নিদর্শন: এ জানউইৎজ়ার এবং এ এম এশাভয়-এর নামাঙ্কিত দেশলাইয়ের লেবেল। ডান দিকে, বাংলার সালকিয়ায় তৈরি দেশলাই ।
ইতিহাসবিদের দৃষ্টি প্রায়শই এক ধরনের গুরুত্ব সন্ধানে আচ্ছন্ন। লঘু বস্তু সে দৃষ্টিকে বিশেষ আকর্ষণ করে না। তাই যুগ বদলের ইতিহাস প্রায় সব সময়ই হয়ে ওঠে মনীষীদের জীবনবৃত্তান্ত, রাজনৈতিক ঘটনার বিবরণ, রাষ্ট্রনৈতিক পালাবদল কিংবা দার্শনিক চিন্তার আখ্যান। উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের ইতিহাসের কথাই ধরুন না। এ বিষয়ে যে সমস্ত আলোচনা কানে আসে, তার পনেরো আনাই তো হয় রাজা রামমোহন বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মনীষীদের জীবনকথা, নয়তো জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উৎস সন্ধান আর তা না হলে যুক্তিবাদী, বৈজ্ঞানিক মানসিকতার উদয়ের গাথা। এতে সাধারণ মানুষের রোজকার জীবনযাপনের বিশেষ ইঙ্গিত পাওয়া যায় না।
অথচ উনিশ শতকে লেখা জীবনী সাহিত্য পাঠ করলে কিন্তু চোখে পড়ে যুগ পরিবর্তনের ভিন্ন একটি মাত্রা। সেখানে জীবনীকারের দৃষ্টি তাঁর দৈনন্দিন জীবনের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া টুকিটাকি নানা নতুন জিনিসের ঝড়ের উপর। তাঁরা ‘সেকাল’ এবং ‘একাল’ এর সীমানা নির্ধারণ করতে গিয়ে বার বার ফিরে গিয়েছেন নিত্যব্যবহার্য জিনিসের নতুনত্বের প্রসঙ্গে। যেমন ধরা যাক, সে যুগের এক জন দারোগা, গিরিশচন্দ্র বসু, তাঁর জীবদ্দশায় দেখা যুগ পরিবর্তনের সাক্ষ্য দিতে গিয়ে লিখেছেন যে, দু’টি জিনিস উনিশ শতকের বাঙালির জীবনে সব চেয়ে বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছিল— ছাপা বাংলা পঞ্জিকা ও দেশলাই কাঠি।
এই নগণ্য দেশলাই কাঠিকে ঐতিহাসিক বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত করেছেন সেই সময়কার আরও অনেকেই। নাট্যকার অমৃতলাল বসু, রহস্য রোমাঞ্চ লেখক দীনেন্দ্রকুমার রায়, দার্শনিক ও স্বামী বিবেকানন্দের সহোদর মহেন্দ্রনাথ দত্ত, এঁরা সকলেই উনিশ শতকের জীবন-বিপ্লবের সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে যুক্ত করেছেন ক্ষুদ্র দেশলাই কাঠিকে।
একটু ভেবে দেখলেই এই যোগের সার্থকতা স্বতঃসিদ্ধ হয়ে পড়ে। দেশলাই আসার দরুন বাঙালির পাকপ্রণালী, মানে রন্ধনকর্মে পরিবর্তন এল। সন্ধেবেলা ঘরে আলো জ্বালানোও হঠাৎ হয়ে পড়ল অনেক সহজ। এই দু’টি পরিবর্তনই বদলে দিল একান্নবর্তী পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর সম্পৰ্কের সমীকরণ। এক দিকে হঠাৎ গৃহবধূর হাতে বেশ কিছুটা বাড়তি সময় বাঁচল, অপর দিকে সন্ধের পর, বাকি পরিবারের থেকে পৃথক ভাবে স্বামী-স্ত্রী ইচ্ছেমতো ঘর আলোকিত করে পরস্পরের সান্নিধ্যে কিছুটা সময় কাটানোর সুযোগ পেয়ে গেলেন। এর আগে গৃহ আলোকিত করা ছিল খুবই জটিল এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ফলে সব ঘরে ইচ্ছেমতো আলো জ্বালানো হত না। সাধারণ ভাবে বাড়ির বড় বৌ তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বেলে পূর্বনির্ধারিত কয়েকটি ঘরে আলো জ্বেলে দিতেন। এবং সেই ঘরগুলোর মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর একাকী বসে আলাপচারিতার অবকাশ ছিল খুবই সীমিত।
আবার অন্য দিকে মানুষের ধূমপানের অভ্যেসও বদলাতে লাগল এবং তাকে কেন্দ্র করে পাল্টে গেল সামাজিকতার রূপ। তামাক খেতে গেলে পাঁচ জনে এক জায়গায় বসে গুলের টিকে দিয়ে বার বার হুঁকো ধরিয়ে ধরিয়ে খাওয়ার আর দরকার রইল না। যে যার নিজের হুঁকো, বা কিছু দিন পরে বিড়ি-সিগারেট, একা একাই উপভোগ করতে পারলেন। তাই এক দিকে যেমন বদলে গেল পরিবারের অভ্যন্তরে দাম্পত্যের রূপ, অন্য দিকে বদলে গেল প্রতিবেশী-বন্ধুদের সঙ্গে দৈনিক সামাজিকতার ধাঁচ। সাধারণ মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় পরিবর্তন আর কী হতে পারে?
এখানে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসা উচিত, সাধারণ বাঙালি গৃহস্থ কোথায় পেল যুগান্তকারী এই আবিষ্কার? কে তার হাতে তুলে দিল এই ছোট্ট, কিন্তু অভূতপূর্ব দেশলাই কাঠি? ভাবলে একটু আশ্চর্য হতে হয় যে, এই প্রশ্নটি কিন্তু কোনও ইতিহাসবিদের মাথায় আসেনি, এসেছিল এক চিত্রপরিচালকের মাথায়। ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ ছবিটি তৈরি করতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় প্রথম এ বিষয়ে ভাবেন। জেনারেল উট্রামকে কী ভাবে তাঁর ছবিতে চুরুট ধরাতে দেখাবেন, সেই ভাবনাই সত্যজিৎকে টেনে নিয়ে যায় দেশলাইয়ের ইতিহাসের প্রতি। ইতিহাসবিদদের মধ্যে যে এক-আধ জন দেশলাই নিয়ে লিখেছেন, যাঁদের মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক রজতকান্ত রায়। তবে তাঁরা মূলত দেশলাই উৎপাদনের ইতিহাস এবং তার অর্থনৈতিক ভূমিকা বিশ্লেষণ করেছেন। দেশলাই ব্যবহারের ইতিহাসের প্রতি আগ্রহী হননি। তাই সে কাজ করতে হয়েছে সত্যজিৎ রায়কে নিজের উদ্যোগেই। তাঁর অনুসন্ধানে প্রতিপন্ন হয়েছে যে, ভারতে দেশলাইয়ের আগমন ঘটে ১৮৫৬-৫৭ সাল নাগাদ।
তবে আজ সত্যজিতের ধার্য এই তারিখটিকে কিন্তু আর ঠিক বলে মেনে নেওয়া যায় না। ১৮৫২ সালের একটি মোকদ্দমার দলিলে দেখতে পাই যে, কলকাতার পুলিশ এক দল চোরের কাছ থেকে চোরাই মাল উদ্ধার করতে গিয়ে এক বাক্স দেশলাই উদ্ধার করেন। তবে জেমস ডগলাস নামক তৎকালীন বোম্বাইয়ের এক বাসিন্দা তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন যে, বোম্বাইয়ে ১৮৩৮ সালেই দেশলাইয়ের আগমন ঘটেছিল। খুব সম্ভব যদি বোম্বাইয়ে ১৮৩৮ সালে দেশলাই বিক্রি হয়ে থাকে, তা হলে তৎকালীন রাজধানী কলকাতাতেও তার আগমন ও রকম সময়ই ঘটে থাকবে। তবে ১৮৫২ সালের আগে কলকাতায় দেশলাইয়ের ব্যবহার সংক্রান্ত আপাতত কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। উপরন্তু, ১৮৫২ সালের সেই দলিলটির থেকে এটুকু তো প্রমাণিত যে, দেশলাই তখনও তেমন বহুল ভাবে ব্যবহৃত হয়নি। তাই তো চোরের কাছে এই বস্তু পাওয়া পুলিশের কাছে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ফলে ১৮৩৮ বা ১৮৪০ নাগাদ দেশলাই যদি কলকাতায় এসেও থাকে, তা হলে উনিশ শতকের ষাটের দশকের গোড়াতেও সেটি বেশ বিরল এবং মহার্ঘ।
আসলে আমরা দেশলাই বলতে ঠিক যা বুঝি, তার আবিষ্কার হয়েছিল সেই ঘটনার মাত্র বছর পঁচিশ আগে। আধুনিক দেশলাইয়ের প্রথম পূর্বাভাস দিয়েছিলেন ফরাসি রসায়নবিদ, জঁহ চাঁসেল, ১৮০৫ সালে। তবে আগুন উৎপন্ন করার সেই উপকরণটিকে দেখলে ঠিক দেশলাই বলে চেনা যেত না। চাঁসেলের উপকরণটির ছিল দু’টি ভাগ। একটি ছোট বোতলে কড়া দ্রাবকে নিমজ্জিত একটি অ্যাসবেস্টসের টুকরো আর আলাদা ভাবে কতগুলি ছোট কাঠি, যাতে মাখানো থাকত তিন রকমের রাসায়নিক দ্রব্য। এই দু’টিকে একত্র করলেই আগুন জ্বলে উঠত। তবে সেই আগুন জ্বালানো ছিল অনিয়ন্ত্রিত এবং বিপদসঙ্কুল। তাই এই উপকরণটির বহুল প্রচার কখনওই ঘটেনি। অবশেষে ১৮২৬ সালে জন ওয়াকার নামক এক ইংরেজ ভেষজ-বিক্রেতা বিশেষ ভাবে তৈরি কাগজের পট্টির উপর রাসায়নিক দ্রব্যে আবৃত কাঠির টুকরো ঘষে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করেন। তবে ইংরেজরা প্রথম দিকে এই নতুন প্রযুক্তির গণ-উৎপাদন শুরু করে উঠতে পারেননি। সেটি হয় তৎকালীন হ্যাব্সবার্গ সাম্রাজ্যের রাজধানী ভিয়েনায় এবং জার্মানির ডার্মস্টাডট শহরে। এই গণ-উৎপাদন শুরু হয় ১৮৩০ নাগাদ। এর কিছু দিনের মধ্যেই কিন্তু দেশলাইয়ের উৎপাদনের মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠে উত্তর ইউরোপের সুইডেন। বিশেষ করে জাংকোপিং নামক একটি ছোট্ট শহর। এই সুইডেন এবং ভিয়েনা থেকেই প্রথম যুগে দেশলাই রফতানি হত ভারতে।
সেই সমস্ত বিদেশি দেশলাই পাড়ায় পাড়ায় তখন ফেরি করে বেড়াতেন এক বিশেষ ধরনের ফেরিওয়ালা। তাঁদের পরনে থাকত জমকালো মখমলের মেরজাই এবং মাথায় সোনালি সুতোর কাজ করা ঝকমকে টুপি। তাঁদের ‘লে দেশলাই’ হাঁক ছিল সকলের পরিচিত। এতটাই দৃষ্টি-আকর্ষক ছিলেন এই দেশলাইওয়ালারা, যে এক সময় চৈত্র মাসের সঙ-রা পর্যন্ত বিভিন্ন দেবদেবীর পাশাপাশি দেশলাইওয়ালা সাজতে শুরু করেন।
তবে এই ফেরিওয়ালাদের হাতে দেশলাইবাক্স পৌঁছে দিত আন্তর্জাতিক কয়েক জন ব্যবসায়ী। এক দিক থেকে বলতে গেলে এই ব্যবসায়ীরাই দেশলাই আমদানি করে এবং ফেরিওয়ালাদের মাধ্যমে বাঙালি গৃহস্থদের দেশলাই ব্যবহার করতে শেখায়। তাই এটাও উল্লেখযোগ্য যে, এই সব ব্যবসায়ীদের মধ্যে বাঙালি হিন্দু ব্যবসায়ী ছিলেন নগণ্য। জে এন মিত্র বা এন সি বসাকের মতো দু’-এক জন বেশ ছোট ব্যবসায়ী ছাড়া, বড় দেশলাই ব্যবসায়ীরা প্রায় সকলেই ছিলেন কোনও না কোনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে তিনটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য, এবং এই তিনটিই ছিল দেশলাইয়ের বাজারে অগ্রগণ্য।
এঁদের মধ্যে সম্ভবত সর্বপ্রথম ছিলেন মেরোয়ানজি নানাভাই মেহতা নামক এক পারসি ব্যবসাদার। মেহতা প্রথম কলকাতায় এসেছিলেন ছাত্র হিসেবে। সেন্ট জ়েভিয়ার্স স্কুলে পড়তে। পড়াশোনা শেষ করে তিনি আর গুজরাতে তাঁর পৈতৃক গ্রামে ফিরে যাননি। ১৮৭৭ সালে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে মেহতা কলকাতা থেকে চিনে ছোটখাটো জিনিস রফতানি করে বেশ কিছু টাকা করে ফেলেন। তার পরেই তিনি জার্মানি থেকে দেশলাই আমদানি শুরু করেন। তাঁর দেশলাই শুধু কলকাতা বা ভারতেই নয়, বিক্রি হত সমস্ত পূর্ব এশিয়া জুড়ে। কিন্তু তিনি নিজে থাকতেন কলকাতায় এবং সে কারণেই তাঁর দেশলাইয়ের বাক্সেও লেখা থাকত কলকাতারই নাম।
দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য দেশলাই-বিক্রেতা ছিলেন এ জানউইৎজ়ার নামক এক ইহুদি ব্যবসায়ী। জানউইৎজ়ার আদতে ছিলেন ভিয়েনার লোক। সেখানে তাঁর একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও ছিল। কিন্তু উনিশ শতকের শেষ দিকে তিনি চলে আসেন কলকাতায়। মেহতার মতো তাঁর দেশলাইগুলোও বিক্রি হত সমগ্র পূর্ব এশিয়া জুড়ে। তবে তিনিও বাস করতেন কলকাতাতেই। সেই সুবাদে শহরের নানা নাগরিক উদ্যোগে তিনি অকুণ্ঠ ভাবে আর্থিক সাহায্য করতেন। তাঁর আর্থিক সাহায্যে বিশেষ ভাবে উপকৃত হয়েছিল কলকাতা চিড়িয়াখানা। বেশ কয়েকটি দামি জন্তু-জানোয়ার জানউইৎজারের আর্থিক অানুকূল্যেই চিড়িয়াখানায় স্থান পায়।
তবে এদের দু’জনের চেয়েই বড় এবং উল্লেখযোগ্য দেশলাই-বিক্রেতা ছিলেন আব্দুলকাদের মোল্লা ঈশাভাই বা এ এম এশাভয়। এই ঈশাভাই পরিবার এক কালে সর্ববৃহৎ দেশলাই-বিক্রেতা হয়ে উঠেছিলেন। এঁরাই প্রথম ইউরোপীয় উৎপাদকদের টক্কর দেওয়ার জন্য, উনিশ শতকের অন্তিম দশক থেকে, জাপান থেকে দেশলাই আমদানি শুরু করেন। এক সময় জাপান-সহ পূর্ব এশিয়ার প্রায় সমস্ত বড় দেশে এঁদের বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল। এঁরাই আবার বিশ শতকে নতুন করে কলকাতায় দেশলাই উৎপাদনের চেষ্টা করেন।
তার আগে উনিশ শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে এবং তার পরের দশকে সালকিয়ায় দু’টি দেশীয় উৎপাদন কল চালু হয়। এর প্রথমটির নাম ‘দ্য ইন্ডিয়ান ম্যাচ ফ্যাক্টরি লিমিটেড’ আর অপরটির নাম ‘বেঙ্গল সেফটি ম্যাচ ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি’। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই দু’টির কোনওটিই দীর্ঘায়ু হয়নি। এর পর স্বদেশি আন্দোলনের সময় আরও কিছু প্রচেষ্টা হয়, কিন্তু সেগুলোও দীর্ঘজীবী হয়নি। এরই মধ্যে ঠিক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে সাসামল্ল নামে এক মারোয়াড়ি ব্যবসাদারের জালিয়াতির ফলে ঈশাভাই কোম্পানি লাটে উঠে যায়।
তবে এক বছরের মধ্যেই, ফতেহ আলি নামক ঈশাভাইদেরই এক দূর সম্পৰ্কের আত্মীয় কলকাতাতেই নতুন নাম দিয়ে আবার দেশলাই ব্যবসা শুরু করেন। এ বার কোম্পানির নাম হয় সি এ মোহাম্মদ। এই সি এ মোহাম্মদ কোম্পানি আবার বিশ শতকের তিরিশের দশকে নাম পাল্টে হয় যায় এসাভি। এই এসাভি কোম্পানির দেশলাই কলকাতায় উৎপাদন হয়েছে একেবারে সত্তরের দশকের শেষ অবধি। এই কোম্পানিই নিজের পয়সায় ১৯২৫ নাগাদ জাপান থেকে কলকাতায় কারিগর এনে দেশীয় কারিগরদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রথম সফল ভাবে দেশীয় দেশলাই উৎপাদনের নজির গড়ে। এই সময় থেকেই সুইডেনের উদ্যোগপতিরা ভারতে কারখানা স্থাপন করে ‘উইমকো’ (অর্থাৎ ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়ান ম্যাচ কোম্পানি) নাম দিয়ে ভারতীয় এবং জাপানি উদ্যোগগুলিকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেন। ‘উইমকো’-র বিপুল পুঁজি সত্ত্বেও কিন্তু এসাভি আরও বহু বছর টিকে থাকে।
এই এসাভি কোম্পানিতেই আবার এক সময় দক্ষিণ ভারত থেকে আগত দুই ভাই কাজ শেখেন। তার পর দক্ষিণে ফিরে গিয়ে শিবকাশীতে বিশাল দেশলাই উৎপাদন-উদ্যোগের ভিত্তি স্থাপন করেন। ১৯৫০-৬০ এর আশপাশে যখন এসাভির আয়ু প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তখন এই শিবকাশীর কুটিরশিল্পগুলিই উইমকো-র সর্বগ্রাসী খিদের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রেখেছিল। আজও শিবকাশীতে তৈরি দেশলাই ব্যবহার করেন বহু লোক। এমনকি আজ যখন কলকাতার দেশলাই শিল্প ইতিহাসে বিলীন, তখন এই শহরের মানুষও প্রায়শই শিবকাশীর তৈরি দেশলাই ব্যবহার করে থাকেন। তাই বিশেষ ভাবে স্মরণীয় যে, এই উৎপাদন শিল্পের মূলে কিন্তু রয়েছে কলকাতার ঈশাভাইদের কীর্তি। ইউরোপ থেকে জাপান, বিপণন থেকে উৎপাদন, দেশলাইয়ের সমস্ত ইতিহাস জুড়েই তাই ঈশাভাই বংশের কর্মকাণ্ডের আভাস। এঁদের দ্বারাই বাঙালির ঘরে ঘরে এক দিন দেশলাই ব্যবহার হয়ে ওঠে দৈনন্দিন ব্যাপার। এবং তারই মাধ্যমে ধীরে ধীরে সাধারণ বাঙালি জীবন হয়ে ওঠে আধুনিক।
আধুনিক বাঙালিরা অনেকেই হয়তো রামমোহনের লেখা পড়েননি। বিজ্ঞান বা জাতীয়তাবাদ নিয়েও হয়তো তাঁরা অনেকেই মাথা ঘামান না। কিন্তু দেশলাই ব্যবহার করেননি এমন বাঙালি পাওয়া নিশ্চয়ই মুশকিল হবে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো সিগারেট ধরাতে কোনও দিন লাইটারের পক্ষপাতী ছিলেন না। ব্যবহত, পোড়া কাঠি ছুড়ে ফেলায় পেতেন নির্মল আত্মপ্রসাদ। অন্য দিকে ইতিহাসের দৃষ্টিতে উপেক্ষিত হলেও কবি সুকান্ত দেশলাইয়ের ঐতিহাসিক সম্ভাবনাকে স্বর দিয়ে বলেছেন—
আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি
এত নগণ্য, হয়তো চোখেও পড়ি না:
তবু জেনো
মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ—
বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস;
আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি।