অগ্নিগর্ভ: সুমাত্রায় অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম আগ্নেয় হ্রদ, লেক টোবা। মহাআগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ জুড়েই এর অবস্থান।
আজ থেকে প্রায় পঁচাত্তর হাজার বছর আগেকার কথা। সারা পৃথিবী জুড়ে তখন উষ্ণ-আর্দ্র উপভোগ্য আবহাওয়া। গ্রীষ্মের পর যেমন বৃষ্টি হয়, তেমনই চলছে। সময়ে শীতও আসে। তখনকার মানুষ তার প্রথম বিশ্ববিজয়ের উদ্দেশ্যে আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে এসে পৌঁছেছে ভারতের পশ্চিমে। অনেকটা পথ তারা ইতিমধ্যেই পেরিয়ে এসেছে। হঠাৎ প্রকৃতির এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন! সারা আকাশ অন্ধকার হয়ে গেল। পূর্ব দিক থেকে ঘন মেঘের মতো কী যেন এগিয়ে এসে ক্রমশ ঢেকে দিল আকাশ। দিন আর রাতের কোনও প্রভেদ নেই প্রায়। না আছে সূর্যের আলো, না আছে চাঁদের জ্যোৎস্না। রোদের অভাবে পৃথিবীর পূর্ব গোলার্ধের প্রায় সবটা ঠান্ডার কবলে পড়ল। থমকে গেল মানুষ, থমকে গেল তাদের অগ্রগতি। হিমযুগ তারা দেখেছে, সেটা মোকাবিলাও করেছে বুদ্ধি খাটিয়ে। কিন্তু এ তো সেই শৈত্যপ্রবাহ নয়, এ যেন এক নতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগ!
উৎস থেকে যাত্রা করে দেখতে দেখতে প্রায় তিরিশ হাজার বছর হয়ে গেল তারা জন্মদেশ আফ্রিকা থেকে বেরিয়েছে। আফ্রিকার পূর্ব উপকূল ধরে উত্তরে হেঁটে চলে এসেছে আরবীয় উপদ্বীপে। সময় লেগেছিল প্রায় কুড়ি হাজার বছর। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা হেঁটে চলেছে। যেন জীবনানন্দ দাশের সেই কবিতা, “হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে।” চলার পথে হাজার হাজার নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। জন্মস্থান থেকে অন্য দেশে পরিভ্রমণ মানুষের জীবনে সেই প্রথম। এর আগে তাদের পূর্বতন প্রজাতিরা আফ্রিকা ছেড়ে বেরিয়েছে। গেছে ইউরোপে, এশিয়ায়। সে অনেক পুরনো আমলের কথা। সেই মানবপ্রজাতি প্রকৃতির নানা খামখেয়াল সহ্য করেছে। কখনও প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহ— যখন হিমবাহে পৃথিবী ছেয়ে থাকে, সমুদ্রের জল কমে যায়, উন্মুক্ত হয় উপকূল এলাকার অনেকটা যা সমুদ্রের নীচে ছিল এক সময়, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে তুষারাবৃত থাকে উঁচু পাহাড়ের মাথা ও উচ্চ অক্ষরেখার অনেকটা। আবার এসেছে উষ্ণযুগ—কখনও সহনীয় গরম থেকে প্রচণ্ড গরম। সেই সব মানুষ তাদের বুদ্ধি দিয়ে আত্মরক্ষার পন্থা বের করে সেই সব অতিক্রম করে এসেছে। প্রযুক্তি বলতে উন্নত ধরনের পাথরের অস্ত্রশস্ত্র আর আগুনের ব্যবহার। পশুদের থেকে শিখেছে গুহাবাস, যা চরম প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাকে রক্ষা করেছে। মানব গণের শেষ প্রজাতি মানুষ। আজ থেকে মাত্র দু’লক্ষ বছর আগে তার উদ্ভব উন্নত মস্তিষ্ক নিয়ে। শুধু তা-ই নয়, সঙ্গে রয়েছে আগেকার সব প্রাণীর জিন। তাই তো তার বুদ্ধি এত প্রখর! স্মৃতিবহনের ক্ষমতাও ব্যাপক। আছে ইন্দ্রিয়ানুভূতিও। ক্রমশ রিপুরাও কাজ করতে শুরু করেছে। অবশ্য এ সব তাদের উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গেই আসেনি, তার জন্যে তাকে নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে।
এক লক্ষ বছর আগে আফ্রিকা ছেড়ে বেরোনোর আগে সে ঘুরে বেরিয়েছে আফ্রিকারই নানা জায়গা। চিনেছে মাটি, পাথর, জল। উঠেছে পাহাড়ে, নেমেছে নদীতে, সমুদ্রে। পরিচিত হয়েছে বিভিন্ন আবহাওয়ার সঙ্গে। আশপাশের অন্য মানব ও পশুর থেকে শিখেছে কঠিন আবহাওয়ায় কী করে বাঁচতে হয়, কী খেতে হয় এবং কী ভাবে আহরণ করতে হয়। নিজেদের মধ্যে আকারে-ইঙ্গিতে গলার স্বর পাল্টে পাল্টে যোগাযোগ করেছে। এই করতে করতে তৈরি হয়েছে গলকণ্ঠ খাঁচা, সেখানে অভিযোজিত হয়েছে স্বরযন্ত্র। এত সব সত্ত্বেও তাকে থমকে দাঁড়িয়ে যেতে হয়েছিল তার বিশ্বপরিক্রমায়, সেই পঁচাত্তর হাজার বছর আগে, যখন পৃথিবীর বুকে ছেয়ে গিয়েছিল সেই অদ্ভুত আঁধার এক। তারা সে দিন শুধু থমকেই যায়নি, পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের ফিরে যেতে হয়েছিল ভারতের পশ্চিম প্রান্ত থেকে আরও পশ্চিমে, যে পথে এসেছিল তারা। কী এমন হয়েছিল আবহাওয়ায় সে সময়? তখন তো উষ্ণযুগ চলছে। আবহাওয়া যথেষ্ট অনুকূল ও উন্নত। হিমযুগ এসেছে আরও পঁচিশ হাজার বছর পরে। তা হলে হঠাৎ কেন এই অন্ধকার! সূর্য উঠছে না, গরম হচ্ছে না পৃথিবী, দিনে ও রাতের তফাত নামমাত্র, রাতের আকাশে যে চাঁদ মাসে এক বার ঘুরে ঘুরে আসে, জ্যোৎস্নায় ভাসিয়ে দেয় পৃথিবী, মায়াময় করে তোলে, সেই চাঁদও অস্তমিত। চাঁদনি রাত নিয়ে তাদের আবেগ হয়তো ছিল না, কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক সেই আঁধার রাতে চাঁদ দেখে হয়তো তাদের মনে সাহস আসত, হয়তো কিছুটা আনন্দও পেত তারা।
ভূতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় জানা যায়, ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় এক ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি টোবা জেগে ওঠে এবং এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ-সহ অগ্ন্যুৎপাত হয়। উত্তর সুমাত্রা থেকে বিয়াল্লিশ কিলোমিটার দূরে ছিল এই টোবা পর্বত। বিস্ফোরণ চলেছিল আজ থেকে ৭৫,০০০ বছর আগে, আনুমানিক হাজার বছর ধরে। এই দীর্ঘ সময় ধরে ক্রমাগত গলিত লাভা বেরিয়ে চলে এবং জমে পাথর হয়। আঠারো লক্ষ বছরে টোবায় চার বার আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ হয়, কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে এটাই ছিল সবচেয়ে ভয়ানক। এতটাই এর শক্তি যে, পাহাড়ের মাঝখান ভেঙে ধস নেমে সেখানে ৩,৫০০ বর্গ কিলোমিটার বিশাল গর্ত তৈরি করে। আজকের টোবা লেক তারই স্মৃতি। নির্গত গলিত পাথরের পরিমাণ ২৮০০ ঘন কিলোমিটার, এর মধ্যে ৮০০ ঘন কিলোমিটার ছাই, যার ওজন হাজার হাজার টন। হালকা বলে এই বিশাল পরিমাণ ছাই ওপরে উঠে আকাশে ভেসে থাকে বহু বছর। পশ্চিমগামী বায়ুপ্রবাহে সেই ভাসমান ছাই বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের ওপর দিয়ে চলে এসেছিল ভারতের ওপর। এত ঘন সেই ছাই যে সূর্যের আলো তাকে ভেদ করতে পারেনি, ফলে পৃথিবীতে নেমে এসেছিল মহাতমসা। রোদ্দুর না আসায় পৃথিবী শীতল হয়ে ওঠে। অবশ্য বিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে গোটা পৃথিবীটাই তমসাচ্ছন্ন হয়েছিল কি না এবং আগ্নেয়গিরির ছাই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়েছিল কি না। অনেকের মতে আফ্রিকায় এই ছাইয়ের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে গ্রিনল্যান্ডে বরফ খুঁড়ে ওই সময় হাজার বছর ধরে অক্সিজেন আইসোটোপে যে হেরফের পাওয়া যায়, তাতে অনুমান করা হয় পৃথিবীতে তাপমাত্রা সেই সময় প্রায় হাজার বছর ধরে তিন থেকে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থেকেছিল। আকাশে সূর্য আড়াল করা ছাইয়ের জন্যে এই অন্ধকার ছেয়ে থাকে প্রায় এক দশক ধরে। ভাসমান ছাই প্রাকৃতিক নিয়মেই নেমে আসে পৃথিবীর মাটিতে। দূর হয় অন্ধকার, কিন্তু শীতল আবহাওয়া বজায় থাকে। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় পনেরো সেন্টিমিটার পুরু ছাইয়ের আস্তরণ পাওয়া যায়। ভারত মহাসাগর, আরব সাগর ও দক্ষিণ চিন সমুদ্রে ছাইয়ের স্তর পাওয়া গেছে।
আধুনিক মানুষের ইতিহাসে, ১৮১৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার মাউন্ট তাম্বোরায় হয়েছিল এক ভয়ানক অগ্ন্যুৎপাত। সে সময়ে আকাশে যে পরিমাণ ছাই ওঠে ও ভেসে থাকে, তার জন্যে উত্তর গোলার্ধে এক বছর গ্রীষ্মকাল বলে কিছু ছিল না। বলা হয় টোবার অগ্ন্যুৎপাতের ভয়াবহতা তার একশো গুণ। ওই রকম সময়ে, মানে সত্তর হাজার বছর আগে নাগাদ সময়ে মানুষের জনসংখ্যা বিপজ্জনক রকম কমে যায়। তার প্রধান কারণ সূর্যের আলোর অভাবে গাছপালার মৃত্যু এবং তৃণভোজী প্রাণীদের খাদ্যাভাবে অকালমরণ। ফলমূল, প্রাণী সব কিছুরই সংখ্যা কমে যাওয়ায় খাবারের হাহাকার ও সঙ্কট চরমে ওঠে। শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাং, চিতা, বাঘ সমেত মানুষের সংখ্যাও কমে যায়। মাত্র সাত থেকে দশ হাজার সংখ্যক মানুষ তখন জীবিত। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা ভারতের দক্ষিণ ও পশ্চিমে ওই পুরু ছাই স্তরের নীচে ও ওপরে প্রাচীন পাথুরে অস্ত্র পেয়েছেন, যা থেকে মনে করা হয়, মানুষ ওই হঠাৎ পরিবর্তিত আবহাওয়ার আগে যেমন ছিল, দুর্যোগ কেটে গেলে আবার ফিরেও এসেছিল। তবে তারা তাদের জীবনধারণ ও অভ্যেস বদলাতে বাধ্য হয়েছিল, বদলেছিল খাদ্যাভ্যাস, অবাধ ঘোরাফেরা। অনেকে মনে করেন, এই পরিবর্তন মানুষকে ‘নিজে বাঁচো’ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুললে তারা তখনও বর্তমান তাদের পূর্ব প্রজাতির মানবদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতে শুরু করে এবং হত্যা করে। অথচ বহু কাল তারা সহাবস্থান করেছে, যৌন সম্পর্কও হয়েছে।
পৃথিবীর অভ্যন্তরে পুঞ্জীভূত বল পাথরের ফাটল ধরে বেরিয়ে এলে মাটি কেঁপে ওঠে, হয় ভূমিকম্প। পৃথিবীর অভ্যন্তরে ম্যান্টল হোল আসলে গলিত পাথরের গুদামঘর, প্রায় ২৮৫০ কিলোমিটারের স্তর। গভীর ফাটল ধরে ম্যান্টল থেকে ওপরে উঠে আসে লাভা, জমা হয় পৃথিবীর ওপরের স্তরে। সেখানে বল ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়, মুক্তির পথ খোঁজে, ফাটিয়ে দেয় পাথর। সেই ফাটল ধরে বেরিয়ে আসে লাভা, কখনও ধীর গতিতে গড়িয়ে পড়ে পাহাড়ের গা বেয়ে, আবার কখনও তীব্র বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয় পাহাড়ের মুখ। ভূমিকম্পের মতো আগ্নেয়গিরির অবস্থানও প্রধানত সমুদ্রে। বর্তমানে জীবন্ত আগ্নেয়গিরির সংখ্যা আটশো। সেই গিরি যখন সমুদ্র থেকে মাথা তোলে, তখন সেগুলো আগ্নেয় দ্বীপ।
আধুনিক মানুষের প্রাচীন সভ্যতা বাসা বেঁধেছিল গ্রিসের দক্ষিণে ভূমধ্যসাগরের সান্তোরিনি দ্বীপে। সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ভয়ঙ্কর অগ্ন্যুৎপাতে গোলাকৃতি এই আগ্নেয় দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে যায় এবং কিছু অংশ সমুদ্রের নীচে চলে গিয়ে অর্ধচন্দ্রাকৃতি চেহারা নেয়। তিন হাজার ছ’শো বছর আগে মিনোয়াঁ সভ্যতা গড়ে উঠেছিল এই দ্বীপে এবং অগ্ন্যুৎপাতে দ্বীপের একাংশের সঙ্গে সেই সভ্যতাও হারিয়ে যায়। ইন্দোনেশিয়াতেই ১৮৮৩ সালে ক্রাকাতোয়ায় ভয়ঙ্কর অগ্ন্যুৎপাতে সারা পৃথিবী জুড়ে গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা কমে যায় এবং আবহাওয়ার ওপর যথেষ্ট প্রভাব পড়ে। ২০১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর ক্রাকাতোয়া আগ্নেয়গিরি আবার জেগে ওঠে এবং ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে দ্বীপের একাংশে ধস নেমে সমুদ্রে পড়ে। ফলে সুনামি আছড়ে পড়ে সুমাত্রার উপকূলে এবং শতাধিক লোকের প্রাণনাশ হয়।
সান্তোরিনির অগ্ন্যুৎপাত সাড়ে তিন হাজার বছর আগে একটা গোটা দ্বীপের সভ্যতা মুছে দিয়েছিল, টোবা অগ্ন্যুৎপাত পঁচাত্তর হাজার বছর আগে মনুষ্য সমাজের সঙ্ঘবদ্ধ অভিযাত্রা থমকে দিয়েছিল, রুখে দিয়েছিল মানুষের প্রথম বিশ্বজয়ের প্রয়াস। আজও এক অদৃশ্য ভাইরাস থামিয়ে দিয়েছে অত্যাধুনিক মানুষের অবাধ গতি। প্রকৃতির এই খামখেয়ালি স্বভাব মানুষ তখনও বুঝত না, আজও বুঝতে পারেনি। মানুষ তার ক্ষুদ্র জ্ঞানে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে নিজের অহঙ্কার আরোপ করে নিজের সর্বনাশই ডেকে আনছে।