ছবি: পিয়ালী বালা।
যে কোনও বোর্ড-গেমে প্রবঞ্চনার কথা ভাবতে গেলে প্রথমেই সেই মহাকাব্য-বর্ণিত পাশাখেলার কথা মনে পড়তে বাধ্য। যেখানে দুর্যোধনের প্রতিভূরূপে অক্ষপাতন করেছেন তাঁদের মাতুল সৌবল শকুনি। শকুনি যে কপটতার আশ্রয় নিয়েছেন, সে বিষয়ে তাঁর প্রতিপক্ষ যুধিষ্ঠিরের সংশয়মাত্র ছিল না। আসলে যে বোর্ড-গেমে অক্ষ বা ছক্কার সাহায্য নেওয়া হয়, সেখানে অক্ষের মধ্যে কারসাজি করে তাকে সুষমতা থেকে বিচ্যুত করে প্রবঞ্চনা করা যায় সহজেই। এ চেষ্টা বোধ করি হয়েছে সেই মহাকাব্যের যুগ থেকেই।
এই সব প্রবঞ্চনার পরিধি অবশ্য বিস্তৃত। ভূগোলের নিরিখেও, সময়ের প্রেক্ষাপটেও। যেমন, প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁড়াখুঁড়িতে বছর কয়েক আগে নরওয়েতে পাওয়া গিয়েছে ছয় শতকের পুরনো একটি কাঠের ছক্কা, যাতে রয়েছে দুটো ৫, দুটো ৪, একটি করে ৩ এবং ৬। কিন্তু নেই কোনও ১ কিংবা ২। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, খেলায় প্রতারণা করার জন্যই ব্যবহৃত হত এই বিশেষ ভাবে তৈরি ছক্কাটি। ছক্কা দিয়ে প্রতারণার অবশ্য আরও পদ্ধতি রয়েছে। যেমন, কোনও একটা দিকে ড্রিল করে ভারী কোনও ধাতু বা অন্য কিছু ঢুকিয়ে দিলে তার বিপরীত পিঠের উপর দিক করে মুখ করে পড়ার সম্ভাবনা যায়বেড়ে। মহাভারতের শকুনির অক্ষ এ রকম কিছু হতেও পারে।
ছক্কার সাহায্যে যে বোর্ড-গেমগুলি খেলা হয়, তাতে প্রতারণার প্রধান পদ্ধতি খুব সম্ভবত ওই ছক্কাটাকে নিয়েই জারিজুরি করা। কিন্তু ছক্কা ছাড়াও খেলা হয় অনেক বোর্ড-গেম, এবং তাতেও রয়েছে প্রবঞ্চনার চিত্তাকর্ষক ইতিহাস।
দুনিয়া জুড়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় বোর্ড-গেম নিঃসন্দেহে দাবা। সেই দাবার জগতেই ‘গেল গেল’ রব উঠেছিল ২০২২-এর শেষ দিকে। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেন অনলাইন দাবায় প্রতারণার অভিযোগ করেছিলেন উনিশ বছরের মার্কিন দাবাড়ু হ্যান্স নেম্যানের বিরুদ্ধে। সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে দাবায় প্রতারণার মহাকাব্যিক ইতিহাস এবং প্রতারণার পদ্ধতিগুলির ক্রমবিবর্তন নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা হয়তো প্রাসঙ্গিকহতে পারে।
ইতিহাসে-সাহিত্যে প্রতারণা
দাবা বা বোর্ড-গেমে প্রতারণা বা তার অভিযোগ যেন এক চিরায়ত ঘটনা। খেলাটা যত প্রাচীন, প্রতারণার ইতিহাস তার চেয়ে কিছু কম পুরনো নয়। একাদশ শতকে ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক এবং নরওয়ের রাজা ছিলেন কানুট। রাজা কানুট এক বার দাবা-জাতীয় একটি খেলা খেলছিলেন উল্ফ নামে ডেনমার্কের এক অভিজাত আর্লের সঙ্গে। তিনি আবার সম্পর্কে ছিলেন কানুটের ভগিনীপতি এবং সেই সঙ্গে তাঁর এক সামরিক সহযোগীও বটে। খেলার সময় রাজা একটি নিয়ম-বহির্ভূত চাল দেন। রেগে গিয়ে উল্ফ বোর্ড উল্টে দিয়ে চলে যান। এ নিয়ে কথা কাটাকাটির ফলশ্রুতিতে রাজা হত্যা করেন উল্ফ-কে। আইসল্যান্ডের কবি এবং সে সময়কালের কাহিনিকার স্নোরি স্টারলুসন-এর বর্ণনা এমনই। তবেই রাজাই যে কেবল খেলায় প্রতারণা করেন, এমনটা নয়। এর উল্টোটাও হয় বইকি। যেমন, দক্ষিণ ভারতে ষোড়শ শতকের রাজা কৃষ্ণদেবরায়ের সভাকবি, পরামর্শদাতা, এবং খানিকটা হয়তো বিদূষকও ছিলেন তেনালি রামা। রাজার সঙ্গে প্রায়ই দাবা খেলতেন রামা। কথিত আছে, এক বার খেলার মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়েন রাজা। আর রামা বারংবার বলতে থাকেন যে, তিনি জিতে গিয়েছেন। সভাসদরাও চিৎকার করতে থাকে সে ভাবে। ঘুম থেকে জেগে উঠে রাজা পরাজয় স্বীকার করলে তার পর বন্ধ হয় এই গোলযোগ।
শেক্সপিয়রের সমস্ত নাটকের মধ্যে দাবা খেলার উল্লেখ সম্ভবত একটি জায়গাতেই। মোটামুটি চারশো বছর আগে, ১৬১০-১১ সাল নাগাদ লেখা ‘দ্য টেম্পেস্ট’ নাটকের পঞ্চম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে। কী আশ্চর্য, সেখানেও মিরান্দা ‘মিথ্যা খেলা’র অভিযোগ করছে ফার্দিনান্দের বিরুদ্ধে।
তুর্কির যন্ত্র-দাবাড়ু
বাস্তবের নাটকীয় প্রতারণার এক গুরুত্বপূর্ণ, আকর্ষক এবং লম্বা অধ্যায় হল ‘মেকানিক্যাল টার্ক’ বা ‘দ্য টার্ক’। কম্পিউটার কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাবের বহু আগেই সে রকম বিভ্রম সৃষ্টি করেছিল এই দাবা খেলার যন্ত্রটি, যা অবাক করেছে অসংখ্য মানুষকে। ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং লেখক টম স্ট্যান্ডেজ-এর ২০০২ সালের বই ‘দ্য মেকানিক্যাল টার্ক’-এ চমৎকার বর্ণনা আছে যন্ত্রটির এবং তার সাহায্যে এক দীর্ঘমেয়াদি প্রতারণার ইতিবৃত্তের। যন্ত্রটির রূপকার উলফ্গ্যাং ভন কেম্পেলেন নামে এক হাঙ্গেরীয় লেখক এবং আবিষ্কারক। ১৭৭০ সালে এর রূপায়ণ। অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি-সহ এক বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্ঞী মারিয়া টেরেসাকে প্রভাবিত করতে। ১৮৫৪-তে আগুন লেগে ধ্বংস হয়ে যায় এটি। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো আবেশ সৃষ্টি করতে পারলেও এ ছিল প্রতারণার এক জবরদস্ত উদাহরণ।
দাবা বোর্ডের উল্টো দিকে বসে এক তুর্কি পোশাক-পরিহিত পুতুল-প্রতিপক্ষ দিত দাবার চাল। যন্ত্রটির ‘দ্য টার্ক’ নাম সে কারণেই। খেলা শুরুর আগে যন্ত্রটি খুলে দেখানো হত তার যন্ত্রাংশগুলি, বোঝানো হত যে তার মধ্যে কোনও মানুষ লুকিয়ে থাকার মতো পর্যাপ্ত পরিসর নেই। কিন্তু যন্ত্রটি তৈরি করা হয়েছিল এমন জটিল ভাবে যে, তার ভিতরে থাকতেন জলজ্যান্ত এক দক্ষ দাবা খেলোয়াড়, বাইরে থেকে যা বোঝা যেত না একেবারে। এই মানুষ-খেলোয়াড়ই খেলত খেলাটা। এবং এক জন দক্ষ খেলোয়াড় যন্ত্রটা চালাত বলে বেশির ভাগ খেলাতেই জিতে যেত ‘দ্য টার্ক’। ম্যাজিকের মতোই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এর যান্ত্রিক বিভ্রম। ইউরোপ এবং আমেরিকাতে সফর করেছে যন্ত্রটি, জিতেছে বেশির ভাগ খেলায়, হারিয়েছে নেপোলিয়ন কিংবা বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের মতো রাষ্ট্রনায়কদেরও। টার্ক-এর ম্যাজিক ছুঁয়ে গিয়েছে আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির জীবনকে— যেমন ক্যাথরিন দ্য গ্রেট, এডগার অ্যালান পো, এমনকি কম্পিউটারের জনক চার্লস ব্যাবেজ-কেও। ‘দ্য টার্ক’-কে নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখাও হয়েছে বিস্তর। বৃথা চেষ্টাও হয়েছে তার রহস্য উন্মোচনের।
মজার কথা হল যে, প্রতারকেরও আবার প্রতারণা রুখবার চেষ্টা থাকে। হয়তো বা একটু বেশিই থাকে। এই ‘প্রতারক’ যন্ত্রটির ক্ষেত্রেও ছিল। কোনও মানুষ প্রতিপক্ষ প্রতারণার চেষ্টা করলে ‘দ্য টার্ক’-এর তথাকথিত পুতুল খেলোয়াড়টি সংশ্লিষ্ট দাবার গুটিটিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেত তার আগের অবস্থানে। প্রতারণার চেষ্টা বার বার হলে, পুতুলটি তার হাত দিয়ে মাটিতে ছড়িয়ে দিত বোর্ডের গুটিগুলিকে। এবং বাস্তবে, ১৮০৯ সালে, স্বয়ং নেপোলিয়নও প্রতারণার চেষ্টা করেছিলেন এই যন্ত্রের সঙ্গে।
দেশপ্রেমে গড়াপেটা
মার্কিন দেশে দাবা খেলায় প্রতারণার অভিযোগ দানা বাঁধে ১৮৮০ সাল থেকে। সে সময়ে হচ্ছিল পঞ্চম আমেরিকান দাবা সম্মেলন। প্রতিযোগিতায় প্রেস্টন ওয়্যার এবং জেমস গ্র্যান্ডি নামের দুই দাবাড়ুর বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল যোগসাজশ এবং ঘুষের অভিযোগ। আসলে দাবা ব্যক্তিগত খেলা হলেও একই প্রতিযোগিতার বিভিন্ন খেলোয়াড়ের মধ্যে পারস্পরিক যোগসাজশ কিন্তু এ খেলায় প্রতারণার একটা ভীষণ পরিচিত রূপ। অনেক সময় একই দেশের খেলোয়াড়রা সতীর্থদের সাহায্য করার জন্য ইচ্ছে করেই কোনও গেম হেরে যান বা ড্র করেন। সেই ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় বড় বড় প্রতিযোগিতায় সোভিয়েট খেলোয়াড়রা নিজেদের মধ্যে প্রায়শই এমন যোগসাজশ করতেন বলে অভিযোগ উঠত। যেমন, ১৯৬২-র ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টে এমনই অভিযোগ করেন কিংবদন্তি মার্কিন দাবাড়ু ববি ফিশার— সোভিয়েট খেলোয়াড়রা নাকি সে প্রতিযোগিতায় যোগসাজশ করেই পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিটি ম্যাচ ড্র করেন।
বিচিত্র পারস্পরিক সন্দেহ
প্রতারণার অভিযোগ কতটা তিক্ত ও উদ্ভট হতে পারে— এমনকি সর্বোচ্চ পর্যায়েও— আনাতোলি কারপভ আর ভিক্টর কর্শনয়ের মধ্যে ফিলিপিন্সে অনুষ্ঠিত ১৯৭৮-এর দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। একে দাবার ইতিহাসের সবচেয়ে কুৎসিত সংঘর্ষ বললেও হয়তো অত্যুক্তি হবে না।
খেলার শুরুতেই কর্শনয়ের চেয়ার নিয়ে তৈরি হয় এক প্রস্ত তিক্ততা। কর্শনয় তাঁর ব্যক্তিগত চেয়ার আনলে কারপভের টিম অনুসন্ধানের অনুরোধ জানায়, চেয়ারের মধ্যে লুকিয়ে কোনও নিষিদ্ধ জিনিস আনা হয়েছে কি না পরীক্ষা করে দেখতে। চেয়ারটিকে ভেঙে ফেলে এক্স-রে করা হয়। কিছুই অবশ্য পাওয়া যায় না। কর্শনয় আবার কারপভের দলের এক জন সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে, তিনি ক্রমাগত তাঁর দিকে তাকিয়ে তাঁকে সম্মোহিত করার চেষ্টা করছেন। এমনকি খেলার সময় গাঢ় রঙের সানগ্লাস পরাও শুরু করলেন কর্শনয়। কারপভ আবার বললেন যে, আয়না থেকে আলো প্রতিফলিত হচ্ছে তাঁর চোখে। সে এক হ য ব র ল-জাতীয় কাণ্ড।
এখানেই শেষ নয়। একটা বেশ মজার এবং অদ্ভুত অভিযোগ আসে দ্বিতীয় গেমের ২৫তম চালের সময়। যাকে বলা যেতে পারে দাবার ইতিহাসের ‘ইয়োগার্ট অধ্যায়’। সে সময় কারপভের টিম তাঁকে একটি ব্লুবেরি ইয়োগার্ট পাঠায় খাওয়ার জন্য, কারপভ ইয়োগার্ট পাঠানোর কোনও অনুরোধ না করা সত্ত্বেও। কর্শনয়ের টিম এর প্রতিবাদ করে, বলে যে এটি হয়তো একটি বিশেষ-সঙ্কেত। স্ট্রবেরি হোক বা রাস্পবেরি কিংবা ব্লুবেরি, ইয়োগার্টের রংই হয়তো বিশেষ বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়ার পূর্বনির্ধারিত গোপন নির্দেশ। ব্লুবেরি হয়তো বা কারপভকে ড্র-এর প্রস্তাব দিতে বা আরও আক্রমণাত্মক ভাবে খেলার নির্দেশ দেওয়ার জন্যই পাঠানো হয়েছে। খেলা বন্ধ হয়, ডাকা হয় মধ্যস্থতাকারীদেরও। এবং প্রতিযোগিতার বাকি সময়ের জন্য কারপভকে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে একটি নির্দিষ্ট স্বাদের ইয়োগার্ট পাঠাবারই অনুমতি দেওয়া হয়। ভাবা যায়!
হারানো সহজ বিশ্বচ্যাম্পিয়নকেও
দাবার দুনিয়া অবশ্য চিরতরে বদলে যায় ঠিক পঁচিশ বছর আগে। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভ যখন ছ’টি গেমের লড়াইয়ে হেরে যান আইবিএম-এর সুপার কম্পিউটার ‘ডিপ ব্লু’-র কাছে। কাসপারভকে হারাতে ‘ডিপ ব্লু’ নাকি খেলেছিল ‘ঈশ্বর’-এর মতো। কিংবা হয়তো ভিনগ্রহের কোনও প্রাণীর মতো। সেই সঙ্গে যন্ত্রের ক্ষমতা যে মানুষের চাইতে বেশি, এমন এক গভীর, অস্থির, অস্বস্তিকর অনুভূতির উদ্ভব হল মানবসমাজে। যন্ত্র আর মানুষের দক্ষতার সেই ব্যবধান কিন্তু প্রশস্ত থেকে প্রশস্ততরই হতে থাকে সময়ের সঙ্গে। আর সেটাই তো ভবিতব্য!
দাবা খেলোয়াড়দের উৎকর্ষ মাপবার মাপকাঠি হল ‘এলো রেটিং’। আজ পর্যন্ত কোনও মানুষের সবচেয়ে বেশি এলো রেটিং-এর রেকর্ড হল ২,৮৮২, যা ম্যাগনাস কার্লসেন অর্জন করেছিলেন ২০১৪ সালে। ২,৮০০-র বেশি এলো রেটিং কিন্তু খুব সহজ বিষয় নয়। বিশ্বে আজ পর্যন্ত মাত্র ১৪ জন খেলোয়াড় তা অর্জন করতে পেরেছেন। ২,৮০০ প্লাস-এর তালিকায় একমাত্র ভারতীয় বিশ্বনাথন আনন্দ। এই প্রবন্ধ লেখার সময় ডি গুকেশের এলো রেটিং ২,৭৬৩ আর রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দের ২,৭৪৭।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের এক উন্নত দাবা খেলার কম্পিউটার ইঞ্জিন ‘স্টকফিশ’-এর ক্ষমতার বহরটা এক বার বোঝার চেষ্টা করা যাক। এই জুনে স্টকফিশের এলো রেটিং পৌঁছেছে ৩,৬৩৪-এ। বোঝাই যাচ্ছে, আজকের যুগের কম্পিউটার প্রোগ্রাম আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের থেকে কত যোজন এগিয়ে। মানুষ-দাবাড়ুকে তুড়ি মেরে সে হারাতে পারে যখন-তখন। আর অনলাইন দাবায়, স্টকফিশের মতো কম্পিউটার ইঞ্জিনের থেকে সাহায্য পাওয়াটা তো মাত্র একটা-দুটো ক্লিকেই সম্ভব। এমন একটা অ্যাপ, মোবাইল বা ল্যাপটপে ইনস্টল করে নিয়ে তার সাহায্যে আমি বা আপনিও তাই বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে হারাতে পারি নিশ্চিত ভাবে!
সন্দেহজনক দাবা-দক্ষতা
তবে দাবার দুনিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করে প্রতারণা যে ঠিক কবে শুরু হয়, বলা কঠিন। হয়তো আশির দশকের শেষ দিকে, বা হয়তো নব্বইয়ের দশকের কোনও সময়। তবে এ-সংক্রান্ত প্রথম প্রতারণার ঘটনাটা নজরে আসে ১৯৯৩-এর দাবা বিশ্বকাপে। সেখানে এক জন খেলোয়াড়ের পকেটে এমন একটি যন্ত্র পাওয়া যায়, যা নির্দিষ্ট সময়ে বেজে উঠছিল। সম্ভবত এটি কোনও সঙ্কেত, কিংবা সতর্কতা, অথবা কোনও বিশেষ নির্দেশ, যা ওই দাবাড়ুর খেলাকে আরও উন্নত এবং সুরক্ষিত করে তুলবে। সর্বসম্মত ভাবে বাতিল করা হয় সেই খেলোয়াড়কে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কৃত্রিম আবছায়ার ঢাকা পড়ে গিয়ে দাবার পূর্ণগ্রাস গ্রহণ-কালের সেই তো শুরু।
১৯৯৭ সালে ‘ডিপ ব্লু’-র কাছে কাসপারভের পরাজয় সমগ্র দাবা-বিশ্বের— হয়তো বা সারা পৃথিবীর কাছেই ছিল একটা বড়সড় ধাক্কা। ইতিমধ্যে এসে গিয়েছে ‘ফ্রিট্জ়’-এর মতো দাবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। তাই ১৯৯৮ সালে ববলিনজেন ওপেন দাবা প্রতিযোগিতায় ৫৫ বছর বয়সি জার্মান দাবাড়ু ক্লেমেন্স অলওয়ারম্যান যখন বেশ কিছু সেরা গ্র্যান্ডমাস্টারকে হারিয়ে বিজয়ী হন, তাঁর বিরুদ্ধে সহজেই অভিযোগ ওঠে অবৈধ ভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেওয়ার। লোকজন অনুসন্ধান করে দেখানোরও চেষ্টা করে যে, অলওয়ারম্যানের বেশির ভাগ চালের ধরন যেন ফ্রিট্জ়ের দেওয়া চালের সঙ্গে গভীর সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রশ্ন ওঠে, কোথাও কি সাহায্য নেওয়া হয়েছিল ফ্রিট্জ়-এর? যথেষ্ট গরমেও খেলার সময় পুরোদস্তুর স্যুট এবং টাই পরতেন অলওয়ারম্যান। এমন সন্দেহ দানা বাঁধে যে, কোনও ছোট ক্যামেরা বা ইয়ারপিস লুকোনো ছিল কি না তাঁর পোশাক বা লম্বা চুলের মধ্যে। তদন্তে অবশ্য ধরা পড়েনি কিছুই। তাতে কী, ওই সন্দেহ আর সংশয়ের কালো মেঘটুকুই যথেষ্ট ছিল বাভারিয়ান দাবা ফেডারেশনের কাছে, তাঁকে ভবিষ্যতের টুর্নামেন্ট থেকে নিষিদ্ধ করার জন্য। হ্যাঁ, দোষ প্রমাণ না হলেও অভিযুক্তর শাস্তি হয় বইকি।
চালকের আসনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
‘ডিপ ব্লু’-এর কাছে কাসপারভের হার ছিল মানুষের বুদ্ধিমত্তার উপর যন্ত্রের বিজয়কেতন ওড়ার ইঙ্গিত। সে এক সন্ধিক্ষণ। শুধু দাবার ক্ষেত্রেই নয়, দুনিয়ার মানসিকতার প্রেক্ষাপটেও। দাবায় যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে মানুষের খেলার মানের উৎকর্ষ বাড়ানোর এক অধ্যায়ের প্রথাগত সূচনাবিন্দুও বোধহয় সেটাই। ফলস্বরূপ বদলে যায় মানুষের খেলার স্টাইল। বদলে যায় প্রতারণার পদ্ধতিও। যেমন ধরা যাক, ২০০৬-এর দাবা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের কথা, যা অনুষ্ঠিত হয় ভেসেলিন টোপালভ এবং ভ্লাদিমির ক্রামনিকের মধ্যে। ম্যাচ চলাকালীন টোপালভ শিবির ক্রামনিকের ব্যবহৃত বাথরুমে একটি বৈদ্যুতিন যন্ত্র লাগানোর অভিযোগ তোলে। টোপালভের ম্যানেজার রাশিবিজ্ঞানের তত্ত্বের প্রয়োগ করে ক্রামনিকের খেলার বিভিন্ন দানের সঙ্গে ফ্রিট্জ়-৯ সফ্টওয়্যারের চালের মিল দেখানোর চেষ্টা করেন। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য সেই সব চার্ট বা তা তৈরির পদ্ধতির মধ্যে অনেক গলদ খুঁজে পেয়েছেন।
আসল কথা হল, দাবায় প্রতারণা কিংবা তার অভিযোগের ধরনধারণ বদলে গিয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দখল নিয়েছে খেলাটার, তাতে প্রতারণার প্রকরণের, এমনকি সে সংক্রান্ত অভিযোগেরও।
কোভিড-উত্তর অনলাইন সমস্যা
পরবর্তী কালে দাবার জগতে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং কম্পিউটার প্রোগ্রামের সাহায্য নিয়ে প্রবঞ্চনার অভিযোগ গাঢ়তর হয়েছে। তবু তা চলছিল একটা ছন্দে। কারণ আগে অনলাইন দাবা বিশেষ গুরুত্বের কিছু ছিল না। পরিস্থিতিতে নাটকীয় বদল এনে দিল কোভিড-১৯ অতিমারি এবং সেই পথ বেয়ে আসা ‘নতুন স্বাভাবিকতা’। আজ দুনিয়া জুড়ে অনলাইনে হচ্ছে বিভিন্ন বড় প্রতিযোগিতা, খেলোয়াড়রা দূরবর্তী স্থানে বসে খেলছেন কম্পিউটারের সাহায্যে। খেলছেন শীর্ষস্থানীয় খেলোয়াড়রাও। রয়েছে মোটা পুরস্কার-অর্থও।
অনলাইন দাবার বিখ্যাত সংস্থা ‘চেস-ডট-কম’ ইতিমধ্যেই প্রতারণার শাস্তি হিসেবে অ্যাকাউন্টবন্ধ করে দিয়েছে বেশ কয়েক লক্ষ খেলোয়াড়ের, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন কয়েকশো ‘ফিডে’ খেতাবপ্রাপ্ত খেলোয়াড়ও।
তবু অনলাইন প্রতারণার বিরুদ্ধে লড়াই কিন্তু সহজ নয় একেবারেই। কম্পিউটার সফ্টওয়্যারের সাহায্য নিয়ে প্রতারণা করা হয়েছে কি না তা শনাক্ত করা কতটা সম্ভব? আসলে তথ্যভান্ডারে দীর্ঘ দিন ধরে সংরক্ষিত মানুষ খেলোয়াড়দের লক্ষ-লক্ষ দাবার চালগুলির ইতিবৃত্ত ব্যবহার করে তৈরি করা হয় একটি উপযুক্ত এবং ক্ষমতাসম্পন্ন রাশিবিজ্ঞানের মডেল। সেই মডেলের সাহায্যে কম্পিউটার ইঞ্জিনের দেওয়া চালের সঙ্গে এক জন খেলোয়াড়ের দেওয়া চাল মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা বার করা হয় অঙ্ক কষে। এর ভিত্তিতেই অনুমান করা হয়, প্রতারণা হয়ে থাকার আশঙ্কা কতটা। আসলে কম্পিউটার প্রোগ্রামগুলি যে কেবল অনেকটা বেশি ভাল খেলে তা-ই নয়, তারা খেলেও একেবারে ভিন্ন ভাবে। সে যেন ভিনগ্রহের কোনও প্রাণীর খেলা। তাই সেই সব চালের সঙ্গে কোনও মানুষ খেলোয়াড়ের চালের ‘সম্পর্ক-সূচক’ যত বেশি হবে, ততই প্রতারণার সম্ভাবনার পাল্লা ভারী বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু এটাও মাথায় রাখতে হবে, এই ধরনের রাশিবিজ্ঞান-ভিত্তিক প্রমাণ কিন্তু একশো শতাংশ নিশ্চিত নয়। এ কেবল সম্ভাব্য প্রতারণার এক ইঙ্গিত মাত্র।
অস্ট্রেলিয়ান দাবাড়ু এবং ফিডে-মাস্টার বিল জর্ডান-এর ২০২১ সালে প্রকাশিত বই ‘দ্য আর্ট অব চিটিং ইন চেস: দ্য মেনি ফেসেস অব চিটিং’ সবিস্তারে বর্ণনা দিয়েছে দাবায় প্রতারণার ইতিহাসের। জর্ডানের বর্ণনায় প্রতারণাও যেন এক শিল্প। যদিও সাম্প্রতিক অতীতের কম্পিউটার এবং অনলাইন প্রতারণা কেবল শিল্প হয়ে থাকেনি, সেই সঙ্গে অনেকটাই হয়েছে প্রযুক্তির প্রয়োগ। কোভিড অতিমারির সময় খেলাটির জনপ্রিয়তা যেমন বেড়েছে, জোয়ার এসেছে অনলাইন খেলায়, সেই সঙ্গে প্রতারণার ক্ষেত্রেও এসেছে এক অতিমারি।
সর্বত্রই পিছু হঠছে মানুষ
তবে শুধু দাবা-ই নয়, অন্যান্য বোর্ড-গেমের ক্ষেত্রেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ডানা মেলেছে ইতিমধ্যে। যেমন জাপানের জনপ্রিয় খেলা ‘শোগি’, যা জাপানি দাবা নামেও পরিচিত। দাবায় যেমন আট-গুণ-আট অর্থাৎ ৬৪টি ঘর থাকে, ‘শোগি’র ক্ষেত্রে ঘর-সংখ্যা নয়-গুণ-নয় অর্থাৎ ৮১। ফলে খেলাটা কিন্তু জটিল হয়ে যায় অনেকটাই। দাবায় সম্ভাব্য চালের সংখ্যা সুবিশাল, ১-এর পরে ১২০টি শূন্য দিলে, যা হয় তা-ই। ‘শোগি’র ক্ষেত্রে সম্ভাব্য চালের সংখ্যা ১-এর পরে ২২০টি শূন্য। ও দিকে কোরিয়ায় জনপ্রিয় বোর্ড-গেম হল ‘গো’, যাতে আবার ঘরের সংখ্যা উনিশ-গুণ-উনিশ অর্থাৎ ৩৬১টি। স্পষ্টতই এটি আরও জটিল, এর ক্ষেত্রে সম্ভাব্য চাল-সংখ্যা ১-এর পরে ৩৬০টি শূন্য। দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে ১৯৯৭-তে হারিয়ে দিলেও, ‘শোগি’র এক জন সক্রিয় পেশাদার খেলোয়াড়কে কম্পিউটার কিন্তু প্রথম হারাতে পারল ২০১৩-তে। আর ‘গো’ খেলার জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি গুগলের ‘আলফাগো’ নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশ্বের শীর্ষ ‘গো’-খেলোয়াড় লি সেদল-কে পরাজিত করল ২০১৬-তে। সেও এক যুগান্ত-বিন্দু— মানুষের দুনিয়ায় যন্ত্রের দখলদারির ক্ষেত্রে। আজ তাই সমস্ত প্রধান বোর্ড গেমগুলিতেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত। এবং প্রবঞ্চনা যে শুধুমাত্র চৌষট্টি ঘরেই হবে, এমন কোনও কথা নিশ্চয়ই নেই। একাশি ঘরের খেলাও প্রবঞ্চনার অভিযোগে টলমল করে ওঠে। হ্যাঁ, ‘শোগি’র দুনিয়ায় ঝড় আসে ২০১৬ সালে। প্রতারণার অভিযোগে শীর্ষস্থানীয় খেলোয়াড় হিরোয়ুকি মিউরার-কে বরখাস্ত করা হয়। জাপানের ‘শোগি’ এবং ‘গো’ উভয় সংস্থাই প্রতারণা রোধ করতে ম্যাচের সময় তাদের খেলোয়াড়দের বৈদ্যুতিন যন্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। দাবার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘ফিডে’ অবশ্য ২০১৪-তেই এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হল, দূর থেকে খেলা হওয়ায় অনলাইন দাবায় এ সবের পূর্ণ তদারকি করা প্রায় অসম্ভব। সব নিষেধাজ্ঞার বেড়ি তাই ভেঙে যায় সহজেই।
প্রমাণ নেই, তবু শাস্তি
দাবায় প্রতারণার অভিযোগ নিয়ে সম্প্রতি উত্তাল হয়েছে দুনিয়া। শুধুমাত্র দাবা-বিশ্ব নয়, সুশীল সমাজও। ওই যে, দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নরওয়ের খেলোয়াড় ম্যাগনাস কার্লসেন ২০২২-এর সিনকুফিল্ড কাপ প্রতিযোগিতায় উনিশ বছরের মার্কিন গ্র্যান্ডমাস্টার হ্যান্স নেম্যানের উপর অনলাইন দাবায় প্রতারণার অভিযোগ করে বসলেন। এমনকি খেলতেও অস্বীকার করলেন তরুণ নেম্যানের সঙ্গে। কার্লসেন মনে করেছেন, অনলাইনে প্রতারণার জোয়ার এই প্রাচীন খেলাটিকে অস্তিত্বের সঙ্কটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
ম্যাগনাস কার্লসেনের অভিযোগের ভিত্তিতে ৭২ পৃষ্ঠার এক তদন্ত-রিপোর্টও বার করে ‘চেস-ডট-কম’। নেম্যানের ক্রীড়াজীবন এবং বিভিন্ন খেলার পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ করে বলা হল, নেম্যান হয়তো অনলাইন দাবায় প্রতারণা করেছেন ১০০ বারেরও বেশি। মজার কথা হল, প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, এমন কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যা প্রমাণ করে যে হ্যান্স নেম্যান প্রতারণা করেছিলেন ম্যাগনাস কার্লসেনের সঙ্গে খেলায়। এটাও ঠিক যে, এমন কোনও স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া প্রায়-অসম্ভবই। তরুণ নেম্যানের দাবা-জীবন প্রায় ধ্বংসের মুখে উপস্থিত হয়। সে সময় ১০০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ দাবি করে নেম্যান মোকদ্দমা করেন চেস-ডট-কম আর ম্যাগনাস কার্লসেনের বিরুদ্ধে। তাঁরা অবশ্য মামলাটা মিটিয়ে নিয়েছেন আদালতের বাইরে, এবং স্বীকার করেছেন যে, নেম্যানের অসৎ ভাবে খেলার কোনও নিশ্চিত প্রমাণ নেই। বিশ্ব-দাবার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘ফিডে’ও কার্লসনকে দশ হাজার ইউরো জরিমানা করেছে উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া ২০২২-এর সিনকুফিল্ড কাপ থেকে নাম তুলে নেওয়ার জন্য। তবু সব মিলিয়ে নেম্যানের পেশাদার জীবনে যে বড়সড় ক্ষতি হয়ে গিয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ কম। এখন নেম্যান খারাপ খেললে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা সেটাকে প্রমাণ হিসেবে দর্শান যে তিনি এক জন প্রতারক; আর যদি তিনি দুর্দান্ত খেলেন, তবে তা তাঁদের সন্দেহ জাগিয়ে তোলে যে, তিনি কোনও ভাবে নির্ভর করছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপর! বেশির ভাগ ভাল টুর্নামেন্টেই কার্যত কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তাঁকে। মনে রাখতে হবে, তাঁর বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন ম্যাগনাস কার্লসেনের মতো দিকপাল খেলোয়াড়, এবং তার অভিঘাত তো কম হতে পারে না। আর ক্লেমেন্স অলওয়ারম্যানের ২৪ বছরের পুরনো ঘটনাটা তো আমাদের জানা।
অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই
দাবার দুনিয়ায় প্রতারণা বা তা নিয়ে ধ্যানধারণার বিবর্তনটা কিন্তু বেশ আকর্ষক। ‘দ্য টার্ক’-এর সময় মানুষের সাহায্য নিয়ে যন্ত্রের ম্যাজিক দেখানো হয়েছে। ১৯৯৭-তে কাসপারভের সঙ্গে ঐতিহাসিক খেলায় ‘ডিপ ব্লু’ দ্বিতীয় গেমের সব চেয়ে বিতর্কিত দানটি দেওয়ার পর কাসপারভ আইবিএম-এর দলের উপর প্রতারণার অভিযোগ তোলেন। অর্থাৎ প্রকারান্তরে কাসপারভ বিশ্বাস করছিলেন যে, আইবিএম-এর দলের মানুষরাই যন্ত্রকে সাহায্য করে জিতিয়ে দিয়েছে। ‘ডিপ ব্লু’-র যে চালকে কাসপারভ বিশ্বাস করেছেন ‘মানুষের মতো’ বলে, ব্রিটিশ গ্র্যান্ডমাস্টার জন নান আবার তাকে ‘অত্যাশ্চর্য’ এবং ‘অসাধারণ’ বলে বর্ণনা করেছেন। আসলে সে ছিল এক সন্ধিক্ষণ। যন্ত্র আর মানুষের ক্ষমতার ভারসাম্যের ক্ষেত্রে সভ্যতার ইতিহাসের এক পরিবর্তন-বিন্দু। মজার কথা হল, আজ হান্স নেম্যানের মতো খেলোয়াড়দের উপর অভিযোগ ওঠে যন্ত্রের কাছ থেকে সাহায্য নেওয়ার। তাই যন্ত্রের আধিপত্য আজ সুপ্রতিষ্ঠিত।
যাই হোক, দাবায় এই প্রতারণার অভিযোগ এবং তা নিয়ে চলতে থাকা চাপান-উতোর দেড় হাজার বছরের পুরনো খেলাটির ভবিষ্যৎকে এক গভীর খাদের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। আজকের প্রযুক্তির যুগে হাজারো চোখের সামনে খেলায় প্রতারণা করা ভীষণ কঠিন। কিন্তু অনলাইন দাবার গতিসূত্র একেবারে ভিন্ন। এবং আরও অনেক কিছুর মতো কোভিড-উত্তর দুনিয়াতে অনলাইন দাবা ‘নতুন স্বাভাবিকতা’-র এক অঙ্গ, যেখান থেকে পুনর্মূষিক হওয়া এক রকম অসম্ভব। তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি এবং সংশ্লিষ্ট মহলকেই বার করতে হবে নতুন ধরনের প্রতারণা রুখবার কৌশল।
খেলা তাই চলতেই থাকে। এও যেন এক অস্তিত্বের লড়াই। এই ভিন্নতর ‘সেভেন্থ সিল’-এ দাবা খেলা নিজেই যেন অ্যান্টনিয়াস ব্লক, তার গুটির রং সাদা আর তার বিপক্ষে কালো গুটি নিয়ে আক্রমণ সাজিয়েছে প্রতারণা। যত ক্ষণ দাবা জিতছে, তত ক্ষণই তার অস্তিত্ব। সপ্তম সিলমোহর উন্মোচন এবং তার পরবর্তী সেই স্বর্গীয় নীরবতা আর কত দূর, সে কথা কারও জানা নেই।