Asthadhatu Durga Idol

দীর্ঘ পরিক্রমা শেষে শান্তিপুরে প্রতিষ্ঠিত তিন পুতুলের জয়দুর্গা

আগে ছিলেন উলার জগত্তারিণী। নানা স্থানে পুজো পেয়ে এখন তিনশো বছরের প্রাচীন এই বিগ্রহ মতিগঞ্জের কোঠাঘরে। ছেলেমেয়েরা কেউ নেই, শুধু দেবী, সিংহ ও অসুর, তাই তিন পুতুল। থিমপুজোর রোশনাইয়ের উল্টো দিকে এখানে শারদীয়ার পুজো হয় নিতান্ত টিমটিম করে।

Advertisement

রাহুল হালদার

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:৫৩
Share:

অধিষ্ঠাত্রী: শান্তিপুরের অষ্টধাতুর জয়দুর্গা। ডান দিকে, মতিগঞ্জের একতলা যে কোঠাঘরে বর্তমানে পূজিতা হন দেবী।

কবি নবীনচন্দ্র সেন রানাঘাটের ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার সময়ে শান্তিপুর প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, এই ‘মতির জুড়ি’ বঙ্গদেশে আর ছিল না। শান্তিপুরের সেই জমিদার মতি রায়ের নামেই এখন পরিচিত মতিগঞ্জ ঘাট। অবশ্য মতিগঞ্জ এখন আর গঞ্জ নয়, শহরতলি। তবে প্রায় দুশো বছরের বেশি আগে থেকেই, যখন কলকাতা থেকে কাশিমবাজার পর্যন্ত গঙ্গানদীকে কেন্দ্র করে নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তখন বড় বড় নৌকো এসে ভিড়ত মতিগঞ্জ ঘাটে। তখন নানা স্থানের এদেশীয় ও বিদেশি লোকজনের সমাবেশে জমজমাট থাকত মতিগঞ্জ ঘাট এবং ঘাট সংলগ্ন বড়বাজার এলাকা। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই গঙ্গার প্রবাহ এখন দক্ষিণ দিকে সরে গেছে। তা সত্ত্বেও আজ মতিগঞ্জ ঘাট সংলগ্ন এলাকায় সেই প্রাচীন গঙ্গা খাতের নিদর্শন রয়ে গেছে বিভিন্ন পুকুর, খাল, বিলে। সড়কপথেও মতিগঞ্জ এখন গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই চৌরাস্তার পশ্চিমে যে সড়ক গেছে, সেটা গঙ্গা পেরিয়ে যেমন গ্রামীণ বর্ধমানের কালনার সঙ্গে যুক্ত, তেমনই পূর্বে কলকাতা, উত্তরে নদিয়া জেলার সদর শহর কৃষ্ণনগরের সঙ্গেও যুক্ত। দক্ষিণে গঙ্গা এবং ফেরিঘাটে সেই গঙ্গা পেরোলে হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়া। এই সব কিছু ছাড়াও মতিগঞ্জের প্রাচীনত্ব নির্দেশ করে যে দু’টি নির্দশন, সেগুলির একটি হল শান্তিপুরের ব্রাহ্মসমাজের মন্দির আর সারা বছর পূজিতা তিন শতকের প্রাচীন জয়দুর্গার অষ্টধাতুর মূর্তি।

Advertisement

শরৎকাল মানেই সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে আপামর বাঙালির কাছে পৌঁছয় আগমনীর আনন্দবার্তা। স্বামী অভেদানন্দ দুর্গাপূজা প্রসঙ্গে ‘শ্রীদুর্গা’ গ্রন্থের অবতরণিকায় লিখেছেন, “ভারতবর্ষের হিন্দুদিগের দুর্গাপূজা সমস্ত পূজা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এই পূজাকে হিন্দু মাত্রেই অতিশয় শ্রদ্ধার চক্ষে দেখেন। ইহাকে হিন্দুদের জাতীয় পর্ব বলা যাইতে পারে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে জগন্মাতা দুর্গাদেবী ভিন্ন ভিন্ন নামে পূজিত হইয়া থাকেন। তিনি কাশ্মীরে ও দাক্ষিণাত্যে ‘অম্বা’ ও ‘অম্বিকা’ নামে, গুজরাটে ‘হিঙ্গলা’ ও ‘রুদ্রাণী’ নামে, কান্যকুব্জে ‘কল্যাণী’ নামে, মিথিলায় ‘উমা’ নামে এবং কুমারিকা প্রদেশে ‘কন্যাকুমারী’ নামে পূজিত হইয়া থাকেন। এইরূপে হিমালয় হইতে কুমারিকা অন্তরীপ পর্যন্ত এবং দ্বারকাপুরী ও বেলুচিস্তানের হিঙ্গলাজ হইতে পুরীতে শ্রীজগন্নাথ ক্ষেত্র পর্যন্ত ভারতবর্ষের সর্বস্থানে শারদীয়া দুর্গাপুজো অথবা নবরাত্র নামে পূজা-পার্বণ অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে।” তবে আমরা বাঙালিরা দেবী দুর্গাকে আমাদের নিজের ঘরের মেয়ে রূপে দেখি, যিনি প্রতি বছরে এই পাঁচটি দিন পুত্রকন্যা-সহ পিতৃগৃহে আসেন।

সেই কারণে শশিভূষণ দাশগুপ্ত তাঁর ‘ভারতের শক্তি সাধনা ও শাক্তসাহিত্য’ গ্রন্থে লিখেছেন, “পণ্ডিতমহলে বা উচ্চকোটি মহলে যতই মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর সহিত যুক্ত করিয়া অসুরনাশিনী দেবীর পূজা মহোৎসব করিয়া তুলিবার চেষ্টা হোক না কেন, বাঙলার জনমানস মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর তেমন ধার ধারে না। জনগণ প্রতিমার দেবী অসুরনাশিনী মূর্তিকে দেখেন— কিন্তু ঐ পর্যন্তই; তাহার পরে তাহারা স্থির নিশ্চিত রূপে জানেন আসলে আর কিছুই নয়— উমা মায়ের স্বামী-গৃহ কৈলাস ছাড়িয়া বৎসরান্তে এক বার কন্যারূপে পুত্রকন্যাদি লইয়া বাপের বাড়ির আগমন। তিনদিন বাপের বাড়ি উৎসব- আনন্দ— তাহার পরে আবার চোখের জলে বিজয়া— স্বামীগৃহে প্রত্যাবর্তন।”

Advertisement

সারা বাংলার মতোই আশ্বিন মাসে দেবী দুর্গার আগমনে নদিয়া জেলার শান্তিপুরও মেতে ওঠে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবে। এখানে বড় বড় প্যান্ডেল বা চোখ-ধাঁধানো থিম না হলেও প্রাচীন কিছু বনেদি বাড়িতে আর কিছু বারোয়ারিতলায় পুজো হয়। তার সঙ্গে অনেকেরই লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে যায় মতিগঞ্জের একটি একতলা কোঠাঘরের দেবী জয়দুর্গা, যে দেবীর বিগ্রহ তিন শতকেরও বেশি প্রাচীন। এই দেবীর প্রতিষ্ঠার পিছনে নদিয়ার ইতিহাসসমৃদ্ধ একটি বড় কাহিনি রয়েছে যা অনেকেরই অজানা এবং বেশ চমকপ্রদ।

১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের আগে যখন উলাতে (এখনকার বীরনগর) মহামারির জ্বর এসে পৌঁছোয়নি, তখন শান্তিপুরের দেবী জয়দুর্গা উলায় পূজিতা হতেন জগত্তারিণী নামে। সৃজননাথ মিত্র মুস্তৌফী-র লেখা থেকে জানা যায়, মুস্তৌফী বাড়ির “ভিতরের উঠানের পূর্ব দিকে স্থিত দুর্গামন্দিরটি সুবৃহৎ ও সুউচ্চ। ইহা পঞ্চচূড়।... মন্দিরের ভিতরে মধ্যস্থলে একটি ইষ্টকের বেদী আছে, উহার উপরে অষ্টধাতুর জগত্তারিণী নামক সিংহবাহিনী অসুরনাশিনী দশভুজা মূর্তি দক্ষিণাস্যা হইয়া দণ্ডায়মান থাকিতেন। দুর্গাপূজার সময় ষষ্ঠীর দিন এই দেবীকে অদূরবর্তী পৃথক পূজার দালানে লইয়া গিয়া তিন দিন মহাসমারোহে পূজা করা হইত ও বহু ছাগ ও মহিষ বলি হইত।”

এর পর ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে এক ভয়ঙ্কর মহামারিতে উলা গ্রামকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে। যাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন এবং যাঁরা প্রাণভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে কিছু মানুষ মহামারি কমে গেলে আবার গ্রামে ফিরে আসেন। এঁদের মধ্যে এক জন ছিলেন গিরীশচন্দ্র বণিক। সৃজননাথ মিত্র মুস্তৌফী লিখেছেন, “গিরীশচন্দ্র বণিকের নিকট শোনা যায় যে, মহামারির পরে একদিন দেখা গেল যে উলার বর্তমান বাজারের পশ্চিমদিকে দত্তপুকুর নামক ডোবার জলে ঈশ্বর মুস্তৌফীর দশভুজার পিতলনির্মিত পাট সূর্যকিরণে জ্বলিতেছে। ঈশ্বরবাবুর অন্যতম খানসামা রূপচাঁদ দাস ওই পাট চিনিতে পারিল। উলার এক ব্রাহ্মণ (কৃষ্ণ ডাক্তার) ওই পাট ও ঈশ্বরচন্দ্রের দশভুজা লইয়া গিয়া কিছুদিন পূজা করেন। পরে তিনি মণির মা নামক এক বিধবা ব্রাহ্মণকন্যার নিকটে ওই প্রতিমা রাখিয়া রংপুর অঞ্চলে চলিয়া যান, আর উলায় ফিরিয়া আসেন নাই। মণির মা উক্ত বিগ্রহের নিত্যসেবা চালাইতে অক্ষম হইয়া শান্তিপুরের মতিগঞ্জের গঙ্গার ঘাটে এই প্রতিমা বিসর্জন দিতে যান। তথায় জনৈক সাধুপ্রকৃতির ব্যক্তি ওই প্রতিমা লইয়া উহার নামমাত্র নিত্যসেবার
ব্যবস্থা করেন।”

‘শান্তিপুর পরিচয়’ গ্রন্থে কালীকৃষ্ণ ভট্টাচার্য বলেছেন, ওই সাধুপ্রকৃতির ব্যক্তি হলেন শান্তিপুরের এক তন্তুবায়, শ্যামাচরণ প্রামাণিক। সেই সময় শান্তিপুরের খাঁ, প্রামাণিকেরা ছিলেন বিত্তবান মানুষ। ঠাকুরপাড়ায় শ্যামাচরণ প্রামাণিকের (বর্তমানে উকিলবাড়ি নামে প্রসিদ্ধ) বাড়ির পঞ্চম পুরুষ শৌভিক প্রামাণিক (রঞ্জু) বলেন, তাঁর বাবার ঠাকুরদার সময়ের মানুষ হলেন শ্যামাচরণ। বাড়ির বয়স্ক সদস্যদের মুখ থেকে শুনেছেন যে, সেই সময় বাবার ঠাকুরদা মতিগঞ্জের গঙ্গার ঘাটে স্নান করতে গিয়ে অষ্টধাতু নির্মিত দুর্গা মূর্তিটি পান। উচ্চতা প্রায় সাড়ে তিন ফুট থেকে চার ফুট। তখন তিনি সেই মূর্তি মাথায় করে বাড়ি নিয়ে আসেন। কিন্তু বাড়িতে তার আগে থাকতেই দুর্গাপুজো হত বলে তখনকার বাড়ির বয়স্করা বলেন, একই বাড়িতে দু’টি দুর্গাপুজো করা যাবে না। তখন শ্যামাচরণ প্রামাণিক সেই মূর্তি যেখান থেকে পেয়েছিলেন, সেই মতিগঞ্জ ঘাটে নিয়ে এসে এক স্থানে একটি কোঠাঘরে প্রতিষ্ঠা করেন।

উলায় যে দুর্গা জগত্তারিণী নামে পূজিতা হতেন, শান্তিপুরে প্রামাণিক বাড়ির হাতে প্রতিষ্ঠা পেয়ে দেবীর নতুন নাম হয় জয়দুর্গা। সঙ্গে লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতী কেউ নেই— শুধু দেবী, সিংহ ও অসুর— তাই ‘তিন পুতুলের জয়দুর্গা’ নামেও দেবী প্রসিদ্ধ। তার পর প্রামাণিকরা সেই কোঠাঘরে জয়দুর্গাদেবীর নিত্যপূজার জন্য সেবায়েত রেখে মাসে মাসে নিদিষ্ট পরিমাণের অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা করেন। সেই অর্থ আজও তাঁরা দিয়ে আসছেন।

বর্তমানে মতিগঞ্জের পুরোহিত শ্রাবন্ত মুখোপাধ্যায়, বংশপরম্পরায় জয়দুর্গার সেবায়েত ও মুখোপাধ্যায় বংশের চতুর্থ প্রজন্ম। এখন জয়দুর্গার নিত্যপুজোর দায়িত্ব তাঁর। তিনি এই মূর্তির প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে ততটা অবগত নন। তবে প্রায় এক বছর আগে তাঁর জ্যাঠামশাই শক্তিপদ মুখোপাধ্যায়কে তিনি জয়দুর্গার ইতিহাস ও পূজাপদ্ধতি সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তরে বলেছিলেন, তাঁর ঠাকুরদাদা রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, বাবা বিজয় মুখোপাধ্যায়ের পর তিনি— তিন পুরুষ ধরে তাঁরা দেবীর পুজো করে আসছেন। আশ্বিন মাসে শারদোৎসব উপলক্ষে যখন প্রামাণিক বাড়িতে দেবী দুর্গার আরাধনা হয়, তখন সেখানেই জয়দুর্গাদেবীর বোধন আর সন্ধিপুজো হয়। এর পর বিজয়া দশমীতে যখন প্রামাণিক বাড়িতে ঠাকুর বিসর্জন হয়, সেই সঙ্গে মতিগঞ্জেও দেবী জয়দুর্গার ঘট নাড়িয়ে দেওয়া হয়। আবার সেই দশমীতেই নতুন করে ঘটের পত্তন করা হয়। সেই নতুন ঘট রাখা হয় পরের বছরের দশমী পর্যন্ত ও প্রতিদিন পুজো করা হয় দেবীর। তিনি আক্ষেপ করে বলছিলেন, এখন চার দিকে যে ভাবে বারোয়ারি পুজোগুলিতে এবং বনেদি বাড়ির পুজোয় আলো, প্যান্ডেল, থিমের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়, সরকার থেকে অর্থসাহায্য আসে, সেখানে প্রাচীন ইতিহাসসমৃদ্ধ এই দেবীর শারদীয় পুজো সম্পন্ন হয় ন্যূনতম জাঁকজমক ছাড়াই, খুবই সাধারণ ভাবে।

কৃতজ্ঞতা: শৌভিক প্রামাণিক ও তাঁদের পরিবার

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement