মে ১৮৩০। গ্রীষ্মের দুপুর যেন আরও তপ্ত হয়ে উঠল গোলদিঘি চত্বরে। সংস্কৃত কলেজে আন্দোলন শুরু করেছেন আয়ুর্বেদের ছাত্ররা। এক সহপাঠীকে শিক্ষক নিযুক্ত করার প্রতিবাদে আন্দোলন। সে কালের ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ এই আন্দোলনের কথা জানাচ্ছে, ‘শ্রীযুত খুদিরাম বিশারদ কর্ম্মে রহিদ হইলে তৎপদে তাঁহার এক ছাত্র শ্রীযুত মধুসূদন গুপ্ত নিযুক্ত হওয়াতে অন্য ছাত্রেরা সমাধ্যায়ির নিকট পাঠ স্বীকার না করাতে কালেজাধ্যক্ষ মহাশয়েরা তাঁহারদিগের প্রার্থনা পূর্ণ না করাতে সকলে কালেজ ত্যাগ করিয়াছেন...।’
আয়ুর্বেদ বিশারদ খুদিরামবাবু ৩০ এপ্রিল শিক্ষকতার কাজে অব্যাহতি নেন এবং মেধাবী ছাত্র মধুসূদন গুপ্তকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করার সুপারিশ করেন। কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্তে অটল থাকায় আন্দোলন নতজানু হল। আর যাঁকে শিক্ষকের আসন এগিয়ে দিয়েছিলেন খুদিরাম, সেই মধুসূদন গুপ্ত বছর তিনেকের মধ্যেই হয়ে উঠলেন শারীরসংস্থানবিদ্যা বা অ্যানাটমির খ্যাতিমান শিক্ষক। যে সহপাঠীরা আন্দোলনে নেমেছিলেন, তাঁরাই হলেন তাঁর বন্ধু-ছাত্র।
১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে হুগলির বৈদ্যবাটীর কবিরাজ বংশে জন্ম মধুসূদনের। ছেলেবেলায় বড্ড অবাধ্য, একগুঁয়ে ছিলেন, কৈশোরে পালিয়ে যান বাড়ি ছেড়ে। খোঁজ মেলে ১৮২৪-এ, সংস্কৃত কলেজের ছাত্র তখন। বৌবাজার এলাকায় একটি ভাড়াবাড়িতে শুরু হয়েছে ‘কলিকাতা সংস্কৃত কলেজ’-এর পঠনপাঠন। ১৮২৬-এ সংস্কৃত কলেজ বর্তমান ভবনে স্থায়ী ঠিকানা পেল। ১৮২৭-এ চালু হল বৈদ্যক (আয়ুর্বেদ) বিভাগ— ‘মেডিক্যাল ক্লাস ইন দ্য সংস্কৃত কলেজ’— সাত জন ছাত্র নিয়ে, মধুসূদন যার অন্যতম। তাঁদের শিক্ষক ছিলেন খুদিরাম বিশারদ।
১৮৩৫-এর জানুয়ারি মাসে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হলে সংস্কৃত কলেজের বৈদ্যক শ্রেণির বিলুপ্তি ঘটল। কিন্তু মধুসূদন থেকে গেলেন স্বমহিমায়। সাহেব চিকিৎসকরা অ্যানাটমিতে তাঁর গভীর মেধার স্বীকৃতি স্বরূপ ডা. ব্রামলি, ডা. গুডিভ-এর মতো সাহেবের সঙ্গে তাঁকে সহ-শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করলেন। অ্যালোপ্যাথির চিকিৎসক হিসেবে প্রথাগত ডিগ্রি তখন তাঁর ছিল না। শিক্ষকতা করতে করতেই ১৮৪০-এ পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে এই ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
১৮৩৫-এর ১৭ মার্চ মধুসূদন শারীরবিদ্যা ও শল্যবিদ্যা বিভাগের ডেমনস্ট্রেটর হিসেবে যোগ দিলেন মেডিক্যাল কলেজে। এ দেশের চিকিৎসকদের সামনে তখন সবচেয়ে বড় সমস্যা শব ব্যবচ্ছেদ। মানুষের চিকিৎসা করতে হয় তাঁদের, অথচ মানুষের শব ব্যবচ্ছেদ করতে পারেন না তাঁরা। পশুর দেহ ব্যবচ্ছেদ করে কোনও রকমে চিনতে হয় শরীরের অভ্যন্তর। কুসংস্কার-আচ্ছন্ন সমাজ ছুঁতে দেয় না মৃত মানবদেহ। ডাক্তারি-ছাত্ররাও মেনে নেন এ সব। মধুসূদন এর বিরোধিতা করলেন। শিক্ষাদানে অসুবিধাও হচ্ছিল সাহেব শিক্ষকদের। এক দিন ডা. গুডিভ পড়ানোর টেবিলে একটি শবদেহ রেখে দীর্ঘ ক্ষণ ছাত্রদের বোঝালেন শব ব্যবচ্ছেদের গুরুত্ব। তবু জড়তা কাটে না ছাত্রদের। এগিয়ে এলেন মধুসূদন। ১৮৩৬-এর ১০ জানুয়ারি ছুরি হাতে মধুসূদন ব্যবচ্ছেদ করলেন শবদেহ। এ দেশে প্রথম। তৈরি হল ইতিহাস। কিন্তু উচ্চবর্ণের হিন্দুরা খেপে উঠল। শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন, ‘সেকালের লোকের মুখে শুনিয়াছি এই মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ লইয়া সে সময়ে তুমুল আন্দোলন উপস্থিত হইয়াছিল।’ জাতধর্ম না জেনে মৃতদেহ ছোঁয়া এবং কাটাকুটির জন্য জাতিচ্যুত করা হল মধুসূদনকে। কিন্তু দমানো গেল না। নব্যবঙ্গের নেতৃবৃন্দ পাশে দাঁড়ালেন। ওই বছর ২৮ অক্টোবর মধুসূদনের অনুপ্রেরণায় চার জন ছাত্র— রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারিকানাথ গুপ্ত, উমাচরণ শেঠ এবং নবীনচন্দ্র মিত্র এগিয়ে এলেন শব ব্যবচ্ছেদে। ক্রমে পিছু হঠল সমাজপতিরা। তথ্য বলছে, ১৮৩৭ সালে ৬০টি মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ হয় এখানে।
শুধু কি শব ব্যবচ্ছেদ? মধুসূদন ১৮৪৯-এ ‘লন্ডন ফার্মাকোপিয়া’ এবং ‘অ্যানাটমিস্ট’স ভাদি মেকাম’-এর বাংলা অনুবাদ করেন। ১৮৫২-তে মেডিক্যাল কলেজে বাংলা শ্রেণি খোলা হলে তার সুপারিনটেন্ডেন্ট হন তিনি। ১৮৫৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘অ্যানাটমি’ নামে তাঁর অমূল্য গ্রন্থ। ‘সুশ্রুত’-ও সম্পাদনা করেন বলে জানা যায়। ১৮৫৬-র ১৫ নভেম্বর মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সেই প্রয়াত হন মধুসূদন গুপ্ত।