উদ্যোগী: বালগঙ্গাধর তিলক ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নিবেদিতার পত্রাবলিতে যখন বুঁদ হয়ে আছি, সেই সময় করোনাবন্দি এক ভদ্রলোকের ফোন এল, শুধু বিবেকানন্দ-নিবেদিতা কেন? প্লেগে বঙ্কিম বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথের কী ভূমিকা ছিল তার খোঁজ দিচ্ছেন না কেন?
আমার হাতের কাছে সব সময় চরিতাভিধান থাকে। বললাম, সঙ্কটের সময় সময়জ্ঞান হারালে যা হয়, তারই আর এক নাম বিনাশকালে বিকৃতবুদ্ধি। কেন ভুলে যাচ্ছেন যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মহাপ্রয়াণ ২৯ জুলাই ১৮৯১ এবং বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যু ৮ এপ্রিল ১৮৯৪!
আমাকে যিনি ফোন করেছিলেন তিনি রবি-কৌতূহলী। বললেন, হোয়াট অ্যাবাউট টেগোর? আপনার তো এক সময় বিশ্বভারতী ও তার প্রকাশন বিভাগের সঙ্গে দহরম-মহরম ছিল। এক সময় শুনতাম, কোনও বিষয় উঠলেই প্রথমে খোঁজ করতে হবে তা ‘ব্যাদে’ আছে কি না এবং রবিঠাকুর এ বিষয়ে কী বলে গিয়েছেন। তার পরেই কৌতূহল, কঠিন সময়ে রবীন্দ্র-বিবেকানন্দ খিটিমিটি কতটা এগিয়েছিল? আরও প্রশ্ন: সন্ন্যাসীদের হাত থেকে নিবেদিতাকে ছিনিয়ে নেওয়ার আশঙ্কা কি সত্যিই ছিল?
সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান একটি সংবাদের স্বর্ণখনি বিশেষ, কিন্তু এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের খবরাখবর কতটুকু থাকবে? হতাশ হওয়ার কারণ নেই ঘরবন্দি অবস্থায়, এক সময় শঙ্করীপ্রসাদ বসুর প্রিয় প্রশান্ত পাল মহাশয়ের বইটা খণ্ডে খণ্ডে কেনা অভ্যেস করেছিলাম এবং আমার হতাশার কারণ, এই বই অসম্পূর্ণ রেখেই প্রশান্ত পাল চলে গেলেন। প্রকাশক অফিসে ফোন করেছি, কিন্তু তাঁরা নির্বাক। বাঙালিরা শুরু করে কিন্তু শেষ করে না, আমাদের কোনও সাহিত্যকর্ম সম্পূর্ণ নয়— এক বার শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, লীলাপ্রসঙ্গ, বাঙ্গালীর ইতিহাস-এর দিকে তাকিয়ে দেখবেন, সব ইনকমপ্লিট! অসমাপ্ত! সেই একই দুঃখ প্রশান্ত পালের রবিজীবনী-তে, অথচ চেষ্টা করলে তাঁর দেহাবসানে রিলে রেসের দ্বিতীয় রানারকে পাওয়া যেত। গবেষক প্রশান্তকুমার অন্ধভক্তিতে গদগদ না হয়ে রবীন্দ্রজীবনকে অন্য এক উচ্চতায় তুলে নিয়ে গিয়ে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রজীবনী-কে কয়েক মাইল পিছনে ফেলে রেখে এগিয়ে গেলেন। প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের এক জন অধ্যাপিকাকে চিনতাম, সেই সুবাদে এক সময় রবীন্দ্রজীবনী-ও কিনেছিলাম, মন দিয়ে পড়েওছিলাম, কিন্তু আমার মাস্টারমশাই অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সব কিছু মনে রাখতে পারিনি। অসিতদা যখন বেঁচে ছিলেন অসুবিধে হয়নি, ফোন ধরেই যে কোনও প্রশ্নের ঝটপট উত্তর দিতে পারতেন, বলে দিতেন কোন বইয়ের কোন খণ্ডে আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর আছে। অসিতদা ফোনের অপর প্রান্তে আছেন বলেই কষ্ট করে কিছু পড়ার বা মনে রাখার প্রয়োজন মনে করতাম না।
এখন দুঃসময়, প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম খণ্ড ধুলো ঝেড়ে বার করলাম, সেখানে ১৮৯৯ পর্বে লেখা— ‘আত্মীয়দের পীড়া লইয়া প্রায় একমাস কলিকাতা কাটাইয়া রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে ফিরিলেন।’ জগদীশচন্দ্রকে চিঠি, ‘চোখের বালি’ উপন্যাস রচনায় মনোযোগী হইয়াছেন, তবে ‘মাসিক পত্রিকার তাড়া নাই’, তাই আপনমনে ‘আস্তে আস্তে লিখিতেছেন।’
চাপেকর ভাইদের নিয়ে তৈরি ওয়েব সিরিজ় ‘গোন্ডিয়া আ লা রে’-র পোস্টার
তার পর প্রভাত মুখোপাধ্যায় দিচ্ছেন মজার খবর— ‘ইতিমধ্যে কলিকাতা হাইকোর্ট হইতে পরোয়ানা আসিল তাঁহাকে জুরিতে বসিতে হইবে। কলিকাতায় যাইতে হইল।... ১৮৯৯ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ হাইকোর্টের জুরি হইতে মুক্ত হইয়া শান্তিনিকেতনের আসন্ন উৎসবের জন্য বক্তৃতা বা ধর্মদেশনা লিখতে ব্যস্ত। কিন্তু মহামারিতে বিড়ম্বিত জর্জরিত কলকাতার খবর কই?
অতএব প্রশান্তকুমার পাল স্মরণং। তিনি খুঁটিনাটি খবর বিতরণে সিদ্ধহস্ত। নতুন বছরে বড় খবর, ২২ এপ্রিল ১৮৯৮ পুত্র রথীন্দ্রনাথের উপনয়ন, তিন দিন পরে ২৫ এপ্রিল বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে নানা দেশের বিখ্যাত পণ্ডিতদের আপ্যায়নের জন্য কলকাতা থেকে ‘প্রচুর পরিমাণে মাখন মিছরি পেস্তা বাদাম’ নিয়ে যাওয়া, ‘ক্যাশবহির হিসাব থেকে জানা যায়, উপনয়নের জন্য ১৩৪৫ টাকা ৪ আনা ৯ পাই খরচ হয়েছিল।’
তার পর শুনুন প্রশান্ত পালের উদ্ধৃতি, তাঁর রবিজীবনী-র চতুর্থ খণ্ড থেকে। ‘রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে থাকিয়া নিশ্চিন্তমনে তথাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সন্দর্শনকরতঃ পরমানন্দ উপভোগ করিতেছিলেন। এমন সময় তথায় সংবাদ পঁহুছিল কলিকাতায় প্লেগ আসিয়াছে।’ বোম্বাই অঞ্চলে প্লেগের ভয়াবহ আক্রমণের বিবরণে গত এক বছরের সংবাদপত্র পূর্ণ ছিল— কলকাতায় যাতে তার সংক্রমণ ঘটতে না পারে তার জন্য বাংলার বিভিন্ন স্থানে বহিরাগতদের পরীক্ষা করার ব্যবস্থা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও ১২-১৩ বৈশাখের সংবাদপত্রে যখন প্লেগাক্রান্ত দু’-একটি রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হল, তখন শহরবাসীর মধ্যে এক ভয়ানক আতঙ্ক দেখা দিল। ‘... ১৫ ১৬ ও ১৭ বৈশাখ শহরে জনস্রোতের বিরাম ছিল না। শহরের গাড়ি পাল্কী ক্রমশ দুর্মূল্য হইয়া উঠিল— অবশেষে তাহাও অপ্রাপ্য হইয়া উঠিল।… যখন গাড়ি পাল্কী পাওয়া একেবারে দুর্লভ হইয়া পড়িল, তখন এই দুর্বিপাকে পড়িয়া কত ভদ্র পরিবারের অসূর্যম্পশ্যা রমণী কলিকাতা সহরের রাজপথে বহিষ্কৃত হইয়া পদব্রজে চলিয়া গিয়াছে— কে তাহার গণনা করিয়াছে।’ তখনকার অমৃতবাজার পত্রিকা এই ঘটনাকে 'The Exodus of the East Bengal People and the Marwaris' বলে বর্ণনা করেছে। প্লেগের টিকা দেওয়া নিয়ে ৩ মে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে দাঙ্গা বাধে— প্রধানত ইউরোপীয়রা এই দাঙ্গার লক্ষ্য।
সুতরাং প্লেগের খবর পেয়েই রবীন্দ্রনাথের পক্ষে শান্তিনিকেতনে বসে থাকা সম্ভব হল না। ‘তিনি পুত্রকন্যাদিগকে বোলপুরে রাখিয়া ত্বরায় প্লেগ-সংক্রামিত শহরে উপস্থিত হইলেন।’ প্রশান্ত পালের এ বার নিবেদন— ‘উদ্বিগ্ন পত্নীকে কুশল জ্ঞাপক টেলিগ্রাম ও পত্রের হিসাবটি রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব ক্যাশবহির অন্তর্গত। দোতলা, তেতলা ও নীচে প্লেগ নিবারণের জন্য condisfluid ছড়ানোর ঠিকে মজুরী বৈশাখ মাসের ১৫ দিন হইতে জ্যৈষ্ঠ মাসের ১৫ রোজ পর্যন্ত একমাসে সাত টাকা খরচের সরকারী হিসেবেও।’ রবীন্দ্রনাথ ২৬ বৈশাখ পর্যন্ত কলকাতায় ছিলেন— এর মধ্যে ১৪, ১৫, ১৭, ১৯, ২২, ২৩, ২৪ ও ২৬ তারিখে পার্ক স্ট্রিটে পিতৃদেবের বাসস্থানে গিয়েছিলেন।
কিন্তু এ যাত্রায় কলকাতায় প্লেগ মহামারির আকার ধারণ করেনি, ফলে উদ্বেগ-আশঙ্কা অল্প দিনেই কেটে গিয়েছিল— এমনকি তাঁর অষ্টাত্রিংশ জন্মদিনে সত্যপ্রসাদের দ্বিতীয় পুত্রের শুভ অন্নপ্রাশন মোটামুটি সমারোহ সহকারে অনুষ্ঠিত হয়— রবীন্দ্রনাথ এই উপলক্ষে ৪ টাকা
যৌতুক দেন।
কয়েক মাস আগে ‘কণ্ঠরোধ’ প্রবন্ধটি ‘সেডিশন বিল’ পাশ হওয়ার আগের দিনে (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৮) ‘টৌন্ হল’ মিটিং-এ পাঠ করেন। সম্পাদকীয় দায়িত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে যে তাগাদা দিয়েছিলেন সেখানেও প্লেগসন্ধানী প্রশান্তকুমার প্রবেশ করেছেন। ২ মে রবীন্দ্রনাথের চিঠি: ‘ভারতী পাইয়া থাকিবেন। কিছু লেখা প্রার্থনা করি। প্লেগের বিভীষিকা কয়দিন উদ্ভ্রান্ত করিয়া তুলিয়াছিল।’ প্রশান্ত পালের অসমাপ্ত রবিজীবনী একটি আশ্চর্য বই, এখানে রবিঠাকুরের গরু হারালেও তা খুঁজে পাওয়া যাবে। তিন রকম সাক্ষ্যের উপর তিনি নির্ভর করেছেন— কবিগুরুর রচনা, তাঁর দৈনন্দিন কাজকর্ম এবং যা অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক, ঠাকুর পরিবারের হিসেব খাতা।
মহামারির খোঁজখবর করতে গিয়ে জোড়াসাঁকোর ‘খামখেয়ালী সভা’-র বিস্তারিত বিবরণেও নাক গলিয়েছেন আমাদের প্রশান্ত পাল। এই সভার নিমন্ত্রণপত্রও বেশ মজার ছিল। ‘একটা স্লেট ছিল... সেই স্লেটটিতে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যেকবার কবিতা লিখে দিতেন, সেটি সভ্য ও অভ্যাগতদের বাড়ি বাড়ি ঘুরত। ওই ছিল খামখেয়ালীর নেমন্তন্নপত্র।’ একটি নিমন্ত্রণপত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন:
শুন সভ্যগণ যে যেখানে থাকো।
সভা খামখেয়াল, স্থান যোড়াসাঁকো,
বার রবিবার, রাত সাড়ে সাত,
নিমন্ত্রণকর্তা সমরেন্দ্রনাথ।
এর পরেই সভার এজেন্ডা—
তিনটি বিষয় যত্নে পরিহার্য্য,
দাঙ্গা, ভূমিকম্প, পুণাহত্যাকার্য্য।
এই ‘পুণাহত্যাকার্য্য’, প্রশান্ত পাল জানাচ্ছেন, তখন বহু আলোচিত। ‘‘১৮৯৬-এ বোম্বাই প্রদেশে মহামারীর আকারে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই রোগ দমনের উদ্দেশ্যে ‘প্লেগ রেগুলেশন’ জারি করা হয়। অত্যুৎসাহী কিছু সরকারি কর্মচারী প্লেগ রোগীর অনুসন্ধানে দেশীয়গণের অন্দরমহলে হানা দিতে শুরু করলে প্রবল বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এর ফলে ২২ জুন মঙ্গলবার পুণার রাজপথে প্লেগ কমিটির প্রেসিডেন্ট ডব্লিউ সি র্যান্ড ও লেফটেন্যান্ট আয়ার্স্ট দু’জন মহারাষ্ট্রিয় যুবকের দ্বারা নিহত হন। ঘটনাটি সমগ্র ভারতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।’’
আসলে তিন ভাই-ই সে দিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। দামোদর হরি চাপেকর, বালকৃষ্ণ হরি চাপেকর আর বাসুদেব হরি চাপেকর। তিন জনেই রাস্তায় পিস্তল ও তরবারি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। র্যান্ডের গাড়ি দূর থেকে দেখামাত্র ‘গোন্ডিয়া আ লা রে’ বলে তাঁরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ওটাই ছিল নিজস্ব সঙ্কেত।
রবিজীবনীকার এর পরে কলকাতা হাঙ্গামার রিপোর্ট সি ই বাকল্যান্ড থেকে উদ্ধৃত করেছেন। এই রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে— ৩০ জুন ও ১ জুলাই ১৮৯৭ কলকাতার চিৎপুরে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়। পুলিশ এই দাঙ্গাবাজদের হঠিয়ে দেয় ৩০ জুনের সকালে, কিন্তু এরা একটু পরে টালা পাম্পিং স্টেশন আক্রমণ করে। হ্যারিসন রোডেও প্রবল অশান্তি পুলিশকে গুলি চালাতে বাধ্য করে। পুলিশের ডেপুটি কমিশনার যে অস্ত্রের ব্যবহার করেন তার নাম ‘বাক-শট’, অনেক লোক মারা যান এবং অনেকে আহত হন। দাঙ্গা থেমে যায় এ বার, কিন্তু মৃতের সংখ্যা ১১ এবং আহত ২০।
এরই মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতৃদেবের হয়ে বিভিন্ন জমিদারি মামলার তদবিরের জন্য আইনজীবী মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পার্ক স্ট্রিটে যাতায়াত করছেন এবং এক দিন মধ্যাহ্নে বাড়ি ফিরতে না পারায় স্থানীয় রেস্তরাঁয় খাওয়াদাওয়া করছেন।
এই সময়ে (১৪ অক্টোবর) লেখক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে লিখছেন— ‘আগামী কার্ত্তিক মাস হইতে ভারতীর সম্পাদকীয় কার্য্যভার আমি গ্রহণ করিতেছি।... তিলকের সমস্ত খবর কাগজে পড়িয়াছেন, এক্ষণে প্রীভি কাউন্সিলে আপিল করিবার খরচা সংগ্রহে ব্যস্ত আছি। আপনাদের অঞ্চলের জমিদারবর্গের নিকট হইতে কিছু কিছু জোগাড় করিতে পারেন না? আমরা মেয়েদের কাছ হইতেও কিছু কিছু পাইতেছি... যদি তিলকের চাঁদা সম্বন্ধে কোন সংবাদ দিবার থাকে আপনি অনুগ্রহপূর্বক আমাদের বাড়ির ঠিকানায় শ্রীমান সুরেন্দ্রনাথকে চিঠি লিখিবেন।’
পুণের প্লেগ হত্যার ব্যাপারে কিছু আলোকপাত প্রয়োজন। র্যান্ড হত্যার পরে বোম্বাই গভর্নমেন্ট প্রতিহিংসা গ্রহণে তৎপর হয়ে ওঠে। মরাঠি সাপ্তাহিক কেশরী পত্রিকায় (১৫ জুন) সম্পাদক বালগঙ্গাধর তিলকের (১৮৫৬-১৯২০) ‘শিবাজী ও আফজল খাঁ’ বিষয়ক একটি বক্তৃতা মুদ্রিত হয়। এরই কয়েক দিন পর ২২ জুন বর্ষপূর্তির দিনে র্যান্ড ও আয়ার্স্টের হত্যাকাণ্ড ঘটে। হত্যাকারীর সন্ধানে ব্যর্থ বোম্বাইপুলিশ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করল রাজদ্রোহের অভিযোগে তিলক ও নাটু-ভ্রাতৃদ্বয়কে গ্রেফতার করে। তিলক তখন বোম্বাই আইনসভার সদস্য, তবু তাঁকে জামিন না দিয়ে বোম্বাই প্রেরণ করা হয়।’’
প্রশান্ত পাল এর পর অমল হোম থেকে যে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তা আজও পাঠযোগ্য, ‘‘১৮৯৭ সালে তিলক যখন প্রথম রাজদ্রোহাপরাধে অভিযুক্ত, বোম্বাই হাইকোর্টে তখন তাঁহার পক্ষ সমর্থনের জন্য কৌঁসুলী পাওয়া দুর্লভ হইল— উকিলমহলেও এমনি আতঙ্ক। তিলক কলিকাতায় শিশিরকুমার ঘোষ মহাশয়ের নিকট অবস্থা জানাইলেন। কলিকাতা হইতে কৌঁসুলী পাঠাইবার ব্যবস্থা করিবার জন্য অমৃতবাজার পত্রিকা অফিসে পরামর্শসভা আহূত হইল। আমন্ত্রিতদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথও ছিলেন। মতিলাল ঘোষমহাশয়ের নিকটে শুনিয়াছি, সভাকক্ষে শুভ্র-উত্তরীয় রবীন্দ্রনাথ প্রবেশ করিলেন— ললাটে তাঁহার রক্ততিলক। তিলকের জন্য কলিকাতার কৌঁসুলী-নিয়োগের ব্যয়নির্বাহার্থ চাঁদা তুলিবার কাগজে রবীন্দ্রনাথ সাগ্রহে যোগদান করিলেন। তাঁহার নিকট শুনিয়াছি, চাঁদার জন্য তারকনাথ পালিত মহাশয় আশুতোষ চৌধুরী মহাশয়ের অনুরোধ রক্ষা না করায় রবীন্দ্রনাথ তাঁহার নিকট গিয়া এক হাজার টাকা আদায় করেন। প্রায় সতেরো হাজার টাকা সংগ্রহ করিয়া কলিকাতার দুইজন বিখ্যাত ইংরেজ ব্যারিস্টার— নিউ ও গার্থ সাহেবকে বোম্বাইয়ে পাঠানো হয়। তাঁহাদের জুনিয়র হিসাবে যান আশুতোষ চৌধুরীর ভ্রাতা ও সুরেন্দ্রনাথের জামাতা ব্যারিস্টার যোগেশচন্দ্র চৌধুরী।’’
প্রশান্ত পাল দিনক্ষণ নথিভুক্ত করতে সর্বদা সজাগ। তিনি লিখছেন, ‘‘বোম্বাই হাইকোর্টে তিলকের মামলা আরম্ভ হল ৮ সেপ্টেম্বর (বুধবার)। ইউরোপীয় জুরিদের সঙ্গে একমত হয়ে বিচারপতি স্ট্র্যাসি ১৪ সেপ্টেম্বর তিলককে ১৮ মাস সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন।... বিলেতের প্রিভি কাউন্সিলে এই দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপীল করার জন্য ‘তিলক ডিফেন্স ফান্ড’ গড়ে চাঁদা তোলা আরম্ভ হয়। রামেন্দ্রসুন্দরকে লেখা চিঠি থেকে দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ এ ক্ষেত্রেও কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিলেন। অবশ্য প্রিভি কাউন্সিলে তিলকের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়।’’
প্রশান্তকুমার জানিয়েছেন এই সময় রবীন্দ্রনাথ আকৃষ্ট হয়েছিলেন মরাঠা ইতিহাসে। মরাঠি গাথা অবলম্বনে তিনি লেখেন ‘প্রতিনিধি’ কবিতাটি। শিবাজির গেরুয়া পতাকা যে ‘ভাগোয়া ঝান্ডা’ নামে খ্যাত, তাও বাঙালি পাঠক জানতে পারছেন।
পুণে হত্যাকাণ্ডের পর ইংরেজ সরকার যে প্রতিহিংসায় তৎপর হয়ে ওঠেন, তা এখন সকলেই জানেন। দেশীয় সংবাদপত্রে এই প্রতিহিংসাপরায়ণতার তীব্র প্রতিবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ, রবিজীবনীকার তার সংক্ষিপ্ত উল্লেখ করে লিখছেন, ‘‘প্রতিবাদী কণ্ঠগুলিকে স্তব্ধ করে দেবার উদ্দেশ্যে ভারতীয় পেনাল কোডের কয়েকটি ধারা সংশোধন করতে চেয়ে ভারত সরকারের আইন সদস্য মিস্টার চাথার্ম ২১ ডিসেম্বর ১৮৯৭ কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভায় সেডিশন বিল পেশ করেন। দেশব্যাপী বিক্ষোভকে উপেক্ষা করে স্থির হয় ১৮ ফেব্রুয়ারি এই বিল আইনে পরিণত হবে। এই সিদ্ধান্তের পুনর্বিবেচনার জন্য ভাইসরয়ের কাছে আবেদনের জন্য টাউন হলে যে সভা হয়, সেখানে প্রতিবাদী রবীন্দ্রনাথ একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন যার নাম ‘কণ্ঠরোধ’। এই প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন রবীন্দ্রজীবনীকার— ‘‘অন্তর্দাহ বাক্যে প্রকাশ না হইলে অন্তরে সঞ্চিত হইতে থাকে, সেই অস্বাস্থ্যকর অস্বাভাবিক অবস্থা রাজাপ্রজা কারও পক্ষেই হিতকর নয়।’’
এই প্রসঙ্গে প্রশান্তকুমার সমালোচকের সুরে লিখেছেন, ‘‘লক্ষণীয়, সিডিশন আইন কতটা তীব্রতার সঙ্গে প্রযুক্ত হতে পারে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকায় রবীন্দ্রনাথ যথাসম্ভব সতর্কতার সঙ্গে মত প্রকাশ করেছেন।’’
জানা যাচ্ছে যে, বোম্বাই সরকার প্লেগের আবির্ভাবের কথা ঘোষণা করে এবং এক বছরের মধ্যে বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোকের মৃত্যু হয়। মহামারি এ দেশে নতুন নয়, ‘‘যেটি অভিনব সেটি হল প্লেগ-দমনের নামে ইংরেজ সৈন্যদের বর্বর অত্যাচার,’’ যা দেশীয় মানুষদের সম্ভ্রমবোধকে দারুণভাবে আহত করেছিল।’’
তিলকের গ্রেফতারের পর দিন ১৮২৭ সালের এক আইনে রাজানুগত্যের অভাবের অপরাধে বলবন্ত রাও নাটু ও তাঁর ভাই হরিপন্থ রামচন্দ্র নাটু ওরফে তাতিয়া সাহেবকে গ্রেফতার করে বিনা বিচারে আমদাবাদের জেলে রাখা হয়, এ ছাড়াও গ্রেফতার হন কেশরী-র মুদ্রাকর কেশব মহাদেব বাল ও পুণের বৈভব পত্রিকার সম্পাদক শঙ্কর বিশ্বনাথ কেলকার। তিলকের ব্যাপারে জানা যাচ্ছে ম্যাক্সমুলারের প্রচেষ্টায় প্রায় এক বৎসর কারাবাসের পর তিলক মুক্তিলাভ করেন ৬ সেপ্টেম্বর ১৮৯৮।
দেশীয় মনোভাব বুঝতে অক্ষম ইংরেজদের দমননীতি কংগ্রেসের ত্রয়োদশ অধিবেশনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তোলে। এর রেশ পড়ে ঢাকা কনফারেন্সে, যেখানে রবীন্দ্রনাথ সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দেখা যাচ্ছে, ভারতী পত্রিকায় বাংলাদেশে যে প্লেগ রেগুলেশন উগ্রমূর্তি ধারণ করেনি তার জন্য সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মন্তব্য : ‘‘ইতিপূর্বে দেখা গেছে, কোনো বিষয়ে আন্দোলনকারী প্রজারা পাছে প্রশ্রয় পেয়ে যায়, এই ভয়ে গবর্নমেন্ট তাদের ন্যায্য দাবী পূরণেও কুণ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু কলকাতায় প্লেগের আবির্ভাবে যখন দেখা গেল, বাংলার লেফ্টেন্যান্ট গবর্নর স্যর জন উডবার্ন পূর্ব দেশীয় প্রজাদের পারিবারিক সংস্কারকে আহত না করার সংকল্প নিয়েছেন তখন ‘বুঝিলাম, বাংলাদেশে রাজার অভ্যুদয় হইয়াছে; এখানে রেগুলেশন-নামক এঞ্জিনের শাসন নহে— রাজার রাজ্য।... রাজার ইচ্ছা আমার ইচ্ছার সহিত একভাবে মিলিতে পারে ইহা জানিতে পারিলে রাজাকেও মনুষ্য বলিয়া প্রীতি করি। এবং আপনার প্রতিও মনুষ্য বলিয়া শ্রদ্ধা জন্মে।’’
এই প্রবন্ধে ‘প্রজাবিদ্রোহ’ নামে যে অভিনব একটি শব্দ উদ্ভাবন করেছেন, তা প্রশান্ত পালের নজর এড়ায়নি। ‘‘আমরা ক্ষুব্ধ হইলে তাহা রাজবিদ্রোহ, কিন্তু রাজারা রুখিয়া থাকিলে কি তাহা প্রজাবিদ্রোহ নহে। উভয়ের ফলই কি সমান অমঙ্গলজনক নহে।’’
প্রতিবাদী রবীন্দ্রনাথকে ঠিক মতো বুঝতে হলে প্লেগ-আক্রান্ত বাংলার কিছু বিবরণ মনে রাখা দরকার। দুঃসময়ে বহিরাগত যাত্রীদের জন্য প্লেগ-নির্ণায়ক কেন্দ্রস্থাপন হয়েছিল খানা জংশন, কাটিহার ও নামুকদিয়ায়। পরে আরও কেন্দ্রস্থাপনের বিবরণ রয়েছে। প্রতিবাদী রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘‘পূর্বে রাজার জন্মদিনে রাজাই দানবিতরণ করিয়া সাধারণকে বিস্মিত করিয়া দিতেন। এক্ষণে রাজকীয় কোন মঙ্গল উৎসবে প্রজাদিগকেই চাঁদা যোগাইতে হয়।... খানা জংশনে যখন প্লেগ-সন্দিগ্ধদের বন্দীশালা দেখিতাম তখন বারম্বার একথা মনে হইত যে অশোকের ন্যায় আকবরের ন্যায় কোনো প্রাচ্য রাজা যদি সাধারণের হিতের জন্য এই প্রকারের অবরোধ আবশ্যক বোধ করিতেন তবে তাহার ব্যবস্থা কখনই এমন দীনহীন ও একান্ত আপত্তিকর হইত না— অন্ততঃ নিরপরাধ অবরুদ্ধদের পানাহার রাজব্যয়ে সম্পন্ন হইত।... সাধারণের জন্য রাজার হিতচেষ্টা বিভীষিকাময় না হইয়া যথার্থ রমণীয় মূর্তি ধারণ করিত যদি এইসকল অবরোধশালা ও মারী হাসপাতালের মধ্যে যত্ন ও ঔদার্য প্রকাশ পাইত।’’
রবিজীবনীকারের পরবর্তী বিশ্লেষণ প্লেগের সময় রবীন্দ্রনাথের ভূমিকার প্রশংসা করেছে। ‘‘প্লেগ দমনে ছোটলাট জন উডবার্নের উদারনীতিকে তিনি প্রাদেশিক সম্মেলনে প্রকাশ্য সভায় অভিনন্দিত করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু খুঁটিনাটি ব্যবস্থার ত্রুটির দিকেও প্রকৃত জনদরদী নেতার মতন তাঁর লক্ষ্য ছিল এবং নির্ভয়ে শাসকবর্গের দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করেছেন এই তথ্যটি উপেক্ষণীয় নয়।’’
এ বার কঠিন সময়ে নিবেদিতা সান্নিধ্যের কথা। নিবেদিতা-প্রসঙ্গ এলেই প্লেগের কথা এসে যায়। সেই সঙ্গে দুঃখ ও দারিদ্রের সঙ্গে তাঁর শান্ত সংগ্রাম। জোসেফিন ম্যাকলাউড বর্ণনা করেছেন (মার্চ ১৮৯৮) যখন নিবেদিতা বেলুড়ে এলেন স্বামীজিকে দেখতে। তাঁর সারা মুখে মশা কামড়ানোর দাগ। শরীরে বোধ হয় এমন কোনও জায়গা ছিল না, যা মশার কামড় থেকে রক্ষা পেয়েছিল।
আর একটি প্লেগ কাহিনির লেখক ডা. রাধাগোবিন্দ কর— হাওড়ায় জন্ম বলে এই কিংবদন্তি চিকিৎসক সম্বন্ধে আমি এক সময় বিশেষ আগ্রহী ছিলাম। পরবর্তী সময়ে ‘প্লেগ’ বলে একটি বই লিখেছিলেন। এ যুগের পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, এ কালের বিখ্যাত আর জি কর হাসপাতাল তাঁরই নামাঙ্কিত। তিনি লিখছেন, ‘‘সেই প্লেগ মহামারীর দিনে বাগবাজারের প্রতি বস্তিতে নিবেদিতার করুণাময়ী মূর্তি দেখা যেত। নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবে তিনি ঐ দরিদ্র-দুঃস্থদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন। দুধ ও ফল ছিল তাঁর আহার। দুধ না খেয়ে ঐ টাকা বাঁচিয়ে তিনি ঐ সব প্লেগের রোগীদের ঔষধ কিনতেন।’’
রবীন্দ্রজীবনীতে নিবেদিতার সেই বিখ্যাত ‘টি পার্টির’ উল্লেখ আছে, যেখানে বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ দু’জনেই উপস্থিত ছিলেন। নিবেদিতা প্রদত্ত বিবরণে দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘মনোরম চড়াসুরে’ স্বরচিত তিনটি গান গাইলেন। পরবর্তী সময়ে জানা যাচ্ছে, নিবেদিতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুর পরিবারের সম্পর্ক ক্রমশ ঘনিষ্ঠতর হয়েছে।
একটি মজার ঘটনার উল্লেখ প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোট মেয়েকে ইংরেজি শেখাবার জন্য নিবেদিতাকে অনুরোধ করেন। ‘‘নিবেদিতা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন, সে কি! ঠাকুর বংশের মেয়েকে একটি বিলাতী খুকী বানাবার কাজটা আমাকেই করতে হবে?’’ রাগে নিবেদিতার দুই চোখ নাকি জ্বলে উঠেছিল।
আবার ফেরা যাক প্লেগ প্রসঙ্গে। ‘‘প্লেগের টিকা দেওয়া নিয়ে দাঙ্গা বাধে ৪ঠা মে। কিন্তু প্লেগের আক্রমণ ঐ বৎসর ভয়াবহ রূপ ধারণ করেনি। বাংলা গবর্মেন্টও প্লেগ-দমনে অত্যন্ত সংযত পদ্ধতি গ্রহণ করে।’’