—প্রতীকী চিত্র।
কথায় কথায় প্রায়ই আমরা পেনাল্টি শব্দটা ব্যবহার করি। শব্দটির অর্থ জরিমানা, শাস্তি বা দণ্ড। কথাটির উৎস কয়েকশো বছরের পুরনো ঔপনিবেশিক প্রশাসনের বিষয় পিনাল কোড। যার পোশাকি নাম ছিল ‘দি ইন্ডিয়ান পিনাল কোড ১৮৬০’ (আইপিসি) বা ভারতীয় দণ্ডবিধি। ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষে ১৮৩৩ সালে চালু হয়েছিল চার্টার আইন। সেই আইনের দৌলতেই পরের বছর টমাস মেকলের নেতৃত্বে ভারতে প্রথম আইন কমিশন গঠিত হয়। কমিশনের সুপারিশেই ভারতীয় দণ্ডবিধির প্রণয়ন হয় ১৮৬০ সালের ৬ অক্টোবর। সমগ্র দেশে তা বলবৎ হয় ১৮৬২ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে।
তৎকালীন ভারত তো বটেই, আজও ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বর্তমান ভারত-সহ পাকিস্তান, বাংলাদেশের দণ্ডবিধিও এই পিনাল কোডকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্রহ্মদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়ার কিছুটা, সিঙ্গাপুরের মতো দেশও নিজেদের দণ্ডবিধির জন্য এর উপরে নির্ভর করেছিল। কিন্তু রচনাকার মেকলে সে সবের কিছুই জানতে পারেননি, কারণ তত দিনে তিনি প্রয়াত। সম্প্রতি ৩৭০ ধারা বিলোপের পরে জম্মু-কাশ্মীরও এর আওতায় পড়ে গিয়েছে। এটি হল দেশে সংঘটিত নানা অপরাধের বিবরণ ও তার সঙ্গে প্রযোজ্য শাস্তির বর্ণনা।
ঊনবিংশ শতকের সাতান্ন সালের মহাবিদ্রোহের প্রভাবে এই খসড়া দণ্ডবিধির সংশোধন এবং বলবৎ হওয়ার পিছনে অবদান ছিল স্যর বার্নেস পিককের। তিনি ছিলেন কলকাতা হাই কোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি। কলকাতা হাই কোর্টও প্রতিষ্ঠিত হয় এই দণ্ডবিধি চালু হওয়ার বছরেই— ১৮৬২ সালে। হাই কোর্ট প্রতিষ্ঠার আগে কিন্তু কলকাতার প্রধান বিচারালয় পরিচিত ছিল সুপ্রিম কোর্ট নামে। ১৭৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত সেই কোর্ট আজ থাকলে এই বছর সাড়ম্বরে তার আড়াইশো বছর পূর্তি পালন করা যেত। মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসিদাতা ইলাইজ়া ইম্পে ছিলেন এই কোর্টের প্রথম বিচারপতি। পরবর্তী সময়ে মেকলে আবার নন্দকুমার হত্যাকাণ্ডের জন্য ইম্পেকে অভিযুক্ত করেছিলেন।
এ বছর ১ জুলাই অর্থাৎ কলকাতা হাই কোর্টের প্রতিষ্ঠা দিবসে এই ইন্ডিয়ান পেনাল কোড প্রতিস্থাপিত ও পরিবর্তিত হয়ে নতুন নামে পরিচিত হয়েছে। সেই আইপিসি-র নতুন নাম এখন বিএনএস বা ‘ভারতীয় ন্যায় সংহিতা ২০২৩’। গত বছর লোকসভায় ভারত সরকারের এই বিষয়ে আনা বিল এই দিন থেকে বলবৎ হয়েছে। তার সঙ্গে দীর্ঘ কাল ধরে প্রচলিত ‘ক্রিমিনাল প্রসিডিয়োর কোড’ বা ‘সিআরপিসি’-রও নাম বদল হল। সিআরপিসি-র নতুন নাম হল ‘ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা ২০২৩’ বা বিএনএসএস। আবার ভারতীয় সাক্ষ্য আইন-এর পরিবর্তিত নাম হল ‘ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম ২০২৩’।
কিন্তু পিনাল কোড নামটি হারিয়ে গেলেও তা কিন্তু অবিনশ্বর হয়ে থাকবে বাংলা সাহিত্যে। পিনাল কোড বলবৎ হওয়ার কালেই প্রকাশিত হয়েছিল কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’। বঙ্গসাহিত্যের অন্যতম নকশা জাতীয় রচনা হল ‘সচিত্র গুলজারনগর’ বইটি। ১৮৭১ সালে প্রকাশিত বইটির লেখক ছিলেন হাটখোলার মানিক বসু ঘাট স্ট্রিটের কেদারনাথ দত্ত। কিন্তু বইটিতে ইংরেজ-বিরোধিতা থাকায় তিনি ‘ভাঁড়’ ছদ্মনামে বইটি প্রকাশ করেছিলেন। বইয়ে পাওয়া যায়, এক চরিত্র নীরদবাবুর চুরি যাওয়া টাকা, ঘড়ি যাদের কাছে পাওয়া গিয়েছিল সেই হেমাঙ্গ ও বাদশা চাটুজ্জেকে নিয়ে আদালতে মামলা চলছিল। বাদশার উকিল কানিংহাম, ‘মেজেস্টার’ অর্থাৎ ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়েছিলেন যে, নীরদবাবুর ভালর জন্যই বাদশা ঘড়িটি সযত্নে তুলে রেখে দিয়েছিল— “পিনালকোডের মর্মানুযায়ী এতে কোন দোষ কি দণ্ড অর্শায় না।” সুদর্শন হেমাঙ্গকে দেখে আদালতের লোকজন তাকে চোর বলে মেনে নিতে পারছিল না। এক জন বলেছিলেন, “পিনালকোড আজকাল বড় শক্ত আইন লিকচে।” অন্য এক জনের মুখের কথাকে লেখক ‘পেনেলকোট’ নামে তুলে ধরেছেন।
আসি বঙ্কিমচন্দ্রের কথায়। ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত ‘দেবী চৌধুরাণী’ উপন্যাসে তিনি পিনাল কোডকে ‘পীনাল কোড’ বানানে লিখেছেন। উপন্যাসের তৃতীয় খণ্ডের প্রথমে হরবল্লভ তখন ইংরেজ সেনা নিয়ে রানির গ্রেফতারির চক্রান্ত করছে। রানির সেনা অর্থাৎ বরকন্দাজদের শক্তিশালী লাঠির গুণকীর্তন করতে গিয়ে তাকে ‘পীনাল কোড’-এর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন বঙ্কিম। এক সময় লাঠির আঘাতে কোম্পানির সেনাকেও নাকি সরতে হয়েছিল। সর্বেসর্বা লাঠির সেই দিন আর না থাকলেও তার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকালিখনে বঙ্কিম ক্লান্ত হননি— “তুমি পীনাল কোডের মতো দুষ্টের দমন করিতে, পীনাল কোডের মতো শিষ্টেরও দমন করিতে এবং পীনাল কোডের মতো রামের অপরাধে শ্যামের মাথা ভাঙ্গিতে।” বোঝাই যায় যে দেশি লাঠির প্রশংসার মাধ্যমে দেশাত্মবোধের পাশাপাশি ইংরেজ সরকারের চাকুরিজীবী হয়েও ইংরেজ শাসনের প্রতি বঙ্কিম ব্যঙ্গ করতে ছাড়েননি। পিনাল কোডের উপর আপিল চলে, অর্থাৎ বিচারের দণ্ডাদেশে সন্তুষ্ট না হলে উচ্চ আদালতে আবেদন করা যায়, কিন্তু লাঠির উপর আর কিছু করার থাকত না। তবে লাঠির অধঃপতনে লেখকের হা-হুতাশও চাপা থাকেনি। তাঁর মতে পিনাল কোড-ই লাঠিকে তার জায়গা থেকে উৎখাত করেছিল।
সমসাময়িক কালে ১২৯২ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ‘কমলাকান্ত’ প্রবন্ধগ্রন্থের পরিশিষ্টে ‘কাকাতুয়া’ নামে বঙ্কিমের একটি প্রবন্ধ রয়েছে। প্রসন্ন গোয়ালিনীর খাঁচার কাকাতুয়া পাখিটি নাকি অন্যের বাসায় ঢুকতে গিয়ে ঠোক্কর খেয়ে প্রাণ হারাতে বসেছিল। ফলে কমলাকান্ত কাকাতুয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারেননি। তিনি কাকাতুয়াকে ‘পীনাল কোডের ৫১১ ধারানুসারে ষোল আনা চুরি এবং অনধিকার প্রবেশের দায়ে দায়ী’ সাব্যস্ত করেছিলেন। এটিই ছিল পিনাল কোডের শেষ ধারা। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার সুবাদে হাকিমি বা বিচার করতে হত বঙ্কিমকে। কাজেই পিনাল কোডের অনুচ্ছেদগুলি ছিল তাঁর নখদর্পণে।
বঙ্গসাহিত্য আকাশের ‘বাঁকা চাঁদ’কে ছেড়ে আসি রবির কথায়। ১৯০৮ সালের আষাঢ় মাসের ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘সমস্যা’ প্রবন্ধ। ঠিক আগের মাসেই ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘পথ ও পাথেয়’ প্রবন্ধের ধারাবাহিকতায় এই প্রবন্ধ রচিত হয়েছিল। মূল আলোচ্য, দেশহিতে দেশবাসীর কর্তব্য ও সাধনপন্থা। বঙ্গভঙ্গের রূপকার লর্ড কার্জনের দমনপীড়ন নীতির কঠোর সমালোচনা করেছিলেন প্রাবন্ধিক। বক্রোক্তির প্রয়োগ করে তিনি লিখেছিলেন, “কেবল ইংরেজদের রক্তচক্ষু পিনাল-কোডই ভারতবর্ষের শান্তিবর্ষণ করিতে পারে এত শক্তি ভগবান ইংরেজের হাতে দেন নাই।” এই কথা তুলনীয় হতে পারে বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে রচিত সেই বিখ্যাত গানের সঙ্গে— ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান/ তুমি কি এমনি শক্তিমান!/ আমাদের ভাঙাগড়া তোমার হাতে এমন অভিমান/ তোমাদের এমনি অভিমান।’
রবীন্দ্র-রচনাবলিতেও পিনাল কোডের কথা এসেছে। শান্তিনিকেতনে থাকতে ১৯১৬ সালের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ তিনি লিখেছিলেন ‘ভাষার কথা’ প্রবন্ধ, যা ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। এক বার রবীন্দ্রনাথ বাঙালির শিক্ষা বাংলা ভাষায় হওয়ার দাবি তুলে বহু বাঙালির বিরাগভাজন হয়েছিলেন। কবির সঙ্গে তৎকালীন শিক্ষিত বাঙালির মতান্তর মনান্তর হলেও থানা-পুলিশ হয়নি। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রাবন্ধিক বলেছিলেন, “এ জাতীয় মতের অনৈক্য ফৌজদারি দণ্ডবিধির মধ্যে পড়ে না।” বাংলার হয়ে লড়াইয়ে পিনাল কোডের বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার করতে তিনি ভোলেননি।
এ বার আসি সেই সাহিত্যিকের কথায়, যাঁর সাহিত্যকর্মে পিনাল কোডের চরম বিরোধিতা হয়েছে বলে মনে করে ইংরেজ সরকার পিনাল কোডের বলেই তা বাজেয়াপ্ত করেছিল। ১৯২৬ সালের অগস্টে প্রকাশিত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’। সেই বছরেরই ২ নভেম্বর বইটির বাজেয়াপ্তকরণ প্রসঙ্গে তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রসচিব প্রেন্টিস সাহেব আইপিসি-র ১২৪ক অনুচ্ছেদের উল্লেখ করেছিলেন। তাঁকে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার স্যর চার্লস টেগার্ট চিঠিতে লিখেছিলেন, “দি অথর অ্যান্ড দ্য প্রিন্টার টু বি প্রসিকিউটেড আন্ডার সেকশন ওয়ান টোয়েন্টি ফোর-এ অব দ্য ইন্ডিয়ান পিনাল কোড।” অ্যাডভোকেট জেনারেল বি এল মিত্র উপন্যাসটির আপত্তিকর অংশগুলি তুলে ১১ ডিসেম্বর ১৯২৬ সালে অভিমত দেন— “আই থিঙ্ক, দেয়ারফোর, দ্যাট দিস বুক কাম্স উইদিন দ্য স্কোপ অব সেকশন ওয়ান টোয়েন্টি ফোর-এ, আইপিসি, টু জাস্টিফাই অ্যাকশন আন্ডার সেকশন নাইন্টি নাইন-এ সিআরপিসি।” ১৯২৭ সালে বইটি বাজেয়াপ্ত হয়। বইতে যে ‘মুক্তিপথের অগ্রদূত’, ‘পরাধীন দেশের রাজবিদ্রোহী’ সব্যসাচীর প্রতি অপূর্ব যে ভাবে ‘শতকোটী নমস্কার’ জানিয়েছিলেন, তাতে এ রকম পুরস্কারই যে জুটবে তা নিশ্চিত ছিল। পুলিশ অফিসার নিমাইবাবু সে দিন সব্যসাচী প্রসঙ্গে রেঙ্গুনের জাহাজঘাটে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “এঁর বিরুদ্ধে কোন চার্জও নেই, অথচ যে চার্জ আছে তা আমাদের পিনাল কোডের কোহিনূর।”
এ বার এমন এক জন সাহিত্যিকের কথা, যাঁর চাকরিজীবন কেটেছে পিনাল কোডের আসামিদের নিয়ে। তিনি পেশায় ছিলেন কারাধিকারিক বা ডেপুটি জেলার। তাঁর প্রকৃত নাম চারুচন্দ্র চক্রবর্তী হলেও, জরাসন্ধ ছদ্মনামেই তিনি বেশি পরিচিত। যে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আজ সংগ্রহশালা হয়েছে, তার তত্ত্বাবধায়ক রূপে অবসর নেন তিনি। ‘দণ্ডিত বিচারক’ নামের একটি গল্পে লেখক স্বয়ং কথকরূপে উপস্থিত। পরিচিত অ্যাডিশনাল সেশন জজ নিখিল সেন এক জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও মন মানছে না। কিন্তু আইনের দৃষ্টিকোণ ব্যাখ্যা করে গল্পকার লিখেছেন, “ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা প্রমাণিত হলে তার দণ্ড মৃত্যু।”
নতুন নামে অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে। পুরনো আইপিসি-কে ছেড়ে মহামান্য জাস্টিস, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, উকিলের কলমকে নতুন সংহিতায় রপ্ত হতে হবে। কিন্তু যতই নামান্তর-অবস্থান্তর হোক, তা যেন ন্যায়বিচারপ্রার্থীদের কখনও আতান্তরে না ফেলে— সেটাই একমাত্র কাম্য।