আলোকবর্তিকা: হুস্ন বাই ছিলেন ‘তবায়েফ সভা’-র সভাপতি। মহাত্মার অনুরোধে শুধুই স্বদেশি গান গাইতেন
বাইজিদের সহবত। এই নিয়ে হাজারো আখ্যান, অজস্র গান। রসলুন বাইয়ের এই বিখ্যাত ঠুমরিটি যেমন। কটিতে ভরা গাগরি, গৃহমুখী নায়িকার পায়ে বিঁধল কাঁকর। শরীর ছলকে তখন তার হাতের ঘড়া গড়াগড়ি যায় ভূমে। ভিজে যায় চুনরি। বালম রাগ করবেন নিশ্চিত! তাতে তার বয়েই গেল। মনমে কুছ ডর নাহি। কিন্তু পায়ে কাঁকর বিঁধবে কেন? কেন জলের ঘড়া তার কাঁকাল পিছলে পড়ে ভেঙে যাবে? কেন তার লিবাস গিলা হবে? এত দিনে এই সহবত শিখল সে! সহবত নষ্ট হলে, মেয়েদের আর রইলই বা কি? না, পায়ে তার এ ভাবে কাঁকর বিঁধে যাওয়া উচিত হয়নি মোটেই।
এই পুকার মেকি নয়। খানদানি বাইজিদের মধ্যে অনেকেই বৃদ্ধ বয়সে শান-শওকত হারিয়ে ভিক্ষে করতে বাধ্য হয়েছেন, কিন্তু তহ্জ়িব আলগা হতে দেননি। তহ্জ়িবের পাঠ নিতে তাই বাইজিদের কোঠিতে ভিড় জমিয়েছেন সে কালের নবাবজাদারা। গানবাজনা আর আদবকায়দার সঙ্গে এই তহ্জ়িব, এতেই তাঁদের প্রেমিকদের রাতের ‘নিদ হারাম’। কট্টর বাইজি-বিরোধী যাঁরা, তাঁরাও মজেছিলেন এতে। প্রেমকুমার খন্না যেমন। বাইজিদের ঘৃণা করতেন তিনি। বেনারস থেকে তাঁদের উৎখাত করতে আদাজল খেয়ে লেগেছিলেন ভদ্রলোক।
কে এই প্রেমকুমার খন্না? ক্ষত্রি পরিবারের জন্ম তাঁর। লেখাপড়া শেখার সুযোগ পাননি। এক কালে পঞ্জাব থেকে বেনারসে এসে শাল আর শাড়ির ব্যবসা করে ফুলেফেঁপে উঠেছিল খন্না পরিবার। বেনারসের ক্ষত্রি সমাজে ছিল তাঁদের মস্ত দাপট। প্রেমকুমারের আমলে সেই প্রতিপত্তি উধাও। বেনারসের নেপালি মন্দিরের সামনে তাঁদের কাফনের দোকান তখন। কষ্টের দিন গুজরান। সাদামাটা জীবনটা তাঁর পাল্টে যায় রমাকান্ত ক্ষত্রীর সাহচর্যে। আর্য সমাজের প্রচারক ছিলেন রমাকান্ত। প্রেমকুমারের জীবনে তাঁর প্রভাব পড়ে। বিয়ে-থা আর করেননি। অল্প দিনেই সন্ন্যাসী গোছের প্রেমকুমার বেনারসবাসীর হৃদয় দখল করে হয়ে ওঠেন আদরের ভাইয়াজি।
শুধু দয়ানন্দ সরস্বতীর জীবনদর্শনই নয়, মহাত্মার আদর্শও ভাইয়াজিকে প্রভাবিত করেছিল। জাতীয়তাবাদীদের রক্ষণশীল মনোভাবেরও উগ্র সমর্থক ছিলেন তিনি, বাইজিদের প্রতি ছিল তাঁর বিদ্বেষ। বিশ শতকের শুরুতে জাতীয়তাবাদীদের সংস্কার আন্দোলনের জোয়ারে ভাসছে গোটা দেশ। এর কোপ পড়েছিল বাইজিদের উপর। অমৃতসর থেকে মাদ্রাজ, সর্বত্র ‘অ্যান্টি নাচ’ (Anti nautch, ভারতীয় ‘নাচ’ শব্দটি ওই ভাবেই ইংরেজি করা হয়েছিল) ক্যাম্পেন জোরদার তখন। নেতৃত্বে কট্টর বিশুদ্ধবাদীরা। সেই দলে কংগ্রেসিরা যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন আর্য কিংবা ব্রাহ্ম সমাজীরাও। বাইজিরা তটস্থ। ভয়ে মহল্লা ছেড়ে পালাতে শুরু করেছিলেন তাঁরা। ১৯১৭ সাল। আগরার মিউনিসিপ্যাল বোর্ড ঘোষণা করে— শহরের ভিতর বাড়ি কেনা তো দূরস্থান, বাইজিরা বাড়ি ভাড়াও নিতে পারবেন না। রুরকি, খুরজার মতো ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের পুরসভাও একই কথা ঘোষণা করে।
ভাইয়াজি উল্লসিত। উনিশ শতকের শেষ দশক থেকেই বাইজিদের বিরুদ্ধে পত্রপত্রিকায় লেখালিখি করছেন তিনি। চোর-ডাকাত-ছিনতাইবাজ-খুনিদের সঙ্গে যে এঁদের বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই, চেষ্টা করেছেন সে কথা প্রমাণ করার। শহরের অন্যান্য এলাকার তুলনায় চক, নারিয়েল বাজার, রাজা দরওয়াজা, ডালমন্ডির মতো বাইজিপাড়াগুলির অপরাধমূলক কাজের আধিক্য সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিভিন্ন মহল্লায় বক্তৃতা দিয়েছেন। তাঁর লাগাতার চেষ্টায় কাজ হয়েছিল। বেনারস পুরসভা কিছুটা বাধ্য হয়েই ঘোষণা করে, বাইজি কিংবা গণিকারা যদি কোনও বিশিষ্ট নাগরিককে হেনস্থা করে বা কোনও অপরাধীকে বাড়িতে আশ্রয় দেয়, তবে তৎক্ষণাৎ তাঁদের বাড়িছাড়া করা হবে।
১৮৯৮ সাল। পুরসভার এই সতর্কতামূলক ঘোষণায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি প্রেমকুমার। খানদানি রইস, প্রভাবশালী মহলে তখনও বাইজিদের মস্ত কদর। তাঁদের হাভেলির পারলৌকিক কাজ থেকে বিয়ে-জন্মদিন-অন্নপ্রাশন, সমস্ত উৎসবের জৌলুস ফিকে হয়ে যেত বাইজিদের অনুপস্থিতিতে। এমনকি মঠ-মন্দিরের অনুষ্ঠান বা সর্বজনীন ‘তেওহার’-এও ছিল তাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। খোদ কাশীনরেশ ছিলেন তাঁদের গুণমুগ্ধ। বাইজিদের বেনারস থেকে তাড়ানো তাই সহজ ছিল না। ফলে বেনারস পুরসভার এ-হেন ঘোষণায় বাইজিপাড়ার তেমন কিছু লোকসান হয়নি। বরং ১৯১২ সালে, বিশিষ্ট বাঙালি ধ্রুপদী ও খেয়াল গায়ক অঘোরনাথ চক্রবর্তীকে যখন ‘সঙ্গীতরত্নাকর’ খেতাব দেওয়া হল, তখন সেই সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য ডেকে পাঠানো হয়েছিল হুস্ন বাইকে। বাইজি-মহল্লার ‘আম্মিজান’ তিনি। চৌধরাইন। তাঁর অনুমতি ছাড়া বাইজি-মহল্লায় গাছের পাতাটি নড়ার জো ছিল না। শুধু সভাপতিত্বই নয়, সে দিন অঘোরনাথের হাতে খেতাবও তুলে দিয়েছিলেন তিনিই।
জাতীয়তাবাদীরা বিরক্ত। পত্রপত্রিকায় নিন্দের ঝড়। শহরের উচ্চশিক্ষিত প্রভাবশালী সম্ভ্রান্ত কলাপ্রেমিক, বিশিষ্ট সব সঙ্গীতজ্ঞ পণ্ডিত যে সভায় উপস্থিত, সেই সভায় কিনা সভাপতিত্ব করছেন এক বাইজি! ‘ভারত জীবন’ পত্রিকার সম্পাদকীয় কলাম তীব্র ভাষায় এর নিন্দে করে। এই অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন তৎকালীন বেনারসের বিখ্যাত এক বাঙালি, বাবু সুরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। সঙ্গীতবোদ্ধা মহলে তাঁর প্রতিপত্তি ছিল খুব।
বিরক্ত হয়েছিলেন ভাইয়াজিও। শহর থেকে বাইজিদের তাড়াতে তিনি আরও আটঘাট বেঁধে নামলেন এবং বাইজিবিরোধী হাওয়া তুলতে সক্ষমও হলেন। গুটিয়ে গেলেন অভিজাতরা। এমনকি কাশীনরেশও। প্রথা ভেঙে বুড়ওয়া মঙ্গল বা বুধওয়া মঙ্গল, বেনারসের অন্যতম জমকালো উৎসবে যোগ দিলেন না। বেনারসের পরম্পরার একটা অংশ এই উৎসব। সীতার সন্ধানে লঙ্কাপুরীতে যাওয়ার পর হনুমানের লেজে যখন আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, তখন বিরাট রূপ ধরে সেই আগুনেই লঙ্কাপুরী পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিলেন পবননন্দন। সেই মঙ্গল-ঘটনাকে মনে রেখেই বুড়ওয়া মঙ্গল উৎসব পালন। প্রায় তিনশো বছরের পুরনো উৎসব। এর মূল আকর্ষণ ছিল বাইজিদের নাচগান। অসি ঘাটে গঙ্গার উপর একের পর এক নৌকো জোড়া দিয়ে তৈরি হত মঞ্চ। সেই মঞ্চে উঠে যখন গাইতে বসতেন বাইজিরা, সেই গান নাকি শোনা যেত দশাশ্বমেধ ঘাট থেকেও। এতটাই গলার জোর ছিল তাঁদের। সে সুর এতই স্পষ্ট যে, শুনেই বোঝা যেত কে গাইছেন! তথ্যদাতা কুবেরনাথ সুকুল। পুরনো বেনারসের অনেক গল্পই শুনিয়ে গেছেন তিনি।
শহরে ভিড় উপচে পড়ত বলে অবাঞ্ছিত অনেক ঘটনাও ঘটত সে সময়। এর বিরুদ্ধে প্রেমকুমার ও তাঁর অনুগামীরা সোচ্চার হলে কাশীনরেশ সেই উৎসব বয়কট করতে বাধ্য হন। পরে বিশুদ্ধবাদীদের আন্দোলনে ১৯৩৬ সালে এই উৎসব বন্ধ হয়ে যায়।
বিশুদ্ধবাদীদের আন্দোলনে ও দাপটে সঙ্গীতরসিকদের হাভেলিতেও তখন বাইজিদের মেহফিল বন্ধ। শিক্ষিত অভিজাতরা প্রকাশ্যে বাইজিদের এড়িয়ে চললেও বাইজি-মহল্লায় রইসদের আনাগোনা বন্ধ হয়নি। আগরা বা ভারতের অন্যান্য পুরসভার মতো বেনারসের পুরসভা বাইজিদের শহর থেকে তাড়িয়ে দেয়নি বলে ক্ষুব্ধ ভাইয়াজি ধুয়ো তুললেন জনবহুল এলাকায় বাইজিদের বসবাসের দরুন কলুষিত হচ্ছে শহরের সাংস্কৃতিক পরিবেশ। বিশুদ্ধবাদীদের পাশে দাঁড়ালেন ব্যবসায়ীমহল। ব্যবসার খাতিরেই। শহরের প্রাণকেন্দ্রে বাড়ি দখল করতে পারলে আখেরে লাভ তাঁদেরই। প্রতিবেশী খানদানি পরিবারগুলিও সুস্থ পরিবেশ চাইছিলেন। এঁদের সঙ্গে কথা বলে বাইজিদের উচ্ছেদ করতে এক দিন সদলবলে ভাইয়াজি হাজির হলেন ডালমন্ডিতে।
১৯১৯ সালের কথা। গ্রীষ্মকাল। বেনারসে লু বইছে তখন। অতিরিক্ত পরিশ্রমে দুর্বল ভাইয়াজির শরীর এই গরম সহ্য করতে পারেনি। হঠাৎই অচেতন হয়ে পড়ে যান তিনি। ভাইয়াজির গতিবিধির উপর কড়া নজর ছিল বাইজিদের। ডালমন্ডির নেতৃস্থানীয়া বাইজি সুলতানার কানে সেই খবর পৌঁছতে সময় লাগেনি। লোক পাঠিয়ে অচেতন ভাইয়াজিকে তিনি তুলে নিয়ে আসেন নিজের কোঠিতে। তাঁর পরিচর্যাতেই সে বার প্রাণ বাঁচে প্রেমকুমারের।
পত্রপত্রিকায় এই বাইজিদেরই কদর্য ভাষায় আক্রমণ করেছেন তিনি। ঘরছাড়া করতে চেয়েছেন তাঁদের। আর তাঁরাই কি না তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করছেন, বাঁচিয়ে তুলেছেন! সুলতানার সহবত, তহ্জ়িব পাল্টে দেয় ভাইয়াজির ভাবনার জগৎ। সুলতানার কাছে বাইজিদের অন্ধকার যাপনকথা শুনে পাল্টায় তাঁর মনোভাব। শান-শওকতের আড়ালে বাইজিদের দুঃখভরা জীবনবৃত্তান্তের সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। সেই থেকে প্রেমকুমার বাইজিদের সুখদুঃখের শরিক। বাইজিপাড়ার কমবয়সি মেয়েদের নাচগানের পেশা থেকে মুক্তি দিতে তিনি তাঁদের বিয়ে দেওয়ার বহু চেষ্টা করেছেন, লাভ হয়নি। বাইজিদের হয়ে উপরমহলে লেখালিখিও করেছেন বিস্তর। চেষ্টা করেছেন তাঁদের নতুন জীবন দেওয়ার। আর হ্যাঁ, তাঁর উদ্যোগেই প্রথম বেনারসের বাইজিরা অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
২৬ নভেম্বর, ১৯২০। সে দিন বেনারসের টাউন হলে বিশ হাজার মানুষের এক সমাবেশে বিদেশি জিনিস বয়কটের আহ্বান জানিয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। বাপুর অজানতেই সে দিন বিদ্যাধরীর নেতৃত্বে এক দল বাইজি উপস্থিত ছিলেন সেই সভায়। এই ব্যাপারে তাঁদের উৎসাহিত করেছিলেন ভাইয়াজি। বাপুর বক্তৃতা শুনে সে দিন বিদ্যাধরী এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, আর কখনও রেশমি কাপড় কিংবা অলঙ্কার স্পর্শ করেননি। অথচ এক কালে ভারতের ফ্যাশন আইকন ছিলেন তিনি। তামাম ভারতবর্ষের প্রতিটি রাজদরবারে বিদ্যাধরী মেহফিল সাজিয়ে বসেছেন। তাঁর সুরের গমক-গিটকিরি-নজ়াকত-নখরায় মুগ্ধ হয়েছেন সঙ্গীতরসিক রাজা-মহারাজার দল। বিদ্যাধরীর গলায় এক বার গীতগোবিন্দ শোনার জন্য হামলে পড়তেন তাঁরা। কামসূত্রের পাঠ নিয়েছিলেন তিনি দামোদরলাল পণ্ডিতের কাছে। রাজরানিরা তাঁর হিরে-জহরত বসানো অলঙ্কারের ডিজ়াইন নকল করে পরতেন।
এ-হেন বিদ্যাধরী রাতারাতি পাল্টে গেলেন। ফিনফিনে রেশমি কাপড়ের বদলে তাঁর গায়ে উঠল খদ্দরের মোটা কাপড়। অলঙ্কার বলতে হাতে শুধু লোহার কড়া আর গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। সুলতানাকে নিয়ে তিনি হাজির হন চৌধরাইন হুস্ন বাইয়ের দরবারে। আর্জি, সভা ডাকতে হবে। আপত্তি করেননি হুস্ন বাই। আম্মিজানের নেওতা পেয়ে তাঁর রাজা দরওয়াজার কোঠিতে হাজির হয় বেনারসের বাইজি-মহল্লার আবালবৃদ্ধবনিতা। সে ১৯২১ সালের অগস্ট মাসের কথা। সেই সভায় বাপুর আদর্শ নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন ভাইয়াজি। গান্ধী মহারাজ বাইজিদের কাছে অপরিচিত নন। তবে তাঁর লড়াইয়ে শামিল হওয়ার গৌরব যে তাঁরাও লাভ করতে পারেন, বাইজি-মহল্লা সেই স্বপ্ন দেখতে সাহস করেনি কখনও। ঘৃণা আর লাঞ্ছনার জীবনকে প্রভাবিত করেছিল মহৎ জীবনের স্বপ্ন। তৈরি হল ‘তবায়েফ সভা’। সভাপতি হলেন হুস্ন বাই।
হুস্ন বাই ছিলেন শিক্ষিতা। তাঁর হাতের লেখার প্রশংসা করতে গিয়ে সমকালীন বেনারসের এক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব রায়কৃষ্ণদাসজি লিখেছিলেন, “পুরুষোঁ কি লিখত-জৈসে সুন্দর অক্ষর উসকে হতে থে।” কেন পুরুষের উপমা টানা? কারণ সেই সময় খুব কম মহিলাই লেখাপড়া জানতেন। হুস্ন জবরদস্ত বক্তৃতাও দিতেন। ‘তবায়েফ সভা’-র প্রথম মিটিংয়ে বলেছিলেন, “সোনার গয়নার বদলে শেকলের প্রতীক লোহার গয়না পরা উচিত আমাদের।” তাঁর বক্তৃতায় প্রভাবিত হয়ে বেনারসের অনেক বাইজিই তখন হাতে লোহার কড়া পরতে শুরু করেছিলেন। বিদ্যাধরী যেমন। বাপু তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন, “আজ থেকে গানের অনুষ্ঠানে আপনি দেশের গান, মাটির গানই গাইবেন শুধু।” সেই থেকে বাপুর অনুরোধ আদেশ হিসেবে পালন করেছেন বিধ্যাধরী। খেয়াল, ঠুংরি, কাজরি, চৈতি, হোরি কিংবা ভজনের বদলে সেই প্রথম স্বদেশি গান বাঁধলেন এক বাইজি। শুধু গান বাঁধা-ই নয়, প্রতিটি মুজরাতে গাইতেও শুরু করেছিলেন সেই গানগুলি। পুলিশ-কোতোয়ালের রাঙাচোখ অগ্রাহ্য করেই। এমনই একটি গান:
চুন-চুন কে ফুল লে লো অরমান রহ ন যায়ে,
ইয়ে হিন্দ কা বগিচা গুলজ়ার রহ ন যায়ে।
ইয়ে বো চমন নহি হে লেনে সে হো উজাড়,
উলফত কা জিসমে কুছ ভি এহসান রহ ন যায়ে...
মুজরা-মেহফিলের ইতিহাসে এর আগে আর কেউ স্বদেশি গান গাইতে সাহস করেননি। পরবর্তী সময়ে সেটাই দস্তুর হয়ে দাঁড়ায়। মেহফিলে তখন শ্রোতারা স্বদেশি গান শোনার বায়না করতেন, জানিয়েছেন আসগরি বাই। বিদ্যাধরীর কোঠিতে সেই সময় আত্মগোপন করে থেকেছেন অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিনি তাঁদের আর্থিক সাহায্য করেছেন। দেশের কাজে বিলিয়ে দিয়েছেন তাঁর লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি। বেনারসের কোঠি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন জসুড়ি, তাঁর গ্রামের বাড়িতে। বিনে পয়সায় তখন গাঁয়ের ছেলেপুলেদের গান শিখিয়েছেন। খুব সাধারণ জীবনযাপন ছিল তাঁর। দয়িতের মৃত্যুর পর, পালন করেছেন কঠোর বৈধব্য। কিংবদন্তি আরও কত কিস্সা শোনায়। সেই সব কিস্সার একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অলিখিত আখ্যান। যা উপেক্ষার আখ্যানও বটে। কারণ ইতিহাসের মূলস্রোতে তাঁদের নামগুলি কোথায় হারিয়ে গেছে।
তথ্যসূত্র: ঠুম্রী ও বাঈজী: রেবা মুহুরী— প্রতিভাস (২০১০); ইয়ে কোঠেওয়ালিয়া: অমৃতলাল নাগর— লোকভারতী পেপারব্যাক, এলাহাবাদ (২০০৮); তবায়েফনামা: সেবা দেওয়ান— ওয়েস্টল্যান্ড পাবলিকেশন্স, চেন্নাই (২০২১)