দিশারি: দিদিয়ের দ্রোগবা
এমন দৃশ্য শুধু ফুটবল দুনিয়া কেন, বাকি দুনিয়াও আগে কখনও দেখেনি। খেলা শেষে ড্রেসিংরুমে ফিরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন জয়ী দলের অধিনায়ক ও সতীর্থেরা। তাঁদের দিকে তাক করা অগুনতি ক্যামেরা। ২০০৫-এর ৮ অক্টোবর। একটু আগেই সুদানকে ৩-১ গোলে হারিয়ে জার্মানিতে ২০০৬-এর বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলার ছাড়পত্র পেয়ে গিয়েছে আইভরি কোস্ট। ইতিহাসে সেই প্রথম বার পশ্চিম আফ্রিকার ওই দেশ বিশ্বকাপ ফুটবলের মূল পর্বে খেলবে। স্বভাবতই দিনটা ঐতিহাসিক আইভরি কোস্ট-এর কাছে। ড্রেসিংরুম থেকে খেলোয়াড়দের প্রতিক্রিয়া সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করেছে দেশের জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেল।
অধিনায়ক দিদিয়ের দ্রোগবা একটি মাইক্রোফোন তুলে বলতে শুরু করলেন, ‘‘আগামী বছর বিশ্বকাপ ফুটবলে আইভরি কোস্ট খেলবে। এখন আমরা প্রত্যেক খেলোয়াড় শুধু একটাই জিনিস চাই, আইভরি কোস্ট ঐক্যবদ্ধ হোক। দেশটা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমরা জানি, এখন আমরা যখন দেশের মানুষকে ডাকছি, তাঁরাও একই কথা বলবেন। আইভরি কোস্ট যখন খেলতে নামে, গোটা দেশ তখন এক হয়ে যায়। এমনিতে যে সব মানুষ নিজেদের মধ্যে কথা বলেন না, আমরা গোল করলে তাঁরাও এক সঙ্গে উল্লাস করেন।’’
এক যুগ পর দ্রোগবার দেশের সাত জন ফুটবলার এখন কলকাতা ফুটবল লিগে খেলছেন। মোহনবাগানে কামো বায়ি, পিয়ারলেসে ডোডোজ, রেনবো-র বাজি। এ যেন কলকাতা ময়দানে শান্তির বার্তা।
২০০২, সাগরতট ও চিরহরিৎ অরণ্যে সমৃদ্ধ আইভরি কোস্ট তখন গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত। দেশের দক্ষিণ দিকে সরকারি বাহিনীর আধিপত্য আর উত্তর প্রান্ত বিদ্রোহীদের কব্জায়। ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উত্তর প্রান্তের প্রার্থীর মনোনয়ন শেষ মুহূর্তে বাতিল করে দেওয়া হয় নতুন আইন বলে। বিরোধের সূত্রপাত সেখানেই। গৃহযুদ্ধে তত দিনে হাজারের উপর মানুষের প্রাণ গিয়েছে। হিংসা, গুলি, অগ্নিসংযোগ প্রায় রোজকার ঘটনা। ঠিক এমন সময়ে ম্যাজিক দেখাল বিশ্বকাপের মূলপর্বে প্রথম বার আইভরি কোস্ট-এর খেলতে পারার যোগ্যতা অর্জন ও দ্রোগবার আহ্বান।
সেই ড্রেসিংরুম থেকেই দ্রোগবা ও তাঁর সহ-খেলোয়াড়রা টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে যুযুধান দু’পক্ষকে অস্ত্র সংবরণের আবেদন করলেন এবং অবিলম্বে আলোচনায় বসা ও দ্রুত নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করার প্রস্তাব দিলেন। কাজ হল এক সপ্তাহের মধ্যে। ২০০৭-এর মার্চে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হল আইভরি কোস্ট-এ। সে বছরই জুনে ঘটল আর একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। দ্রোগবার উদ্যোগেই আফ্রিকান নেশনস কাপের আইভরি কোস্ট ও মাদাগাসকারের ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হল বিদ্রোহীদের শক্ত ঘাঁটি বোউয়াকে-তে। গোটা মাঠ ও ফুটবলারদের নিরাপত্তার দায়িত্বে বিদ্রোহী শিবিরের সেনারা। সরকার পক্ষের সেনারা আমন্ত্রিত হয়ে গ্যালারিতে দর্শকাসনে। ২৫ হাজার ফুটবলপ্রেমীতে ঠাসা ছিল ওই মাঠ। ফুটবল মিলিয়ে দিল দু’পক্ষকে। জাতীয় সঙ্গীত যখন চলছে, দু’পক্ষের নেতারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। দ্রোগবার কথায়, ‘‘আমার মনে হল, আইভরি কোস্ট-এর পুনর্জন্ম হয়েছে।’’