যুদ্ধক্ষতি: আফগানিস্তানে তালিবানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। (ছবি: গেটি ইমেজেস)
চিন থেকে ইংল্যান্ডে নিজের সংবাদপত্রকে দ্বিতীয় ইন্দো-চাইনিজ় যুদ্ধের অজস্র খবর পাঠাতেন টমাস উইলিয়াম বলবি। তাঁর পাঠানো খবর গোগ্রাসে পড়েছে মানুষ। তৎকালীন ব্রিটিশ কূটনীতিবিদ এবং পরবর্তী কালে ভারতের ভাইসরয় লর্ড এলগিন তাঁর পাঠানো খবরের ওপর নির্ভর করে যুদ্ধের ঘুঁটি সাজাতেন। অথচ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পালনে যখন চিনারা তাঁকে বন্দি করল তখন তিনি একা, নিরস্ত্র। তিন দিন ধরে চলল আমানুষিক অত্যাচার। জল চাইলে মুখে ঢেলে দেওয়া হল দুর্গন্ধ কাদা। ১৮৬০ সালের ১৭ অক্টোবর বেজিংয়ের প্রান্তে যখন বলবি-র দেহ পাওয়া গেল, তখন তা এমন ভাবে বিকৃত ও ক্ষতবিক্ষত যে চেনা ভার।
এর অনেক বছর পরের কথা। কিশোরী বয়স থেকে ডিকি চ্যাপেলের স্বপ্ন যুদ্ধক্ষেত্রে সাংবাদিকতা করা। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর মুখে, উঠে পড়ে বাদ সাধলেন মার্কিন সৈন্যবাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা। কিন্তু আমেরিকান নৌবাহিনীর সঙ্গে নাছোড় হয়ে লেগে থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছবি তোলা শুরু করেন তিনি। অবস্থা এমন হয়েছে, কখনও কখনও বন্দুকের নলের সামনে থেকে নৌবাহিনী উদ্ধার করেছে তাকে। ডিকি কিন্তু তার মধ্যেও ছবি তুলে এনেছেন। প্রায়ই বলতেন নৌবাহিনীর সঙ্গে কোনও অভিযানেরই যেন মৃত্যু আসে তার। সে বড় সুখের মরণ হবে। ১৯৬৫ সালে আমেরিকান নৌবাহিনীর সঙ্গে দক্ষিণ ভিয়েতনামে কমব্যাট অপারেশনে গিয়ে বোমা বিস্ফোরণে মারা যান তিনি। মৃত্যুর পর চ্যাপেলের সহকর্মী হেনরি হায়েত যখন তাঁর ছবি তোলেন, সামরিক পোশাকের সঙ্গে তখনও তার কানে পরা রয়েছে মুক্তোর দুল। সেটার গায়ে তখন রক্তের ফোঁটা। যুদ্ধক্ষেত্রেও প্রিয় দুলটা পরে যেতে ভুলতেন না তিনি।
এই তো কিছু দিন হল সবে, যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গেলেন চিত্রসাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকি। মৃত্যুর ঠিক আগে যাঁর শেষ টুইট ছিল
“...আমি ভাগ্যবান যে এখনও বেঁচে আছি।” বহু ক্ষেত্রে বলা হয়, বিদেশে যুদ্ধক্ষেত্রে রিপোর্টিং করতে গেলে স্বাধীনভাবে না গিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গেই যাওয়া উচিত, বিশেষত কাবুল আফগানিস্তানে। নয়তো অপহৃত হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি। সিদ্দিকি আফগানিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছিলেন। তাও প্রাণে বাঁচতে পারেননি। যুদ্ধক্ষেত্রে সাংবাদিকদের আনাগোনা দীর্ঘ দিনের। কিন্তু পেশার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিনিয়ত তাঁদের সঙ্গী হয়েছে মৃত্যুভয় আর ভয়াবহ বিপন্নতা। ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী শুধু ২০১২ সালেই ১৪৭ জন এবং ২০১৮ সালে সারা বিশ্বে ৮০ জন সাংবাদিক মারা গিয়েছেন। পরের বছরের হিসেব অনুযায়ী তুরস্ক থেকে সিরিয়া, ভিয়েতনাম থেকে ইয়েমেন, সারা পৃথিবীতে ৩২৫ জন সংবাদকর্মী বিভিন্ন জেলে আটক হয়ে আছেন। এখন সংখ্যাটা আরও বেশি।
এমন কিন্তু একেবারেই নয় যে যুদ্ধ ‘কভার’ করতে সাংবাদিক বা চিত্রসাংবাদিকরা শুধুমাত্রই বহিঃশত্রুর হাতেই পর্যুদস্ত হয়েছেন। তাঁদের খবর যখন নিজের রাষ্ট্রের মুখোশ খুলেছে, তখনই হয় চোখ রাঙিয়েছে সরকার, নয়তো সম্পূর্ণ চেপে দেওয়া হয়েছে সেই খবর। তাও তাঁদের দমিয়ে রাখা যায়নি। ১৮৫৪-তে অনিচ্ছুক সাংবাদিক উইলিয়াম হাওয়ার্ড রাসেলকে যখন তাঁর সম্পাদক প্রায় জোর করে ক্রিমিয়ায় পাঠান, তখন তিনি রাসেলকে কথা দেন যে আগামী দু’মাস পরের ইস্টারে তিনি ফিরে এসে পরিবারের সঙ্গে কাটাতে পারবেন। তখন তাঁরা কেউই জানতেন না, দু’মাস নয়, দু’বছর আর রাসেলের ইংল্যান্ডের মাটিতে পা রাখা হবে না। যুদ্ধক্ষেত্রে পা দিয়েই তিনি ইংল্যান্ডের সেনা নীতি এবং তাদের কর্তাব্যক্তিদের ওপর ক্ষোভ উগরে দেন। তিনি লেখেন, ইংরেজ সেনানায়করা যুদ্ধনীতি বা সাধারণ সৈনিকদের মরণ-বাঁচন থেকে ঢের বেশি ব্যস্ত থাকতেন ড্রেস কোড, আদবকায়দা নিয়ে। তাঁর লেখায় বার বার উঠে আসে আহত সৈনিকদের অমানুষিক কষ্টের কথা। যুদ্ধের ক্ষত ছাড়াও সৈনিকদের লড়তে হত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সঙ্গে। কলেরা ছিল ব্রিটিশ সাধারণ সৈনিকদের নিত্যসঙ্গী। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাঁদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুল্যান্স ছিল অপ্রতুল। কখনও মাটিতে, কখনও বেঞ্চের পর বেঞ্চ জড়ো করে তাদের শুইয়ে রাখা হত। ক্রমাগত বিরুদ্ধ লেখায় তাঁর ওপর প্রতিশোধ নিতে শুরু করে ব্রিটিশ সেনানায়করা। কোনও দিন রাসেলের খাওয়া জুটত না, তো কোনও দিন তাঁবু। রাসেলের লেখা ইংল্যান্ডে বিপুল জনমত তৈরি করে। বালাকলাভার যুদ্ধ নিয়ে তাঁর লেখা শোরগোল ফেলে দেয় সরকার এবং বিরোধীদের মধ্যে। তৎকালীন সরকার প্রাণপণে সব অস্বীকার করতে থাকে। এমনও বলা হয় যে তিনি যুদ্ধে ইংল্যান্ডের বিপক্ষ দেশগুলির কাছ থেকে বিশেষ সুবিধে পেয়ে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে সর্বৈব মিথ্যা লিখছেন। তাঁর সংবাদপত্রের সার্কুলেশন চেপে দেওয়ার চেষ্টা করে ব্রিটিশ সরকার। সেই সময় রাসেলের কাগজের সম্পাদক পার্লামেন্টে যুদ্ধ নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিগুলি বিলি করতে শুরু করেন। চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার তাদের রণনীতিতে বদল আনে। রাসেল ভারতেও আসেন সিপাহি বিদ্রোহের কিছু দিন পরে। নিজের দেশের সংবাদপত্রের হয়ে ১৮৫৮-তে লখনউ পুনরুদ্ধার কভার করেন।
দেশের বিরুদ্ধে লিখলে বা সরকারের সমালোচনা করলে তার ফল কোনও দিনই সাংবাদিকদের পক্ষে শুভ হত না। বার্নার্ড ফল ছিলেন আমেরিকার রাষ্ট্রনীতিবিদ এবং সাংবাদিক। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় তাঁর সংবাদ এবং বিশ্লেষণের প্রশংসা করেছিলেন নোয়াম চমস্কিও। কিন্তু মার্কিন সাহায্যপ্রাপ্ত জিং জিয়াম সরকারের তীব্র সমালোচক ছিলেন তিনি। তাঁর ইতিবাচক মন্তব্যগুলি সমাদৃত হলেও যখনই তিনি আমেরিকার ভিয়েতনাম নীতির সমালোচনা করেছেন, মার্কিন সরকারের রোষদৃষ্টিতে পড়েছেন।
চিত্রসাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকি ।
সাংবাদিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞার কড়াকড়ি অব্যাহত ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েও। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাঁরা ঠিক কতটা লিখবেন আর কতটা লিখবেন না সেটা নির্ধারিত করে দিত ইংল্যান্ড। কর্তাব্যক্তিদের নিষেধ তো ছিলই, তাঁরা নিজেরাও সেই সময় এমন কিছু লিখতেন না, যাতে দেশের মানুষের সামনে যুদ্ধের নগ্ন সত্য উন্মোচিত হয়। যুদ্ধের প্রথম দিকে যখন ব্রিটিশ আর ফরাসি সৈন্য পিছু হটছে, তখন সেই ঘটনার উল্লেখ করে সাংবাদিক আর্থার মুর লিখলেন, সাময়িক পরাজয় সত্ত্বেও সৈনিকদের মনোবল অটুট। এর কিছু দিন পর বিভিন্ন কাগজের ছ’জন সাংবাদিককে মনোনীত করা হল, যাঁরা যুদ্ধের হাল-হকিকত লিখবেন। কিন্তু সংবাদ সংগ্রহের সময় তো বটেই, এমনকি খাওয়া ঘুমোনোর সময়ও সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিরা তাঁদের সঙ্গে থাকবেন। একে তো ব্রিটিশ ট্রেঞ্চে প্রতিদিন সেনাবাহিনীর হাতে প্রবল হেনস্থা আর অপমান নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল, তার ওপর ফৌজের পোশাক পরাও ছিল বাধ্যতামূলক। একটু এ দিক-ও দিক হলে জুটত টিটকিরি। ১৯১৬-তে শুরু হল সম-এর যুদ্ধ। প্রায় পাঁচ মাসব্যাপী এই যুদ্ধে ৩০ লাখ সৈন্য অংশগ্রহণ করে, যার মধ্যে এক লক্ষ সৈন্য আহত এবং নিহত হয়। যুদ্ধের ভয়ঙ্কর ক্ষতির কথা সম্পূর্ণ চেপে গিয়ে একটি বিখ্যাত সংবাদপত্রের প্রতিনিধি ফিলিপ গিবসকে দিয়ে লেখানো হল, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের পক্ষে শুভ দিন। প্রথম দিন ভাল ভাবেই শুরু করল দুই দেশ। লন্ডনের প্রায় সমস্ত সংবাদপত্রেই এই ধরনের খবর প্রকাশিত হল। এই মিথ্যাচারের ফল ভুগতে হয়েছিল দুই দেশকেই। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার সাত বছর পরে আক্ষেপ করে লিখছিলেন সাংবাদিক বিচ টমাস, পরে বুঝেছিলেন, ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্স যে খবর তাঁদের দিতেন তা মিথ্যে। দিনের পর দিন তিনি সে অসত্য খবর দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়েছিল তাঁর।
যখনই সব অপপ্রচার ভেঙে সত্য উন্মোচনের পথে গিয়েছেন সাংবাদিকরা, তার মূল্য দিতে হয়েছে। মার্কিন সাংবাদিক মেরি কোলভিন, বিল স্টুয়ার্ট, মহিলা চিত্রসাংবাদিক গ্রেটা তারো... মৃত সাংবাদিকদের নামের তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় শুধু।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সাংবাদিকতার উল্লেখযোগ্য নাম এরনি পাইল। পেয়েছিলেন পুলিৎজ়ারও। কিন্তু তাঁর লেখায় যুদ্ধের জয়-পরাজয় ছাপিয়ে শুধু থাকত সাধারণ সৈনিকদের বেদনার কথা। ডি-ডে-র পর তিনি লিখেছিলেন, ‘মাইলের পর মাইল সৈন্যদের ব্যাগ ছড়ানো, কোথাও ভাঙা টুথব্রাশ... একটা ছেঁড়া ফ্যামিলি অ্যালবাম... বাইবেলের কয়েকটা পাতা... ছেঁড়া জুতো। এরা সাধারণ সৈনিক। যারা যুদ্ধ করে নিজেদের প্রাণ দিয়ে আমাদের ইউরোপে ঢোকার রাস্তা করে দিয়েছে।’ শেষে পাইল ভুগছিলেন পোস্ট ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে। লিখেছিলেন, ‘আর একটা যুদ্ধও নয়, আর একটা গুলির শব্দ বা কোনও সৈনিকের আর্তচিৎকার যদি কানে আসে আমি পাগল হয়ে যাব।’ আর অ্যাসাইনমেন্টে যেতে চাননি, তবু যেতে হয়েছিল। সেখানেই লে সিমা আইল্যান্ডে জাপানি মেশিনগানের গুলি তার প্রাণ কেড়ে নেয়।
২০০৮ সালে এরনি পাইলের মৃতদেহের ছবি জনসমক্ষে আসে। এক ছোট পাহাড়ের তলায় শান্তিতে শায়িত দেহ। হাত দুটো জড়ো করা। ঘাড়টা অস্বাভাবিক ভাবে বেঁকে আছে। চশমার একটা কাচ ভাঙা, ঠোঁটের কোনা বেয়ে নামছে ক্ষীণ রক্তধারা। এরনির মৃতদেহের ছবি বোধহয় হাজারটা না-বলা কথা বলে গিয়েছিল। আমরা শুধু আলোটুকুই দেখি, এই অন্ধকার আর এই বেদনা শুধুই সেই সাংবাদিকদের, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ছবি আর খবর যাঁরা আমাদের কাছে পৌঁছে দেন।