Lord Byron

পৌরাণিক নায়কের মতোই সাঁতরে উত্তাল সমুদ্র পেরিয়েছিলেন তিনি

কবিতার রোমাঞ্চকর নানা অভিযাত্রার কারণেই তিনি ছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তাঁর কবিতার প্রভাব এসে পড়েছিল সুদূর কলকাতাতেও।

Advertisement

সত্যরঞ্জন দাস

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০২৪ ০৭:৩৬
Share:

লর্ড বাইরন।

দিনটা ছিল ১৮২৪ সালের ১৯ এপ্রিল। পশ্চিম গ্রিসের মিসোলঙ্গি শহরে ইস্টারের উৎসব চলছিল। সন্ধ্যার সময় দুঃসংবাদ আছড়ে পড়ল, ইংরেজ কবি লর্ড বায়রন আর বেঁচে নেই। সে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে কবি মাসতিনেক আগে মিসোলঙ্গিতে হাজির হয়েছিলেন। ফেব্রুয়ারিতে এক বার জ্বরে ভুগেছিলেন, এপ্রিলে দ্বিতীয় বারের জ্বরে কাহিল হয়ে পড়েছিলেন তিনি। ব্যক্তিগত চিকিৎসক আর পরিচারকের অক্লান্ত চেষ্টা সত্ত্বেও পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে গড়িয়েছিল। শোকের মুহূর্তে গ্রিসে ইস্টারের উৎসব বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হল। বিপ্লবীদের একটি সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন সাঁইত্রিশে পা দেওয়া কবি। তাই তাঁর প্রয়াণে সাঁইত্রিশ বার তোপধ্বনি করা হল। কবির মৃতদেহ চার্চে নিয়ে গিয়ে কালো কাপড়ে ঢেকে তার উপর রাখা হল হেলমেট ও তরবারি, মাথায় পরানো হল লরেল পাতার মুকুট। শোকস্তব্ধ মিসোলঙ্গি শহরের কথা বলতে গিয়ে কবির এক বন্ধু লিখেছিলেন, গোটা শহরে যেন কবরস্থানের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। শোক পালন হল তিন সপ্তাহ ধরে।গ্রিসে বায়রনের এক সহযোদ্ধা, কবির ব্যক্তিগত ডাক্তার আর বিশ্বস্ত পরিচারক ফ্লেচার— তিন জনে মিলে উদ্যোগ নিলেন কবির মৃতদেহ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। ও দিকে বেদনাহত গ্রিকরা ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, গ্রিসের জাতীয় নায়ক হয়ে ওঠা মানুষটির কিছু স্মৃতি তাঁদের দেশেও থাকুক। কেউ কেউ মনে করেন, বায়রনের দেহ ইংল্যান্ডে আনা হলেও ময়নাতদন্তের জন্য শব ব্যবচ্ছেদের সময় তাঁর হৃৎপিণ্ডটি মিসোলঙ্গিতে সমাধিস্থ করা হয়। অনেকে এমনও বলেন, বায়রনের ফুসফুস এবং স্বরযন্ত্রটি নাকি চেয়ে নিয়েছিলেন গ্রিসের মানুষ, কারণ সে যুগের সেলেব্রিটি এই কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল গ্রিসের স্বাধীনতার জোরালো দাবি।

Advertisement

ভিনদেশি এক কবির সম্মানে কোনও দেশে বছরের একটি দিন তাঁর নামে চিহ্নিত, এমন উদাহরণ কমই। ২০০৮-এ এমনটাই হয়েছে গ্রিসে। সে দেশের সরকার প্রতি বছর ১৯ এপ্রিল দিনটিকে ‘বায়রন দিবস’ হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গ্রিসের বহু শহরে বায়রনের নামে রাস্তা আছে, তাঁর সুন্দর প্রতিকৃতি বা স্মারকও রয়েছে কোথাও কোথাও।

একুশ বছর বয়সে বায়রন যখন প্রথম গ্রিসে গিয়েছিলেন, তখনই দেশটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। রোম্যান্টিক যুগের কবি আগে থেকে গ্রিক পুরাণের প্রতি অনুরক্ত তো ছিলেনই, গ্রিসের স্থাপত্য-ভাস্কর্যও তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। সে সময় তিনি লিখছেন তাঁর ‘চাইল্ড হ্যারল্ড’স পিলগ্রিমেজ’ কবিতাটি। কবিতাটি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। সে কবিখ্যাতি এমনই আকস্মিক ছিল যে, বায়রন লিখেছিলেন, “এক সকালে ঘুম ভেঙে উঠেই দেখলাম, আমি বিখ্যাত হয়ে গেছি।” বলেছিলেন, “কবি যদি আমি হয়েই থাকি, তবে গ্রিসের হাওয়া বাতাসই আমাকে কবি করেছে।”

Advertisement

ইউরোপ জুড়ে খ্যাতিমান বায়রন দ্বিতীয় বার গ্রিসে গিয়েছিলেন সে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিতে। পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে অটোমান সম্রাটদের শাসন চলছিল সেখানে। ইংল্যান্ডের রোম্যান্টিক যুগের স্বাধীনতা স্পৃহার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল কবি বায়রনের জীবন ও কবিতায়। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা না থাকলেও বায়রন গ্রিসের স্বাধীনতার লড়াইয়ে এক নিঃস্বার্থ সৈনিক হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে পড়েছিলেন। জীবনের শেষ পর্বে তাঁর অর্থ, শ্রম, সময় অকুণ্ঠচিত্তে উৎসর্গ করেছিলেন গ্রিসের জন্য। গ্রিসের মুক্তির স্বপ্ন দেখতে দেখতেই বেপরোয়া কবি অকালে প্রাণ হারান সে দেশে। তাঁর অকালমৃত্যু গ্রিসের বিবদমান নানা গোষ্ঠীর নেতাদের অনুপ্রাণিত করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের মুক্তি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে। ইউরোপের বহু দেশ গ্রিসের লড়াইকে সক্রিয় ভাবে সমর্থন করে। এক দিন গ্রিস স্বাধীন হয়। বায়রন লিখেছিলেন, “যাঁরা মহান আদর্শের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেন, তাঁরা কখনও ব্যর্থ হন না।” কবির সে বাণী বিফল হয়নি।

বায়রনের প্রথম গ্রিস সফরে, গ্রিসের শান্ত মনোরম নিসর্গ তাঁর চোখ জুড়িয়ে দেয়। ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত থাকাকালীন লর্ড এলগিন পার্থেননের মার্বেল পাথরের তৈরি বেশ কিছু অপরূপ ভাস্কর্য ইংল্যান্ডে নিয়ে এসেছিলেন। তাই নিয়ে বায়রন অসন্তোষ প্রকাশ করেন তাঁর কবিতায়। গ্রিক পুরাণের ট্রয় নগরীটি ঠিক কোথায় ছিল, তা দেখতে এক দিন তিনি হাজির হন হেলেসপন্টের সাগরসৈকতে। আবার গ্রিক পুরাণের বহুশ্রুত প্রেমকাহিনির নায়ক লিয়েন্ডার প্রতি রাতে এই সাগরপ্রণালী পেরিয়ে ও পারে যেত প্রেয়সী হিরোর সঙ্গে মিলিত হতে। লিয়েন্ডারের দুঃসাহসিক সেই সাঁতারের কাহিনি দুর্দান্ত সাঁতারু বায়রনকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাই তিনিও হেলেসপন্টের উত্তাল সমুদ্র সাঁতরে পার হয়েছিলেন। নিজের সাঁতারের সেই অভিনব কৃতিত্ব নিয়ে কবিতাও লিখেছিলেন তিনি। তাঁর লেখা ‘ডন জুয়ান’ কবিতায়ও সে ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। পুরাণ ও ইতিহাসখ্যাত ওই জায়গাটির নাম এখন বদলে হয়েছে ডার্ডানেলেস। ২০১০ সালের মে মাসে বায়রনের সাঁতার কাটার দু’শো বছরও সেখানে পালন করা হয় ঘটা করে।

বায়রনের ভালবাসার দেশ গ্রিস দাসত্বের শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত হয়ে আছে, এই ব্যাপারটা কবির কাছে ছিল বেদনার। ‘চাইল্ড হ্যারল্ড’স পিলগ্রিমেজ’ হোক, বা কয়েক বছর পর লেখা ‘দি আইল অব গ্রিস’ কবিতাই হোক, সর্বত্রই বায়রন গ্রিকদের অতীত গৌরবের কথা স্মরণ করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের শৃঙ্খলমোচনের প্রেরণাও দিয়েছিলেন। ছাত্রাবস্থায় ধ্রুপদী গ্রিক-চর্চা তো ছিলই, গ্রিসে থাকাকালীন আধুনিক গ্রিক ভাষা শিখতে ‘টিউটর’-এরও সাহায্য নিয়েছিলেন তিনি। গ্রিকদের তিনটি দেশপ্রেমের গান তিনি ইংরেজিতে অনুবাদও করেছিলেন।

কবি দ্বিতীয় বার গ্রিসে গিয়েছিলেন সে দেশের মুক্তি আন্দোলনের সমর্থকদের সনির্বন্ধ অনুরোধে। সবার আশা ছিল, বায়রনের মতো ইউরোপ-খ্যাত এক ব্যক্তিত্বের সমর্থনে গ্রিকদের আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগবে। বায়রন তাঁর ব্যক্তিজীবনে নানা সমস্যায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে দেশ থেকে স্বেচ্ছানির্বাসনে গিয়ে বছর সাতেক কাটান সুইৎজ়ারল্যান্ড, রোম এবং ইটালির নানা স্থানে। আমোদপ্রমোদের পাশাপাশি জীবনের সেরা কাব্যগ্রন্থ ‘ডন জুয়ান’-এর ষোলোটি খণ্ডও সম্পূর্ণ করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তাও যেন মন টিকছিল না। গ্রিকদের লড়াইয়ে যোগ দেওয়ার প্রস্তাবে ভবিষ্যৎ জীবন আরও অর্থপূর্ণ ভাবে কাটানোর সুযোগ এসে গেল তাঁর সামনে। গ্রিসের নেতাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে প্রথমেই নিজের চার হাজার পাউন্ড ব্যয় করলেন গ্রিক যুদ্ধজাহাজগুলো মেরামতির জন্য। সে টাকার বর্তমান মূল্য কয়েক কোটি টাকা। ইংল্যান্ডে তাঁর যে মূল্যবান সম্পত্তি ছিল, তাও তিনি গ্রিসের জন্য বিক্রি করে দেন। মিসোলঙ্গিতে পৌঁছে বায়রন তুর্কিদের দখল করে রাখা এক দুর্গ আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু অভিযান শুরুর আগেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। বায়রনের স্বদেশ ইংল্যান্ডে ছিল গ্রিসের প্রচুর সমর্থক। তাঁদের থেকে গ্রিসের জন্য নিয়মিত অর্থসাহায্যও সংগ্রহ করতেন তিনি। কিন্তু আকস্মিক অসুস্থতার কাছে হার মানেন তিনি।

ইংল্যান্ডে বায়রনের মৃত্যুসংবাদ পৌঁছলে সর্বত্র বিষাদের ছায়া নেমে আসে। কবির প্রয়াণে বহু পত্রপত্রিকা তাঁকে সে যুগের সেরা কবি বলে সম্মান জানিয়ে শোকপ্রকাশ করে। দু’মাস সমুদ্রযাত্রার পর দেশে কবির মৃতদেহ পৌঁছলে তাঁর সুহৃদরা তাঁকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে সমাধিস্থ করতে চাইলেন, যেখানে চসার বা স্পেন্সারের মতো কবিদের সমাধি। কিন্তু বায়রনের ব্যক্তিগত জীবন যথেষ্ট বিতর্কিত হওয়ায় ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের কর্তৃপক্ষ তাঁকে সেখানে সমাধিস্থ করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। শেষে নটিংহ্যামশায়ারে পারিবারিক সমাধিস্থলে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।

আটাশ বছর বয়স পর্যন্ত নিজের দেশে ছিলেন বায়রন। খ্যাতি আর বিতর্ক, দুই-ই তাড়িয়ে বেড়িয়েছিল তাঁকে। প্রেমে পড়েছিলেন বার বার। অনেক বিবাহিত নারীর সঙ্গেও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কুৎসা আর বদনাম জীবনকে করেছিল দুর্বিষহ। শুধু নারী নয়, পুরুষদের সঙ্গেও বায়রন যৌন সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন বহু বার। অনেকে মনে করেন, আশৈশব এক বিষাদ তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। বিষণ্ণতার রাহুগ্রাস থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টায় হয়তো বার বার এমন প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তেন তিনি।

মৃত্যুর আট বছর আগে, ১৮১৬ সালে বায়রনকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। জনরোষ থেকে বাঁচতেই নাকি তিনি পালিয়েছিলেন। বিদেশেও নানা সম্পর্কের জালে জড়িয়েছিলেন দুঃসাহসী কবি। জীবনের শেষ দিকে লেখা তাঁর ‘ডন জুয়ান’ কবিতার নারীসঙ্গপিয়াসী নায়কের মধ্যে বায়রনের পরিষ্কার ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। তবে স্পেনের লোককথার লম্পট ডন জুয়ান বায়রনের চোখে ধরা দেয় এমন এক যুবক হিসেবে, যে নিজেই নারীদের ছলাকলার শিকার। বায়রনের নিজের জীবনে অবশ্য অনেক বার এমনটাই ঘটেছিল। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে লেডি ক্যারোলিন পুরুষের ছদ্মবেশও ধারণ করেছিলেন। তিনি যখন দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন, তখনও তাঁকে এক পলক দেখার জন্য অনুরাগিণীর দল হন্যে হয়ে ছুটেছে, ছদ্মবেশও নিয়েছে।

দু’শো বছর আগেই বায়রনের বোহেমিয়ান জীবনযাত্রা, তাঁর কবিতার রোমাঞ্চকর নানা অভিযাত্রার কারণে তিনি ছিলেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। দেশে শুধু নয়, দেশের বাইরেও। ‘চাইল্ড হ্যারল্ড’স পিলগ্রিমেজ’ কবিতার প্রথম দু’টি খণ্ডের পাঁচশো কপি তিন দিনে বিক্রি হতে হইচই পড়ে গিয়েছিল। তৃতীয় খণ্ড যখন প্রকাশিত হয়, এক সপ্তাহের মধ্যে তার সাত হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায়। সঙ্গীত, চিত্রকলা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছিল এ কবিতা। ‘দ্য করসেয়ার’ কবিতার বইটি এখন তেমন গুরুত্ব না পেলেও প্রকাশের দিনেই বইটির দশ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। আরও মাসখানেকের মধ্যে বিক্রি হয় পঁচিশ হাজার কপি। তাঁর সেরা কাব্যগ্রন্থ ‘ডন জুয়ান’ যখন প্রকাশিত হয়েছিল, সে বইয়ের নকলে ভরে গিয়েছিল বাজার। অনুরাগীদের কাছ থেকে শয়ে শয়ে চিঠি আসত তাঁর ঠিকানায়। মহিলা অনুরাগী ছিলেন অসংখ্য। তাঁদের অনেকেই আত্মনিবেদনের জন্য ছিলেন উন্মুখ। পরকীয়ার জন্য বায়রনের বিয়েও ভেঙে যায় ঠিক এক বছরের মাথায়। ক্ষিপ্ত স্ত্রী অ্যানাবেলা স্বামীকে ঘিরে যে তুমুল উন্মাদনা লক্ষ করেছিলেন, তার নাম দিয়েছিলেন ‘বায়রোম্যানিয়া’— বায়রন এবং ম্যানিয়া এই দুই শব্দ মিলিয়ে।

বায়রনের বিপুল জনপ্রিয়তা সুদূর কলকাতাতেও আছড়ে পড়েছিল। ১৮১৯ সালে বায়রনের কিছু ছোট কবিতা বেরিয়েছিল ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ পত্রিকায়। পরের বছর জানুয়ারি মাসে তিন থেকে পাঁচ তারিখ পর্যন্ত ‘ডন জুয়ান’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড ছাপা হয়। পাঠকমহলে বায়রনের কবিতার চাহিদা এমনটাই ছিল যে, প্রথম দু’দিন পুরো পত্রিকা জুড়ে ‘ডন জুয়ান’ ছাপা হয়। বায়রনের প্রয়াণে শোকগ্রস্ত গ্রিক মানুষজন কলকাতার গ্রিক চার্চে বায়রনের শেষকৃত্যের আয়োজন করেন।

এ দেশের কবিদের উপর বায়রনের গভীর প্রভাব ছিল। হেনরি ডিরোজ়িয়ো লিখেছিলেন ‘ডন জুয়ানিক’ নামে একটি কবিতা। তাঁর বিভিন্ন কবিতায় বায়রনের কবিতা উদ্ধৃত করেন তিনি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্মেছিলেন বায়রনের মৃত্যুর বছরেই। কলেজে পড়তে গিয়ে বায়রনের একনিষ্ঠ ভক্ত হন তিনি। তাঁর লেখা ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’ অথবা ‘বঙ্গভূমির প্রতি’র মতো কবিতা শুরু হয়েছিল বায়রনের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বা নবীনচন্দ্র সেনের মতো বহু কবির কবিতাতেও দেখা গিয়েছিল বায়রনের প্রভাব। ‘বঙ্গদর্শন’-এর ১৮৭৪ সালের আশ্বিন সংখ্যায় পাওয়া যায় এই মন্তব্য, “বায়রণকে অনুকরণ করতে দেখা যাচ্ছে সর্বত্র।” রবীন্দ্রনাথও উনিশ শতকের বাঙালির বায়রন-প্রীতির কথা লিখেছেন। মাইকেল মধুসূদন বন্ধু গৌরদাসকে লিখেছিলেন, বায়রনের মৃত্যুর কথা পড়ে কী ভাবে তাঁর চোখের জল বাঁধ মানেনি। প্রমথ চৌধুরীর ‘প্রগতিরহস্য’ নামে সরস গল্পটিতে, ইংরেজি সাহিত্যের অনুরাগী বাঞ্ছারামের শেষ সময়ের বিবরণ দিয়েছেন লেখক। বাঞ্ছারামকে দেখতে হাজির হন ইংরেজিনবিশ উকিল ও ডাক্তার বন্ধুরা। এক ডাক্তার বাঞ্ছারামের নাড়ি পরীক্ষা করে মনের যন্ত্রণা প্রকাশ করতে বায়রনের ‘ডন জুয়ান’ কবিতার লাইন আউড়েছিলেন। আর ডাক্তারের গলায় বায়রনের কবিতা শুনে শেষ মুহূর্তে বাঞ্ছারামের গলায় নাকি শোনা গিয়েছিল, ‘লং লিভ বায়রণ।’ বাঞ্ছারাম ও তাঁর বন্ধুদের মতো বাঙালির অভাব সে যুগে ছিল না এই বঙ্গভূমিতে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement