Chaitra Sankranti

মধুমাসের মেঘ ও মায়া

ঝরা পাতায় ঢেকে আছে পথ। গাছে গাছে নতুন পাতার সঞ্চার, মুকুলের ঘ্রাণ। নব কিশলয়ে ফিরে আসা হারানো আখর। বনজ্যোৎস্নায় ভিজে-ওঠা দেহ-মনে দোলের জলরং।

Advertisement

অনিতা অগ্নিহোত্রী

শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:২৬
Share:

যেথা এই চৈত্রের শালবন

Advertisement

দোলপূর্ণিমার চাঁদ যেন পাঙাশ এক ফানুসের মতো দুলতে দুলতে উঠে এল বনের উপরের আকাশে। পিছনের পাহাড়ের ঢেউ যেন এক অর্ধবৃত্তে ঘিরে রেখেছে তৃণপ্রান্তর। তার শরীর জুড়ে, সামনে ঘন দেওয়ালের মতো শালের অলীক জঙ্গল। সূর্য অস্ত গেছে কিছু আগে। বন জুড়ে সিকাডার ডাক। ডাক তো নয়, পেটের ঝিল্লিতে প্রত্যঙ্গ ঘষার বিরামহীন শব্দ, আর বন্য ময়ূরের ক্রাঁও ক্রাঁও। মাঝে মাঝে পাহাড়ি ময়নার অতর্কিত ধ্বনি আকাশ থেকে বিদ্যুতের মতো খসে পড়ছে। সব কিছুর মধ্যে এক অতি সাধারণ খয়েরি অনাদৃত পাখি কথা বলে চলে নানা ভাবে। কখনও খসখসে গলায়, কখনও একটানা ঠক ঠক ঠক ঠক। এ হল ইন্ডিয়ান নাইট জার বা কাপু। এই অপস্রিয়মাণ বসন্ত তাদের মিলন ও প্রজননের সময়। সামনের পাহাড়ের ঢেউ, পাশের তৃণভূমির ঢাল বেয়ে নেমে আসছে শম্বর হরিণের দল। তাদের সঙ্গে মিশে গেছে ছোটখাটো তামাটে চেহারার কোটরা হরিণেরা। বাতাসে কখনও ময়ূর, কখনও নাইট জার, কখনও কোটরা হরিণের ডাক। শব্দগুলো মাথার উপর দিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরছে। এগুলো কি সাবধান করা ডাক? ওয়ার্নিং কল? সামনের তিনটে সল্ট লিক দ্রুত খালি হয়ে যাচ্ছে। হরিণেরা দ্রুত বনে চলে যাচ্ছে। অন্ধকারে তাদের ঝাপসা অথচ ত্বরিত চলন বোঝা যায়। তবে কি সে আসছে? যার জন্য কোনও কথা না বলে, না নড়ে বসে আছি আমরাও? চায়ের প্রবল তেষ্টা কিন্তু কেউ নড়তে রাজি নয়।

চাঁদ এখন তাম্রাভ, বর্তুল নিঃসঙ্গ এক উপগ্রহ। জ্যোৎস্না ফোটার সময় হয়নি, অথচ সূর্যের আলো মিলিয়ে গেছে অনেক ক্ষণ আগে। এ বার তার আনাগোনার সময় বনপথে। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বা আরবিটি। টি (টাইগার)-২২ আর ২৭ এই পথে আনাগোনা করে নিত্য। ট্র্যাপ ক্যামেরায় তাদের ছবি দেখা গেছে।

Advertisement

চৈত্রের অরণ্য এত শীতল হয়ে যাবে দিন গড়াতেই, বুঝতে পারিনি। এ নাকি পশ্চিমি ঘূর্ণাবর্ত, মধ্য এশিয়া-আফগানিস্তান হয়ে আসে। অনিশ্চিত তার গতিপ্রকৃতি। অত দূরের আবহাওয়ার তোলপাড় কত দূরের পথ বেয়ে মেঘের বুক থেকে বৃষ্টি টেনে আনছে! কেওনঝড় জেলার আনন্দপুরে বৈতরণি নদী পার হয়েছি। তার পর করঞ্জিয়া ও ঠাকুরমুন্ডা পার হয়ে যশিপুর। ময়ূরভঞ্জ জেলার পথে আসতে জামুয়ানির বিস্তীর্ণ শাল জঙ্গল পেরিয়েছি। শাল কোথাও নিষ্পত্র, কোথাও সবুজ পাতায় ঝলমল করছে। শালের পাতা ঝরে ঢেকে গেছে পথ। জঙ্গলে আগাছা গুল্ম সব পিঙ্গল হলুদ পাতায় ঢাকা। জঙ্গলের সবুজকর্মী ব্লোওয়ার দিয়ে পাতা উড়িয়ে পথ পরিষ্কার করে দেয়। কিন্তু একই সঙ্গে নতুন পাতাও তো ছেয়ে যাচ্ছে গাছে। আমের ডালে কচি লাল সবুজ পাতা, কোথাও বড় গাছে মুকুলের শোভা আর ঘ্রাণ। শালের মাথা সাদা হয়ে আছে ফুলে। কুসুম কনেবৌয়ের মতো ঝলমল করছে রাঙা পাতা পরে। তবে কি নতুন প্রাণের আবির্ভাব আর জীবনের বিসর্জন চলেছে একই সঙ্গে?

দিয়ে গেনু বসন্তের গান খানি

এই তো কোলে ‘গীতবিতান’ নিয়ে বসে আছি। কলকাতার পথঘাট অল্প বৃষ্টিতে ভেজা। আমার মাথার ভিতর এখনও চৈত্র অরণ্যের মায়া ও মেঘ। দেখছি গীতবিতানের প্রকৃতির গানে, ‘বসন্তে কি শুধু (কেবল) ফোটা ফুলের মেলা রে।/ দেখিসনে কি শুকনো পাতা ঝরাফুলের খেলা রে॥’

তার পর, ‘যে ঢেউ উঠে তারি সুরে বাজে কি গান সাগর জুড়ে।/ যে ঢেউ পড়ে তাহারো সুর জাগছে সারা বেলা রে।’ কবি যে রবীন্দ্রনাথ, তাই পরের পঙ্‌ক্তিতেই বসন্তের গান হয়ে যায় পূজার।

‘আমার প্রভুর পায়ের তলে শুধুই কি রে মানিক জ্বলে,/ চরণে তাঁর লুটিয়ে কাঁদে লক্ষ মাটির ঢেলা রে।’

তবে কি চৈত্রের অরণ্যে চলেছে সৃজনের ঢেউয়ের ওঠা আর পড়া? আর স্খলিত পাতার গানে নষ্ট জীবনের কান্নার নিঃশব্দ স্বর?

নানা ঋতুতে বসন্তের গান লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ যেমন ফাল্গুনের কথা বলেছেন বহু বার, তেমনি নব বসন্ত আর বিলম্বিত বসন্তের মধ্যেকার বিভাজনরেখাটি স্পষ্ট হয়েছে তাঁর গানেই। ‘মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি, কোন নব চঞ্চল ছন্দে’, ‘ফাগুন লেগেছে বনে বনে’, ‘বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা’— এই সব গান ফাল্গুনের, বসন্ত সমাগমের। চৈত্রের দিন আনে ক্লান্ত বিদায়-অভিমুখী বসন্তকে। এ বেলা ডাক পড়েছে কোনখানে, ফাগুনের ক্লান্তক্ষণের শেষ গানে। এ বার বিদায়বেলার সুর ধরো ধরো, (ও চাঁপা ও করবী), তোমার শেষ ফুলে আজ সাজি ভরো। চৈত্র আনে বৈশাখের আভাস, সে যেমন নতুন বছর, তেমনই কালবৈশাখীর কাল।

‘আজ খেলা ভাঙার খেলা খেলবি আয়।/ সুখের বাসা ভেঙে ফেলবি আয়।/ ... অস্তগিরির ঐ শিখরচূড়ে, ঝড়ের মেঘের আজ ধ্বজা উড়ে।’

কালবৈশাখীর যে নাচন হবে, তার সঙ্গে নাচবে মরণ বাঁচন। হাসি কাঁদন পায়ে ঠেলার ডাক দেয় চৈত্র। চৈত্র মাসের মধ্যে তাই কি সর্বনাশের পূর্বাভাস? ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসের দ্বিতীয় অধ্যায়। মোকামাঘাটের স্টিমারে অতীনের সঙ্গে এলার প্রথম দেখা। ‘সেই চৈত্র মাসের বারবেলা থেকেই আমার পাগলামি শুরু। যে সব দিন চরমে না পৌঁছোতেই ফুরিয়ে যায়, তারা ছায়ামূর্তি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় কল্পলোকের দিগন্তে। তোমার সঙ্গে আমার মিলন সেই মরীচিকার বাসর ঘরে।’

‘প্রহর শেষের আলোয় রাঙা/ সেদিন চৈত্রমাস,/ তোমার চোখে দেখেছিলাম/ আমার সর্বনাশ।’ অতীনের মুখে এই কবিতার ফুটে ওঠা আর এর সূত্র ধরে বাঙালির অন্তরে চৈত্র মাসের সঙ্গে সর্বনাশের জড়িয়ে যাওয়ার অশনি-সঙ্কেত। পাতা উল্টে দেখলাম, ‘চার অধ্যায়’-এর প্রথম পাণ্ডুলিপিতে কবিতার দ্বিতীয় লাইনে ছিল, ‘প্রহর শেষের বেলা তখন, সেদিন চৈত্রমাস।’ পরিমার্জনার ফলে দ্বিতীয় লাইন প্রথমে এসেছে আর ‘আলোয় রাঙা’ কথা দু’টির প্রবেশ। এর ফলে চৈত্রের ব্যঞ্জনা তীব্রতর, গভীরতর হয়েছে, সন্দেহ নেই।

লিখন তোমার ধূলায় হয়েছে ধূলি

আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে, ১৩৩২-এর চৈত্রে, বেহাগে এই গানটি লেখা হয়েছিল। হারানো আখরগুলি ফিরে আসবে নব কিশলয়ে।

‘চৈত্র রজনী, আজ বসে আছি একা,/ পুন বুঝি দিল দেখা,/ বনে বনে তব লেখনীলীলার লেখা, নব কিশলয়ে গো।’

কিশলয়ে হারানো অক্ষর ফিরে আসার আনন্দ যেন নির্জন বিষাদে ঢেকে গেছে রজনীর উল্লেখে। চৈত্ররজনী কি ফাল্গুন রাতের চেয়ে আলাদা? দিনশেষ, চাঁদ, চাঁদের আলো, রাত্রি, চৈত্ররজনী, চন্দ্র কিরণসুধা সিঞ্চিত অম্বর— রাতের সঙ্গে প্রাণে বিলীয়মান বসন্তের উদ্‌যাপন মিলে গেছে কবির কল্পনায়।

‘ফাগুনের পূর্ণিমা এল কার লিপি হাতে,/ বাণী তার বুঝি না রে, ভরে মন বেদনাতে॥’ দোল ফাগুনের চাঁদের আলোয় সুধায় মাখা প্রেমের দোলনচাঁপা। তাতে রং লাগে পূর্ণিমার। কিন্তু দোলপূর্ণিমা কি ফাল্গুনের না চৈত্রের? ফাগ নিয়ে খেলা, তাই ফাগুয়া। তা কি ফাল্গুন মাসেই? মাসের নাম এসেছে ফাল্গুনী নক্ষত্রের নাম থেকে। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি দোলের তিথি নিয়ে গাণিতিক গণনা করে বলেছেন, যজুর্বেদ অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমায় বসন্তের আরম্ভ। যজুর্বেদের এই বিধি মেনে নিলে, ২০০০ বছর আগে চৈত্রী পূর্ণিমায় বসন্ত আরম্ভ হত। আরও দু’হাজার বছর আগে, বৈশাখী পূর্ণিমায়। এই সব কালের স্মৃতি রাখা আছে চাতুর্মাস্য গণনায়। কিন্তু তিনি এও বলেছেন যে, দোল দুই প্রকার। ফাল্গুনের দোল। তার পর আবার চৈত্রের দোল। চৈত্রের আর এক নাম মধুমাস। বৈদিক কালে মধুমাসে মদনোৎসব বা বসন্তোৎসব হত। বসন্ত ঋতুরাজ বটে, কিন্তু মদন ছাড়া বসন্তোৎসব হয় না। তাঁর মতে, দোলযাত্রার প্রকৃত অর্থ আমরা ভুলে গেছি। পরে দোলযাত্রাকে বসন্তোৎসব মনে করা হয়েছে। এ বছর দোল ছিল ১১ চৈত্র। কিন্তু এ তো দ্বিতীয় দোল নয়! অতীতে উৎসব পালন কেমন ছিল, তার চেয়ে এখনকার সময় অনেকটাই সরে এসেছে। এ হয়তো বিদ্যানিধি সূচিত চাতুর্মাস্য গণনার ফল নয়, কেবল অধিকমাস বা মলমাসের প্রভাব।

নিজে আমি দোল থেকে দূরেই থেকেছি বরাবর। রংগোলা জলে আতঙ্ক, তাই আমার কৈশোর কেটেছে না-খেলা দোলের জন্য মনকেমনে। কিন্তু পূর্ণ চাঁদের মায়ায় অবগাহনে তো কোনও নিষেধ নেই। বনের প্রান্তে জ্যোৎস্নায় ভিজে-ওঠা দেহ-মনে এই আমার দোলযাত্রা।

চৈত্রের সেল, মায়ের নীলষষ্ঠী, গাজনের সং

দীনের জীবনে রবীন্দ্রনাথের সম্যক প্রবেশের আগে চৈত্র মাস সম্বন্ধে বিশেষ ভক্তিভাব জাগেনি, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। মা-দিদারা অনায়াসে বলতেন, চোত-বোশেখ। চৈত্রকে এই ভাবে ঠেলে দেওয়া হত গ্রীষ্মের চৌকাঠে। চোত-বোশেখের গরম আর ভাদ্রের গরম, দুটো দু’রকমের, কিন্তু বেশ সাংঘাতিক। হয়তো জ্যৈষ্ঠ আসতে আসতে গরম গা-সওয়া হয়ে যায় কিংবা ভয়ে-ভক্তিতে কেউ চট করে বিনা ছাতায় বেরোতে চায় না। আমাদের লোডশেডিং-রঞ্জিত শৈশবে চৈত্রের কালবৈশাখী মনে আনত ভয়, বাড়ির বাইরে থাকা স্বজনদের জন্য বিড়বিড় করে প্রার্থনা করা, তারই সঙ্গে তাপের দাহ জুড়িয়ে বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির ফলে কিঞ্চিৎ শান্তি। তাপ কমে আসা মানে রাতে ভাল ঘুম, কারণ আরশোলারা উড়ে বেড়াবে না। আমাদের বৃহৎ ও বিকট লম্বা ফ্ল্যাটবাড়ির নীচে ছিল কারখানা ও গুদাম। সেখান থেকে মুক্তিকামী আরশোলারা রেনওয়াটার পাইপ বেয়ে তিনতলায় উঠে তিনতলার ফ্ল্যাটে তাণ্ডব করত।

চৈত্রের সেল বলে একটা জিনিস ছিল (আজও অবশ্য আছে), যার জন্য কেনাকাটা করতে মফস্‌সলের আত্মীয়া মহিলারা কলকাতার গড়িয়াহাটে আসতেন। সারা বছর ধরে কেনাকাটার নিরন্তর অভিযাত্রা সে কালে ছিল না। পুজোর আগে এক বার, চৈত্রের সেলে বৈশাখের নতুন জামা, বিছানার চাদর ইত্যাদি। সস্তায় কেনা সম্বৎসরের জিনিসপত্র আমাদের খাটের উপর পেতে মেলে তাঁরা আহ্লাদ করতেন। আমার মা তাঁদের চা আর শিঙাড়া, ছানার জিলিপি ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়িত করতেন, কিন্তু কখনও সেলের মারদাঙ্গায় যেতেন না। তার কারণটা জানতাম আমরা ভাইবোনেরা। মা ফুটপাতের দরাদরিতে এত পটু ছিলেন যে, সেলের মতো সস্তায় সারা বছর কেনাকাটা করতে পারতেন। চৈত্রের সেল নাকি দোকানীদের পক্ষে পুরাতন স্টক ঝেঁটিয়ে ফেলে দেওয়ার এক মহতী প্রচেষ্টা। বিদেশে সারা বছর সেল চলতে দেখেছি, কিন্তু আমাদের কোলাহলমুখর কনুইয়ের ধাক্কা, বিনা শিঙে গুঁতোনো চৈত্র সেলের তুলনায় তা নিতান্ত পানসে।

চৈত্র মাস আমার শিশুমনে আনত আর এক আশঙ্কা। নীলষষ্ঠী আর মায়ের উপোস। বাবার অনুরোধ মেনে সব উপোস থেকে বিরত হলেও মা একটি উপোস ছাড়েননি। তা হল নীলষষ্ঠী। ওই এক দিন মা রাঁধবেন বাড়বেন আর আমাদের সঙ্গে খেতে বসবেন না, এটা মেনে নিতে আমার খুব কষ্ট হত। ভেজানো সাবু, নারকোল কোরা মাখা, চিনি আর মর্তমান কলা দিয়ে, আর ফুটির মতো একটা ফল যা নাকি ফেটে যেতেই ফলে, তাই ছিল মায়ের ষষ্ঠীর আহার। উপোসের ফলারেরও একটা বড় অংশ আমরাই চেটেপুটে খেতাম। কিন্তু বিভীষিকাময় পর্বটি ছিল সকালের পর যখন মা কালীঘাটের কাছে নকুলেশ্বরতলার শিবমন্দিরে শিবের মাথায় জল ঢালতে যেতেন। সঙ্গে কোমর বেঁধে আমি। প্রবল ভিড়ে গরদ পরিহিতা মহিলাদের ধাক্কাধাক্কির মধ্যে এক বার মা আমাকে ‘এইখানে দাঁড়িয়ে থাকবি, কোথাও যাবি না’ বলে রেখে গেলেন। বেলা বাড়তে থাকল। যেখানে ছায়া ছিল, সেখানে রোদ। সে রোদও খরতর হল। কিন্তু আমি তো নড়ব না। কিছু দিন আগেই স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য ‘দ্য বয় স্টুড অন দ্য বার্নিং ডেক...’ সেই বিখ্যাত ‘ক্যাসাবিয়াঙ্কা’ কবিতার অনুবাদ করেছি, ‘বালক দাঁড়ায়ে ছিল প্রজ্জ্বলিত ডেকের উপর...’ ইত্যাদি। কাজেই সেই বালকের বীর মূর্তি আমার কল্পনায় জাগ্রত। ডিউটিতে দাঁড়ানো তরুণ পুলিশটি মিনতি করতে থাকল, ‘খুকি, সরে এসো, রোদে মাথা ঘুরে যাবে...’ তবু আমি অটল। বাড়ি এসে মাথায় প্রবল যন্ত্রণা ও বমি। মায়ের আদেশ পালন করতেই হবে যে, যদিও উপোসটি সন্তানেদের কল্যাণার্থেই অবশ্য।

চৈত্রে গাজনের সং দেখতে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম কালীঘাট ব্রিজের ওপর। কালী, শিব, গণেশ, হনুমান ইত্যাদি নানা রকম সেজে তারা বেরোত পটুয়াপাড়া থেকে। তাদের চাল আর পয়সা দিত পাড়ার লোক। চামড়ার উপর আঁকা সাদা নীল কালো হলুদ রঙের ভিতর দিয়ে তাদের পাঁজরের হাড় দেখা যেত। সং সাজা যে গরিবের শখ, নেহাত কিছু পয়সা আর চালের প্রয়োজনে, সেই ছোট বয়সেও বুঝতে বাকি থাকত না।

চোতপরবের মানুষজন

পুরাতন লেখাপত্রেও দেখেছি, গ্রামবাংলাতেও চড়ক আর গাজন, চৈত্রের এই দুই মহোৎসবই প্রধানত দরিদ্রজনের।

চৈত্র সংক্রান্তিরই সব ক’টি উৎসব— চড়ক, গাজন, নীলষষ্ঠী। গ্রামের দিকে নীলের গাজন বলেন অনেকে। ষষ্ঠী তিথি না হলেও সংক্রান্তির দিনই বিবাহিতা সন্তানবতী মহিলারা সন্তানের মঙ্গল কামনায় শিবের মাথায় জল বা দুধ ঢালেন। নীললোহিত বা শিবের নাম থেকেই নাম নীলপূজা।

‘ভারতী’ পত্রিকায় ১৩২১-এ প্রকাশিত শীতলচন্দ্র চক্রবর্তীর লেখায় পাই, বৃহদ্ধর্ম পুরাণে চৈত্র মাসে শিবের পূজার বিধান আছে। শাস্ত্রে চড়ক বলে কোনও উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে মহাবিষুব সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত চড়ক পূজার সঙ্গে হরগৌরীর যোগ ছিল প্রাচীন কাল থেকে, দুর্গাপূজারই মতো গ্রামে গ্রামে ঢাকঢোল বাদ্য বাজিয়ে ধুমধাম হত।

আমাদের পূর্বপুরুষরা নাকি উত্তরে থাকতেন। শীতের ছ’মাস উত্তর কুরুপ্রদেশবাসীর কাছে প্রায় অদৃশ্য থাকার পর বসন্তে নীল আকাশের শোভায় রক্তবর্ণ সূর্য প্রকট হন। তাঁর অভিনন্দনের জন্য যে ধর্মানুষ্ঠান, তাই চড়ক ও নীল পূজার রূপে অনুষ্ঠিত হয়ে এসেছে। এই সময়কে ঘিরেই দক্ষকন্যা সতীর সঙ্গে শিবের বিবাহের কল্পনা। চক্রবর্তী মহাশয়ের মতে, উত্তরায়ণ গতিতে সূর্য বিষুবরেখায় এসে উপস্থিত হলে উত্তর কুরুতে তাকে ছ’মাস পর প্রথম উদিত হতে দেখা যেত। নীলবর্ণ আকাশ ও রক্তবর্ণ প্রভাতসূর্যের যে মিলন, তাই হল হরগৌরী বা শিব ও সতীর মিলন। লোককল্পনায় শিব প্রান্তিক মানুষের দেবতা, আর শিবের অনুচরের দল হল ভূত প্রেত ইত্যাদি।

‘পথের পাঁচালী’তে বিভূতিভূষণ লিখেছেন, চড়ক রাতের ভূতপ্রেত বেরোনো পথের ভয়। বালক অপু নেড়ার ঠাকুমাকে বলছে এগিয়ে দিতে তাকে। ঠাকুমা চড়কের নৈবেদ্য নিয়ে চলেছেন সন্ধেবেলা।

‘কিসের গন্ধ বেরিয়েছে ঠাকুরমা?

বুড়ি বলিল, আজ ওঁরা সব বেরিয়েছেন কিনা?— তারই গন্ধ আর কি?

অপু বলিল, কারা ঠাকুরমা?

কারা আবার— শিবের দলবল, সন্দেবেলা ওঁদের নাম করতে নেই— রাম রাম— রাম রাম—’

নেড়ার ঠাকুমা রাতে কেন নৈবেদ্য নিয়ে যান? দিনেও তো যাওয়া যায়। এ প্রশ্নটা মনে উঠেছে ‘পথের পাঁচালী’ পড়তে পড়তে। আমার মা তো দিনের বেলা যায়।

‘পূজা পার্বণের উৎসকথা’-য় চড়ক গাজন ইত্যাদি প্রসঙ্গে পল্লব সেনগুপ্ত লিখেছেন, চড়ক কথাটি কোথা থেকে এসেছে, তা নিয়ে নানা অনুমান আছে। কথাটি চক্রের অপভ্রংশ হতে পারে। চক্র হল সূর্যের রূপ। কাজেই বলা যায়, চড়ক এক ধরনের সূর্যবন্দনাও।

আবার গাজন গাছে চড়ার সূত্রেও চড়ক নামটি এসে থাকতে পারে। গাজন কথার অন্তরালে থাকতে পারে গর্জন, যা শিবের একটি বর্ণনা। আদিম রীতি বাহিত যৌনজীবনের বা উর্বরতার সমারোহও এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে। গাজনের গাছ পোঁতা এবং তাকে কেন্দ্র করে নানা দুরূহ শারীরিক ক্রিয়ার বর্ণনায় মনে হয়, কিছু আদিম জাদুবিশ্বাস তথা যৌনজীবনের বা উর্বরতার উদ্‌যাপনও এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে। একটি শাল বা গর্জনের খুঁটিকে সারা বছর পুকুরে ডুবিয়ে রেখে তাকে তুলে মাটিতে পোঁতা হয় সংক্রান্তির দিন।

এই থেকে গাজনের শুরু। এখানে মাটি বা পৃথিবী হলেন গৌরী বা পার্বতী। পোঁতা গাছটি হলেন শিব।

পাশ্চাত্যেও বসন্তের আগমনে পুষ্পপত্র দিয়ে তরুশাখা সাজিয়ে তার চার দিকে নৃত্য করে আনন্দ উৎসব পালনের প্রথা ছিল। চড়ক বা গাজনের কেন্দ্রেও কিন্তু বৃক্ষ। মহাবিষুব বা চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে গ্রামবাংলায় যে সব উৎসব হয়, তার নাম কোথাও গম্ভীরা, কোথাও গাজন, কোথাও চড়ক। শিব এই সব অনুষ্ঠানের কেন্দ্রে থাকেন, আর থাকেন তাঁর ভক্ত সম্প্রদায়, যাঁরা প্রান্তিক সমাজের।

মেয়েদের নানা ব্রত পালনও এই সময় হয়। এয়োসংক্রান্তি, ছাতু সংক্রান্তি, আদা হলুদ, পাঁচকুমার ইত্যাদি নানা ব্রত পালনের রীতিও আছে। রাঢ় অঞ্চলে প্রচলিত এই গল্পটির কথা ও আছে চড়ক গাজন বিষয়ক প্রবন্ধে। বাণরাজার কন্যা ঊষার প্রেমিক ছিলেন কৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধ। অনিরুদ্ধকে ঊষার সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে ধরে ফেলার পর বাণ তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হন। তখন সুদর্শনচক্রে তাঁর দেহ টুকরো টুকরো হয়ে যায়। মৃত্যুর আগে অন্ত্যজদের রাজা বাণ এই বর পান যে, যে হেতু ঊষার সন্ততিরা কৃষ্ণের বংশধরদের জনক-জননী হবেন, বছরে একটি দিন তাঁরা পূজা পাবেন, সম্মান পাবেন। সেই দিন হল গাজনের। কিন্তু একটি দিনের সম্মানের বর কোনও সামাজিক ন্যায়ের প্রতীক হয়ে আসেনি। বাণ যে হেতু প্রান্তিক মানুষের রাজা, অনিরুদ্ধর উপর রুষ্ট হওয়াই তাঁর অপরাধ। জীবন দিয়ে যে বরটি তিনি পেলেন, তা আজও কোন প্রকৃত সাম্য আনল না।

সমাজের উচ্চবর্গের চোখে গাজন চড়ক ইত্যাদি কোনও দিন মূল স্রোতের উৎসবসমূহের মতো মান্যতা পাবে না। গাজনের সং, সন্ন্যাসী, চড়কের কাঁটা ঝাঁপ দেওয়া ভক্তরা সবাই ডোম-হাঁড়ি-কাহার বর্গের। তাঁদের জীবন বিপন্ন করে ভক্তির পরীক্ষা দেওয়ার ফলে সমাজের ‘উচ্চবর্ণ’ নিরাপদ দূরত্বে বসে ভক্তির এই সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখতে পারে।

মরি হায় বসন্তের দিন চলে যায়

রুক্ষ বাস্তবের গ্রীষ্ম এসে সামনে দাঁড়িয়েছিল এক দিন। চার দশক আগের এক চৈত্রদিনে জন্মভূমি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এক মেয়ে। হাতে মলাট-ছেঁড়া ডক্টর জ়িভাগো। চোদ্দো বছর বয়সে সেই মেয়েই কবিতায় লিখেছিল— মাগো, ঘর ছেড়ে গেছে বলে তুমি যেন ভুলো না রুণিকে। সে কি নিজের জন্য ভবিষ্যদ্বাণী ছিল? কলকাতা আর বাংলার বদলে বাকি দেশ। সহজ সিদ্ধান্ত নয়। বুকের ভিতর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় বেদনায়। চেনা মহানগরের পিছুডাক আসছে বার বার। মা ডাকছে, ফিরে আয়। ধূসর সামনের পথ, স্টেট ট্রান্সপোর্টের বাস ছুটেছে রাঁচি থেকে পালামৌ। পথের ধারে মিশ্র পর্ণমোচী অরণ্যে রাঙা এক-একটা কুসুম গাছ চমক আনে। শালের সবুজ। নিষ্পত্র শিমূল। রাঙা ফুল-জাগা পলাশ। বসন্তের কোকিল ডেকে চলেছে তখনও। সেটলমেন্ট ক্যাম্পে ট্রেনিংয়ের তারিখ এসে গেছে। এ বার শুরু হবে ফসল-কাটা। বুনো ঘাস গজানো জমির উপর মাপজোকের শিকল নিয়ে মাইলের পর মাইল ঘোরা। ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে কলকাতার মুখচ্ছবি, হাজরা রোডের ছোট বাসা, যেখানে সূর্যাস্ত দেখতে চাইলে দারোয়ানকে ধরে ছাদের দরজা খোলাতে হয়। সেই মেয়েটি হারিয়ে গিয়েছিল সূর্যডোবা দেখতে গিয়ে, তার আর ফেরা হয়নি। কিন্তু দেশান্তরি হওয়া কি, তা সে নিজের অস্তিত্ব দিয়ে বুঝেছে।

তামনার শেষ চৈত্র

আমরা এখন গভীর অরণ্যভূমি পার হয়ে চলেছি। এই সেই জেনাবিলের গভীর জঙ্গল আর মায়াবী তৃণভূমি। পাতাঝরা রাঙা পথ মাড়িয়ে যাচ্ছে জিপ। এত ক্ষণে রাত ঘন, জ্যোৎস্না তার চাদর বিছিয়ে দিয়েছে সারা অরণ্যে। মাটি থেকে ধোঁয়ার মতো উঠছে কুয়াশা। তার ভিতর দিয়ে ধাবমান হরিণদের সিল্যুয়েট দেখা যায়। যেন দেহহীন তারা। একটা বড় ফাঁকা জমি। সেখানে ঘাসের জঙ্গল। ছড়ানো এমন কিছু গৃহস্থ গাছ যাতে বোঝা যায় এটা একটা গ্রাম ছিল। পাথরগঢ়ি বনগ্রামটি উঠে গেছে দূরে। অভয়ারণ্যের ভিতর তাদের কোনও ভবিষ্যৎ ছিল না। না স্কুল, না হাসপাতাল, না বিদ্যুৎ। এক মাজা-ভাঙা পেয়ারা গাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তামনা হো। তার কপালে একটু দোলের শুকনো রং।

এখানে কী করছ তামনা? বন থেকে উঠে গেছ না তোমরা? গ্রামের সব ক’টি পরিবার উঠে চলে গেলেও তামনা আর তার বৌ শেষ পর্যন্ত বুক দিয়ে মাটি আঁকড়ে পড়ে ছিল। বনের বাইরে যাবে না। এখানে চার পুরুষের বাস ছিল যে! ছোটনাগপুরের হো জনজাতি, ময়ূরভঞ্জে তার পূর্বপুরুষ এসেছিল রাজার আমলে রেলওয়ে স্লিপারের জন্য শালের গাছ কাটতে।

এইটা আমাদের পেয়ারা গাছ। আর ওইটা সজিনা। ফুল হয়েছে সজিনা গাছে। দূরে কোণে ফলন্ত কাঁঠাল গাছ। আমাদের ফাঁকা ঘরটা ভেঙে দিয়েছে হাতিরা।

তামনা যেতে চায়নি। এ দিকে অন্যরা চলে গেছে। জঙ্গল ধেয়ে আসছে খালি গ্রামে। ওর জেদ দেখে গ্রামের বাকি লোকেরা আঙন থেকে গ্রামদেবতার মূর্তি জোর করে তুলে নিয়ে চলে গিয়েছিল। তার পরেই ওর মোষটাকে ঘাড় কামড়ে নিয়ে গেল বাঘ। আর সাহস করেনি তামনা হো। চলে গেছে ভিটেমাটি ছেড়ে। আজ তাকে ডেকেছে কি বনের মাথায় রাঙা গোল চাঁদ? জঙ্গলের ফাঁকফোকর দিয়ে তামনা চেনা পথ ধরে গলে চলে এসেছে। দেখছে তার ভিটেয় এখন বড় বুনো ঘাস। সেখানে দলে দলে হরিণ চরে। হরিণের পিছনে আসে বাঘ। আর বৃংহণ তোলে হাতির যূথ, যাদের জন্য সারা বনটাই চলার পথ। জ্যোৎস্না-মাখা পাহাড় শ্রেণি তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে উজাড় গ্রামকে। চৈত্ররজনীতে তামনা হো পুরনো বসতের হারানো আখরগুলি খুঁজছে। তার দুই গালে চিকচিক করছে— ও কি অশ্রুর দাগ?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement