নের মতো। ক্লাসের লাস্ট বয়ের মতো কূল পাচ্ছে না ডাম্বো। সে বুঝতে পারছে, পুলিন স্যরের সামনে তার পারফরম্যান্স আশানুরূপ হচ্ছে না।
বেশির ভাগ বল ব্যাটের কানা ছুঁয়ে যাচ্ছে, যেগুলো লাগছে সেগুলোও জোরালো শট হচ্ছে না।
কেলেঙ্কারিটা হল একটা মিলিটারি পেস বল খেলতে গিয়ে। নিতান্ত নির্বিষ ডেলিভারি, কিন্তু স্কোয়ার কাট করতে গিয়ে ব্যাটের কোণ ছুঁয়ে বল লাগল অফ স্টাম্পে।
“আহ! দর্পণ! কী হচ্ছেটা কী? একটা বল মিডল করতে পারছ না। আর এই বলে কেউ আউট হয়! কনসেন্ট্রেট দর্পণ, কনসেন্ট্রেট!”
ডাম্বোর চোয়াল শক্ত হল। নাহ, কিচ্ছু ঠিকঠাক হচ্ছে না। মনোযোগ আনতে হবে। নড়ে যাওয়া অফ স্টাম্প ব্যাটের হ্যান্ডেল দিয়ে ঠুকে ঠুকে ঠিক করে নিল সে। স্টান্স নিয়েছে আবার।
কয়েকটা বল ব্যাটের মাঝখান দিয়ে খেলল ডাম্বো, তার পরেই সে স্পষ্ট দেখল একটা হলুদ ট্যাক্সি বালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে বাঁ দিকে বেঁকে গড়িয়াহাটের দিকে ছুটছে। ট্যাক্সিতে একটা ছ’বছরের ছেলের পাশে বসে অঝোরে কাঁদছে তার মা আর ছেলেটা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে একটা পুরনো সস্তার ব্যাটের শোকে।
কোথায় যে ডাম্বো রেখে এল ব্যাটটা! শোওয়ার ঘরে, সোফার পাশে না কি দোতলার করিডরের প্রান্তে যেখানে দেওয়ালে খড়ি দিয়ে উইকেট এঁকে শ্যাডো করত সে? ডাম্বোর চোখের সামনে সবুজ গালিচার মতো বাইশ গজ যেন আবছা হয়ে এল। তারই মধ্যে সে দেখল অফ স্পিনারের বল পিচ পড়তে চলেছে অফ স্টাম্পের হাতখানেক দূরে। ডাম্বো স্কোয়ার ড্রাইভ মারতে হাঁটু ভাঁজ করল।
পরমুহূর্তে কপাল আর মাথা বরাবর এক অসহ্য যন্ত্রণায় বিদ্ধ হল ডাম্বো। লালরঙা এক তরলের স্রোতে দৃষ্টিপথ ঝাপসা হয়ে এল। জ্ঞান হারানোর আগে ডাম্বো প্রবল হইচই শুনতে পেল। সে বুঝল পুলিন স্যর আর বাকি সতীর্থরা ছুটে আসছে তার দিকে। ডাম্বোর শেষ চেতনাটাও লুপ্ত হয়ে গেল। মাসখানেক পর টুর্নামেন্টের টিম সিলেকশন।
হল না। এ বারেও হল না।
গাড়ি থেকে নেমে প্র্যাকটিস নেটের দিকে আসছিল অভিরাজ। ক্লাবের আর্দালি রাঘব তাকে দেখে ছুটে এল, “আপনি এসেছেন স্যর! লেবু চা দিই একটু?”
“দে...” উৎকণ্ঠা ভরা স্বরে অভিরাজ বলল, “ওই ছেলেটা কে রে? স্পিনারের বলে মাথায় চোট পেল? গাধার মতো ব্যাট করছে!”
অদূরে তখন সংজ্ঞাহীন এক জুনিয়র ক্রিকেটারকে ধরাধরি করে ক্লাবের ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে সবাই।
সে দিকে তাকিয়ে রাঘব বলল, “ওই ছেলেটা! ও তো দর্পণ গাঙ্গুলি। আন্ডার ফোর্টিন। আপনি চেনেন না?”
অভিরাজের ভুরু কুঁচকে গেল। স্মৃতি আবার বিট্রে করছে। খুব চেনা নাম। অথচ কিছুতেই মনে করতে পারছে না নামটা সে কোথায় শুনেছে।
রাঘব চা আনতে চলে গেছে, সন্ধে নামার মুখে অভিরাজ সেন মাঠে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছে, “দর্পণ গাঙ্গুলি... দর্পণ... দর্পণ...”
৫
মিহিকা আর জীয়ন পাশাপাশি বসে আছে। এই ঘরে আলাদা চেয়ারের ব্যবস্থা নেই, তারা বসে আছে একটা বেঞ্চের উপর। অপরিসর বেঞ্চ, গায়ে গায়ে লেগে বসে আছে দু’জনে।
জীয়ন মিহিকার দিকে তাকাল, “আর কত ক্ষণ রে?”
মিহিকা উত্তর দিল না, সে নিজেও একই চিন্তা করছে।
এই ঘরে তারা অনেক ক্ষণ ধরে বসে আছে এমন নয়, তবু মনে হচ্ছে যেন অনন্তকাল পেরিয়ে গেছে।
ছোটখাটো কেবিন, মাঝারি মানের সাজানো-গোছানো অফিস ঘর। এই ঘরের বাইরে আর একটা চওড়া ঘর আছে। সেই ঘরটা বেশ বড়সড়, ওরা এই অফিসে ঢোকার সময় দেখেছিল, সেখানে ঘাড় গুঁজে জনা সাতেক ছেলেমেয়ে কাজ করে চলেছে। পলাশ তাদের দু’জনকে বসিয়ে সেই যে হাওয়া হয়েছে তার আর দেখা নেই।
জীয়ন উসখুস করছে। তার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকাল মিহিকা, একে নিয়ে আসার ইচ্ছে তার ছিল না। কিন্তু পলাশের সঙ্গে সেই প্রথম দিন দেখা করার পর থেকেই মিহিকার অস্বস্তি হচ্ছিল। কাজের ব্যাপারে এই লোক যে পাকা তাতে সন্দেহ নেই, শুধু পাশ নম্বর নয়, মিহিকা পলাশকে প্রায় ডিস্টিংশন দিয়ে ফেলেছে মনে মনে। কিন্তু পলাশের দৃষ্টি সুবিধের নয়। মাঝে মাঝেই মিহিকার শরীরে সেই দৃষ্টি কিলবিল করে বেড়ায়। অথচ আচরণে বিন্দুমাত্র বেচাল নেই, রীতিমতো পেশাদারি বোলচাল।
পর পর তিন দিন পলাশের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছে সে। কাজও এগিয়েছে অনেকটাই। পলাশ মিত্র যে বিজ়নেস এস্টাবলিশমেন্ট ফার্মটা চালায়, তাদের তরফ থেকেই প্রথম ফোনটা গিয়েছিল মিহিকার কাছে। আশা-আশঙ্কার মাঝামাঝি মানসিক অবস্থায় পলাশের সঙ্গে মিটিংয়ে রাজি হয়েছিল মিহিকা।
নতুন প্রজেক্ট, নতুন ব্যবসা গড়ে তোলায় পেশাদারি মদত করে পলাশের ফার্ম। আজকাল শহরে এ রকম বেশ কিছু সংস্থা গজিয়ে উঠেছে, এরা কিছুটা প্রফেশনাল ফি নেয় বটে, কিন্তু এদের সাহায্য থাকলে কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। উৎসাহী হয়েছিল মিহিকা। কাউকে না জানিয়েই পলাশের সঙ্গে প্রথম দিন দেখা করেছিল সে। সেই আলাপ বেড়েছে, কাজও এগিয়েছে হু হু করে।
অজানা পথেরও একটা আশ্চর্য আকর্ষণ আছে। দিদিয়াকে না জানিয়ে এত বড় পদক্ষেপ সে নিতে চলেছে, এই চিন্তা কয়েক দিন আগেও রাতে ঘুমোতে দিচ্ছিল না তাকে, অথচ ব্যাপারটা বেশ সহজ হয়ে এসেছে কয়েক দিনে। এমন জোরালো লোকের হাত তার কাঁধে এসে পড়েছে বলেই কি? কিন্তু ওই বিচ্ছিরি দৃষ্টি চাপে রেখেছে মিহিকাকে। আজ তাই জীয়নকে বগলদাবা করে নিয়ে এসেছে সে। পুরুষ হিসেবে যে জীয়ন এক অতি শক্ত অবলম্বন এ কথা বলা যায় না, তবু হাতে পায়ে আস্ত একটা পুরুষমানুষ তো বটে। রাজি করাতে বেগ পেতে হয়নি, বলামাত্র বাইক ছুটিয়ে এই অফিসে এনে হাজির করেছে জীয়ন।
সবে যখন এফিশিয়েন্সির দিক থেকে মনে মনে পলাশের নম্বর কাটা শুরু করেছিল মিহিকা, তখনই দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেছে সে।
হাসিমুখে বসেছে সামনের চেয়ারে, “স্যরি, একটু দেরি করে ফেললাম। আচ্ছা, আপনার ডকুমেন্টগুলো এনেছেন?”
মিহিকা ব্যস্ত হল, ব্যাগ থেকে মোটা ফাইল বের করেছে। একে একে বার করে আনল জরুরি কাগজের তাড়া। পলাশ বেশ কিছু ক্ষণ ধরে জরিপ করল সব ক’টা ডকুমেন্ট, তার পর চোখ না তুলেই বলল, “ওরিজিনালগুলো একটু দেখাবেন প্লিজ়।”
দেখাল মিহিকা।
পলাশের মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল, হাসলে তার চোখ ছোট ছোট হয়ে যায়। তিরিশ বছর বয়সেই চোখের নীচে পুরু অ্যালকোহলিক প্যাড।
ওরিজিনাল কাগজগুলো ফিরিয়ে দিয়ে পলাশ হাসিমুখে তাকাল মিহিকার দিকে, “হ্যাঁ, ফর্মালিটিগুলো আপাতত এটুকুই। আর কিছু লাগলে পরে চেয়ে নেব। এ বার পরের স্টেজে আসি।”
মিহিকা নড়েচড়ে বসল। তার দেখাদেখি জীয়নও। বেশ কয়েক দিন পর পর মিহিকা একা একা বেরিয়ে গিয়েছিল কলেজ থেকে, কোথায় টো টো করে বেরিয়েছে তা নিয়ে ধন্দে ছিল জীয়ন। শুধু তাই-ই নয়, কখন যেন নিজে নিজেই মিহিকার অভিভাবকের আসনেও বসে পড়েছে সে।
আজ এখানে আসার আগে ক্যান্টিনে বসে গোটা কেসটা মিহিকা জীয়নকে বলেছে। শুনে কিছু ক্ষণ কথা বলতে পারেনি জীয়ন।
তার কি খুশি হওয়া উচিত? মিহিকার জন্য আনন্দে, গর্বে তার চৌত্রিশ ইঞ্চির ছাতি বাড়তে বাড়তে প্রায় ছাপ্পান্ন ইঞ্চি হয়ে যাবে? না কি যে রিস্ক মিহিকা নিতে চলেছে, তা নিয়ে দুর্ভাবনায় কপালে ভাঁজ ফেলবে সে?
মিহিকা অবশ্য কোনওটাই করার সময় দেয়নি জীয়নকে। ব্যাপারটুকু জানিয়েই জীয়নকে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে এসেছে এই অফিসে। জীয়ন আর আজকাল অবাক হয় না, মিহিকাকে কম দিন দেখছে না সে। ইদানীং তার মনে হয় এই বেমক্কা আচরণগুলো না থাকলে হয়তো মিহিকাকে সে ভাবে ভালবেসে উঠতেই পারত না জীয়ন।
পলাশ হঠাৎ দরজার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “এই যে, আসুন আসুন। আপনার কথাই বলছিলাম।”
জীয়ন আর মিহিকা অবাক হল, পলাশ কারও কথাই বলছিল না তাদের। ছোট্ট কেবিন, তবু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল দু’জনে।
সাদা নীলের স্ট্রাইপ শার্ট আর নেভি ব্লু ফর্মাল ট্রাউজ়ার্স পরা মানুষটা কেবিনে ঢুকতেই চেয়ার ছেড়ে সম্ভ্রমের সঙ্গে উঠে পড়েছে পলাশ, “আসুন, আপনি এখানে বসুন স্যর।”
পলাশ বিনয়ের অবতার হয়ে বলল, “আমাদের কোম্পানির যে ব্যাঙ্কের সঙ্গে টাই-আপ, ইনি সেই ব্যাঙ্কের রিপ্রেজ়েন্টেটিভ। আমি যতটা কাজ এগিয়ে দেওয়ার দিয়েছি, বাকিটা ইনিই সামলে নেবেন।”
ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি চেয়ারে এসে বসলে মিহিকা ভাল করে দেখল লোকটাকে। পলাশেরই প্রায় সমবয়সি। অ্যাথলিটদের মতো চেহারা, চওড়া কাঁধ থেকে ফিটিংস শার্ট নীচে নেমে সরু কোমরে ট্রাউজ়ার্সের ভিতর ঢুকে আছে, শার্টের হাতা কনুই অবধি গোটানো। যুবক চেয়ারে বসে সরাসরি তাকাল মিহিকার দিকে।
“মিস মিহিকা চ্যাটার্জি আপনিই তো?”
মিহিকা মাথা নাড়ল। যুবক এক বার জীয়নের উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, “ওকে, আপনার ক্রেডেনশিয়ালগুলো ফাইনাল অ্যাপ্রুভালের জন্য চলে যাবে, আমার মনে হয় খুব একটা সমস্যা হবে না। এ বার আপনার বিজনেস প্রেমিসেস ফাইনাল করতে হবে, আপনি কি কিছু ডিসাইড করেছেন?”
মিহিকা এই প্রশ্নের জন্য তৈরিই ছিল। পলাশের উদ্যোগে তাদের কোম্পানির সঙ্গে নথিবদ্ধ চারটে বিজ়নেস প্রেমিসেস সে দেখে এসেছে। সে এক বিরাট অধ্যায়, ভাড়ায় পোষায় তো জায়গা পছন্দ হয় না, জায়গা পছন্দ হয় তো বনিবনা হয় না টেঁটিয়া মালিকের সঙ্গে।
তবু শেষমেশ অনেক ভেবে একটা জায়গা ফাইনাল করে ফেলেছে মনে মনে। সামান্য দরদামের ব্যাপার আছে, সেটা কে করবে?
মিহিকা বলল, “কেয়াতলার জায়গাটাই ভাল হবে। আমার রিকোয়ারমেন্টের চেয়ে একটু কম, কিন্তু ভাড়ার ব্যাপারটাও তো দেখতে হবে।”
যুবক জিজ্ঞাসু চোখে পলাশের দিকে তাকাল।
পলাশ ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল, “হ্যাঁ স্যর। বিপ্লব ঘোষের প্রপার্টিটা। ম্যাডাম চাইলে ওটাই ফাইনাল করে ফেলা যেতে পারে। আমি ফোন করে না হয়...”
যুবক হাত তুলে থামিয়ে দিল পলাশকে, তার মুখেচোখে চিন্তার ছাপ, “ফোন করে হবে না। এক বার মিট করে না নিলে প্রসেসটা ঝুলে থাকবে।”
পলাশ রীতিমতো অবাক, “আপনি! ইয়ে মানে, আপনি নিজে যাবেন স্যর?”
লোকটা পলাশের কথায় তেমন গা করল না, সে মিহিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “মিস চ্যাটার্জি, আপনার অন্য কোনও কাজের তাড়া না থাকলে চলুন তো। কেয়াতলার প্রপার্টির ফাইনাল ডিলটা সেরে আসি।”
জীয়ন দেখল, এত ক্ষণ থমকে থাকা সময় হঠাৎ যেন ফাস্ট ফরোয়ার্ড হয়ে টগবগে এক টাট্টুঘোড়ার মতো হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে জীয়ন আর মিহিকা উঠে বসেছে লোকটার গাড়িতে। নিজেই ড্রাইভ করে লোকটা তাদের নিয়ে যাচ্ছে গোলপার্কের উপর দিয়ে। দক্ষিণ কলকাতায় দুপুরের যানজট বেশ কম, ফুরফুরে হাওয়া আসার কথা জানলা দিয়ে, কিন্তু লোকটা এসি চালিয়ে রেখেছে।
রিয়ারভিউ মিররে জীয়নের দিকে তাকিয়ে যুবক বলল, “আপনাকে চিনলাম না কিন্তু...”
জীয়ন যে কারণেই হোক, লোকটাকে পছন্দ করে উঠতে পারেনি এ পর্যন্ত। লোকটার সমস্ত মনোযোগ যেন মিহিকার দিকেই স্থির। আর মিহিকার চোখ দু’টো যেন লোকটার সঙ্গে কথা বলার সময় একটু হলেও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। গাড়িতে ওঠার সময়েও নিজে থেকেই লোকটার পাশের সিটে বসে পড়ল, জীয়ন একা একা বসে আছে পিছনের সিটে।
সে উৎসাহ দেখাল না, খুব স্বাভাবিক স্বরে বলল, “আমি জীয়ন, জীয়ন মুখার্জি। আমি আর মিহিকা...”
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মিহিকা বলে উঠল, “আমরা একই কলেজে পড়ি।”
জীয়ন থতমত খেয়ে চুপ করে গেল। এই তা হলে তার পরিচয়? বন্ধু নয়, স্পেশ্যাল কেউ নয়, শুধু একই কলেজে পড়ে? ঠিক আছে, জীয়নও এখন থেকে সে রকমই থাকবে। লোকের কাছে তার পরিচয় দিতেও যখন মিহিকার এত আপত্তি...
জীয়ন দেখল রিয়ারভিউ মিররে এখনও লোকটার চোখ তার উপর স্থির। যেন খুব খুঁটিয়ে দেখছে কিছু। জীয়ন চোখ সরিয়ে নিল।
লোকটা গাড়ি পার্ক করার পর সর্বাঙ্গ আর এক বার চিড়বিড় করে উঠল জীয়নের। গাড়ি থেকে নেমে লোকটা মিহিকার জন্য দরজা খুলে দিল, রাজেন্দ্রাণীর ভঙ্গিতে গাড়ি থেকে নামল মিহিকা।
জীয়ন দাঁতে দাঁত পিষল, যে ছেলেরা মেয়েদের এক্সট্রা প্রেফারেন্স দেয় তাদের নাকি মিহিকা সহ্য করতে পারে না, রেস্তরাঁর দরজা খুলে মেয়েদের আগে ঢুকতে দেয় যে পুরুষ, যারা সঙ্গিনীর বসার জন্য চেয়ার টেনে আনে, তাদের নাকি দু’চক্ষে দেখতে পারে না সে!
বাহ! কী তাড়াতাড়ি রং পাল্টাতে পারে মেয়েরা! সাব্বাশ মিহিকা, সাব্বাশ!
গাড়িতেই গোঁজ হয়ে বসে রইল জীয়ন। সেও তো ওই লোকের কাস্টমার, স্পেশাল ট্রিটমেন্ট মিহিকা একা কেন পাবে?
লোকটা দরজা খুলে দিল না, বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে হালকা টোকা মারল পিছনের জানলার কাচে, “নেমে এসো জিয়ান, আমরা পৌঁছে গেছি।”
দাঁতে দাঁত পিষতে পিষতে ফুটপাতে পা রাখল জীয়ন, তার পর তেতো স্বরে বলল, “দাদা, আমার নাম জিয়ান নয়, ইটস জী-য়-ন।”
বিপ্লব ঘোষ সদ্য ষাট-পেরনো সদাহাস্যময় মানুষ। মিহিকাদের দেখে তিনি হইহই করে উঠলেন। চা পাঁপড়ভাজা ইত্যাদির ব্যবস্থা করে সে এক হুলস্থুল কাণ্ড! যেন ভাড়াটে নয়, কোনও এক পরমাত্মীয় দীর্ঘ দিন পর তাঁর বাড়িতে এসেছেন।
দেখা গেল, তাঁর স্ত্রীও একই রকম অতিথিবৎসল। মিহিকাদের সঙ্গে থাকা যুবক কাজের কথা না পাড়লে আরও অনেক ক্ষণ এলোমেলো আলোচনা চালিয়ে যেতেন ভদ্রলোক। মূলত যুবকের উৎসাহেই বিপ্লব ঘোষ তাদের নিয়ে এলেন ভাড়া দেওয়ার জায়গাটায়, এক তলায়। ছিমছাম দু’শো স্কোয়ারফুটের জায়গা। আগে এই জায়গাটা ছিল বিপ্লব ঘোষের গ্যারাজ ঘর। রিটায়ার করে গাড়ি বেচে দিয়েছেন, এখন ভাড়া দিতে চাইছেন এই জায়গাটা।
মিহিকা স্বপ্নাবিষ্ট চোখে চার দিকে তাকাল। এই জায়গা দিয়েই তা হলে তার স্বপ্নের যাত্রা শুরু হবে! মিহিকার স্বপ্নটা আজকের নয়। জ্ঞান হওয়া অবধি স্বপ্নটাকে সযত্নে লালন করে আসছে সে।