Coronavirus in West Bengal

আকারে কী যায় আসে!

প্রতিষেধক বড়জোর ওদের শরীরটুকু বাঁচাতে পারে। তার বেশি নয়। কারণ, ওদের ভেদবুদ্ধি প্রবল। তবু বলবে, সবার উপরে মানুষ সত্য! করোনাভাইরাসের আত্মকথা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৭:০৩
Share:

প্রতীকী ছবি।

আপদ! কী আপদ! মহা-আপদ! অণুবীক্ষণীতে আমাদের বেশ একটা ফুলেল অবয়ব ধরা পড়লেও এই তিন ধিক্কার আমাদের শুনতে হচ্ছে অহরহ। এতে আমাদের প্রতি মানুষের বিরাগ আর বিদ্রুপ ধরা পড়ছে একাধারে। ধরা পড়ছে ওদের ত্রাস আর আমাদের প্রকৃত প্রকৃতি অনুধাবনের অক্ষমতা। ঠিক কিসের জোরে আমরা এতটা ভীতিপ্রদ? প্রাণের অণোরনীয়ান বিকাশ হয়েও আমরা প্রাণেরই মহতোমহীয়ান প্রকাশ যে-মনুষ্যকুল, তাদের গলা টিপে ধরছি বলে? কিন্তু মনুষ্যকণ্ঠ নিষ্পেষণের স্পর্ধা আমাদের হল কী করে? ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’, যোগ্যতমের উদ্বর্তনের যে পিরামিড, তার শিখরাসীন মানুষের প্রাতিস্বিক বা সামষ্টিক রোধশক্তির হলটা কী?

Advertisement

তারও আগে প্রশ্ন থাকে। আমরা কি স্বয়ম্ভু? নিসর্গপ্রকৃতির কালাপাহাড় জাতক? না কি মহাকাশপ্রেরিত ধূলিবাহন ঘাতক? ওরা নাম একটা দিয়েছে আমাদের। করোনাভাইরাস। কিন্তু ওদের কোনও কৌশলই আমাদের উৎস ও অস্তিত্বের রহস্যব্যূহ ভেদ করতে পারছে না। ওদের আর্ত অনুসন্ধিৎসায় শুধু এটুকুই নিশ্চিত যে, যা ছিল না ভারতে, যা ছিল না মহাভারতে, তেমনই এক অতিবিচিত্র প্রাণবস্তু সদর্পে উপস্থিত। এবং প্রাণকণা হয়েও মানসপ্রকৃতিতে তারা প্রাণঘাতী। তাদের বেলাগাম বিশ্বাশ্বমেধ আপাতত অপ্রতিহত।

কোথায় ছিলাম আমরা? প্যানডোরার বাক্সে? প্রমাণ নেই। অয়দিপাউস যে মহামারি থেকে থিবস নগরীকে রক্ষা করে সেখানকার নৃপতি হয়ে উঠেছিলেন, তার পিছনে ছিল কি আমাদেরই কারসাজি? স্ফিংকসের ধাঁধা বা অয়দিপাউসের মীমাংসায় তার কোনও ইঙ্গিত নেই। যুধিষ্ঠিরকে ধর্মবক যে প্রশ্নমালা দিয়েছিলেন, মানুষের এই বিচিত্র বিষ-বিপদের ইতিবৃত্ত ঠাঁই পায়নি তাতেও।

Advertisement

ভারতীয় পুরাণকথার ইঙ্গিত, মন্থনের উদগ্র বাতিকে সমুদ্রকে না ঘাঁটালে হলাহল সাগরতলেই থেকে যেত চিরকাল। স্থলবিশ্বকে বিষিয়ে উঠতে হত না কোনও দিন। মন্থনে ওঠা অমৃত নিয়ে দেব-অসুরে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। অথচ কালকূটকে ঠাঁই দেওয়ার বেলায় পিঠটান দিল সুরাসুর সকলেই। পুরাণের সাক্ষ্য, শ্মশানে-মশানে ঘুরে বেড়ানো আপনভোলা, বাঘছালের কৌপীন-সম্বল এক মহাযোগী সেই কালকূট কণ্ঠে ধারণ করে সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে দিলেন। নীলকণ্ঠ হওয়ার মতো কেউ নেই, বিশ্বভারত কি এখন এতটাই শিবহীন?

কবি যতই আকাশভরা সূর্য-তারার গুণগান করুন, আধুনিক বিজ্ঞান জানে, মহাকাশ থেকে অমলিন আলোই শুধু ঝরে না। সেখানে রাজত্ব সংখ্যাতীত কৃষ্ণগহ্বরেরও। সেখানে নিত্য সংঘর্ষ বিচিত্র পদার্থপুঞ্জের। সেই ঘর্ষণজাত ধূলিকণা নিরন্তর মিশে চলেছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আবহমণ্ডলে। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আজব সব জীবাণু তার সঙ্গে মহীতলে অবতীর্ণ হচ্ছে অহরহ এবং তাদের সকলে এই জীববিশ্বের সুহৃদ, এমন মনে করার কোনও কারণই দেখছে না বিজ্ঞান। তা হলে কি আমরা সেই মহাজাগতিক জীবকণার কালকূট-অবতার? আমরা জানি না। কিন্তু বিজ্ঞান তা জানবে না কেন? জানাবে না কেন? যুক্তির জবাব, জানতে পারছে না বলেই জানাতে পারছে না। সে-ক্ষেত্রে প্রশ্ন, তা হলে মানুষের যোগ্যতমত্বের আস্ফালন কেন?

বিজ্ঞান যেখানে অন্ধ গলিতে থমকে যায়, তার থেকে আরও একটু এগিয়ে যান কবি। ‘রোগশয্যা’র কবি জগতের মাঝখানে যুগে যুগে জমা হতে থাকা যে ‘সুতীব্র অক্ষমা’‌কে চিনিয়েছিলেন, আমরা কি তা-ই? আমাদের বিশ্ব-অভিযান কি সেই পুঞ্জীভূত অক্ষমারই বিস্ফোরণ? মানুষের তথাকথিত ইতিহাসের অসঙ্গতিই আমাদের মাতৃজঠর? মনুষ্যকুল জীববিশ্বে শ্রেষ্ঠত্বের যে অসার দম্ভে মটমট করে, আমরা কি তারই বিপরীত প্রতিক্রিয়া?

উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম, মানুষের প্রজ্ঞা-অহমিকা কত ফঙ্গবেনে! দেখলাম, ‘তৎ+ত্বম+অসি’, ‘সোহম’ থেকে শুরু করে ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’, ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’র মতো উচ্চারণ কত অসার! সর্বভূতে সেই শক্তির প্রকাশের কথা বলা হলেও মানুষের জীবনাচরণে তার অনুশীলন কই? বাস্তবে তো শুধুই জীবহত্যা, কেবলই বৃক্ষনিপাত! দেখলাম, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ যত শ্রুতিসুন্দর, তত সত্যসুন্দর নয়। এটা নিতান্তই কাব্যিক, আলঙ্কারিক এবং অবশ্যই মানবিক অতিশয়োক্তি। যেমন ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’ অত্যন্ত অর্বাচীন বাহ্বাস্ফোট, তাতে আপন কৌমের প্রতি অপ্রশ্ন আস্থা ও আনুগত্য যতই থাকুক, সর্বভূতে সমদর্শিতা নেই। নেপোলিয়ান হোক বা আলেকজান্ডার, তৈমুর লং হোক বা চেঙ্গিজ় খাঁ— মানুষের বীরত্ব কত দূর পর্যন্ত? নিজ কৌমের রক্তে যদি বীরত্ব অর্জন করতে হয়, সেই বীরত্বে কী কাজ— আমাদের মস্তকহীন মস্তিষ্কে তা ঢোকে না। জাতি বলা হোক বা প্রজাতি, মানুষের থেকে আমরা এখানেই শ্রেয় যে, আমরা আমাদের কৌমের কারও গলা টিপে ধরি না, স্বজাতীয় কারও সর্বনাশের সুযোগ অন্বেষণ করি না।

অবজ্ঞাতের ইতিহাস অলিখিত। তাই আমাদের এই ঐতিহাসিক আগ্রাসন— এ ভাবে দেখলেও যোগ্যতমের উদ্বর্তন তত্ত্বের ফাঁকফোকর স্পষ্ট হয়ে যায়। আমাদের বিশ্ব-অভিযান আসলে ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’-কে ভেংচি। মানুষের যোগ্যতমত্বের দর্প নিয়ে রগড়! মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মূর্খ দম্ভ নিরাকরণে ক্ষুদ্রত্বের অহঙ্কারই আমাদের বাহন। যোগ্যতমতা বহুলাংশে পরজীবিতাই।

তবু সেই নেপথ্যশক্তির স্বীকৃতি বা তার প্রতি কোনও রকম কৃতজ্ঞতা নেই মানুষের ইতিহাসে। বরং দেখছি, ওদের শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষুধা এমন এক সর্বগ্রাসী ভেদবুদ্ধির আশ্রয় নিয়েছে, যা সমূলে আত্মধ্বংসী। ধর্মভেদবুদ্ধি, বর্ণভেদবুদ্ধি, সীমান্তভেদবুদ্ধির পূর্ণগ্রাস তো চলছেই। সর্বোপরি মানুষের সৃষ্টিমেধার সর্বোৎকৃষ্ট কীর্তি যে-ঈশ্বর, মানুষেরই ভেদবুদ্ধির দুষ্ট সরস্বতী ভাগ করে ফেলেছে তাঁকেও! যে আস্তিক্য বিশ্বাসের সর্বোত্তম জাতক অহিংসা, ইতিহাসের কী পরিহাস, এই তো সে দিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বৌদ্ধ অহিংসার সঙ্গে খ্রিস্টান অহিংসার লড়াইয়ে বিশ্ব জুড়ে রক্তগঙ্গা বয়ে গেল। ঈশ্বরকে শিখণ্ডী করে ধর্মে-ধর্মে লড়াইয়েই কি তবে শেষ হবে মানুষের ইতিহাস? যে স্বার্থান্ধ সীমান্তভেদবুদ্ধি যুদ্ধজিগিরে নিত্য অক্সিজেন জোগায়, সে-ই তো অস্ত্রভান্ডারে জাতির অধিকাংশ অর্থ, সময় ও বিদ্যাবত্তা অপচয় করতে প্ররোচনা দেয়। উপেক্ষিত থেকে যায় শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য। উপেক্ষার অন্ধকারে থেকে যায় সেই কৃষকসমাজ, স্মরণাতীত কাল থেকে যারা অন্নবস্ত্র জুগিয়ে খাড়া রেখেছে মনুষ্যকুলকে। সীমান্তরেখার তোয়াক্কা না করে বিশ্বের দখল নিয়ে করোনা তো দেখিয়ে দিয়েছে, সীমান্তচেতনা কোনও সর্বনাশকেই ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। দেখিয়ে দিয়েছে, সভ্যতা ততটাই এগিয়েছে, স্বার্থপরতার বুলেট যত দূর যায়।

জানি, অতিমারিতার নিরিখেও মানুষের ব্যষ্টিগত ও সমষ্টিগত যুদ্ধপ্রবণতার কাছে আমাদের পরাক্রম অকিঞ্চিৎকর। জানি, ইতিহাস নবতর পথে চললেও মনুষ্যপ্রকৃতির প্রকৃত পরিবর্তন হয়তো করোনার কাজ নয়। মানুষ কি জানে, হেমলক গুল্মের বিষে অরণ্যপ্রকৃতি ধ্বংস হয় না। সাপের বিষে মরে না সাপ। কিন্তু মানুষের বিষ ঝাড়েবংশে নিঃশেষ করে দেয় মানুষকেই। জানে কি মানুষ? আমরা আছি। সময়ের আগে থেকেই। কে জানে, সময়ের পরে থাকব কি না! আমরা চক্ষুহীন দৃষ্টিতে দিব্য দেখতে পাচ্ছি, পরিবর্তন আসছে। মনুষ্যপুঙ্গবদের ধূসরপদার্থের এতই গুণকীর্তন শুনেছি যে, বিলক্ষণ জানি, বিষম ভীতির মধ্যেও তারা আমাদের জীর্ণ করে ফেলবে অচিরাৎ। শুধু অমৃত বা বিষ নয়, সমুদ্রমন্থনে উঠেছিলেন ধন্বন্তরিও। জানি, বিজ্ঞানসমুদ্র মন্থনে এ-যুগের ধন্বন্তরির উত্থান সময়ের প্রতীক্ষা মাত্র। তাঁর আবির্ভাব-মঞ্চ প্রস্তুত করে যে জাগরণী আঘাত আমরা হেনেছি, অন্য ইতিহাসের উপক্রমণিকা রচনায় আমাদের সেই অবদান পরজীবী মনুষ্যকুল কবুল করবে কি?

ছবি: রৌদ্র মিত্র

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement