Indian Cricket team

ভারতীয় ক্রিকেটের মেরুদণ্ড  ভাঙতে অপহরণের ষড়যন্ত্র

খবর শুনে প্রথমে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল পোড়-খাওয়া গোয়েন্দা কর্তাদেরও। প্রথমে অজ্ঞান করা হবে! তার পর সারা শরীরে ব্যান্ডেজ বেঁধে নাকে অক্সিজেনের নল গুঁজে অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে বিমানবন্দর। চার্টার্ড ফ্লাইটে প্রথম গন্তব্য বাংলাদেশ, তার পর সেখান থেকে করাচি! কিন্তু কাকে অপহরণ? গোপন সূত্রের খবর, টার্গেট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। সঙ্গে সচিন তেন্ডুলকরও। কী হল তার পর?

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০২৩ ০৮:১৭
Share:

ছবি: অমিতাভ চন্দ্র।

ডান পা বাড়িয়ে গুড লেংথ স্পট থেকে বলটা তুলে দিলেন লং অফের উপর দিয়ে। টিভির সামনে বসা আপামর বাঙালি গর্জে উঠল, “বাপি, বাড়ি যা।”

Advertisement

কলম্বোর প্রেমদাসা স্টেডিয়াম। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ওপেন করতে নেমে ১১৭ রানের অপরাজিত ঝকঝকে ইনিংস খেলে, দেশকে জিতিয়ে, বুক চিতিয়ে মাঠ ছাড়লেন বাংলার ঘরের ছেলে সৌরভ।

জানলেন না, গোয়েন্দাদের তীক্ষ্ণ চোখ অনবরত নজরদারি চালাচ্ছে তাঁর উপরে। মাঠটুকু বাদ দিয়ে দেশে ও বিদেশে, হোটেলের লবি থেকে বিমানবন্দর, যেখানেই তিনি যাচ্ছেন, তাঁর পিছনে সর্বত্র ছায়ার মতো সাদা পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন গোয়েন্দারা। লক্ষ রাখছেন তাঁর প্রতিটি গতিবিধি। শুধু সৌরভ কেন, তাঁর সেই সময়কার সতীর্থ ক্রিকেটার, বোর্ড কর্তা, ঘনিষ্ঠ মহল, পরিবার থেকে সাধারণ মানুষ, সকলেরই অগোচরে থেকে গেল সে কথা।

Advertisement

খবরটা শুনে প্রথমে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল পোড়-খাওয়া গোয়েন্দা কর্তারও।

বলছে কী! প্রথমে নাকি অজ্ঞান করবে! তার পর সারা শরীরে ব্যান্ডেজ বেঁধে, নাকে অক্সিজেন নল গুঁজে অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে নিয়ে যাবে বিমানবন্দরে। যাতে কারও সন্দেহ না হয়। কলকাতা থেকে চার্টার্ড ফ্লাইটে নাকি প্রথমে বাংলাদেশে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে! সেখান থেকে অন্য চার্টার্ড ফ্লাইটে করাচি!

তাও যে-সে ব্যক্তিকে নয়! ভারতের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে!

সেটা ২০০২ সালের গোড়ার দিক। ২২ জানুয়ারি সকালে, কলকাতার চৌরঙ্গিতে আমেরিকান সেন্টারের সামনে পাহারায় ছিলেন কলকাতা পুলিশের চার কর্মী। সকাল সাতটার কিছু পরে, শহর ভাল করে সচল হওয়ার আগেই, গাড়িতে করে এসে সেই চার জনের সঙ্গে এক পথচারীকেও ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল জঙ্গিদের একে-৪৭ থেকে ছিটকে আসা গরম সিসা। কেঁপে উঠেছিল গোটা বিশ্ব। আমেরিকান সেন্টারে হানা বলে কথা! কলকাতার অবস্থা তখন সহজেই অনুমেয়।

সেই প্রথম বড়সড় জঙ্গিহানার শিকার তিলোত্তমা। জঙ্গি আফতাব আনসারির সেই হামলার পরে কার্যত রাতের ঘুম উড়ে যায় পুলিশ-প্রশাসনের। নিরাপত্তা আঁটসাঁট করতে শহরের রাজপথে ভারী বুটের আওয়াজ বাড়তে থাকে।

আর এই আবহে আচমকাই লর্ড সিনহা রোডে রাজ্যের গোয়েন্দা দফতরে উড়ে এল দু’লাইনের সেই সতর্কবার্তা। দিল্লি থেকে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতর জানাল— অপহরণ করা হতে পারে সৌরভকে। অনেক সময়েই দিল্লি থেকে বিভিন্ন সতর্কবার্তা আসে। যা মূলত বাহিনীকে সজাগ করার জন্য। অনেক সময়েই বেশির ভাগ সতর্কবার্তাকেই ‘রুটিন’ বলেই দেগে দেয় গোয়েন্দা দফতর। সেই বার্তা পেয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিকঠাক রয়েছে কি না, তা এক বার ঝালিয়ে নেওয়া হয়।

কিন্তু এটা নির্দিষ্ট নাম করে সতর্কবার্তা। তাও আমেরিকান সেন্টারে হানার অব্যবহিত পরে। নিশ্চিত হয়ে শুরু হয় যোগাযোগ। তখন একটা নয়, কেন্দ্রের অধীনে থাকা তিনটি গোয়েন্দা সংস্থাই নিশ্চিত করল সৌরভ অপহরণের পরিকল্পনারসেই খবর।

এই ঘটনার মাত্র দিন কয়েক আগে মার্কিন সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্লকে পাকিস্তানের মাটিতে নৃশংস ভাবে খুন করেছে জঙ্গিরা। জঙ্গি গোষ্ঠী আল কায়দা নিয়ে খবর করতে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন ড্যানিয়েল। ছিলেন এক বন্ধু সাংবাদিকের বাড়িতে। প্রথমে সেখান থেকে তাঁকে অপহরণ করা হয়। তার পর কার্যত ধড় থেকে মুন্ডু আলাদা করে সেই ভিডিয়ো প্রকাশ করেছিল জঙ্গিরা। মস্তিষ্কের কোথাও ছবির মতো ফুটে উঠল সেই ভিডিয়ো। শিরদাঁড়া দিয়ে যেন ঠান্ডা জলের স্রোত বয়ে গেল গোয়েন্দা কর্তার।

কলকাতায় আমেরিকান সেন্টারের সামনে জঙ্গিহানার ক্ষতও তখন দগদগে। দিল্লি আবার নির্দিষ্ট ভাবে জানাল, লস্কর-ই-তৈবা এবং ‘হুজি’ বা হরকত উল জিহাদ আল ইসলামি জঙ্গিরা মিলে ভারতীয় ক্রিকেটের দুই মহাতারকা সৌরভ এবং সচিন তেন্ডুলকরকে অপহরণের ছক কষেছে বলে খবর এসেছে তাদের কাছে। সচিনের খবর ইতিমধ্যেই মুম্বই পুলিশের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু কেন এই অপহরণের পরিকল্পনা?

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ভারতীয় জেলে থাকা দুই পাক জঙ্গি নাসারুল্লা লানগ্রিয়াল এবং আবদুল রহিমকে ছাড়াতে চায় জঙ্গিরা। এমনিতে তা সম্ভব নয়। সৌরভ ও সচিনের মতো দুই মহাতারকাকে যদি অপহরণ করা যায়, তা হলে তাঁদের মুক্তির বদলে ওই দুই হুজি জঙ্গিকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবে তারা। সৌরভ ও সচিনের মধ্যে এক জনকেও অপহরণ করা গেলে তাঁর বদলে দুই জঙ্গিকে ছেড়ে দিতে কার্যত বাধ্য হবে ভারত সরকার।

চোখের সামনে ঝলসে উঠল ফ্ল্যাশব্যাক। ১৯৯৯। ২৪ ডিসেম্বর। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস-এর উড়ান আইসি ৮১৪ কাঠমান্ডু থেকে দিল্লি যাচ্ছিল ১৭৬ জন যাত্রী নিয়ে। সেই বিমানকে হাইজ্যাক করে আফগানিস্তানের কান্দাহারে নিয়ে গিয়েছিল জঙ্গিরা। সে বারেও তো অপহরণের উদ্দেশ্য ছিল জঙ্গিদের মুক্তি!

ভারতীয় জেলে তখন বন্দি, জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ-এ-মহম্মদ এর প্রধান মৌলানা মাসুদ আজাহার। তাঁকে ছাড়াতেই মূলত হাইজ্যাক করা হয়েছিল যাত্রীবাহী সেই বিমান। এখানেই শেষ নয়, জঙ্গিদের চাপে এবং দেশবাসীকে বাঁচাতে সে বার মাসুদকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় ভারত সরকার। কিন্তু যে যাত্রীদের আটকে রেখে সেই ‘সওদা’ করেছিল জঙ্গিরা, তাঁদের মধ্যে এক জনকে হত্যা করতেও হাত কাঁপেনি তাদের। অকথ্য অত্যাচার চালানো হয়েছিল অন্য যাত্রীদের উপরেও। ফলে, যাঁকে বা যাঁদের তুলে নিয়ে গিয়ে জঙ্গিদের ছাড়ানো হয়েছে, তাঁদের যে অক্ষত ফেরানো হয়েছে, এমনটা নয়।

কী হবে সৌরভের?

জুটি: সচিন তেন্ডুলকর ও সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। জানতেনও না তাঁদের বিপদের আশঙ্কার কথা

সত্যিই যদি অপহরণ করা হয় বাংলার নয়নের মণি মহারাজকে, তার ফল কী হতে পারে ভেবে এসি-র সামনে বসে দরদরিয়ে ঘেমে গেলেন গোয়েন্দা কর্তা। জঙ্গিরা অপহরণ করলে কী হতে পারে তা বিলক্ষণ জানা আছে তাঁর। যে নিষ্ঠুর অত্যাচার করা হয় অপহৃতের উপরে, তা ভেবে শিউরে উঠলেন তিনি! তবে কি সৌরভকেও...

তখনও অবশ্য অবাক হওয়ার বাকি ছিল। সে কথায় পরে আসছি।

এ দিকে শহরের বাতাসে তখন ‘সাবোতাজ’-এর গন্ধ ম-ম করছে। আমেরিকান সেন্টারের সামনে জঙ্গি হানা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, কত ঢিলেঢালা আমাদের নিরাপত্তা। তার উপরে সৌরভ ‘হাই-প্রোফাইল’ ভিআইপি। তাঁর অপহরণের পরিকল্পনার কথা জানাজানি হলে যে কত বড় কেলেঙ্কারি হবে, তা বুঝতে বেশি সময় নেননি রাজ্যের গোয়েন্দা কর্তারা।

রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বাহিনীর মাথায় তখন পোড়খাওয়া আইপিএস শ্যামল দত্ত। আর গোয়েন্দা বাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ পদে আরও এক অভিজ্ঞ আইপিএস, অস্ত্রবিশারদ বলে খ্যাত দিলীপ মিত্র। শুরু হয় তাঁদের বৈঠক। দুই গোয়েন্দা কর্তা মিলে ছয়-সাত জন অফিসারকে বেছে নেন। ঠিক হয়, বাইরে থেকে মহারাজের বাড়ির উপরে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি চালানো হবে। আর বাড়ির বাইরে শ্যাডো করা হবে ভারতীয় অধিনায়ককে। তিনি বেহালার বাড়ি থেকে বেরোলেই ছদ্মবেশে তাঁর পিছু নেবেন গোয়েন্দারা। যেখানেই তিনি যাবেন, ছায়ার মতো তাঁর আশপাশে ঘুরে বেড়াবে বেশ কয়েক জোড়া চোখ। কোনও রকম সন্দেহজনক কিছু দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন তাঁরা। সৌরভ বাড়ি ফেরা পর্যন্ত সেই নজরদারি চলবে।

আরও একটি বিষয় ঠিক হয়। দুই গোয়েন্দা কর্তা শ্যামল দত্ত ও দিলীপ মিত্র ছাড়া এই অপহরণের পরিকল্পনার কথা শুধুমাত্র সেই ছয়-সাত জন গোয়েন্দা জানবেন, যাঁরা শ্যাডো করার কাজে যুক্ত হবেন। তার বাইরে প্রশাসনের একেবারে উচ্চ পর্যায়ে দু’-এক জনকে জানিয়ে রাখা হবে একটাই শর্তে, তাঁরা ঘুণাক্ষরেও যেন আর কাউকে সেই খবর না জানান। সৌরভকে কিছুতেই এই বিষয়ে জানতে দেওয়া যাবে না। তাতে পরিবারের মধ্যে তো টেনশন তৈরি হবেই, তা ছাড়া খবর বেরিয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা থাকবে। ভারত অধিনায়কের খেলার উপরেও প্রভাব ফেলতে পারে সেই খবর।

যে-হেতু সৌরভ তখন ভারত অধিনায়ক, বছরের অনেকটা সময় হয় তাঁকে দেশের অন্য শহরে বা বিদেশে থাকতে হত। ঠিক হল, শহর ছাড়ার সময়ে কলকাতা বিমানবন্দর পর্যন্ত শ্যাডো করা হবে। বিমানবন্দরের ভিতরে নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় নেই। তবুও সাবধানের মার নেই। ঠিক হয়, বিমানের ভিতরেও গোয়েন্দারা যাত্রী সেজে থাকবেন। সৌরভ যে শহরে যাচ্ছেন, সেখানকার গোয়েন্দাদের খবর পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তাঁরা সেই শহরের বিমানবন্দর থেকে একই ভাবে তত ক্ষণ পর্যন্ত সৌরভকে শ্যাডো করবেন, যত ক্ষণ না তিনি সেই শহর ছাড়ছেন।

বিদেশে সাধারণত অপহরণের আশঙ্কা কম। কিন্তু নির্দিষ্ট দুই তারকা ক্রিকেটারের ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিতে রাজি ছিল না ভারত সরকার। ফলে, ওই সময়ে বিদেশের যেখানেই পা রেখেছেন ওই দু’জন, সে দেশের সরকারকে নিরাপত্তার বিষয়টি জানানো হয়েছে। সে দেশের সরকারও দুই ক্রিকেটারের উপরে চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারি চালিয়েছে। বলাই বাহুল্য, সেটাও অত্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রেখেই করা হয়েছে। যে কারণে সৌরভ-সচিন তো বটেই, দলের অন্য কোনও ক্রিকেটারও ঘুণাক্ষরে সে কথা বুঝতে পারেননি। ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরেই ভারতীয় দল আইসিসি চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে শ্রীলঙ্কা যায়। সেখানেই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১১৭ রানের সাজানো ইনিংস খেলেন সৌরভ। মাঠের বাইরে থেকে চলে নজরদারি।

দিল্লির বার্তা আসার কার্যত পরমুহূর্ত থেকেই শুরু হয় অপহরণ বানচাল করার ‘অপারেশন’। বেহালা তখন রাজ্য পুলিশের অধীনে। সৌরভের বাড়ি ছিল বেহালা থানা এলাকায়। সে সময়ে না ছিল বাড়ির বাইরে পুলিশি প্রহরা, না ছিল সৌরভের পুলিশ দেহরক্ষী। প্রথমেই তাঁর বাড়ির মানচিত্র বানানো হয়। চার দিকে কোন কোন বাড়ি রয়েছে, সেখান থেকে কোনও ভাবে সৌরভের বাড়িতে ঢোকা সম্ভব কি না, বাড়ির সামনের মূল গলি ছাড়া আর কোনও ভাবে ওই পর্যন্ত পৌঁছনো যায় কি না, কোনও গাড়ি গলিতে ঢুকলে বেরোনোর দ্বিতীয় কোনও রাস্তা রয়েছে কি না, এ সমস্তই ঠাঁইপায় মানচিত্রে।

কখনও দু’টি, কখনও তিনটি গাড়ি নিয়ে বাড়ির আশপাশে ‘পজ়িশন’ নেওয়া শুরু হয়। সৌরভ বা অন্য কারও যাতে সন্দেহ না হয়, তার জন্য ব্যবহার করা হয় হলুদ ট্যাক্সিও। গলির ভিতরে চায়ের দোকানেও খদ্দের সেজে শুরু হয় অপেক্ষা। সতর্ক করা হয় অফিসারদের, তাঁদের এই নজরদারির কথা যেন কাকপক্ষীতেও টের না পায়। কারণ, যে এলাকায় সৌরভ থাকেন, তা বেশ জনবহুল। এক লহমায় গোয়েন্দাদের একটা ভুল পদক্ষেপ যে কোনও মুহূর্তে সমস্ত পরিকল্পনায় জল ঢেলেদিতে পারে।

সৌরভের গাড়ির সামনে তখন এসকর্ট ভ্যানও থাকত না। গাড়ি নিয়ে সৌরভ বেরোলেই চায়ের দোকান থেকে খবর পৌঁছে যেত গলির মুখে দাঁড়ানো গাড়ির কাছে। সৌরভের গাড়ি গলি থেকে বেরোলেই পিছু নিত সেই গাড়ি। কিছু দূর গিয়ে বদলে যেত পিছু নেওয়া গাড়ি। কারণ, একটি গাড়ি ক্রমাগত পিছনে আসতে থাকলে সন্দেহ হতে পারত সৌরভের গাড়িচালকেরও। সৌরভ মাঠে নামলে, মাঠের পাশে দর্শক সেজে গোয়েন্দারা নজর রাখতেন সৌরভের উপরে। সন্ধ্যা-রাতে কোনও নিমন্ত্রণবাড়ি বা পার্টি থাকলে আগে থেকে জানা থাকত গোয়েন্দা কর্তাদের। সেই সব পার্টি বা নিমন্ত্রণবাড়িতে ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরে অতিথি সেজে থাকতে বরং সুবিধাই হত অফিসারদের।

গোয়েন্দা কর্তাদের মতে, এই ছ’বছর সময়টা তাঁদের পক্ষে খুব স্বস্তির ছিল না। সৌরভের পিছনে ঘুরে বেড়ালেও ঠিক কখন, কোন পথে, কী বেশে জঙ্গিরা আসবে তা পরিষ্কার ছিল না তাঁদের কাছে। স্বস্তির জায়গা ছিল একটাই। এটা জঙ্গি হানার ঘটনা নয়, যে গাড়ি করে এসে ব্রাশ ফায়ার করে বেরিয়ে যাবে। প্রায় ছ’ফুট লম্বা, সুঠাম, শক্তিশালী সৌরভকে অপহরণ করতে হলে তাঁকে কোনও ভাবে কাবু বা কব্জা করতে হবে। তাতে সময় লাগবে। সেই সময়টুকুই অস্ত্র হয়ে উঠবে গোয়েন্দাদের। আর বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঝের রাস্তাটুকু ছাড়া সৌরভ আর যেখানে যেখানে যেতেন, প্রায় সব জায়গাতেই তাঁকে ঘিরে থাকতেন একাধিক মানুষ। ফলে, সেখান থেকে অপহরণ করার সুযোগটা কম। উপরন্তু, নজরদারি তো ছিলই।

পাশাপাশি গোয়েন্দা কর্তাদের অনুমান ছিল, সৌরভকে অপহরণ করলে তাঁকে মুখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাঁকে আপামর মানুষ চেনে। ফলে, ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবেই। সেই অনুমান কার্যত সত্য প্রমাণ হয় যখন দিল্লি থেকে বার্তা আসে, জঙ্গিদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সৌরভকে অজ্ঞান করে সারা দেহে ব্যান্ডেজ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হবে। যাতে তাঁকে বাইরে থেকে দেখে চেনা না যায়। তাতে দ্বিতীয় সুবিধা, মুমূর্ষু রোগী বলে অ্যাম্বুল্যান্সে নিয়ে যাওয়ার সময়ে পুলিশেরও সন্দেহ হবে না। প্রয়োজনে নাকে অক্সিজেনের নল গুঁজে রাখা যাবে।

সাধারণত অপহরণের জন্য অজ্ঞান করার কথা উঠলে ক্লোরোফর্মের কথাই প্রথমে মনে আসে। গোয়েন্দারাও প্রাথমিক ভাবে সে রকমই কিছু ভেবেছিলেন। কিন্তু, সোর্স মারফত খবর আসে, জঙ্গিরা অন্য ফিকির বার করেছে। ‘সেভোফ্লুরান’ নামে এক ওষুধের কথা জানতে পারেন গোয়েন্দারা। যে ওষুধ অস্ত্রোপচারের জন্য ব্যবহার করা হয়।

খবর নিয়ে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করতে প্রথমত বেশি সময় লাগে। দ্বিতীয়ত, কত ক্ষণ অজ্ঞান থাকবে তাও নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বেশি ডোজ় হলে বেশি ক্ষণ থাকে। কিন্তু, তাতে প্রাণহানির আশঙ্কাও থাকে। তুলনায় সেভোফ্লুরান অনেক নিরাপদ। অপহরণকারীরা তাদের শিকারকে কত ক্ষণ অজ্ঞান রাখতে চাইছে, ওই ওষুধ ব্যবহার করে তা নিয়ন্ত্রণও করা সম্ভব। দীর্ঘ অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে যেমন হয়।

জানা যায়, জঙ্গিদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সৌরভকে কলকাতায় অজ্ঞান করে কোনও ডেরায় নিয়ে গিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে বিমানবন্দরে যাওয়া হবে। কলকাতা থেকে ওই অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার সময়ে অন্য নাম দিয়ে সৌরভের ভুয়ো পরিচয়পত্র বানানো হবে। কলকাতা থেকে ভাড়া করা বিমানে বাংলাদেশ হয়ে করাচি নিয়ে যেতে বেশ কিছু ক্ষণ সময় লাগার কথা। সে ক্ষেত্রে সেভোফ্লুরান অনেক বেশি কার্যকরী। তা খুব তাড়াতাড়ি কাজও করতে শুরু করে। এ ছাড়াও গোয়েন্দাদের কানে আসে কেটামিন ইঞ্জেকশনের কথাও। জানা যায়, জঙ্গিরা প্রয়োজনে সেই ইঞ্জেকশনও ব্যবহার করতে পারে।

এক দিকে শ্যাডো যেমন চলছিল, তেমনই বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছিল বিবিধ খবরও। নজরদারির ফাঁকে আরও দু’টো বড় খবর এসে পৌঁছয় কলকাতায়। এক, করাচি নয়, মিশন অপহরণ যদি সফল হয়, তা হলে সৌরভ ও সচিনকে নিয়ে যাওয়া হবে আফগানিস্তান। সেখান থেকেই শুরু হবে ‘নেগোশিয়েশন’। দুই, সৌরভকে অপহরণ করতে পারলে বিমানবন্দর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নাও নিতে পারে জঙ্গিরা। সে ক্ষেত্রে কলকাতা থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে উত্তর ২৪ পরগনার ঘোজাডাঙা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ নিয়ে যাওয়া হবে।

খবরটি পেয়ে শুধু ঘোজাডাঙা নয়, ভারত বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী সম্ভাব্য সমস্ত যাতায়াতের পথে নজরদারি বাড়ানোর জন্য সতর্ক করা হয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা বিএসএফ-কে। যদিও তাঁদের কাছে আসল কারণের কথা বলা হয়নি। সীমান্তে সেই নজরদারির মধ্যেই ঘোজাডাঙার মাহাদিপুরের কাছে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে একটি সন্দেহভাজন অ্যাম্বুলেন্স নজরে আসে। কলকাতার গোয়েন্দা কর্তারা কালবিলম্ব না করে সে খবর পাঠিয়ে দেন দিল্লিতে। দিল্লি ঘুরে খবর পৌঁছয় ঢাকায়। বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থার হাতে ধরা পড়েন তিন ব্যক্তি। দেখা যায় অ্যাম্বুল্যান্সের মাথায় দুটো অদ্ভুত দেখতে অ্যান্টেনা বসানো। অ্যাম্বুলেন্সের ভিতরে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকলে তবেই ওই ধরনের অ্যান্টেনা থাকার কথা। তবে সৌরভের অপহরণ পরিকল্পনার মধ্যে সেই অ্যাম্বুল্যান্সের কোনও ভূমিকা ছিল কিনা, তা আর জানা যায়নি।

নিরন্তর খবর সংগ্রহের কাজ চালাচ্ছিলেন দুই কর্তা। ক্রমাগত যোগাযোগ রাখছিলেন দেশের প্রায় সমস্ত গোয়েন্দা দফতরের সঙ্গেই। আর তখনই এমন কিছু খবর পাওয়া যায়, যা শুনে নতুন করে হিসাব কষতে শুরু করেন গোয়েন্দা দফতরেরদুই শীর্ষ কর্তা।

যে দুই জঙ্গিকে ছাড়ানোর জন্য সৌরভদের অপহরণের পরিকল্পনা, তাদের মধ্যে আবদুল রহিমের সম্পর্কে খোঁজখবর করতে গিয়ে জানা যায়, সে ছিল আসিফ রেজা খানের সঙ্গি। শুনে নড়েচড়ে বসেন গোয়েন্দা কর্তারা। কারণ, আসিফ ছিল কুখ্যাত পাক জঙ্গি। ২০০১ সালের জুলাইয়ে কলকাতা থেকে খাদিম কর্তা পার্থ রায়বর্মণকে অপহরণের পিছনে তার মাথা ছিল বলেই মনে করা হয়। যদিও হাতে-কলমে সেই কাজ করে আফতাব আনসারি। ২০০১ সালের অক্টোবরে আসিফ গ্রেফতার হয় এবং ৭ ডিসেম্বর রাজকোটে গুজরাত পুলিশের গুলির শিকার হয়ে যায়। অভিযোগ, পুলিশের হাত ছাড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করে সে।

জঙ্গি-মহলে আসিফ এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে তার মৃত্যুর পরে তার নামে আসিফ রেজা কম্যান্ডো ফোর্স তৈরি করা হয়। মনে করা হয়, আসিফের মৃত্যুর বদলা নিতেই নাকি কলকাতার আমেরিকান সেন্টারের সামনে হামলা চালিয়েছিল আফতাব আনসারি। এ বার আরও অবাক হওয়ার পালা। খবর নিয়ে জানা যায়, এই আসিফের সঙ্গে ১৯৯৯ সালে তিহাড় জেলে আলাপ হয়েছিল উমর শেখের। মনে করা হয়, আসিফ জঙ্গি সংগঠন জইশ-এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল উমরের পরামর্শেই। আবার কান্দাহার কাণ্ডে ভারতীয় বিমানযাত্রীদের অপহরণ করে যে জঙ্গিকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই মাসুদ আজাহারের সঙ্গে জেল থেকে ছাড়া হয়েছিল এই উমর শেখকেই।

অবাক হন গোয়েন্দারা। নিছকই কাকতালীয়! তিন বছরের আগে ঠিক যে ভাবে অপহরণ করে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জঙ্গিদের, এখন একই রকম পরিকল্পনা ছকেছে জঙ্গিরা। তফাত শুধু এটুকুই যে সে বার গোটা বিমান ছিনতাই করা হয়েছিল। এ বার টার্গেট করা হয়েছে দুই জনপ্রিয়তম ক্রিকেটারকে। টানটান হয়ে যায় অফিসারদের স্নায়ু। ঠিক হয়, জঙ্গিদের সেই পরিকল্পনা বানচাল করতে দিন-রাত এক করে দেওয়া হবে।

এ ভাবে এক-দু’দিন, এক-দু’মাস নয়। ছায়ার মতো সৌরভের পিছনে এই নজরদারি চালানো হয়েছে দীর্ঘ ছ’বছর। আর সেই ছ’বছরের প্রতিটি রাতে শোওয়ার আগে গোয়েন্দা কর্তার কাছে ফোন এসেছে। যাঁরা সৌরভকে ছায়ার মতো অনুসরণ করছিলেন, তাঁরা প্রতি রাতে ফোন করে জানিয়েছেন, ‘‘স্যার। সব ঠিক আছে।’’ সেই ফোন পাওয়ার পরে রাতটা শুধু নিশ্চিন্তে কেটেছে দুই গোয়েন্দা কর্তার। এই অপহরণের পরিকল্পনা করার অভিযোগে ২০০৩ সালে ছয় জঙ্গি দিল্লি পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পরেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেননি গোয়েন্দা কর্তারা। তার পরে আরও পাঁচ বছর একনাগাড়ে চলেছে নজরদারি। তত দিন পর্যন্ত তাঁর পিছনে ছায়ার মতো গোয়েন্দাদের ঘুরে বেড়ানোর কথা এক মুহূর্তের জন্যও বুঝতে পারেননি ভারত অধিনায়ক।

গোয়েন্দা কর্তাদের মতে, সৌরভ-সচিনকে অপহরণের পরিকল্পনা সফল হলে ভারতীয় ক্রিকেটের মনোবল, মেরুদণ্ড ভেঙে যেত। যার প্রভাব পড়তে পারত গোটা দেশের উপরেই। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গ ও মহারাষ্ট্র পুলিশের গোয়েন্দাদের তৎপরতায় বানচাল হয়ে যায় জঙ্গিদের পরিকল্পনা। ওই দুই রাজ্যের গোয়েন্দাদের পাশে ছিল গোটা দেশের একাধিক গোয়েন্দা বাহিনীর কর্তারাও।

জঙ্গিরা ধরা পড়ার পরে জানা যায়, ছ’জনের দলে ছিল তিন পাকিস্তানি যুবকও। তারিখ মেহমুদ, আরশাদ খান ও ঈশাক আহমেদ নামে ওই তিন জনকে অপহরণের কাজে সাহায্য করার কথা ছিল তিন ভারতীয় জঙ্গি গুলাম মহম্মদ দার, গুলাম কাদির ভাট এবং মুফতি মহম্মদ ইসরার। প্রথমে তাদের যাবজ্জীবন সাজা হলেও ২০১২ সালে তা কমিয়ে আট বছর করে দিল্লি হাই কোর্ট।

বাস্তব সত্যিই রহস্য উপন্যাসের চেয়েও বিস্ময়কর। গল্পে বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার পর শুরু হয় গোয়েন্দার কার্যকলাপ। কিন্তু বাস্তবে দুরন্ত নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে আগে থেকে বিপদের অনুমান করা এবং বিপদ ঘটতে না দেওয়ার জন্যই তাঁরা সদাসতর্ক এবং তৎপর। অনেক সময় সে সবের কথা জানতেও পারেন না সাধারণ মানুষ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement