ছবি: মণীশ মৈত্র
ছো ট্ট একটা গলির শেষ প্রান্তে ছোট্ট একটা বাড়ি। প্রেসি়ডেন্সি কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়া দাদার হাত ধরে ছোট্ট আমি সেই বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখলাম— গেরুয়া ফতুয়া আর গেরুয়া লুঙ্গি পরে হারমোনিয়ামের সামনে তিনি বসে আছেন। দেবব্রত বিশ্বাস। ১৯৭৪ সাল। আমি ক্লাস টু।
হয়েছিল কী, ছোটবেলায় আমি নাকি ছিলাম দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠস্বরে, যাকে বলে একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ। এটার পিছনে যুক্তি-বুদ্ধি-বিশ্লেষণ সেই সময়ে অন্তত কী ছিল জানি না, কিন্তু ঘটনা হল, ওঁর গান হলেই আমি নাকি রেডিয়োর সামনে গিয়ে চুপ করে বসে থাকতাম। রেকর্ড প্লেয়ারে দেবব্রত বিশ্বাসের গান চালিয়ে মা নাকি আমায় ভাত খাওয়াতেন। শুধু গান শোনা-ই নয়, আমার সারা দিনের আলোচনার বিষয়বস্তুও ছিলেন নাকি উনিই। ‘দেবব্রত আমাদের বাড়ি আসে না কেন?’ বা ‘দেবব্রতর মা-কে তুমি চেনো?’ ইত্যাদি প্রশ্নে মা-কে বিরক্ত করতাম। ওঁর গলায় শোনা গান চিৎকার করে গাইতাম সারা ক্ষণ। আমার এই প্রবল দেবব্রতামি-তে অতিষ্ঠ হয়ে আমার বড়দা পলাশবরন অবশেষে আমায় নিয়ে গেল ট্র্যাঙ্গুলার পার্কের সেই বাড়িটায়।
রেডিয়োতে ওঁর গলা শুনে আমার কেন জানি না ধারণা ছিল যে, দেবব্রত বিশ্বাস এক জন গোঁফওয়ালা বাজখাঁই গোছের লোক এবং কোট-পেন্টুলুন পরে পাইপ টানেন। প্রাথমিক আলাপ-পরিচয়ের পরে উনি আমার দাদাকে এবং আমাকেও বললেন, ‘বসেন আপনারা।’ দাদা একটু কুণ্ঠিত হয়ে বলল, ‘আমাদের আপনি-আপনি করবেন না, মানে...’ থামিয়ে দিয়ে জানালেন, উনি সবাইকেই আপনি-আপনি করে বলেন। আমার একটু রোমাঞ্চই হচ্ছিল অবশ্য। কারণ, বলা বাহুল্য, সে সময়ে আর কেউ আমায় ‘আপনি’ বলত না।
যা-ই হোক, দাদা যখন জানাল যে আমি গান গাইবার চেষ্টা করি, তখন উনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী গান, রবীন্দ্রসংগীত?’ সেই বস্তুটা যে কী, এ সম্বন্ধে কোনও ধারণাই ছিল না তখন আমার। তাই একটু ভড়কে গিয়ে দাদার দিকে তাকাতেই দাদা বলল, ‘ও রবীন্দ্রসংগীত কাকে বলে জানে না। ও দেবব্রতর গান গায়।’ ‘কই দেখি, ক্যামন করেন দেবব্রত বিশ্বাসের গান!’ আমি, মনে আছে, প্রথমে গেয়েছিলাম ‘হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ দেহ প্রাণ।’
অনুষ্ঠানের শুরুতে আমি তিনটে গান গাইতাম, তার পর উনি গাইতেন।আমার পরিচয় করাতেন— ‘ইনি এক জন দ্বিতীয় শ্রেণির গায়ক, অর্থাৎ ক্লাস টু-তে পড়েন’! পরাগ বরন পাল
পর পর গোটা চারেক গান শুনে উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গল্পদাদুর আসর বা শিশুমহল-এ গাওয়া হয় নাকি?’ (এগুলো সেই সময়ের খুব জনপ্রিয় রেডিয়ো অনুষ্ঠান)। দাদা মাথা নেড়ে ‘না’ বলাতে উনি বললেন, ‘ভালই হয়েছে। বিশ্বাসদাদুর আসরে গাইবেন।’
এর মানেটা কী, তখন বুঝিনি। আরও দু’-এক দিন এই রকম হওয়ার পর উনি প্রস্তাব দিলেন— রবীন্দ্র সদনে ওঁর অনুষ্ঠানে আমায় নিয়ে মঞ্চে উঠবেন। শুরুতে আমি তিনটে গান গাইব, তার পর উনি গাইবেন। জানতে চাইলেন আমার মা-বাবার মত আছে কি না। সেই বয়সে খুব একটা গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারিনি ঘটনাটার। কিন্তু মা-বাবা আর দাদাদের উচ্ছ্বাস দেখে বুঝলাম, একটা বিরাট কিছু ঘটেছে।
এ রকম বেশ কয়েকটা অনুষ্ঠান হয়েছে সেই সময়ে, যত দিন পর্যন্ত না উনি অভিমানে অনুষ্ঠান করা ছেড়ে দিলেন। শুরুতে আমার পরিচয় করাতেন— ‘ইনি এক জন দ্বিতীয় শ্রেণির গায়ক, অর্থাৎ ক্লাস টু-তে পড়েন’— এই বলে। তার পর আমার জন্য বরাদ্দ থাকত তিনটি করে গান। স্বভাবসিদ্ধ উচ্চারণ ও ভঙ্গিমায় উনি ঘোষণা করতেন, ‘আগে ছোট-দেবব্রতর গান শোনেন, তার পর বুড়ো-দেবব্রত গাইবেন।’
এর পাশাপাশি চলছিল রোববার সকালগুলোয় ওঁর বাড়ি যাওয়া, নতুন গান শোনা, গান নিয়ে আলাপচারিতা। এখানে বলে রাখা ভাল, ‘আসুন, শেখাই’ বলে ধরেবেঁধে আমায় উনি গান শেখাননি কখনও। কোনও গান দিয়ে হয়তো আলোচনা করছেন, তার অন্তর্নিহিত ভাবটাকে ব্যক্ত করছেন, হঠাৎ হারমোনিয়ামে আঙুল চালিয়ে এক লাইন গেয়ে উঠলেন— এই রকম হত ব্যাপারটা। তাই ‘তুমি কার কাছে গান শিখেছ’-র উত্তরে ওঁর নাম আমি বলিনি কখনও। কিন্তু দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে মূলত যে তালিমটা পেয়েছি, সেটা হল, একটা গানকে কী ভাবে ধরতে হয়, বুঝতে চেষ্টা করতে হয়, তার পর মানেটা বুঝে কী ভাবে কোন কথাটা উচ্চারণ করতে হয়।
ওঁর রেকর্ডের সব গান তো আমার জানা ছিলই। তখন কোনও রেকর্ডে ছিল না এমন কিছু গানও ওই বাড়িতে বসেই জানা হয়েছিল আমার। কথাবার্তা চলতে চলতে কখন যেন দেখেছি যে গানটা শেখা হয়ে গেছে। যেমন, ‘শ্রাবণমেঘের আধেক দুয়ার ওই খোলা’, ‘পুব-হাওয়াতে দেয় দোলা’, ‘এ যে মোর আবরণ’ ইত্যাদি। এই শেষ গানটি, সত্যি বলতে কী, আমি আর কোথাও শুনিনি। রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ নাটকের গান। কী যে দুর্ধর্ষ গানটা! আর কী অসম্ভব গাইতেন উনি!
ক্লাস টু থেকে ক্লাস এইট— এই সময়টুকু আমার ওঁকে পাওয়া। অনেক বিখ্যাত মানুষজনকে দেখেছি তখন ওই বাড়িতে। সুবীর সেনকে দেখেছি। কিশোরী বয়সের ইন্দ্রাণী সেনকে দেখেছি। দীর্ঘদেহী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে দেখেছি ঘাড় কাত করে ঢুকতে। এমনকী এক দিন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কেও। বেশ মনে আছে, এক দিন গিয়ে দেখি ওঁর ডান পাশে খাটের ওপর একটা শোয়ানো টেপ-রেকর্ডার রাখা।
বললেন যে, এক রেকর্ড কোম্পানির কর্ণধার সেটা দিয়ে গেছেন। বলেছেন, যত খুশি গান ওটায় টেপ করে রাখতে। সেই টেপ-রেকর্ডারে কী করে ‘রেকর্ড’ আর ‘প্লে’ একসঙ্গে টিপে রেকর্ড করতে হয়, গান শেষ হওয়ার পর প্রথমে ‘পজ’ টিপে তার পর ‘স্টপ’ টিপতে হয়— সে সব শিখে ফেললাম আমি। ওই সময়ে ওটা একটা নতুন শেখা খেলার মতো ছিল আমার কাছে। এর পর ওঁর বাড়িতে গেলে মাঝে মাঝেই আমার কাজ ছিল বোতাম টিপে ওঁর গান রেকর্ড করা। ওঁর মৃত্যুর পর এই রেকর্ডিংগুলোর সঙ্গে যন্ত্রানুষঙ্গ যোগ করে, রিমিক্স ও রিমাস্টার করে, শুরু হয় এগুলোর প্রকাশ। তাই, এগুলোর সঙ্গে হারমোনিয়ামের আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যায়। এখনও এগুলো প্রকাশিত হয়ে চলেছে বোধহয়। এগুলো শুনলেই আমার মনে হয়— আহাহা! সাউন্ড রেকর্ডিস্ট হিসেবে আমার এই অমর কীর্তি ইতিহাসে লেখা রইল না!
আমার ক্লাস এইটে শেষ দেখা ওঁর সঙ্গে। তখন উনি অসুস্থ। মায়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম। এ-কথা সে-কথার পর গান শোনাতে বললেন। ‘কণ্ঠে নিলেম গান, আমার শেষ পারানির কড়ি—’ গাইলাম। একটু বিকেলের দিকে গিয়েছিলাম সে দিন। গানটা যখন শেষ হল, তখন সন্ধে হব-হব। ঘরের ভিতর আলো বেশ কম। গান শেষ হওয়ার পর চুপচাপ বসে রইলেন কিছু ক্ষণ। তার পর অস্ফুটে বললেন, ‘পার হব কি নাই হব তার খবর কে রাখে!’ আবার স্তব্ধতা। তার পর বললেন, ‘শোনেন, এট্টা কথা কই। আপনার গলা ভাঙা শুরু হইছে, স্কেলও নামছে। এই বার গলা চেঞ্জ হইব। এখন চড়ার দিকে বেশি চেঁচিয়ে গাইবেন না।’ আবার একটু চুপচাপ, তার পর, ‘আপনি এ বার বড়-পরাগবরন হয়্যা যাবেন। আপনারে আর ‘ছোট-দেবব্রত’ ডাকতে পারুম না।’ মা তা়ড়াতাড়ি বলতে গেলেন ‘না না, তাতে কী...’ ইত্যাদি। হাত তুলে থামালেন মা-কে, তার পর আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘আপনি এক্কেরে আমার মতো কইর্যা গান করতাসেন। করবেন না। আমার ভাবটা, উপলব্ধিটা গ্রহণ করেন, তার পর নিজের মতো কইর্যা গান।’
প্রায়ান্ধকার ঘরে একমুখ দাড়ি নিয়ে বসে থাকা মহাঋষি-সদৃশ এক মূর্তির ওই গমগমে গলা আজও কানে বাজে। ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে’ বা ‘আকাশভরা সূর্যতারা’ গাইতে গেলে যে গলা বলে উঠত— ‘ফিল করেন: ইয়্যু আর সারাউন্ডেড বাই কসমিক এলিমেন্টস’— সেই গলা। যে গলা বলে উঠত— ‘অন্ধকারে চাঁদ ওঠেনি, সিন্ধুপারে চাঁদ ওঠেনি। এই ‘সিন্ধুপার’ কথাডা অ্যাড কইর্যা ক্যানভাস কতডা বেড়ে গেল ভাবেন দেহি’— সেই গলা। তখন অতটা বুঝিনি। আজ বুঝতে পারি কত সমৃদ্ধ হয়েছিলাম ওই বিরাট বটের ছায়ায় এসে।
ট্র্যাঙ্গুলার পার্কের পাশের সেই বাড়িটা এখনও চোখ বুজলে দেখতে পাই। ঢোকার মুখে একটুখানি ছোট্ট উঠোনের মতো— ডান দিকে রান্নাঘর— যেখানে হারমোনিয়ামের ও-পারে বসে থাকতেন দেবব্রত বিশ্বাস।
ওঁর আর এক প্রিয় ছাত্র অরুণ গঙ্গোপাধ্যায়। আমার অরুণদা। গত বছর আমায় নিয়ে গেল সেই বাড়িটায়। সেখানে এখন একটা কাফে। তাতে সারা ক্ষণ দেবব্রত বিশ্বাসের গান বাজে। দুজনে বসে গল্প করলাম অনেক। প্রায় পুরোটাই স্মৃতি-রোমন্থন। ‘তোমার দ্বারে কেন আসি’ গানটার প্রসঙ্গে অরুণদা বললেন, কেমন করে শিখিয়েছিলেন গানটা। গানটার প্রথম অন্তরা ‘সে-সব চাওয়া সুখে দুখে ভেসে বেড়ায় কেবল মুখে’, আর দ্বিতীয়টা হল ‘একটি চাওয়া ভিতর হতে ফুটবে তোমার ভোর-আলোতে’। অধিকাংশ গায়ক-গায়িকাই দুটি অন্তরা প্রায় একই ভাবাবেগে গেয়ে চলেন। দেবব্রত বিশ্বাস বলেছিলেন, ‘দুইডা এক ভাবে কওন যায়? একটি চাওয়া— এ সিংগল সলিটারি ডিজায়ার ফ্রম উইদিন— উপলব্ধি করেন। আর শুনেন, রবীন্দ্রনাথের ভোর হইত চাইরটার সময়ে, আর আপনারটা হইত্যাছে বেলা দশটায়। ভোর অত জোরে, অত স্পষ্ট কইর্যা হয় না। ভোর হয় অস্ফুট ভাবে। সাট্লি। ভিজুয়ালাইজ করেন।’
কত স্মৃতি! কথা বলতে বলতে এক সময়ে দেখলাম গলা ভারী হয়ে আসছে আমাদের। বিভূতিভূষণের বাংলা ধার করে বলতে গেলে ‘গলার কাছে কী-একটা পুঁটুলি পাকাইয়া উঠিয়াছে।’
আসলে একই বটগাছ দুজনের মধ্যেই ঝুরি ছড়িয়েছে যে!
paragbaran@gmail.com