পথিকৃৎ: জন রুজ় স্টেপলটন। ডান দিকে, টেম্পল চেম্বার্স ভবনের বর্তমান রূপ, যেখানে স্থাপিত হয়েছিল প্রথম বেতার কেন্দ্র।
সময় তখন রাত সোয়া বারোটা। তারিখ ১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল। ঠিক আধ ঘণ্টা আগেই একটি হিমশৈলের সঙ্গে সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিলাসবহুল প্রমোদতরীটি। নাম ‘টাইটানিক’। দুর্ঘটনার গুরুত্ব বুঝে রেডিয়ো রুম থেকে বিশেষ বিপদসঙ্কেত অতলান্তিকের বুক চিরে ছুটে গেল। বাকি গল্প আমরা সকলেই জানি। কিছু ক্ষণ বাদেই ডুবে গেল টাইটানিক। প্রায় পনেরোশো যাত্রীর মৃত্যু। কিন্তু এই চরম দুর্দৈব থেকে বেঁচে গেলেন সাতশোর বেশি যাত্রী। চার দিন পর তাঁদের নিয়ে উদ্ধারকারী জাহাজ ‘কার্পেথিয়া’ যখন নিউ ইয়র্ক বন্দরে পৌঁছল, তখন ব্রিটিশ পোস্টমাস্টার জেনারেল হার্বার্ট স্যামুয়েল মন্তব্য করলেন, ‘এই নাটকীয় উদ্ধারকার্যে বহু অমূল্য জীবন বাঁচানোর পিছনে সর্বাধিক কৃতিত্ব শুধু এক জনের, তিনি মিস্টার মার্কোনি। মার্কোনি প্রবর্তিত ব্যবস্থার মাধ্যমেই টাইটানিকের রেডিয়ো রুম থেকে সে দিন বিপদবার্তা শুনতে পেয়ে ছুটে গিয়েছিল কার্পেথিয়া।
মার্কোনির নামে সংস্থা হলেও, টাইটানিকের রেডিয়ো ব্যবস্থা হাতেকলমে যিনি স্থাপন করেছিলেন, সেই প্রকৌশলীর নাম জন রুজ় স্টেপলটন। টাইটানিক-দুর্ঘটনার কয়েক বছর পরই তিনি এসে পৌঁছন কলকাতায়। অতলান্তিক মহাসমুদ্রের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের এক যোগসূত্র হয়ে উঠেছিলেন এই মানুষটি। ।
বহু দিন পর স্টেপলটনের পুত্র, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রয়্যাল এয়ার ফোর্সের বিখ্যাত ফাইটার পাইলট, স্কোয়াড্রন লিডার বেসিল জেরাল্ড স্টেপলটন নিজের জীবনীতে তাঁর বাবার পেশাগত জীবনের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকের কথা উল্লেখ করেন। প্রথমটি অবশ্যই টাইটানিকের রেডিয়ো রুম স্থাপন। আর দ্বিতীয়টি ছিল অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে ভারতে রেডিয়ো সম্প্রচার ব্যবস্থা শুরু করা।
জন স্টেপলটনের জন্ম ১৮৮৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। সাউথ লন্ডন টেলিগ্রাফ ট্রেনিং কলেজ থেকে প্রথাগত শিক্ষা সম্পূর্ণ করে তিনি ১৯০৩ সালে মার্কোনি কোম্পানিতে চাকরি নেন। তখনকার জাহাজগুলিতে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের কাজে একচেটিয়া ব্যবসা ছিল মার্কোনি কোম্পানির। সেই কাজেই দীর্ঘ দিন নিযুক্ত ছিলেন। টাইটানিকের উদ্ধারকার্যে মার্কোনি কোম্পানির রেডিয়োর ভূমিকার ফলে, জাহাজ চলাচলে যোগাযোগের জন্য লন্ডনের ‘ইন্টারন্যাশনাল রেডিয়োগ্রাফিক কনফারেন্স’-এ কিছু নির্দিষ্ট প্রোটোকল মেনে চলার সিদ্ধান্ত হয়। তার মধ্যে একটি সিদ্ধান্ত ছিল প্রত্যেক প্রথম শ্রেণির যাত্রীবাহী জাহাজে ২৪ ঘণ্টা স্থায়ী ‘রেডিয়ো ওয়াচ’ রাখা। আর ছিল একই ওয়েভ লেংথে সঙ্কেত পাঠানোর নিয়ম এবং বিপদসঙ্কেত শোনার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ‘রেডিয়ো সাইলেন্স’ থাকা। এই সব নিয়ম চালু হওয়ার ফলে রেডিয়ো অফিসারের কাজের পরিধি ও সুযোগ বেড়ে গেল অনেকটাই। জন স্টেপলটনও জাহাজের রেডিয়ো অফিসারের পদে কাজ করার সুযোগ পেলেন।
১৯১৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ইংল্যান্ডগামী এমনই এক জাহাজে ডিউটি করার সময় স্টেপলটনের পরিচয় হয় অষ্টাদশী মার্টিল নাটাল বোরল্যান্ডের সঙ্গে। ‘রয়্যাল অ্যাকাডেমি অব মিউজ়িক’-এর স্বর্ণপদক বিজয়ী মেয়েটি সে সময়ে এক জন উদীয়মান শিল্পী। ডারবান ছেড়ে লন্ডনে যাচ্ছিলেন আরও বড় সুযোগের আশায়। কিন্তু জাহাজের ব্রিটিশ ওয়্যারলেস অফিসারের সঙ্গে পরিচয় থেকে প্রণয় ও তার পর পরিণয়। লন্ডনের সোনালি ভবিষ্যতের হাতছানি এড়িয়ে জনের সঙ্গে পাড়ি জমালেন মার্টিল, এক অন্য ভবিষ্যতের উদ্দেশে।
তত দিনে মর্স কোডের সাঙ্কেতিক বার্তার পরিবর্তে মানুষের কণ্ঠস্বর সম্প্রচারের ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে বেতার তরঙ্গ। আমেরিকায় বাইবেল পাঠ এবং গান সম্প্রচার করতে সফল হয়েছেন লি ডি ফরেস্ট এবং রেজিনাল্ড ফেসেনডেন। জাহাজ বা সেনাবাহিনীর ব্যবহারিক প্রয়োজনকে সম্প্রসারিত করে বিনোদন ও তথ্য আদানপ্রদানে এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনার কথাটাও মাথায় আসতে দেরি হয়নি মানুষের। ১৯২০-র দশক থেকেই পৃথিবীর নানা জায়গায় স্থাপিত হতে শুরু হয়েছে রেডিয়ো স্টেশন। তাই মার্কোনি কোম্পানির মতো যোগাযোগ মাধ্যমের অগ্রগামী সংস্থার পোড়খাওয়া কর্তারাও আর দেরি না করে শুরু করে দিলেন এই নতুন সুযোগ সদ্ব্যবহারের প্রস্তুতি।
ভারতের রাজধানী আর না থাকলেও, কলকাতার অর্থনৈতিক শক্তি তখনও যথেষ্ট। তাই মার্কোনি কোম্পানির নতুন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কলকাতাও জড়িয়ে গেল। ১৯১২ সাল থেকেই শহরে তাঁদের অফিস ছিল, তবে সেটা পৃথিবীর বিভিন্ন রুটে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ ব্যবসায় যুক্ত ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির বিভিন্ন জাহাজকে বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থায় সাজিয়ে তোলার কাজই করত। ১৯১৮ নাগাদ তাঁদের
আরও বড় জায়গার প্রয়োজন হওয়ায় তাঁরা অফিস স্থানান্তরিত করেন
ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটের ‘টেম্পল চেম্বার্স’ বাড়িটিতে।
মার্কোনি কোম্পানির নতুন আধিকারিক হয়ে তখনই শ্রীলঙ্কার কলম্বো থেকে কলকাতায় বদলি হয়ে আসেন জন স্টেপলটন। বেতার যোগাযোগ ব্যবসার সঙ্গে টেম্পল চেম্বার্সের অফিস থেকে শুরু হল পরীক্ষামূলক সম্প্রচার। সেই বাড়ির অন্য একটি ফ্ল্যাটে ডেরা বাঁধলেন স্টেপলটন পরিবার। তাই খুব সহজেই সঙ্গীতানুষ্ঠান সম্প্রচারের জন্য পাওয়া গেল মার্টিল স্টেপলটনের কণ্ঠ। আর এ ভাবেই ইতিহাসে জায়গা করে নিলেন মার্টিল স্টেপলটন, কলকাতার বেতার তরঙ্গে সম্প্রচারিত প্রথম সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে। ১৯২২ সালে, মার্টিল এবং জনের কন্যা মারজোউরির জন্ম হয়েছে কলকাতার ইডেন হাসপাতালে। পরের বছর স্টেপলটনের উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘বেঙ্গল রেডিয়ো ক্লাব’ এবং এই সংস্থাই সরকারি অস্থায়ী অনুমোদনের ভিত্তিতে ১৯২৩ সালের নভেম্বর মাসে সম্প্রচার শুরু করে মার্কোনি কোম্পানির একটি ছোট ফাইভ এএফ ট্রান্সমিটার ব্যবহার করে।
জগদীশচন্দ্র বসুর শহর কলকাতায় রেডিয়ো সম্প্রচারে বাঙালির ভূমিকার কথাও বলতে হয়। স্টেপলটনের সঙ্গে অনুষ্ঠান পরিচালনা ও নির্দেশনার দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে ছিলেন হীরেন্দ্রনাথ বসু। এই প্রতিভাশালী গায়ক, সুরকার, গীতিকার, ঔপন্যাসিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা সে সময়ের কলকাতার সাংস্কৃতিক জগতে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি নাম। ‘আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও’ অথবা ‘আমার আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ’-এর মতো জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা গায়ক ও সুরকার হিসেবে তিনি যুক্ত ছিলেন বেতার সম্প্রচারের এই আদি পর্বে।
বেঙ্গল রেডিয়ো ক্লাবের সঙ্গে এই সময় যুক্ত হন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী শিশিরকুমার মিত্র। গবেষণার কাজে প্যারিসে গিয়ে কিছু রিপোর্ট ও ল্যাবরেটরিতে কাজ দেখে এ ব্যাপারে উৎসাহী হন তিনি। তার পর উদ্যোগ নিয়ে বেতারকে একটি বিষয় হিসেবে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করান স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সহযোগিতায়। প্রতি দিন যেমন বেঙ্গল রেডিয়ো ক্লাবের অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হত, তেমনই সম্প্রচার হত শিশির মিত্রের ল্যাবরেটরিতে বসানো আর একটি ট্রান্সমিটার থেকেও।
এখানে একটা কথা মনে রাখার— এই সময় পর্যন্ত ভারতে বেতার সম্প্রচারের যতগুলি উদ্যোগ করা হয়, সেখানে বাণিজ্যিক লাভের কথা ভাবা হয়নি। অর্থনৈতিক ভাবে এই উদ্যোগ কতটা ফলপ্রসূ হতে পারে তা দেখতে ১৯২৬ সালে বিবিসি-র পক্ষ থেকে সি সি ওয়ালিক-কে কলকাতায় পাঠানো হয়। স্টেপলটনের সহযোগিতায় টেম্পল চেম্বার্সে গড়ে ওঠে বিবিসি-র পরীক্ষামূলক স্টুডিয়ো। এই স্টুডিয়োটি আনুষ্ঠানিক রূপ পেল এক বছর পর ১৯২৭-এ, ব্যক্তিগত মালিকানায় গঠিত ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানির তত্ত্বাবধানে ১ নং গার্স্টিন প্লেসের নতুন স্টুডিয়োতে স্থানান্তরিত হয়ে। সে বছর ২৬ অগস্ট বাংলার গভর্নর স্যর স্ট্যানলি জ্যাকসন সন্ধ্যা ছ’টায় উদ্বোধন করলেন কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম আনুষ্ঠানিক সম্প্রচারের।
কিন্তু বেসরকারি মালিকানায় ভারতে বেতার সম্প্রচার শুরুর কয়েকটি বছর ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা। বেতার কেন্দ্রের অস্তিত্ব নিয়েই সংশয় দেখা দেয় আর্থিক কারণে। তবে শেষ পর্যন্ত ১৯৩২ সালের মে থেকে পুরোপুরি সরকারি পরিচালনায় আসার পর সেই মেঘ কেটে যায়। তার পর ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কলকাতার রেডিয়ো কেন্দ্র উঠে আসে তার বর্তমান নিজস্ব ভবনে। টেম্পল চেম্বার্স থেকে ১ নং গার্স্টিন প্লেস হয়ে আকাশবাণী ভবনে পৌঁছতে লেগে যায় বেশ ক’টি বছর এবং জন স্টেপলটনের মতো কিছু নিবেদিত মানুষের প্রয়াস।
স্টেপলটন প্রথমে ‘ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি’ এবং পরে ‘অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো কলকাতা’-র সঙ্গে নির্দেশক হিসেবে যুক্ত ছিলেন কর্মজীবনের শেষ পর্যন্ত। সেই সময়ের বেতারকে জনপ্রিয় ও উন্নত করার কাজে তাঁর উদ্যোগের উল্লেখ পাওয়া যায় সে সময়ের বেতার মুখপত্র ‘দি ইন্ডিয়ান লিসনার’-এ। ১৯৩৮-এর ডিসেম্বরের এক খবরে দেখা যাচ্ছে, বেতারকে কলকাতার স্কুলগুলিতে পড়ুয়াদের কাছে পৌঁছে দিতে তাঁর বিশেষ উদ্যোগের কথা। ১৯৪১ সালে রাজা ষষ্ঠ জর্জের জন্মদিন উপলক্ষে বেতার মাধ্যমে তাঁর কাজের জন্য স্টেপলটনকে ‘অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ খেতাব দেওয়া হয়।
অবসর নেওয়ার পর ১৯৪২-এ পাকাপাকি ভাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাস শুরু করেন জন ও মার্টিল স্টেপলটন। ডারবানের কাছে পাইনটাউনে চামড়ার সামগ্রীর দোকান খোলেন। শেষ বয়সে চোখে ছানির সমস্যায় গাড়ি চালাতে অসুবিধে হত। মাঝে মাঝেই রাস্তায় মেজাজ হারাতেন বৃদ্ধ। সে সময় তাঁর বাবার মুখ দিয়ে বাছা বাছা হিন্দুস্থানি ‘সুভাষিত’ বেরনোর কথা জীবনীতে উল্লেখ করেছেন জেরাল্ড স্টেপলটন।
স্টেপলটনের সন্তানদের মধ্যেও কলকাতায় কাটানো শৈশব নিয়ে স্মৃতিমেদুরতা ছিল প্রবল। জেরাল্ডের স্মৃতিকথায় আছে টেম্পল চেম্বার্সে বাবার অফিসে টেবিলের উপর বসে খেলার স্মৃতি। কন্যা মারজোউরির শেষ ইচ্ছে অনুসারে তাঁর দেহভস্ম ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বাড়ির বাগানে লাগানো এক জারুল গাছের নীচে, যাকে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘প্রাইড অব ইন্ডিয়া ট্রি’ বলে। মারজোউরির কন্যা অলিভিয়া শ্যাফার ক’বছর আগে কলকাতায় এসেছিলেন তাঁর মা-ঠাকুমার স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলি দেখতে।
কলকাতার আর এ সব মনে নেই। ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসের বাড়ি ভেঙে কবেই উঠেছে আধুনিক ইমারত, টেম্পল চেম্বার্স আজ স্রেফ এক অফিসবাড়ি। আজ ১৩ ফেব্রুয়ারি ‘বিশ্ব বেতার দিবস’, শক্তিশালী গণমাধ্যমটির ভূমিকা স্মরণের দিন। কলকাতা প্রথম বেতার কেন্দ্র ও তার পিছনে থাকা বিস্মৃতপ্রায় মানুষটিকে স্মরণের দিনও।