ছবি: সুব্রত চৌধুরী
প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের ভারী লোহায় তৈরি, তিনটে তোরঙ্গ। তার মধ্যে সুতো আর রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা কয়েক হাজার চিঠির তাড়া, সঙ্গে নোটবুক, ডায়েরি, নথিপত্র, ছবি। এত বছরের ব্যবধানে কাগজের রং জ্বলে গিয়েছে। জায়গায় জায়গায় লেখা অস্পষ্ট। চিঠির মাথায় ডাকটিকিটগুলো অবশ্য স্পষ্ট— পেচোরা গুলাগ ক্যাম্প।
গুলাগ? সে তো সাইবেরিয়া এবং স্টালিনের আমলের কথা! ইতিহাসবিদ অরল্যান্ডো ফাইজিস তাঁর ম্যাগনিফাইং গ্লাস নিয়ে আরও ঝুঁকে পড়লেন। তিন নম্বর ট্রাঙ্কের কাগজপত্রগুলো একটু অন্য রকম লাগছে না? তাড়া তাড়া চিঠি। প্রায় দু’হাজার! সব মিলিয়ে ৩৭ কেজি ওজন। প্রেরক ও প্রাপক দু’জন। লেভ মিশচেঙ্কো আর স্বেতলানা ইভানোভা।
সোভিয়েট ভেঙে যাওয়ার পর রুশ আর্কাইভে বহু সম্ভারের খোঁজ পেয়েছেন অরল্যান্ডো। স্টালিনের আমলে কী ভাবে ‘ফিসফিস’ কথাটা গুজগুজ করা আর কর্তৃপক্ষের কাছে লাগানি-ভাঙানি দু’টো অর্থে ব্যবহৃত হত, তা খুঁজে পেয়েছেন তখনকার সাধারণ মানুষের চিঠিপত্র, অ্যালবামে। সে সব নিয়েই তাঁর বিখ্যাত বই ‘হুইস্পারিং’। সেই অরল্যান্ডো একটু থমকে গেলেন। লেভ আর স্বেতলানার এই ট্রাঙ্কভর্তি চিঠিই কি তা হলে গুলাগের সবচেয়ে মূল্যবান দলিল?
২০০৭ সাল। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে চিঠির মধ্যে ডুবে গেলেন অরল্যান্ডো। শেষে বোঝা গেল, এই ট্রাঙ্কে আছে দুনিয়ার বৃহত্তম ও সবচেয়ে ওজনদার প্রেমপত্র। আট বছর ধরে প্রতি সপ্তাহে লেভ আর স্বেতলানা পরস্পরকে দু’টো করে চিঠি লিখত।
প্রথম চিঠি স্বেতলানার। জুলাই, ১৯৪৬। মস্কোয় বসে লিখছে, “এই যে আমি আছি, কিন্তু কী লেখা উচিত, জানি না— তোমার কথা মনে পড়ে। সে তো তুমি জানোই। আমি যেন সময় ছাড়িয়ে বাস করছি, জীবন কখন শুরু হবে তার অপেক্ষা, যেন একটা বিরতি চলছে।” লেভের জবাব, “তুমি এক বার জানতে চেয়েছিলে, আশা নিয়ে বাঁচা বেশি সহজ, না কি আশা ছাড়া। আমি কোনও আশা দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু সেটা ছাড়াও আমি শান্ত বোধ করছি।” শেষ চিঠিও লেভের। তারিখ ছিল জুলাই ১৯৫৪।
আশ্চর্য এক প্রেমকাহিনির বিস্তার চিঠিপত্র জুড়ে। গুলাগের কানুন খুব কড়া। স্টালিনের আমলে সোভিয়েট রাষ্ট্র যাকে সামান্যতম সন্দেহজনক বলে মনে করত, তাকেই পাঠিয়ে দিত সাইবেরিয়ার এই সংশোধনাগারে। অমানুষিক কষ্টের জীবনে। সেখানে বন্দিরা মাসে এক বার চিঠি গ্রহণ-প্রেরণের অনুমতি পেত, সেই চিঠিও আবার সেন্সর করা। আগে পুলিশ পড়ত। ব্যক্তিগত কথা লেখা কঠিন ছিল। কিন্তু ক্যাম্পের কর্মীরা লেভকে ভালবাসত, চোরাচালানের কাজটা তাদের হাত দিয়েই হত। লেভ আর স্বেতলানা নিয়ম ভেঙে সপ্তাহে অন্তত দু’বার চিঠি চালাচালি করত। দেখাও করত। ভালবাসার নমুনা হিসেবে সমস্ত চিঠি তারা জমিয়ে রেখেছিল। চিঠিগুলোই ছিল তাদের অবলম্বন। এ ভাবেই তৈরি হয়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রেমপত্র— ‘গুলাগ চিঠি’র সবচেয়ে বড় ভাণ্ডার।
অরল্যান্ডো লিখছেন, এত চিঠির প্রতিলিপি করতে বছর দুয়েক সময় লেগেছিল। অজস্র সাঙ্কেতিক শব্দ তাতে। তার পর তাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়া, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলা, এলাকাগুলো ঘুরে দেখা। শেষে তৈরি হয়ে ওঠে এমন এক নথি, যা ইতিহাসের আকরও বটে। প্রাক্তন বন্দিদের বয়ানে গুলাগের ছবি পাওয়া যায়, তবে এমন দৈনন্দিন খুঁটিনাটি কোথাও উঠে আসেনি।
বছর সাতেক আগে প্রকাশিত হয় অরল্যান্ডোর বই: ‘জাস্ট সেন্ড মি ওয়ার্ড’।
প্রেমের শুরু
লেভই স্বেতলানাকে প্রথম দেখে। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে এনট্রান্স পরীক্ষার দিন। লেভের এক বন্ধুর সঙ্গেই দাঁড়িয়ে ছিল সে। বন্ধু পড়ত স্বেতলানার স্কুলে। সামান্য কথাবার্তার বেশি সে দিন এগোয়নি। এটা ‘প্রথম দর্শনে প্রেম’ নয়। তবু ভালবাসার জন্ম হল। দেখতে-দেখতে একদিন স্বেতলানার বাড়িতে যাতায়াত শুরু করল লেভ।
বলশেভিকদের নিয়ে দুই পরিবারে দুই বিপরীত অভিজ্ঞতা ছিল। স্বেতলানার বাবা নিজে বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানের ছাত্রটিকে তাঁর পছন্দই হল। লেভও ভালবেসে ফেলল সাজানো পরিবারটিকে। আর লেভের নিজের পরিবার বলে তেমন কিছু ছিল না। ১৯১৭-র ২১ জানুয়ারি তার জন্ম। মাসখানেকের মধ্যেই ফেব্রুয়ারি বিপ্লব। লেভের বাবা ছিলেন ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী। গৃহযুদ্ধ বাধলে পরিবারটা চলে গেল সাইবেরিয়ার বেরিয়োজ়োভো শহরে। ১৯১৯-এ সে-শহরও বলশেভিকদের দখলে এল। ‘বুর্জোয়া’ আর বিরোধী পক্ষ ‘হোয়াইটস’দের সাফ করতে উদ্যোগী হল তারা। প্রথমে খুন হলেন লেভের মা, পরে বাবা। এক কমিউনে লেভকে বড় করতে লাগলেন দিদিমা।
জুন, ১৯৪১। যুদ্ধে যাওয়ার ডাক পড়ল লেবেদেফ ফিজ়িক্স ইনস্টিটিউট-এর টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট, উজ্জ্বল তরুণ লেভের। লেভ লিখছে, ‘‘ভবিষ্যৎ নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারব না। একটা কথা জানতাম। যত ক্ষণ না সেনা বাহিনী থেকে আমাদের ডাক পড়ছে, তত ক্ষণ আমরা এখানে থাকব, পড়াশোনা করব।’’ তবে ভয়ে গুটিয়ে গিয়েছিল সে। গবেষণা, মস্কোর জীবন, স্বেতলানার সঙ্গে সম্পর্ক— সব ছাপিয়ে কেবল বিড়বিড় করতেন, ‘‘যুদ্ধ, যুদ্ধ, আমরা যুদ্ধে আছি।’’
দু’বছর মিলিটারি ট্রেনিং চলল। জুনিয়র লেফটন্যান্ট হল লেভ, তিরিশ জনের একটা প্লাটুন সামলানোর দায়িত্ব পেল। তবে তার না ছিল আত্মবিশ্বাস, না ছিল যুদ্ধের দক্ষতা। শেষমেশ তার অধীনেই তৈরি হল আট জনের দল। কেউই তেমন দক্ষ নয়। সবাই ধরা পড়ল জার্মানদের কাছে। স্মোলেনস্ক শহরের কাছে এক ট্রানজ়িট ক্যাম্পে ঠাঁই হল। তার নাম ‘দুলাগ’। সেখান থেকে কাতিন শহরের বিশেষ কারাবাসে। মস্কোর বাছা বাছা ‘শিক্ষিত’, বেশির ভাগই সায়েন্টিস্ট এবং ইঞ্জিনিয়ার, বন্দি সেখানে। লেভকে গুপ্তচর করে মস্কোয় ফেরত পাঠাতে চেয়েছিল জার্মানরা। স্বদেশের কমরেডদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, তাই যায়নি লেভ। ফল, ফের স্থানান্তর। এ বার যুদ্ধবন্দিদের শিবিরে।
এই শিবিরগুলোরই পরিচিত নাম কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। অত্যাচার সহ্য করে শ্রম দিতে হয়। লেভ পালাল। ধরাও পড়ল। এ বার ঠিকানা হিটলার-জমানার কুখ্যাত সশ্রম কারাগারে— লিপজ়িগ-এর ‘স্টালাগ’। তার পর আর এক জেলের কোয়ারান্টাইন ব্যারাকে। ফের পালানো। সোভিয়েট-মার্কিন যৌথ বাহিনীর কল্যাণে এ বার মুক্ত হল লেভ। তত দিনে যুদ্ধে হেরে গিয়েছে জার্মানেরা।
দেশে ফিরতে চাইল লেভ। মার্কিন সেনার পক্ষ থেকে ভাল প্রস্তাব এল, নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্টকে নিজেদের দেশে নিয়ে যেতে চায় তারা। প্রত্যাখ্যান করল লেভ। ভালবাসার টানে সে ফিরতে চায় স্বদেশেই। তখনও স্বেতলানাকে জীবিত দেখতে পাওয়ার একটা ক্ষীণ আশা তার মনে।
তবে সমাপ্তি সুখের হল না। তখন সোভিয়েট বাহিনীর মধ্যে বাছাই চলছে। যারা জার্মান গুপ্তচর, তাদের শাস্তি হচ্ছে। শাস্তি হল লেভেরও! লেভ জার্মান বলতে পারত। ফলে বন্দিশিবিরে তাকে দিয়ে অনুবাদকের কাজ করাত জার্মানরা।
এই স্বদেশ অসহনীয়! মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে লেভকে দিয়ে সই করিয়ে নিল সোভিয়েট প্রশ্নকর্তারা। দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। এ বার ঠিকানা উত্তর মেরুর কাছে, পেচোরা-র গুলাগ-এ।
তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা
১৯৪৬। সকলেই যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছে। লেভ হয় হারিয়ে গিয়েছে, নয় মারা গিয়েছে। তার সঙ্গে কোনও দিন দেখা হবে, আশা করে না স্বেতলানা। মাসের পর মাস যায়। স্বেতলানা ঘুমোয় না, খায় না। প্রেমিকের থেকে শুধু একটি সঙ্কেতের অপেক্ষায় সেই মেয়ে। ‘ভাল আছি, ভাল থেকো’। তা হলেই বিধ্বস্ত এই স্বদেশে তার ছোট্ট পৃথিবীতে আলো জ্বলে উঠবে।
১২ জুলাই, ১৯৪৬। অবশেষে এল বহু-প্রতীক্ষিত সেই সঙ্কেত। স্বেতলানার কাছে নয় অবশ্য, লেভের মাসি ওলগার কাছে। স্বেতলানাকে নিয়ে তাতে তেমন কিছু ছিল না। শুধু সকলের কুশল সংবাদ নেওয়ার শেষে প্রশ্ন ছিল, ‘‘এস-এর পরিবার কেমন আছে? আমার কথা ওদের বোলো না। শুধু ওদের সম্পর্কে যা জানো, আমাকে লেখো।’’ ওলগা জানিয়েছিলেন, স্বেতলানা বেঁচে আছে, ভাল আছে। চিঠির খবরটা স্বেতলানাকে ফাঁস করে দিলেন তিনি।
সেই দিনই প্রথম চিঠি লিখল স্বেতলানা: ‘‘লেভি, সেই সেপ্টেম্বরের কথা মনে আছে? তুমি বলেছিলে, এ ভাবে দেখা করতে ভাল লাগে না। আমাদের গোটা একটা সপ্তাহ দেওয়া হয়েছিল। তাই আমি কৃতজ্ঞ ছিলাম। ব্যাপারটা এখনও একই রকম, লেভ। আমরা দু’জনেই ২৯ বছর। ১১ বছর আগে আমাদের দেখা হয়েছিল। একে অপরকে দেখিনি ৫ বছর। এই সংখ্যাটা বলতে কষ্ট হয়। কিন্তু সময় পেরিয়ে যায়, লেভ। এবং আমি জানি, আরও পাঁচটা বছর পেরিয়ে যাওয়ার আগেই যাতে আমাদের দেখা হয়, সে জন্য যা করার, তুমি করবে।’’
৮ অগস্ট। সন্ধে। ব্যারাকে কাজ করার সময় খামটা হাতে এল লেভের। হাতের লেখা তো চেনা। চিঠি খুলতেই বেরিয়ে পড়ল স্বেতলানার একটা ফটোগ্রাফ। চিঠিটা পড়তেই থাকল লেভ। সারা রাত ঘুম নেই। ভোর সাড়ে পাঁচটায় লিখতে বসল উত্তর। ৯ অগস্ট পেচোরা থেকে পাঠানো চিঠির বয়ান: ‘‘স্বেতলানা, স্বেত, তুমি কল্পনা করতে পারছ এখন আমার কেমন লাগছে? একে নাম দেওয়া যায় না। খুশি মাপাও যায় না। ৮ তারিখটা আমার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল (এই দেখো, আমি কেমন নিয়তিবাদী হয়ে গিয়েছি), এখন দেখছি আনন্দেরও বটে।... মনে হয়, ওই পাঁচ বছর কখনও আসেনি। যদিও আমাদের মাঝে দূরত্বটা ২১৭০ কিলোমিটার।... চিঠি, চিঠি এবং চিঠি ছাড়া আর কিছু পাঠিয়ো না।’’
গুলাগে চিঠি দেওয়া-নেওয়ার হাজার ঝামেলা। লেভের ইউনিটে মাসে একটা সেন্সর-করা চিঠি পেতে পারত বন্দিরা। অন্য জিনিস পাঠানোয় সমস্যা, তাই চিঠি ছাড়া লেভ চাইত কেবল কাগজ আর পেনসিল। তবে বন্দি তো। কীই বা লিখবে? এক দিন লিখে ফেলল, ‘‘নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে কী করে লিখতে হয়, আমি জানি না।’’ কিছু কোড ছিল। সোভিয়েট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ‘এমভিডি’-র অফিসাররা ‘আঙ্কল’ বা ‘রিলেটিভ’, গুলাগ ব্যবস্থা ‘আমব্রেলা’, ঘুষ হল ‘ভিটামিন ডি’।
গুলাগে বসে মস্কোর স্বপ্ন দেখত লেভ। স্বেতলানা লিখল: ‘‘তুমি যেমন কল্পনা করো, মস্কো আর সে রকম নেই।’’ চলছিল মনের কথা দেওয়া-নেওয়াও। মাঝে মাঝে বেশ দার্শনিক হয়ে উঠত স্বেতলানা। আবার লিখত, ‘‘আমায় ক্ষমা কোরো। বাড়িতে বসে তুচ্ছ সত্যি নিয়ে জ্ঞান, উপদেশ দিচ্ছি।’’ লেভ অবশ্য বেঁচে থাকত ওই চিঠিগুলোতেই। লিখল, ‘‘যখন খামের উপরে আমার নাম দেখি আর সেটা তোমার হাতে লেখা, প্রত্যেক বার একই অনুভূতি হয়। অবিশ্বাস, বিস্ময়, আনন্দ, নিশ্চিন্তি মেশানো এই অনুভব আগে টের পাইনি, জানো?’’
কথা বিনিময় চলতে থাকে স্মাগলারদের সাহায্যে। যে সব বন্দি ভাল কাজ দেখিয়ে ছাড়া পেয়ে গিয়েছে, সাহায্য করে তারাই। স্বেতলানা এ বার দেখা করতে চায়। বারণ করে লেভ। বলে, ‘‘স্বেতকা, এটা প্রায় অসম্ভব। ৫৮-১(বি) একটা ভয়ানক সংখ্যা।’’ ঠিকই। বন্দিদের সঙ্গে দেখা করা ছিল খুব কঠিন। আত্মীয় বা স্ত্রী হলে তা-ও মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। স্বেতলানা তার কোনওটাই নয়, শুধুই বন্ধু, সহপাঠী। তা হলে কোন সম্পর্কের ভিত্তিতে দেখা হবে? তবু কাজের ছুতোয় রওনা দেয় স্বেতলানা। লেভকে লেখে, ‘‘সঙ্গে টিকিট নেই, কিন্তু প্রচুর ভিটামিন ডি আছে।’’ ঘুষ দিয়ে ঠিকই দেখা হল। গার্ডরা জানল, স্বামীর বাড়িতে যাচ্ছে এক দর্শনার্থী। পরে অরল্যান্ডোর কাছে সেই মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করেছিল লেভ, ‘‘আমাদের অনুভূতিগুলো সামলে রাখতে হয়েছিল। পরিস্থিতি তো এমন ছিল না যে, আমরা একে-অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। আমরা যা করছিলাম তা ছিল আইনত নিষিদ্ধ।’’ স্বেতলানার মনে পড়ে, ‘‘ওরা আমাদের দু’টো চেয়ার এনে দিয়েছিল। একটা ফাঁকা ঘরে দু’জনে বসে রইলাম। ফাঁকা, কারণ, লেভের বন্ধুরা আমাদের জন্য লুকনোর অন্য জায়গা খুঁজতে গিয়েছিল।’’ অতঃপর বিচ্ছেদ। নিয়মেই। আবার মনখারাপ।
চলতে থাকে চিঠি চালাচালি আর দিন গোনা। স্বেতলানার জন্মদিনে লেখে লেভ— ‘‘প্রিয়তমা, তোমাকে শুভেচ্ছা জানানো আমার পক্ষে খুব কঠিন। আমি তোমার জন্য যা করতে চাই আর যা করতে পারি, তার মধ্যে অনেক ফারাক।’’ কখনও স্বেতলানার উত্তর আসতে দেরি হয়। ভয় পায় লেভ। কখনও আবার খবর পায়, স্বেতলানাকে পছন্দ হয়েছে অন্য কারও। আবার ভয়। স্বেতলানা ফের স্বপ্ন দেখে লেভকে নিয়ে। এ বার তার আক্ষেপ, ‘‘তোমায় রাতের স্বপ্নেও ছুঁয়ে দেখতে পারিনি।’’
স্টালিনের মৃত্যু
৫ মার্চ, ১৯৫৩। মারা গেলেন জোসেফ স্টালিন। সোভিয়েট ইউনিয়ন জুড়ে যেন একটা মস্ত আঘাত। তিরিশ বছর জুড়ে উথালপাথাল সমস্ত দিনে স্টালিনের ছায়াতেই বেঁচেছিলেন সোভিয়েটবাসী। তিনিই শিক্ষক, পথপ্রদর্শক, রক্ষাকর্তা, নেতা এবং অবশ্যম্ভাবী বিচারকর্তা— সকলের মতোই ভাবতেন লেভের মাসি ওলগাও। বিপদ এলে বলতেন, ‘‘স্টালিন আছেন।’’ দেশ জুড়ে, বিশেষত মস্কোয়, বিশৃঙ্খলা শুরু হয়েছিল। তার আঁচ পৌঁছেছিল পেচোরাতেও। তবে এ সময়েই ছাড়া পেয়েছিল কিছু রাজবন্দি। লেভের ভাগ্যে তখনও শিকে ছেঁড়েনি। তবু আশায় বুক বাঁধল সে-ও।
এক বছর চার মাস পর মুক্তি পেল লেভ। তবে তখন বাবা অসুস্থ বলে স্বেতলানা আছে স্যানেটোরিয়ামে। ছাড়া পাওয়া কয়েদির পোশাকেই সেখানে হাজির লেভ। স্বেতলানা অবশ্য তেমনটা চায়নি। মাসছয়েক আগে লিখেছিল, ‘‘আমাদের প্রথম দেখাটা অন্যদের সামনে হোক, আমি চাই না।’’ তবে সেটা এখন গৌণ। লেভ-স্বেতলানা এক সঙ্গে। এটাই সব। স্বেতলানার বাবা বললেন, তাঁর সেভিংস অ্যাকাউন্টে ৩০ হাজার রুবল আছে। তা দিয়ে একটা বাড়ি কিনে নিতে পারবে লেভ-স্বেতলানা।
বিবাহিত জীবন শুরু। স্বেতলানা ফিরল চাকরিতে, লেভ খুঁজতে লাগল কাজ। প্রাক্তন জেলবন্দিকে নিয়োগ করতে অনেকেরই অনীহা। মস্কো চিড়িয়াখানায় ইলেকট্রিশিয়ানের পদে আবেদন করল লেভ, চাকরি হল না। শেষে এক যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানায় ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি। বেতন, মাসে ৬০০ রুবল। ১৯৫৫ সালে কন্যা আনাস্তাশিয়া, ১৯৫৭-তে পুত্র নিকিতার জন্ম হল।
১৯৬২। আস্তে আস্তে জীবন সহজ স্বাভাবিক হল। লেভ বলেছিল, ‘‘এটাই স্বপ্নে দেখেছিলাম। আমার ডান দিকে স্বেতলানা, আর বাঁ দিকে আমার ছোট্ট মেয়ে।’’
শেষ কথা
লেভ-স্বেতলানার জীবনটা শেষ অবধি সুখেরই হয়েছিল। ২০০৮ সালের ১৮ জুলাই লেভ মারা
গেল, ২০১০-এর ২ জানুয়ারি স্বেতলানা। মস্কোর গলোভিনস্কয় সিমেট্রিতেও আজও ওরা দু’জন পাশাপাশি শুয়ে।
ও দিকে, ১৯৮০ সালে পুড়িয়ে দেওয়া হয় পেচোরা। লোহার প্রবেশদ্বার, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইটের চিমনি, কয়েকটা বাড়ি ছাড়া আস্ত কাঠের কলটা ভস্মীভূত হয়ে যায়। পরিত্যক্ত সেই পতিত জমি এখন বন্য কুকুরদের চারণভূমি।