প্রতিভাময়ী: বাঁ দিকে, দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে উমা।
মার্চ মাসের ঘটনা। ১৯৩৮ সাল। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং উপলক্ষে অন্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে গাঁধীজি রয়েছেন কলকাতায় শরৎচন্দ্র বসুর উডবার্ন পার্কের বাড়িতে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাড়ির ছাদে প্রার্থনাসভা। সঙ্গীতস্রষ্টা, শিল্পী, চিন্তাবিদ দিলীপকুমার রায়ের যাতায়াত ছিল সেখানে। গাঁধীজি গান শোনার ইচ্ছে প্রকাশ করলে এক দিন দিলীপকুমার তাঁর এক প্রিয় শিষ্যাকে নিয়ে গেলেন। সতেরো বছরের রোগা, লাজুক মেয়েটি নম্র সুরেলা কণ্ঠে শোনাল মীরার ভজন— ‘মেরে তো গিরিধর গোপাল’। শুনে গাঁধীজি মোহিত। সঙ্গে সঙ্গে স্বহস্তে লিখে তাকে উপাধি দিলেন ‘নাইটিঙ্গেল অব বেঙ্গল’। বাংলার বুলবুল এই কিশোরীর ডাকনাম ‘হাসি’। সে নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন তিনি। রেকর্ড বা অন্যত্র, সব জায়গাতেই লেখা হত কুমারী উমা বসু (হাসি)। শুধু বাংলা নয়, সারা ভারত জুড়েই এই সুধাকণ্ঠী সঙ্গীতশিল্পীর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল দ্রুত। অথচ মাত্র একুশ বছর বয়সে দিলীপকুমারের এই মানসকন্যার অতর্কিত প্রস্থান গানের জগৎকে বিমূঢ় করে দিয়েছিল বইকি! আসা ১৯২১-এর ২২ জানুয়ারি, যাওয়াও একই তারিখে, সাল ১৯৪২— ‘জন্মদিন মৃত্যুদিন দোঁহে একাকার।’ প্রসঙ্গত দিলীপকুমারেরও জন্মদিন ২২ জানুয়ারি।
এক অভিজাত পরিবারে হাসির জন্ম। বাবা ধরণীকুমার বসু পেশায় স্থপতি, তা ছাড়া কলিকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ছিলেন। মা প্রভা বসু। ছোটবেলা থেকেই হাসি গানের ভক্ত। এক বার আট বছর বয়সে মাসির সঙ্গে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে আব্দুল করিম খাঁর গান শুনতে গিয়ে হাসি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ে। গানের অমোঘ টানে লেখাপড়া বেশি দূর এগোয়নি। পরে অবশ্য এক প্রাইভেট স্কুলে ইংরেজি ভাষা শেখেন মিস বি হার্লের কাছে। প্রতিবেশী কুমুদেশ সেনের সূত্রে সে কালের নামী শিল্পী হরেন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে সঙ্গীতে তালিম শুরু। কিছু দিনের মধ্যেই গুরু বুঝতে পারেন ছাত্রীর প্ৰতিভা। বেতারে ছাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে হরেনবাবু গাইলেন অতুলপ্রসাদ সেনের ‘মেঘেরা দল বেঁধে যায়’। ১৯৩২ সালের জুনে রেকর্ডও বেরিয়ে গেল, এক পিঠে হরেনবাবুর একক কণ্ঠে অতুলপ্রসাদের ‘কে তুমি বসি নদীকূলে’, অন্য পিঠে গুরু-শিষ্যার ‘ও আকাশ বল আমারে’।
হাসি একক ভাবে তাঁর প্রথম রেকর্ডে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচালনায়, ‘সেই ভাল সেই ভাল’ ও ‘তোমার সুর শুনায়ে’। ১৯৩৫-এর জানুয়ারিতে প্রকাশিত এই রেকর্ড সম্পর্কে রেকর্ড-তালিকায় লেখা হয়েছিল— ‘কুমারী উমা বসু আমাদের রেকর্ড-জগতে নবাগতা। শীত-অন্তে ফাল্গুন-বনে প্রথম পিক-কূজনের মতো মিঠে এর কণ্ঠস্বর। সহজ লীলায়িত স্বরভঙ্গি এঁর কণ্ঠের সবচেয়ে বড় প্রসাদ।... রবীন্দ্রনাথের মধুর-সুর মধুর-বাণী দুটি গান নিয়ে এঁর শুভাগমন। আমাদের শুভ্র-শুচি শিল্পী শতদলে এঁর স্থান হবে অক্ষয়...’ এঁদের এই বিশ্বাস সত্যে পরিণত হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে হাসির পরিচয় আগেই ঘটেছিল। হয়তো এই রেকর্ডের নেপথ্যে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা ছিল। ন’বছর বয়সে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে শিবনাথ শাস্ত্রীর কন্যা হেমলতা সরকারের বাড়ি নর্থভিউতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। হাসির গলায় ‘এখনও গেল না আঁধার’ শুনে তাঁকে কোলে টেনে নিয়েছিলেন কবি। পরে হাসিকে গানও শিখিয়েছিলেন ‘মনে কি দ্বিধা’।
এরই মধ্যে হরেন চট্টোপাধ্যায়ের মাধ্যমে হাসির পরিচয় হয় দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে। এক জন প্রকৃত শিল্পী খুঁজছিলেন দিলীপকুমার তাঁর গানের জন্যে। হাসির গান শুনে তাঁর মনে হল এই সেই শিল্পী। তার পর তাঁর সঙ্গীতসৃষ্টির ফল্গুধারা বইল যেন। দিলীপকুমারের গানের যথার্থ আধার হয়ে উঠলেন প্রতিভাময়ী হাসি।
হাসির গলায় দিলীপকুমারের গান বিষয়ে ১৯৩৭ সালের সেপ্টেম্বরে দিলীপকুমারকেই এক চিঠিতে যখন জানান রবীন্দ্রনাথ— ‘হাসির কাছ থেকেই তোমার গান শুনেছিলুম। তার গলায় রস আছে।’— তার মধ্যে অতিকথন ছিল না। হাসির একটি রেকর্ড সম্পর্কে গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ড-তালিকা পুস্তিকায় (অক্টোবর, ১৯৩৮) একই সুরে রবীন্দ্রনাথের কথা বিজ্ঞাপিত হয়েছিল— ‘আঁধারের এই ধরণী’ গানটি খুব ভালো লাগল। ওর কণ্ঠে রস আছে...।
দিলীপকুমারকে এক বার কথাপ্রসঙ্গে হাসিকে নাচ শেখানোর কথাও বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। হাসির গানে অতুলপ্রসাদও মুগ্ধ হয়েছিলেন। হাসিকে শিখিয়েছিলেন ‘ডাকে কোয়েলা’। স্থপতি পিতার কথা ভেবে হাসির গান সম্পর্কে বলেছিলেন : ‘কংক্রিটের মধ্যে যে ঝরনা প্রবাহিত হচ্ছে।’ এক বার নেতাজি সুভাষচন্দ্রকেও গান শুনিয়েছিলেন হাসি, দিলীপকুমারের সঙ্গে।
রেকর্ডে নানা রচয়িতার নানা ধরনের গান গাইলেও হাসির প্রধান আশ্রয় দিলীপকুমার রায়ের গান। সে গান কথায়-সুরে-ছন্দে একেবারেই অন্য গোত্রের। বিশেষত, অভিনব অপ্রত্যাশিত স্বরবিন্যাসে, তান-অলঙ্কার প্রয়োগে দিলীপকুমারের সুর স্বভাবতই স্বতন্ত্র। উপরন্তু তাঁর নিজস্ব গায়ন। একের পর এক গান শিখিয়ে হাসিকে রেকর্ড করিয়েছেন, স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর বিশেষ গায়নের ছায়া পড়েছে হাসির গানে। একক ভাবে ও দিলীপকুমারের সঙ্গে যুগ্মকণ্ঠে হাসি গেয়েছেন দিলীপকুমারের রচনা, তা ছাড়া দিলীপকুমার সুরারোপিত অন্যান্য কবির রচনাও। দিলীপকুমারের কথায়-সুরে ‘বুলবুল মন’, ‘জীবনে মরণে এসো’, ‘নীলপরী’, ‘রূপে বর্ণে ছন্দে’, ‘মধু মুরলী বাজে’ বা ‘আঁধারের ডোরে গাঁথা’ হাসির সুরেলা কণ্ঠের লালিত্যে প্রাণময় হয়ে উঠেছিল। একই ভাবে উল্লেখযোগ্য কবি নিশিকান্তর লেখা ‘আঁধারের এই ধরণী’ (দিলীপকুমারের তত্ত্বাবধানে প্রথম রেকর্ড), ‘তব প্রণয় পুলক’ আর অজয় ভট্টাচার্যের ‘ফোটে ফুল’। হাসির গান সম্পর্কে দিলীপকুমারের একান্ত অনুভব— ‘তার মুখে আমার নানা সুর ও গান শুনে সে যে কী আনন্দ পেতাম— সত্যিই মনে হত— এ ঠাকুরের করুণা।... তার কিন্নরী কণ্ঠের নানা ভাব দোলা মীড়— সর্বোপরি হৃদয়াবেগের স্পন্দন আমাকে সত্যি অভিভূত করত।’ সুরসাগর হিমাংশু দত্তের সুরে গাওয়া হাসির ‘চাঁদ কহে চামেলি গো’ (কথা: সুবোধ পুরকায়স্থ) ও ‘আকাশের চাঁদ মাটির’ (কথা: সুনির্মল বসু) দু’টি কাব্যগীতিই হৃদয়ছোঁয়া। হিমাংশু দত্তর সুরে ভজনও রেকর্ড করেন হাসি। লক্ষণীয় যে, এ সব গানে হাসির গায়নে ‘দৈলীপি’ ধরন অনেকটাই অনুপস্থিত। কাব্যগীতি, ভজনের সঙ্গে সঙ্গে গজল এবং ঠুমরিও হাসির কণ্ঠে প্রাণ পায়। আবার জসীমউদ্দীনের কথায়-সুরে গাওয়া লোকসঙ্গীত ‘রাধা ব'লে ভাইরে’ বা ‘জল দেখিতে’ একটুও বেমানান লাগে না। হাসির গান শুনে আর এক স্মরণীয় শিল্পী সাহানা দেবী যথার্থই বলেছিলেন: ‘এমন গলা বাঙালি মেয়েদের মধ্যে আমি তো আর শুনিনি। এত মিষ্টি, এত সুরেলা...’
শেষ দিকে হাসি উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে প্রথাগত তালিম পেয়েছিলেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। তৎকালীন পন্ডিচেরি যাওয়ার আগে সে-ও ঠিক করে দিয়ে যান দিলীপকুমার। কিছু দিন ভীষ্মদেবের নিবিড় তালিমে হাসি নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করেন, আরও পরিণত হয়ে ওঠেন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত হাসির প্রাণ হয়ে ওঠে। তবে ভীষ্মদেবও পন্ডিচেরি চলে যাওয়ায় ফের তাতে ছেদ পড়ে। ভীষ্মদেবের সঙ্গে তাঁর অবশ্য চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল। নিজেকে ভাল করে তৈরি করলেও হাসি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের রেকর্ড করেননি, এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।
শেষ দু’-আড়াই বছরে হাসি নানা ভাবে আঘাত পেলেন। ১৯৩৯-এর জুলাই মাসে এক জলসায় যোগ দেওয়ার জন্য শিলং থেকে শিলচর যাওয়ার পথে বাস দুর্ঘটনায় মারা গেলেন বাবা ধরণীকুমার। সেই বাসে হাসির পরিবারের সঙ্গে ছিলেন দিলীপকুমার রায়, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, পাহাড়ী সান্যাল প্রমুখ। এক বছর বাদে টাইফয়েডে চলে গেল একমাত্র ভাই বাবুল। মানসিক ভাবে একেবারে ভেঙে পড়লেন হাসি। শারীরিক অসুস্থতাও ছিল।
১৯৪১ সালের মে মাসে শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ হল হাসির। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সঙ্গীতবোদ্ধা অশোক মিত্রের মতে হাসি ‘যথার্থই গান গেয়ে-গেয়ে ক্ষয়ে গেলেন।’ এখানে গানের জন্যে হাসিকে দিলীপকুমারের অতিরিক্ত চাপের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন অশোকবাবু। যা হোক, দিলীপকুমার পন্ডিচেরি থেকে কলকাতায় এসে দেখে গেলেন তাঁর প্রাণপ্রিয় শিষ্যাকে। শয্যাপার্শ্বে গুরুর সুরে সুর মিলিয়ে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে হাসি গেয়েছিলেন: ‘এসো কাছে যবে আঁখি মুদিব হে শেষে/...জীবনে মরণে থেকো হে আমার পাশে।’ কলকাতায় আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় হাওয়া বদলের জন্যে হাসিকে নিয়ে যাওয়া হয় রাঁচি। সেখানেই প্রয়াত হলেন ক্ষণজন্মা এই প্রতিভা, তারিখ ছিল ১৯৪২ সালের ২২ জানুয়ারি।
হাসির অকাল প্রয়াণের পর দিলীপকুমারকে শ্রীঅরবিন্দ চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘...তার অকালমৃত্যু ও দুঃখকষ্ট হয়ত তার প্রারব্ধ ছিল। ...তার প্রতিভার পূর্ণিমার পথে মেঘ এসে হানা দিল।’
তথ্যঋণ : সুধাকণ্ঠী উমা বসু, রুনু বসু সম্পাদিত, সুচেতনা, ২০০৫