ছবি: কুনাল বর্মণ
শৈশবের কথা মনে হলেই টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়া ফুলে ভরা দুটো গাছের সারি মনে পড়ে। সারি দুটো গিয়েছিল চা বাগানের সাহেব ম্যানেজারের বাংলোর দিকে। সেই সুরকি-বিছানো পথে দিয়ে চলত পাদানিওয়ালা, ক্যানভাসের আচ্ছাদন দেওয়া গাড়ি— সাহেব ম্যানেজারদের বাহন। সেই চা বাগানের নাম ছিল পাহাড়গুমিয়া চা বাগান, বাগডোগরা থেকে বেশি দূর নয়।
সেই বাগান অন্যান্য চা বাগানের মতোই ছিল ছাঁটাই করা চা গাছের সবুজ সৌন্দর্যে ভরা। মাঝে মাঝে রেন ট্রি। এই চমৎকার সবুজ সৌন্দর্যের অন্তরালে কী বিপুল শ্রম ছিল, তখন বুঝতাম না। সাধারণত মদেশিয়া শ্রমিক, যাদের বলা হত কুলি, তাদেরই শ্রমে চা বাগানের সৌন্দর্য, বাগানের ব্যবসায়িক উৎপাদনশীলতা। এক দিন এক সাহেব ম্যানেজার— যিনি বাবার প্রতি বিশেষ প্রীতিপরায়ণ ছিলেন— রোষাবিষ্ট হয়ে এমন এক লাথি ছুড়লেন যে এক শ্রমিকের মৃত্যু হল। এই সব চা বাগান ছিল সমস্ত আইনের বাইরে। এই অপরাধের জন্য কোনও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবা হয়নি, যেন এ এক অতি সাধারণ ঘটনা।
আমিও এই কুলিদের শ্রমশীলতার সৌভাগ্যে ভাগ্যবান ছিলাম। সাইকেল চালাতাম কিন্তু প্যাডেল করতাম না, কুলি বালকেরা ঠেলে ঠেলে আমাকে সাইকেল চড়াত। তাদের বস্তিগুলো ছিল অপরিচ্ছন্ন। আমাদের কোয়ার্টার্সের পিছনে একটা গোয়ালঘর ছিল। সেই গোয়ালঘর থেকে গরু চরাতে বেরোত ওই কুলি বালকেরা। চা বাগানে থাকাকালীন প্রচুর দুধ খাওয়ার চল ছিল বাড়িতে।
মা-কাকিমারা পৌষপার্বণে প্রচুর পিঠে করতেন। আশেপাশের চা বাগান থেকে বাঙালি ভদ্রলোকেরা আমন্ত্রিত হয়ে খেতে আসতেন। মহিলাদের আসতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এমন নয় যে নিয়মিত দুধ খাওয়ার এই স্বাস্থ্যকর অভ্যাসের ফলে কোনও দিন অসুখ হয়নি। এক বার এক প্রাণঘাতী অসুখ হয়েছিল, তার নাম শুনেছিলাম ‘ব্ল্যাক ওয়াটার’, ডাক্তারি নাম জানি না। তখন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে একটা গাছ এনে লাগানো হয়েছিল বাগানের দফতরের সামনে। সেই গাছ থেকে যে নির্যাস আমাকে খাওয়ানো হয়েছিল তাতে এমন কিছু অমৃত ছিল যা পরবর্তী কালে আমাকে আর কোনও বড় অসুখে পড়তে দেয়নি।
বাবা ছিলেন চা বাগানের প্রধান করণিক। ম্যানেজারের খুব প্রিয়পাত্র। পরের ম্যানেজার এসে মনে করলেন যে বাবা অনেক অবৈধ সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। বাবাকে তিনি বরখাস্ত করেন। বাবা আমার লেখাপড়ার জন্য শিলিগুড়িতে বসবাসের সুযোগসুবিধে রেখেছিলেন। এই ঘটনার পরে তিনি নিজেও সেখানে চলে আসেন।
যত দূর মনে পড়ে, বাবা ইংরেজি ভালই লিখতেন। কিন্তু অন্য বই পড়ার দিকে বিশেষ আগ্রহ ছিল বলে মনে পড়ে না। তবে বাবার আলমারিতে তখনকার জজসাহেব পান্নালাল বসুর ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলার বিস্তারিত রায়টি পুস্তকাকারে ছিল। বাবা সেটা আগ্রহ করে পড়েছিলেন। কারণ সেই সময়ে ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা একটা অতি উত্তেজক মামলা ছিল। বাবার ছিল একটা গ্রামোফোন। পরে আমার ভাগ্নের দৌলতে সেটা চোঙহীন হয়। সেই গ্রামোফোনে ছোটবেলায় শুনেছি কৃষ্ণচন্দ্র দে’র গান। বিশেষ করে মনে পড়ে ‘কুঞ্জ সাজায় দে লো, ঐ বুঝি বঁধূ এল’ গানটি। আরও দু-এক জন মহিলা শিল্পীর গানও মনে পড়ে, বিশেষ করে কমলা ঝরিয়ার গান।
মায়ের পরিবার ছিল পড়াশোনা আর নাটকের পরিবার। পরে শুনেছি, আমার যশোরের বাসিন্দা দাদু যখনই কোনও কাজে কলকাতা যেতেন, নাটক না দেখে ফিরতেন না। বিশেষ করে তাঁর আগ্রহ ছিল শিশির ভাদুড়ীর অভিনয়ে। আমার দিদিমা যশোর প্রাইমারি স্কুলের পরীক্ষায় প্রথম স্থানাধিকারী হয়ে সোনার মেডেল পান, সেটা আজও পরিবারে সুরক্ষিত আছে। বড়মামাও খুব ভালবাসতেন নাটক করতে। প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’ ছবির গান তাঁর গলাতেই আমি প্রথম শুনি।
মামাদের বাড়িতে উপেন্দ্রকিশোর সম্পাদিত ‘সন্দেশ’ পত্রিকা নেওয়া হত। এক বার নৌকা করে আসতে গিয়ে সেই পত্রিকাগুলো নষ্ট হয়ে যায়। বাবার নিজের সাহিত্যে ঝোঁক না থাকলেও মা’র পড়ার প্রতি ভালবাসা ছিল। সেটার প্রতি বাবারও গভীর সম্মান ছিল। তিনি মা’কে ‘মাসিক বসুমতী’ ও ‘ভারতবর্ষ’-এর গ্রাহক করে দিয়েছিলেন। সেগুলি চমৎকার ভাবে বাঁধানো ছিল, তাতে সোনার জলে মায়ের নাম লেখা। দুই আলমারি ভর্তি সেই পত্রিকাগুলো আমি বাবার ইজ়িচেয়ারে শুয়ে সারা দুপুর অনর্গল পড়তাম। দীনেন্দ্রকুমার রায়ের গোয়েন্দা গল্প আমাকে আকর্ষণ করত না একেবারেই। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তাম তিমিরবরণের লেখা ‘উদয়পথের সহযাত্রী’। তাতে ছিল উদয়শঙ্করের নাচের দলের ইউরোপ ভ্রমণের বিবরণ। দেরিতে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে, তিমিরবরণ ভাবছেন তার দিকে বুঝি খারাপ কিছু ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে, পরে দেখছেন শুধু ফুল আর ফুল। নরওয়ে বা সুইডেনের রাজা রাজাসনে বসে উদয়শঙ্করের অসিনৃত্যের অনুকরণ করছেন। এই লেখাতেই প্রথম পড়ি প্যারিসের সাঁজেলিঁজে রাস্তার বিবরণ। রাস্তার সামনেই আর্ক দ্য ট্রায়াম্ফ। বহু বছর পরে সেই আলোকোজ্জ্বল রাস্তায় দাঁড়িয়ে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম, মনে পড়ে গিয়েছিল তিমিরবরণের লেখা। আরও মনে পড়ে, হলিউডের একটি সিনেমায় সোভিয়েট রাশিয়াকে বিদ্রুপ করা হয়েছিল। প্যারিসের ওই আলোকোজ্জ্বল রাস্তায় দাঁড়িয়ে সোভিয়েট রাশিয়ার মহিলা রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন ‘ওয়েস্টেজ অব ইলেকট্রিসিটি’। আর বুঝে না বুঝে পড়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিখ্যাত গণিতজ্ঞ দেবপ্রসাদ ঘোষের বাংলা বানান নিয়ে বিতর্ক। দেবপ্রসাদ রাজনীতিতে এবং বাংলা বানানের ব্যাপারেও রক্ষণশীল ছিলেন। এই বিতর্কটি অনেক পরে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রকাশ করেছিল বলে মনে পড়ে। দেবপ্রসাদ ঘোষের প্রতি আকর্ষণের আরও একটা কারণ, তিনি রংপুরের কারমাইকেল কলেজে অধ্যক্ষ থাকাকালীন আমাদের স্কুলে দু’বার পুরস্কার বিতরণ করেন। তাঁর হাত থেকে যে পুরস্কার নিয়েছিলাম, ভাবতে ভাল লাগে।
বাবা আমাকে তৎকালীন তরাইয়ের একমাত্র হাই স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল, আমাকে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করা হোক। নিয়ামুদ্দিন স্যর পরীক্ষা করে বললেন, আমি ক্লাস ফোরে ভর্তি হওয়ার উপযুক্ত। ক্লাস ফোরে ভর্তি হওয়ার ফলে আমার পরবর্তী জীবনে এক অসামান্য বন্ধুলাভ হয়। না হলে তাকে সারা জীবন সমীহ করে ‘দাদা’ বলেই ডেকে যেতে হত। নিয়ামুদ্দিন স্যরের আরও দুটি ঘটনা মনে পড়ে। ১৯৪২-এর অগস্ট আন্দোলনের সময় এক বিরাট মিছিল ৯ সেপ্টেম্বর তারিখে স্কুলে ঢুকে পড়ে। হেডমাস্টারমশাই ঢংঢং করে নিজের হাতে ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে দেন। আর নিয়ামুদ্দিন স্যর একতলার শিকহীন জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পালিয়ে যান। আর এক বার রেলস্টেশনের ধারে পোড়া কয়লার স্তূপে পড়ে আমি আহত হই। নিয়ামুদ্দিন স্যর যত্ন করে ওষুধ লাগিয়ে দেন। আমৃত্যু সেই পোড়া চিহ্ন শরীরে থাকবে, নিয়ামুদ্দিন স্যরের স্মৃতি নিয়ে।
ক্লাস ফোরের ঘরটায় ছিল দুটো অংশ। এক দিকে থাকতেন লাল ফেজ টুপি পরা মৌলবি স্যর, আর এক দিকে আমাদের ক্লাস হত। এক দারুণ বর্ষায় পাঠ্যবই সরিয়ে রেখে অজিতবাবু বা নতুন স্যর ‘সোনার তরী’র স্পন্দিত পঙ্ক্তিগুলি আবৃত্তি করলেন। একটু উঁচু ক্লাসে গিরীনবাবুও পাঠ্যবই সরিয়ে রেখে ‘মহেশ’ গল্পটি শুনিয়েছিলেন। ইংরেজি পাঠ্যবইয়ের মধ্যে চমৎকার কিছু কবিতা পাঠ্য ছিল এবং ছিল কোনান ডয়েলের বিখ্যাত গল্প ‘দ্য লর্ড অব শ্যতু নয়্যার’। বাড়িতে মায়ের সংগ্রহের পত্রিকা পড়ে আর মাস্টারমশাইয়ের পাঠ্য অ-পাঠ্য রচনা পড়ানোর মধ্যে দিয়ে আমার সাহিত্যের প্রতি ভালবাসার উন্মেষ।
যে শহরে আমরা থাকতাম, সেই শহরের এক দিকে মহানন্দা নদী। মহানন্দার ধার ঘেঁষে বেড়াতাম কখনও। শীতকালের শীর্ণ মহানন্দা অনায়াসেই পারাপার করা যেত। অনেক সময়ে সাইকেল করে চাঁদমণি চা বাগান, এখন যেখানে ঝলমলে শপিং মল ও আবাসন, সেখানে এক বন্ধুর বাড়িতে যেতাম। সেই বাড়িতে ঘি দিয়ে যে লাল চালের ফেনাভাত খেতাম, তার স্মৃতি আজও অমলিন। সাইকেল চড়ে, বন্ধুবান্ধবরা দল বেঁধে মাঝে মাঝেই চলে যেতাম সেবকের দিকে। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং হিল রেলওয়ে-র সরু লাইন এক দিকে দার্জিলিং চলে গিয়েছিল, অন্য দিকে পুরোপুরি কালিম্পং অবধি যায়নি, গেইলখোলা অবধি গিয়েছিল। আমরা অনেক সময়ে দার্জিলিঙের পথে রেললাইন ধরে পঞ্চনই নদী অবধি যেতাম হেঁটে হেঁটে।
আমি একটু একটু রাজনীতি করতে শুরু করি কৈশোরের দিনগুলিতে। প্রয়াত মন্ত্রী, জলপাইগুড়ির বাসিন্দা নির্মল বসুর উদ্যোগে উত্তরবঙ্গ ছাত্র সম্মেলন হয়েছিল শিলিগুড়িতে, বাবুপাড়ার পাটগোলায়। কী করে জানি না আমি তার সম্পাদক হয়ে গিয়েছিলাম। তখন আমার বয়স চোদ্দো বছর। পঞ্জাব থেকে এক ছাত্রনেতা এসেছিলেন সভাপতিত্ব করতে। সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল দেশভাগের বিরোধিতা করা। কিন্তু পঞ্জাবি সভাপতি ছিলেন দেশভাগের পক্ষে! সম্মেলনের কাজে ভীষণ ভাবে জড়িয়ে পড়ায় বাবা আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরে ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফল বার হলে আবার কথাবার্তা শুরু করেন।
পাড়ায় এক বাড়িতে আমার কৈশোরকাল পর্যন্ত নিয়মিত যেতাম। সেখানে দেবব্রত বিশ্বাস মাঝে মাঝে আসতেন। সেই বাড়িতে ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ডের এক অসামান্য সংগ্রহ। অন্য গানও যে ছিল না তা নয়। এখনও কানে বাজে শচীন দেববর্মনের ‘পদ্মার ঢেউ রে’ গানটি। আর শুনেছিলাম সুচিত্রা মিত্রের অসংখ্য গান। এখান থেকেই আমার গানের প্রতি ভালবাসা তৈরি হয়। ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রতি আসক্তি অবশ্য হয়েছিল আরও পরে, কলকাতায় পড়তে গিয়ে। তখন বড়বেলা শুরু হয়ে গিয়েছে।