ভারতের মাটিতে প্রথম রেল চলাচল ঘটে ১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল। সেদিন ছিল শনিবার। তখনকার বোম্বের নিকটবর্তী বোরি বন্দর থেকে থানে পর্যন্ত ২১ মাইল বা ৩৪ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে শুরু হয়েছিল ভারতীয় ট্রেনের পথ চলা।
রেল চলাচলের শুরুর ইতিহাস খুব মসৃণ নয়। পরাধীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার সহজে ভারতের মাটিতে রেল চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়নি। কারণ ভারতীয় জনগণ রেলে চড়তে আদৌ আগ্রহী হবে কি না, তা নিয়ে সাহেবদের মনে সংশয় ছিল। তাদের মনে হয়েছিল, বিপুল অর্থ ব্যয় করে পাতা রেললাইনে রেল চালানো হবে, কিন্তু যদি মানুষ আগ্রহী না হয়, তা হলে প্রচুর অর্থের লোকসান।
দীর্ঘ দিন ধরে চলে আলোচনা। চলে সরকারি অফিসারদের টেবিল থেকে টেবিলে নোট চালাচালি। তার পর শেষমেশ গৃহীত হয় এদেশে রেল চালানোর সিদ্ধান্ত। তবে তার পিছনে ছিল বেশ কয়েকটি কারণ।
প্রথমত, তত দিনে ভারতের নানা স্থানে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল ব্রিটিশ বিরোধী বিক্ষোভ ও আন্দোলন। কোথাও বিপ্লবীরা আচমকা গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সাহেবকুঠি ধ্বংস করে ফেলল কিংবা শাসককে প্রাণে মেরে ফেলল— এমন সংবাদ আসার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ইংরেজ সৈন্য পাঠিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, রেল চলাচল হলে সবচেয়ে বেশি সাহায্য হবে বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহণে। এতে জলপথের চেয়ে অনেক কম সময়ে এবং কম খরচে কয়লা, তুলো, মশলাপাতি মতো নানা রকম কৃষিজ এবং খনিজ পণ্য সহজে বিভিন্ন গন্তব্যে বা বাণিজ্য বন্দরে আনা নেওয়া করা সম্ভব হবে।
তিন নম্বর কারণটা বেশ মজার। ইংল্যান্ড রেল চলাচল নিয়ে তখন অনেকখানি এগিয়ে চলেছে। ১৮২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বাষ্পচালিত যান ‘লোকোমোশন নং ওয়ান’ যাত্রী পরিবহণ করল উত্তর পূর্ব ইংল্যান্ডের স্টকটন-ডার্লিংটন রেলওয়েতে। এটিই বিশ্বের প্রথম যাত্রিবাহী ট্রেন হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত। যানটি তৈরি করেছিলেন জর্জ স্টিফেনসন। এর ঠিক পাঁচ বছরের মাথায়ই, ইংল্যান্ডেই প্রথম স্থাপিত হল আন্তঃশহর বা ইন্টারসিটি রেলওয়ে। ১৮৩০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশায়ারের লিভারপুল এবং ম্যানচেস্টারের মধ্যে রেলচলাচল শুরু হল। এই সব কারণে সাহেবদের ভারতীয় উপনিবেশসহ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে রেল-ম্যানিয়া। ঔপনিবেশিকরাও চাইল ভারতবর্ষেও এই রকম রেলপথের সুবন্দোবস্ত করা হোক। শুরু হল সেই অনুযায়ী প্রস্তাবিত কাজকর্ম।
অনেক সাহেব ভেবেছিলেন, ভারতীয় জনগণ রেলভ্রমণে আদৌ আগ্রহী হবেন না। তাঁদের সংশয় মিথ্যে করে ভারতীয়রা নিয়মিত ভাবে রেলে চড়ে যাতায়াতে বিশেষ ভাবে আগ্রহী হয়ে উঠলেন।
যাই হোক, ফিরে আসি প্রথম ট্রেন চলাচলের ঘটনায়। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে বোম্বের বাইকুল্লা ফ্ল্যাটের পাশে, ভারতের মাটিতে প্রথম বাষ্পচালিত ইঞ্জিনকে ট্রেনের কামরা শান্টিং করার কাজে দেখা গেল। এর পর থেকে শান্টিংয়ের কাজের সময় তা দেখার জন্য লাইনের দু’ধারে ভিড় জমাতেন অজস্র কৌতূহলী জনতা।
এই বাষ্পচালিত ইঞ্জিনটি জাহাজে করে ইংল্যান্ড থেকে আনা হয়েছিল। বোম্বের তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্নর লর্ড ফকল্যান্ডের নামানুসারে ইঞ্জিনটির নামকরণ করা হয়েছিল ‘ফকল্যান্ড’।
১৮৫২ সালের ১৮ নভেম্বর তারিখে গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার (জি আই পি) কোম্পানির ডিরেক্টররা তাঁদের বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে এই ট্রেনে চেপে একটি পরীক্ষামূলক যাত্রা বা ট্রায়াল রানের ব্যবস্থা করেন। সে দিন তাঁরা পাড়ি দিয়েছিলেন মোট ২১ মাইল রেলপথ, সময় লেগেছিল ৪৫ মিনিটের কাছাকাছি। যাত্রাকালে তাঁরা থানের কাছে কুরলায় ভারতের প্রথম টানেল পথের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় প্রাতরাশ সেরেছিলেন। মোটামুটি সফল ভাবেই উতরেছিল তাঁদের ট্রায়াল রান। তার পরবর্তী কয়েক মাসে চলল কিছু যান্ত্রিক কাজকর্ম, শেষ মুহূর্তের সংশোধন, প্রস্তুতি, নানা অফিশিয়াল ফর্মালিটি।
এক সময় পরীক্ষানিরীক্ষার পর্ব শেষ হল। এল প্রথম রেল চলাচলের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল, অর্থাৎ ভারতের মাটিতে বোম্বে থেকে থানে পর্যন্ত প্রথম ট্রেন চলার দিনটি সরকারি ছুটির দিন হিসেবেও ঘোষিত হয়েছিল। যাত্রা শুরুর সেই বহু প্রতীক্ষিত ক্ষণটি ছিল বিকেল সাড়ে তিনটে। বেজে উঠল গভর্নরের ব্যান্ড-বিউগল। ঐতিহাসিক মুহূর্তটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ২১ বার তোপধ্বনিও করা হল।
মোট ১৪ টি কামরায় সওয়ার হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন শহরের বহু গণ্যমান্য মানুষজন, তাঁদের মোট সংখ্যা ছিল ৪০০। উপস্থিত অসংখ্য আগ্রহী দর্শকের চোখের সামনে দিয়ে ট্রেন রওনা দিল বোরি বন্দর স্টেশন থেকে থানে স্টেশনের দিকে।
এই ঐতিহাসিক ঘটনা স্বচক্ষে দেখতে সে দিন ভিড়ও হয়েছিল দেখার মতো। সে প্রসঙ্গে পরের দিনের ‘বোম্বে টাইম্স’ কাগজে যে রিপোর্ট লেখা হয়েছিল, তার সারমর্ম হল—এই যুগান্তকারী ঘটনা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহ ও উদ্দীপনার অন্ত ছিল না। দুপুর দুটোর আগে থেকেই শিশু-নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ স্টেশনে উপস্থিত হন। এমনকি অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সমস্ত তল্লাটে অসংখ্য মানুষের ভিড়ে আর তিল ধারণের জায়গাও ছিল না।
কাগজের রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায়, টানা রেলপথের দু’ধারে থিকথিকে ভিড় তো বটেই, তা ছাড়াও, লাইনের দু’ধারে অবস্থিত বাড়িগুলির জানলা বারান্দা এবং ছাদেও আর জায়গা অবশিষ্ট ছিল না। নিকটবর্তী নৌরজি হিল্সের চুড়োগুলোতেও উঠে বসেছিলেন অসংখ্য দর্শক।
সমগ্র যাত্রাপথে বাষ্পচালিত ইঞ্জিনটি ‘সায়ন’ স্টেশনে জল নেওয়ার জন্য কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। অবশেষে বিকেল চারটে ৪৫ মিনিটে ট্রেনটি তার নির্ধারিত গন্তব্যস্থল থানে স্টেশনে গিয়ে পৌঁছয়।
গন্তব্য, অর্থাৎ থানে স্টেশনে ছিল আপ্যায়নের জাঁকজমক। সেখানে ট্রেন পৌঁছনোর পরই অতিথি যাত্রীদের জলযোগ দেওয়া হয়। উপস্থিত মেজর সোয়ানসন আনুষ্ঠানিক ভাবে সদ্য প্রতিষ্ঠিত গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার কোম্পানি এবং তার মুখ্য ইঞ্জিনিয়ার বার্কলে সাহেবকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং উত্তরোত্তর সাফল্যপ্রাপ্তি কামনা করেন।
সে দিন সেই যাত্রীরা রাতে ফিরে আসেননি বোরি বন্দরে। থানে-তে সেদিন প্রথম রেলযাত্রীদের রাত্রিবাসের জন্য নির্মিত হয়েছিল রাজকীয় তাঁবু। রাতে ছিল সুস্বাদু খাদ্য ও পানীয়সহ নৈশভোজ, তার সঙ্গে সবার মনোরঞ্জনের জন্য বসেছিল সঙ্গীতের আসর।
পরের দিন, অর্থাৎ ১৭ এপ্রিল, রবিবার সমস্ত যাত্রীকে ট্রেনযোগে বোম্বের বোরি বন্দর স্টেশনে ফিরিয়ে আনা হয়।
তারও পরের দিন, সোমবার, ১৮ এপ্রিল, স্যর জামশেদজি জিজিবয় গোটা ট্রেনটি তাঁর পরিবারের জন্য ভাড়া নেন এবং সমস্ত আত্মীয়-স্বজনকে সঙ্গে নিয়ে বোম্বে থেকে ওই ট্রেনে চেপে থানে যান, আবার সে দিনই বিকেলে ফিরে আসেন।
এই সব কিছুর সঙ্গে আরও একটি অদ্ভুত খবর প্রকাশিত হয়েছিল বোম্বে টাইম্সে। সেই খবর থেকে জানা যায়, গভর্নর লর্ড ফকল্যান্ড, কম্যান্ডার ইন চিফ লর্ড ফ্রেডারিক, বিশপ রেভারেন্ড জন হার্ডিঞ্জ এবং তাঁদের আরও কিছু পারিষদ ১৬ এপ্রিলের আগের সন্ধ্যায় কোনও অজ্ঞাত কারণে বেড়াতে গিয়েছিলেন পুণের পাহাড়ি এলাকায়। সেই কারণে তাঁরা রেলযাত্রার উদ্বোধনী
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারেননি।
কিন্তু প্রথম রেলযাত্রার উদ্বোধনের মতো এত বড় একটি ঘটনার তারিখ তাঁরা আগে থেকে জানতে পারবেন না, এমনটা সম্ভব নয়। কিন্তু তাও সে দিন তাঁরা কেন অনুপস্থিত রইলেন, এর সদুত্তর আজও মেলেনি।