সময়টা ১৯৪২। কলকাতার অভিজাত রেস্তরাঁ ফারপোজ়-এ এক চা-পানের আড্ডায় কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বন্ধু আবু সয়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এক পঞ্জাবি-তনয়ার, মিস বাসুদেব। তার কিছু দিন আগে প্রকাশিত, রাজেশ্বরী বাসুদেব নামে এক জনের রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে’ শুনে মুগ্ধ আইয়ুব তরুণীকে প্রশ্ন করেন, “রাজেশ্বরী বাসুদেব আপনার কেউ হন?”
অতঃপর যখন জানলেন তিনিই রাজেশ্বরী, আইয়ুবের বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে তাঁর প্রিয় শিল্পী সামনেই বসে! রাজেশ্বরী বাসুদেব (দত্ত) এক ব্যতিক্রমী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, আবার সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়েও উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন, অথচ প্রায় অনালোচিত। তাঁর জন্মশতবার্ষিকীও চলে গেছে নীরবে। জন্ম ১৯১৮-র ১৭ এপ্রিল (মতান্তরে ১৯২০, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান অনুযায়ী)। বাবা অর্জুনদাস বাসুদেব ছিলেন লাহৌর হাই কোর্টের বিচারক। লাহৌরেই কেটেছে রাজেশ্বরীর স্কুল-কলেজ জীবন। বারো বছর বয়সেই শুনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনের কথা, যেখানে মেয়েরাও গান শেখে। সে কালে সামাজিক কারণেই মেয়েদের গান শেখা সহজ ছিল না। স্নাতক হওয়ার পর সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের মেধাবী ছাত্রী রাজেশ্বরী এক রকম জোর করেই শান্তিনিকেতনে চলে আসেন সঙ্গীতশিক্ষার জন্য। সেটা ছিল ১৯৩৮ সাল। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত চার বছরের শিক্ষাক্রমে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখেন শান্তিদেব ঘোষ, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, ইন্দুলেখা ঘোষ, অমিতা সেন (খুকু) প্রমুখের কাছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছেও তালিম পেয়েছিলেন। রবিলিপিকর সুধীরচন্দ্র করের লেখায় পাওয়া যায়, ‘(গুরুদেব) উদয়নের একতলায় সামনের চাতালে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বসে গান শেখাচ্ছেন সঙ্গীতভবনের ছাত্রী রাজেশ্বরী দেবীকে। গেয়েই চলেছেন। কণ্ঠে আকুলতা কুল মানছে না। পুরনো গান— ‘আমার পরান লয়ে...’। কখনও গাইতেন— ‘বড়ো বেদনার মতো...’।” (কবিকথা)। সে সময় শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন নৃত্যনাট্যে গানে অংশ নিয়েছিলেন রাজেশ্বরী। প্রথম রেকর্ডও শান্তিনিকেতনে বাসকালেই ১৯৪১-এ। বর্ষামঙ্গলের জন্যে ১৯৩৯-এ কবির লেখা ‘আজি তোমায় আবার’ ও ‘বাদলদিনের প্রথম কদম ফুল’ গেয়েছিলেন।
শান্তিনিকেতন পর্বেই রাজেশ্বরীর জীবনে ঘটে যায় এক বিশেষ ঘটনা। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের জ্যেষ্ঠতাতপুত্র সুমন্ত্র মহলানবিশের বাড়িতে পরিচয় হয় কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে। রাজেশ্বরীর ‘ফুল বলে ধন্য আমি’ শুনে সে দিন সুধীন্দ্রনাথ মোহিত। সুধীন্দ্রনাথ বিবাহিত, কিন্তু কিছু দিন ধরেই বনিবনা হচ্ছিল না প্রথমা স্ত্রী ছবি দত্তের সঙ্গে, একটা দূরত্বও তৈরি হয়েছিল, এ রকম সময়ে রাজেশ্বরীর সঙ্গে দেখা। ঘনিয়ে উঠল প্রেম। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩, দু’জনের মধ্যে বহু পত্রবিনিময় হয়। সুধীন দত্তের স্ত্রী বর্তমান, উপরন্তু দু’জনের মধ্যে বয়সের ফারাক অনেকটা— এ সব নিয়ে অনেক টানাপড়েনের পর ১৯৪৩-এর ২৯ মে লাহৌরে বিবাহ।
শান্তিনিকেতনের পর রাজেশ্বরী কলকাতায় গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী, যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিলেও রেকর্ডে গেয়েছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতই। বেশির ভাগ রেকর্ডই ‘হিন্দুস্থান’-এ। প্রধানত খেয়াল-ঠুংরি-টপ্পা ধরনের দুরূহ রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতিই তাঁর বরাবর পক্ষপাত। চর্চিত উজ্জ্বল কণ্ঠ, উচ্চারণ অবাঙালিসুলভ নয়, অলঙ্করণ-প্রয়োগও নিপুণ। উপস্থাপনায় আবেগের আতিশয্য নেই, বরং যেন একটু নিস্পৃহতা। রবীন্দ্রগানের অন্তর্লীন বেদনা ঠিকই ধরতে পারেন ‘আজি যে রজনী যায়’, ‘কখন বসন্ত গেল’, ‘চিরসখা হে’, ‘শেষ গানেরই রেশ’— এমন সব গানে। রমেশচন্দ্রর সঙ্গে দ্বৈত গান ‘আমার মাথা নত করে’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তবে কোনও কোনও গানে, যেমন— ‘কিছুই তো হল না’, ‘এ পরবাসে’, সুরবিহার করেছেন যা স্বরলিপিতে নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ সব পছন্দ করতেন না, তার অবকাশও রাখেননি। হয়তো সঙ্গীতগুরু রমেশচন্দ্রের প্রশ্রয় এর পিছনে কাজ করেছে। কিন্তু রেকর্ডগুলি বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতি অনুমোদিত, তাই সুরান্তরগুলি সংশ্লিষ্ট স্বরলিপিতে থাকা উচিত। ছবির জন্যও রেকর্ড করেছিলেন। প্রণব দে-র সঙ্গীত পরিচালনায় ‘প্রিয় বান্ধবী’ (১৯৪৩) ছবির জন্য গেয়েছিলেন। ‘তোমার আমার এই বিরহের’ ও অনিল বাগচীর পরিচালনায় ‘ভগিনী নিবেদিতা’-র (১৯৬২) জন্য ‘আমার জীবনপাত্র’— ছবি দু’টির নেপথ্য শিল্পী তালিকায় রাজেশ্বরীর নাম ছিল না।
রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে গেয়েছেন লন্ডনের অ্যালবার্ট হল-এ, সরবন ও রোমায়। গত সত্তরের দশকে রবীন্দ্র সদনে একটি অনুষ্ঠানে শিল্পী ছিলেন তিন জন— দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও রাজেশ্বরী দত্ত। গানের আগে রাজেশ্বরী জানালেন, বিদেশে গানের ব্যাপারে একটু হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, লন্ডনে হেমন্তর সঙ্গে দেখা হতে হেমন্ত খুব উৎসাহ জুগিয়েছিলেন।
রাজেশ্বরীর গানের বহু অনুরাগীর এক জন কবি বিষ্ণু দে। সুধীন দত্তের বাড়ি যেতেন অনুজ বিষ্ণু দে। মতপার্থক্য থাকলেও দু’জন দু’জনকে শ্রদ্ধা করতেন। বিষ্ণু গেলে, কোনও দিন সুধীন্দ্রনাথ সেজে আসতে বলেন রাজেশ্বরীকে, কোনও দিন বলেন, “বিষ্ণু তোমার গান পছন্দ করে।” গুণমুগ্ধ বিষ্ণু রাজেশ্বরীর উদ্দেশে লিখেছিলেন এক অসামান্য কবিতা, ‘পরকে আপন করে’।
গান ছাড়াও ভাষা, সাহিত্য বিষয়ে রাজেশ্বরী ছিলেন উৎসাহী। ফরাসি, ইটালীয়, জার্মান ভাষা শিখে এই সব ভাষার কিছু কবিতা অনুবাদ করেন সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে। ক্রিস্টিন বসনেকের সঙ্গে ফরাসিতে অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’। ১৯৬০ সালে সুধীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর রাজেশ্বরী নিজেকে সক্রিয় রেখেছিলেন। ১৯৬৩ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরি সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা, ১৯৬৫-তে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি, সব শেষে ১৯৬৯-এ লন্ডনে এসওএএস (দ্য স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ়)-এ ভারতীয় সঙ্গীত ও সঙ্গীততত্ত্বের শিক্ষকতা।
১৯৭৫-এ দেশে ফেরা কিছু কাজ নিয়ে। কিন্তু কাজ ফেলে রেখে হঠাৎই বিদায়, ১৯৭৬-এর ১০ এপ্রিল কলকাতার এক নার্সিংহোমে তাঁর মৃত্যু হয়।
এ প্রসঙ্গে জ্যোতির্ময় দত্তের অভিজ্ঞতা, “দেশময় রাজেশ্বরীর অসংখ্য ভক্ত, কিন্তু তাঁকে বিদায় দেওয়ার সুযোগ কেউ পেল না।... শ্মশানে ছুটলাম... জানলাম দাহ হয়ে গেছে।... সুধীন্দ্রের ভাইয়ের বাড়ির প্রায় উল্টোদিকে থাকতেন সত্যজিৎ রায়। রাজেশ্বরী আর সত্যজিৎ শান্তিনিকেতনে সমসাময়িক ছিলেন, খুব বন্ধুও ছিলেন দু’জনে। সত্যজিৎ আমাকে বলেছিলেন ‘আশ্চর্য! একটা খবরও পেলাম না।’ নিঃশব্দে চলে গেলেও রয়ে গেল তাঁর গান, যে-গান শুনে বিষ্ণু দে-র মনে হয়েছিল ‘মানুষেরই গান শুনে প্রাণ ভরে, মনে হয়/ সকলই সম্ভব আহা সকলই সম্ভব...’ বলেছিলেন, ‘গান করো, পরকে আপন করো তবে’।”
কৃতজ্ঞতা : অমিয় দেব, সুব্রত সিন্হা, প্রণব বিশ্বাস