ছবি: ‘কোয়েরেল’ সিনেমার পোস্টার থেকে। শিল্পী: অ্যান্ডি ওয়ারহল
প্রায় চল্লিশ বছর ধরে নানান দেশের নানা চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমার কাজে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কত স্বপ্নের পরিচালক, কত নাম-না-জানা পরিচালকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কত রকমের দর্শক দেখেছি। কোনও এক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ দেখানো হচ্ছে। সে দিন চতুর্থতম এবং শেষ স্ক্রিনিং। প্রথম থেকেই ছবিটি নিয়ে দর্শক ও মিডিয়ার উৎসাহের মাত্রা একটু বেশি রকমের ছিল। সব শেষে রাস্তা দিয়ে একা হেঁটে হোটেলে ফিরছি। শহরটা প্যারিস, আর সে বছর প্রচুর আলবেনিয়ান রিফিউজি ভিড় জমিয়েছে সে শহরে। পিছন থেকে ‘এ মিস্টার, এ মিস্টার’ ডাক শুনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তরুণ এক ফরাসি দর্শক আমি হল থেকে বেরনোর থেকেই আমার পিছু ধাওয়া করছেন। কাছে এসে ছবি নিয়ে দু-একটা কথার পর বললেন, ‘আমি একটি আলবেনিয়ান মেয়েকে চিনতাম। সতেরো-আঠারো বছর বয়স। ও চেয়েছিল ডাক্তার হতে, কিন্তু সে অনেক খরচের ব্যাপার বলে শুয়ে রোজগার করত, আর জমিয়ে রাখত সেই টাকা। আমার সঙ্গেও শুয়েছিল বেশ কয়েক বার। রিফিউজি মেয়েটি আমাকে বলত ওর স্বপ্নের কথা— ডাক্তার হবে, চিকিৎসা করবে, রুগির মুখে হাসি ফোটাবে আবার। আমি বোধহয় আস্তে আস্তে ভালবেসে ফেলেছিলাম ওকে। কিন্তু এক দিন ওকে আর খুঁজে পেলাম না। পরে জেনেছিলাম, ও খুন হয়ে গেছে। আপনার ছবিটা দেখতে দেখতে আমার বারবার ওর কথা মনে পড়ছিল।’ তার পর মিলিয়ে গেল ছেলেটি। মিলিয়ে গেল সেই শহর অন্য একটা শহরের মধ্যে।
আশির দশকের গোড়ার দিকের বার্লিন। ফেব্রুয়ারি মাস। একটানা বরফ পড়ে চলেছে কয়েক দিন ধরে। কিন্তু বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের তাতে কিছু এসে যাচ্ছে না। সেই বারও আমার ছবি আছে। আমারই বয়সি ওয়ের্নার ফ্যাসবিন্ডারের ছবি দেখে হল-এর উলটো দিকের একটা ক্যাফেতে সেঁধিয়ে গেলাম। দেখলাম, ফ্যাসবিন্ডার এবং আরও কয়েক জন ফিল্মমেকার বসে আছেন, যাঁরা প্রত্যেকেই আমার অল্পবিস্তর চেনা, আর ভলকার স্লনডর্ফ, রেইনহার্ড হফ তো তত দিনে একেবারে বন্ধু। ওদের সঙ্গেই বসলাম। কফি ও আড্ডার পর সবাই একে একে উঠে গেল। আমি আর ফ্যাসবিন্ডার তখনও বসে। কেমন উদ্ধত হাবভাব। উঠব-উঠব করছি, এমন সময় ফ্যাসবিন্ডার বললেন, ‘ছবিটা ভাল লাগেনি, না?’ আমি বললাম, না। কী করে যেন ওইটুকু সময়ের মধ্যেই ওঁর ঔদ্ধত্য আমাকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল। দুজনেই বাইরে বেরোলাম। ফ্যাসবিন্ডারের ছাতার তলায় ঢুকে পড়ে ওঁর সঙ্গেই আবার পৌঁছে গেলাম উলটো দিকের সিনেমা হল-এর ভেতর। এর পর মাঝে মাঝেই দেখা হয়েছে, অল্পস্বল্প আড্ডাও হয়েছে। কিন্তু সেই আড্ডা বন্ধুত্বের পর্যায়ে পৌঁছনোর আগে একটা দেয়াল এসে দাঁড়িয়েছে মাঝখানে। অথচ আমরা সমবয়সি। শেষ বার দেখা ভেনিসে। ওঁর ছবি ‘কোয়েরেল’ দেখে বেরিয়ে কফি খেতে বসেছি। মেজাজ একদম খিঁচড়ে আছে। কোনও সম্পর্কেই আমার আপত্তি নেই, তা যদি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসে আর সে সম্পর্ক শরীর ঘিরে অবশ্যই এগিয়ে যেতে পারে আরও অনেক দূর। বাইবেলে যদিও নিষেধ আছে, বলাই আছে যে পুরুষ এবং নারীর সম্পর্কের বাইরে সমস্ত কিছুই পাপ। কিন্তু মহাভারতে কৃষ্ণ-সুদামার সম্পর্কটা যে ঠিক কেমন ছিল, এ নিয়ে মাঝেমাঝেই আমি মাথা ঘামিয়েছি। কিন্তু ফ্যাসবিন্ডারের ‘কোয়েরেল’ দেখে, আমার অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসার জোগাড়। আর ঠিক হবি তো হ, পাশের খালি চেয়ারটায় এসে বসলেন ফ্যাসবিন্ডার। ওঁর জন্য কফির অর্ডার দিয়ে বললাম, তোমার ছবি দেখেই বেরচ্ছি। ‘ভাল লাগেনি তো?’ কফি খেতে খেতে ফ্যাসবিন্ডার জিজ্ঞেস করলেন। আমি আবার বললাম, না। ফ্যাসবিন্ডার বললেন, ‘কারওই ভাল লাগেনি।’ তার পর এটা-সেটা কথা হওয়ার পর ফ্যাসবিন্ডার উঠে গেলেন, বলে গেলেন, ‘আমি কাল সকালে বেরিয়ে যাচ্ছি, বার্লিন এলে জানিও।’ গিয়েওছিলাম বার্লিন, কিন্তু আর দেখা হয়নি। কোকেন আর ঘুমের ওষুধ খেয়ে কোথায় যেন কেটে পড়েছেন ফ্যাসবিন্ডার। মরে যাওয়াটা ওঁর কাছে ছিল বাঁয়ে হাত কা খেল!
সেই দিন একাই বসে ছিলাম বেশ কিছু ক্ষণ কফি শপে, তার পর দেখি তারকভস্কি হেঁটে যাচ্ছেন। ভীষণ ভাবে অনুরোধ করলাম আমার সঙ্গে এক কাপ কফি খাওয়ার জন্য। খানিক ক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে, মাপলেন। উনি জুরি, আর আমার ছবি কম্পিটিশনে আছে, অতএব নিয়মের বাইরের কোনও কথা বলেও বসতে পারি। তার পর কোথাও বোধহয় আশ্বস্ত হয়ে বসলেন আমার টেবিলে। কফি খেতে খেতে বললেন, ‘কোয়েরেল দেখলে?’ আমি কোনও রকমে মাথা নাড়লাম। কফির চুমুকের ফাঁকে-ফোকরে আড়চোখে দেখে নিচ্ছিলাম ওঁকে। ইনিই বানিয়েছেন ‘সোলারিস’, ‘মিরর’, ‘নস্টালজিয়া’-র মতো ছবি, যা দেখে দিনের পর দিন কেঁপে উঠেছি আমি। ‘পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর কী বলো তো? আকাশের চেয়েও সুন্দর, নদীর চেয়েও সুন্দর, গাছের চেয়েও সুন্দর?’ আমি তাকিয়ে থাকলাম ওঁর দিকে। উনি বললেন, ‘নারী। পুরুষ শরীরে আছেটা কী? নাথিং।’ বলেই উঠে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন।
এর কিছু কাল পরেই ‘স্যাক্রিফাইস’ শেষ করলেন তারকভস্কি। ক্যানসার ধরা পড়ল। চুয়ান্ন বছর বয়সে মারা গেলেন। ডায়রি লেখার অভ্যেস করেছিলেন, যা পরে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানেই একেবারে শেষের দিকে লিখছেন, ‘স্যানেটোরিয়ামের মাঠে জুতো মোজা খুলে খালি পায়ে হাঁটতে শুরু করলাম আর তখনই হঠাৎ ভীষণ ইচ্ছে করতে শুরু করল।’ প্লেনে করে যাচ্ছি সান ফ্রান্সিসকো থেকে হনলুলু। সামনে বসা দুই যুবক চার ঘণ্টার সেই উড়ানে চার হাজার বার চুমু খেল পরস্পরকে। পুরুষ শরীরে সত্যি কি কিছুই নেই! আছে তো। যাঁরা জানেন, তাঁরা কিছু ভুল জানেন না।
১৯৯৫ সাল। আবার বার্লিন। এ বার ‘চরাচর’। আমার সঙ্গে প্রতিযোগিতা বিভাগে আছে কিসলোস্কি, ওর ছবি ‘থ্রি কালার্স’-এর ‘রেড’ নিয়ে। কিসলোস্কির সঙ্গে আমার সখ্য বহু দিনের, দুজনেই প্রথম ছবি নিয়ে লোকার্নো শহরে গিয়েছিলাম। বার্লিনে, রাস্তা দিয়ে দেখছি একটা মিছিল যাচ্ছে। দেখি মিছিলের মধ্যে হাঁটছে কিসলোস্কিও, হাত নেড়ে আমায় ডাকল। আমি কিছু না বুঝেই ঢুকে পড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলাম, কীসের মিছিল এটা? কিসলোস্কি বলল, ‘গে রাইট্স।’ আমি বললাম, কিন্তু আমি তো গে নই। ও বলল, ‘তাতে কী? আমি তো গে। তুমি তো আমার বন্ধু। হাঁটতে বাধা কোথায়?’ আমি বললাম, তা বটে। কিসলোস্কি বলল, ‘ডেরেকের কথা শুনেছ তো?’ আমাদেরই আর এক বন্ধু ছিল ডেরেক জারমান। এড্স-এ মারা গিয়েছিল কয়েক মাস আগেই। সমকামী এবং নিরীশ্বরবাদী। অসামান্য ফিল্মমেকার, লেখক ও আরও অনেক কিছু। সেই দিনই হাঁটতে হাঁটতে কিসলোস্কি বলেছিল, আমি আর সিনেমা করব না, ভাল লাগছে না। খ্যাতির ওই চুড়োয় দাঁড়িয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ কথা নয়। ও-ও চলে গেল এর কিছু সময়ের মধ্যে। মাঝে মাঝে এদের কথা মনে পড়ে আর তাকাই এই সময়ের পরদার দিকে, আর এমন চূড়ান্ত মিডিয়োক্রিটি দেখে নীল হয়ে যায় শরীর। চেষ্টাগুলো সব কোথায় গেল! আর যৎসামান্য যা আছে তা নিয়ে চর্চাটাই বা কোথায়?
‘চরাচর’ করতে গিয়ে কানাঘুষোয় শুনেছিলাম, আমার ছবির নায়ক রজিত কপূর সমকামী। পরে অবশ্য ও আরও অনেকের মতোই সবাইকেই জানিয়েছে। শুধু রজিত কেন, আরও অনেক নারী ও পুরুষকেই আমি ঘনিষ্ঠ ভাবে চিনি যারা সমকামী। তারা দিব্যি বেঁচে আছে নিজেদের মতো, পাশের বাড়ির জানলা থেকে উড়ে আসা মন্তব্যের তোয়াক্কা না করেই। আসল বেঁচে থাকাটা লুকিয়ে থাকে কবিতায়, সুরে, চিত্রকলায় আর সিনেমায়।
আমার ধারণা, তারকভস্কি যদি আরও কিছু বছর বাঁচতেন, যে নারী বা যে পুরুষ তার সম-শরীরের মধ্যে রহস্য খুঁজে পান, তাদেরও নিশ্চয়ই বুঝতেন। সময় তো এ ভাবেই আমাদের বদলে দেয়।