দেশের প্রথম লৌহ-ইস্পাত সংস্থা তাঁর হাত ধরেই পৌঁছয় সাফল্যের শীর্ষে।
IISCO

দেশের ইস্পাত শিল্পের প্রথম রূপকার আজ বিস্মৃত

তিনি স্যর বীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছে তাঁর সংস্থা। শুধু এই বাঙালির কর্মোদ্যোগ মনে রাখেননি কেউই।

Advertisement

সুশান্ত বণিক

শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০২১ ০৭:৪১
Share:

স্মৃতিসাক্ষ্য: কুলটির এই আবাসনে থাকতেন স্যর বীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।

এই ভবনকে স্থানীয়রা এখনও ‘ডাইরেক্টর বাংলো’ বলেই চেনে। পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খণ্ড সীমান্তে প্রথম ইস্পাত শিল্পের শহর কুলটিতে অবস্থিত এই বাংলো কবে তৈরি হয়েছিল, কারও মনে নেই। তবে শিল্পাঞ্চলবাসীর দাবি, বাংলোটি প্রায় একশো বছরের পুরনো তো হবেই। আধুনিক স্থপতিদের মত, আদ্যোপান্ত পাশ্চাত্য নকশায় তৈরি এই ভবনে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা এখন আর দেখাই যায় না।

Advertisement

বাংলোটি তৈরি করিয়েছিলেন বাঙালি শিল্পপতি স্যর বীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। ইন্ডিয়ান আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি লিমিটেড (ইস্কো)-এর কর্ণধার বীরেন্দ্রনাথবাবু কুলটি ও বার্নপুর কারখানা পরিদর্শনের সময় এই বাংলোয় থাকতেন। তবে এখন এটি কার্যত খণ্ডহর। ঝোপ-জঙ্গলে ঢেকে গিয়েছে পুরো এলাকা। ১৯৭২ সালে ইস্কো কারখানার সমস্ত শাখা রাষ্ট্রায়ত্ত হয়ে যায়। তার কয়েক বছর পর থেকেই জৌলুসহীন হয়ে পড়ে এই বাংলো। পরবর্তী কালে এই বাংলোয় একটি হাসপাতাল তৈরি হয়। কিন্তু ইস্কোর কুলটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে সেটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন এটি একটি শয্যাবিহীন ছোট প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। চিকিৎসকের সংখ্যা এক। শুধু এই বাংলোটিই নয়, কুলটি ও বার্নপুরে স্যর বীরেনের তৈরি বঙ্গসংস্কৃতির প্রায় সব স্থাপত্যই এখন জৌলুসহীন। বিস্মৃতির আড়ালে স্যর বীরেন্দ্রনাথ নিজেও।

শিল্পাঞ্চলবাসীরা আজও মনে করেন, এক জন প্রকৃত আত্মনির্ভর বাঙালি বলতে যা বোঝায়, তা-ই ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। পরাধীন ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান শিল্পোদ্যোগী স্যর রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সন্তান বীরেন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৯৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ইস্কো-য় যোগ দেওয়ার পর তিনিই এই কারখানাকে আধুনিক করে তুলেছিলেন। উনিশ শতকের গোড়ায় ব্রিটিশ নাগরিক টমাস অ্যাকুইন মার্টিন ও রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় যৌথভাবে গড়ে তোলেন মার্টিন অ্যান্ড বার্ন কোম্পানি। ১৯২৪ সালে এই সংস্থায় বীরেন্দ্রনাথবাবু সহকারী কর্ণধার হিসেবে যোগ দেন। তিনি ছিলেন শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের স্নাতক, স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন কেমব্রিজ থেকে। প্রায় ন’বছর তিনি বাবার সংস্থায় সহকারীর পদে কাজ করেন। ১৯৩৩ সালের ২৬ জুন তিনি ইস্কোর বোর্ড অব ডাইরেক্টর্স-এর সদস্য হিসেবে মনোনীত হন। ঠিক এই দিনটি থেকেই শুরু তাঁর নতুন কর্মোদ্যোগ, বলা যায় দেশের এক জন সফল শিল্পপতির জয়যাত্রার সূচনা। ১৯৩৬ সালে মারা যান রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। এর পরই বীরেন কার্যত ইস্কোর একছত্র অধিপতি হয়ে বসেনে। ১৯৫৭ সালে তিনি ইস্কো কারখানার বোর্ড অব ডাইরেক্টর্স-এর চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হলেন। এর পর ইস্কো-র সাফল্যের রেখাচিত্র আরও উপরে ওঠে। টানা প্রায় ১৫ বছর সংস্থার পরিচালন ভার সামলেছেন তিনি।

Advertisement

যে ইস্কো কারখানার সাফল্যকে শিখরে তুলে ধরেছিলেন স্যর বীরেন, সেই সংস্থার চলার পথটিও ছিল বর্ণময়। দেশের প্রথম লৌহ-ইস্পাত শিল্পের শিরোপা আজও এই সংস্থারই। তবে কালের পরিবর্তনের সঙ্গে পুরনো খোলনলচে বদলে ফেলে আরও আধুনিক হয়ে উঠেছে ইস্কো। স্মৃতির সরণি বেয়ে এগোলে দেখা যায়, ইস্কো-র সূচনা ১৮৭০ সালে। বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমান্তের কুলটিতে প্রথম এক ব্রিটিশ নাগরিক জেমস এরিকসন তৈরি করেন ‘বেঙ্গল আয়রন ওয়ার্কস’। পরাধীন ভারতবর্ষে এই কারখানাকে স্থানীয়রা চলতি কথায় ‘কেন্দুয়া কারখানা’ বলে ডাকতেন। প্রথম দিকে খুব ভাল লোহা উৎপাদন হয়নি এই কারখানায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, তখনও উন্নত মানের লৌহ আকরের খোঁজ যেমন পাওয়া যায়নি, তেমনই লোহা উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তিও এ দেশে আসেনি। ১৮৮০ সালে বেঙ্গল আয়রন ওয়ার্কস-এর নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ হল ‘বরাকর আয়রন ওয়ার্কস’। পরবর্তী দশকের মাথায় এই নাম পাল্টে সংস্থাটির নতুন নাম হল ‘বেঙ্গল আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি’। আকরিক লোহা গলিয়ে তার সঙ্গে আরও কিছু সামগ্রী মিলিয়ে পরিপূর্ণ লোহা উৎপাদনের জন্য এই কারখানায় একটি ছোট ওপেন হার্থ ফার্নেস (চুল্লি) বসানো হয়। বিশেষজ্ঞদের কথায়, এই চুল্লি করিগরির দিক থেকে সাফল্য পায়। কিন্তু লোহা উৎপাদনের খরচ এত বেড়ে যায় যে, বাজারে সেই লোহা বিক্রি করে উচিত মূল্য পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে লাভ হচ্ছিল না।

তত দিনে বার্নপুর ও হিরাপুর অঞ্চলে আরও দু’টি ইস্পাত কারখানা তৈরির উদ্যোগ শুরু হয়। রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও টমাস মার্টিনের যৌথ উদ্যোগে ১৯১৮ সালে হিরাপুর মৌজায় গোড়াপত্তন হয় ইন্ডিয়ান আয়রন এন্ড স্টিল কোম্পানি (ইস্কো)-র। কুলটির ইস্পাত কারখানাগুলির তুলনায় এই সংস্থা আরও বেশি উন্নত। ১৯২৪ সালে ইস্কো কারখানায় সহকারী প্রধান হিসেবে যোগ দেন বীরেন্দ্রনাথ। তিনিই উদ্যোগী হয়ে ১৯৩৬ সালে কুলটির ‘বেঙ্গল আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি’-কে ইস্কোর সঙ্গে যুক্ত করেন। মার্টিন বার্ন গ্রুপের উদ্যোগে ১৯৩৯ সালে বার্নপুরে ‘স্টিল কর্পোরেশন অব বেঙ্গল’ নামে আরও একটি ইস্পাত সংস্থার জন্ম হয়। ১৯৫৩ সালে এই সংস্থাটিকেও ইস্কো-র সঙ্গে সংযুক্ত করেন স্যর বীরেন্দ্রনাথ। ১৯৫৭ সালে স্যর বীরেন ইস্কো-র পরিচালন সমিতির চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত হন। তিনি ইস্কো-তে যোগ দেওয়ার পর নিজ উদ্যোগে বার্নপুরে উন্নত মানের লোহা গলানোর চুল্লি (ব্লাস্ট ফার্নেস) বসালেন। কুলটিতে উন্নত মানের পাইপ তৈরি শুরু হল। পরবর্তী কালে এই পাইপ বিশ্বের বাজারে সুনাম অর্জন করে। গুয়া, চিরিয়া, মনোহরপুরে লৌহ আকরের খনি কেনা হল। মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীতে আরও একটি ইস্পাত কারখানা গড়া হল। চাষনালা, জিতপুর ও রামনগরে খোলামুখ কয়লাখনির পত্তন করা হল। ষাটের দশকে স্যর বীরেন তৈরি করালেন দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ, ৫৩ কিমি দূরত্বের রোপওয়ে ব্যবস্থা। চাষনালা থেকে বার্নপুর পর্যন্ত কয়লা বহন করত এই রোপওয়ে। বলা হয়, ইস্কো কারখানার এই ক্রমবর্ধমান উত্থানে অত্যন্ত প্রীত হয়েছিলেন ইস্কো-র প্রাক্তন চেয়ারম্যান টি লেসলি মার্টিন। তিনি স্যর বীরেনের বিশেষ প্রশংসা করেন।

ইস্কো থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, স্যর বীরেনের সঙ্গে ইস্কো-র প্রায় ৪২ বছরের সম্পর্ক ছিল। কখনও তিনি পরিচালন বোর্ডের সদস্য, কখনও তিনি পরিচালন বোর্ডের সহকারী কার্যকরী সদস্য, আবার কখনও তিনি ডাইরেক্টর, কখনও তিনি পরিচালন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে থেকে কাজ করেছেন। সত্তরের দশকের শুরু থেকে ইস্কো-র বাজার পড়তে শুরু করে। শ্রমিক, কর্মীরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় দিন কাটাতে শুরু করেন। বিভিন্ন মহল থেকে ইস্কো-কে রাষ্ট্রায়ত্তকরণের দাবি ওঠে। শেষমেশ ১৯৭২ সালের ১৪ জুলাই দেশের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার ইস্কো কারখানা অধিগ্রহণ করে। কিন্তু তার পরেও ইস্কো লাভের মুখ দেখেনি। অবশেষে ১৯৭৮ সালে দেশের নবরত্ন সংস্থা স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া ইস্কোকে অছি সংস্থা (ট্রাস্টি) হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু এর পরেও প্রায় তিন দশক সংস্থাটির আর্থিক অবস্থা বদলায়নি। ক্রমাগত লোকসানের ধাক্কা সামলে উঠতে না পারায় ১৯৯৪ সালে সেইল কর্তৃপক্ষ ইস্কোকে রুগ্ণ ঘোষণা করে। ২০০০ সালে কেন্দ্রীয় ইস্পাত মন্ত্রক ও মন্ত্রিসভা সেইলের মাধ্যমে ইস্কো-র আধুনিকীকরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০৬ সালে আধুনিকীকরণের কাজ শুরু করে সেইল।

দীর্ঘ ৪২ বছর ইস্কো-র কর্মজীবনে বহু স্থাপত্য গড়েছিলেন স্যর বীরেন। এর মধ্যে যেমন রয়েছে ব্যক্তিগত ও প্রশাসনিক ভবন, তেমনই রয়েছে সাংস্কৃতিক ও বিনোদনমূলক স্থাপত্য। মূলত কুলটি ও বার্নপুরেই তিনি এগুলি তৈরি করিয়েছিলেন। শ্রমিক কর্মীদের জন্য ১৯২৯ সালে কুলটিতে গড়ে তুলেছিলেন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র কুলটি সম্মিলনী ও একটি পাঠাগার। কথিত আছে স্যর বীরেনের স্ত্রী লেডি রাণু মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছিল এগুলি।

বার্নপুরের ভারতী ভবনে স্থাপিত এই শিল্পোদ্যোগীর আবক্ষ মূর্তি।

আজ সেগুলির ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কারণ কুলটি কারখানা ক্রমশ লোকসানে চলায় ২০০৩ সালে এটি বন্ধ করে দেয় সরকার। ২০০৮ সালে কারখানার দু’টি বিভাগে ঠিকাদারি সংস্থার অধীনে কাজ শুরু হয়। ২০১০ সালে রেল ও সেল-এর যৌথ উদ্যোগে একটি বেসরকারি সংস্থা রেলের ওয়াগন তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছে। কিন্তু কুলটি ইস্পাত-শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা স্যর বীরেনের কোনও স্থাপত্য রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বার্নপুরে তিনি যে স্থাপত্য তৈরি করেছিলেন, সেগুলি কিছু কিছু রক্ষিত হচ্ছে। কারণ বার্নপুর ইস্কো-র আধুনিকীকরণ হওয়ায় সংস্থাটি এখনও চালু আছে, রক্ষা পেয়েছে স্যর বীরেনের কৃতকর্মগুলি। অবশ্যই উল্লেখ করার মতো বিষয়, পরাধীন ভারতবর্ষে কলকাতার শেরিফ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন তিনি। ১৯৪১ সালে কলকাতার শেরিফ হওয়ায় পরের বছর অর্থাৎ, ১৯৪২ সালে তিনি ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত হন।

১৯৮২ সালের ৪ নভেম্বর এই কর্মময় চরিত্রের জীবনাবসান হয়। ইস্কো-র বার্নপুর কুলটি কলকাতা উজ্জয়িনী চাষনালা গুয়া চিরিয়া মনোহরপুর রামনগর সর্বত্র প্রয়াত এই শিল্পোদ্যোগীকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এর পর কেটে গিয়েছে আরও ৩৮ বছর। বহু জল গড়িয়েছে দামোদর নদ দিয়ে। বার বার ঘাত- প্রতিঘাতের মুখে পড়েছে ইস্কো কারখানা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘুরেও দাঁড়িয়েছে। ১৪ বছর আগে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা খরচ করে কারখানার আধুনিকীকরণ হয়েছে। স্যর বীরেনের তৈরি ইস্কো-র পুরনো অংশ এখন পুরোপুরি বন্ধ। কারখানা লাগোয়া গ্রামগুলি থেকে অনেক জমি অধিগ্রহণ করে অত্যাধুনিক ইস্পাত প্রকল্প তৈরি করেছে সরকার। সেজে উঠেছে ইস্পাত শহর। বহু বেকার যুবক চাকরি পেয়েছেন। ইস্কো-কে কেন্দ্র করে ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছে আসানসোল শিল্পাঞ্চলের মৃতপ্রায় অর্থনীতি। কিন্তু কোনও ভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই স্যর বীরেনের সেই অমর কীর্তি। অবশ্যই মনে রাখা দরকার, শতাধিক বছর আগে তিনিই এই শিল্প সংস্থাটিকে বড় করে তুলেছিলেন। তাঁর হাত ধরেই নগরসভ্যতার গোড়াপত্তন, শক্তিশালী অর্থনীতির জন্ম। তাঁকে অনায়াসে দেশের ইস্পাত শিল্পের পথিকৃৎ বলা যেতে পারে। শহরবাসীর আক্ষেপ, বার্নপুর ও কুলটি ইস্পাত শহরে তাঁকে মনে রেখে কোনও স্মৃতিসৌধ আজও তৈরি হয়নি। বছর কয়েক আগে বার্নপুরের ভারতী ভবনে স্যর বীরেনের একটি আবক্ষ মূর্তি বসিয়েছেন ক্লাবের সদস্যরা। এ বছর ছিল তাঁর ১২১তম জন্মবার্ষিকী।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement