Bengali Scientist

ফলিত পদার্থবিদ্যার ভগীরথ

ফণীন্দ্রনাথ ঘোষের তৈরি স্পেক্ট্রোস্কোপ, ভূগর্ভস্থ গবেষণাগার ছিল বিশ্ববিখ্যাত। তাঁকে বলা হত ‘বেস্ট মেজারিং ম্যান অব দি ইস্ট’।

Advertisement

কৌশিক দাশশর্মা

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:১৮
Share:

পথিকৃৎ: ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ

১৯১৮ সাল। ইংল্যান্ডের ‘নেচার’ পত্রিকায় ছাপা হল এক বাঙালি তরুণ বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক সি ভি রামনের যৌথ গবেষণাপত্র। এই লেখায় অভ্রের আলোক-বিচ্ছুরণ সংক্রান্ত কিছু প্রশ্নের উত্তর দিলেন নোবেল পুরস্কারজয়ী ইংরেজ পদার্থবিদ লর্ড র‌্যলে, যা ছাপা হল ওই গবেষণাপত্রের সঙ্গেই। মাত্র এক বছরের মধ্যেই লর্ড র‌্যলের দেখানো পথে কাজ করে এই তরুণ বিজ্ঞানী তাঁর একক গবেষণাপত্র এ বার প্রকাশ করলেন লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির জার্নালে। তাঁর এই অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২০ সালে পেলেন ডক্টরেট উপাধি। তাঁকে বরণ করে নেওয়া হল সদ্য চালু হওয়া স্যর আর বি ঘোষ চেয়ার প্রফেসর হিসাবে। এর পরই পাড়ি দিলেন ইউরোপের উদ্দেশে। দেশে ফিরে তৈরি করলেন ভারতের প্রথম প্রযুক্তিবিদ তৈরির পীঠস্থান কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লায়েড ফিজ়িক্স বিভাগ। আবার ১৯৩৮ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদ্যনির্বাচিত সভাপতি সুভাষচন্দ্র তাঁকে ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির সদস্য করছেন। কিন্তু কে এই বাঙালি বিজ্ঞানী?

Advertisement

তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, তথা দেশ-বিদেশের তৎকালীন বৈজ্ঞানিক মহল চিনতেন প্রফেসর পি এন ঘোষ নামে। তিনি ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ। বাঙালির চায়ের আড্ডায় বা বৌদ্ধিক চর্চায় তাঁর সমসাময়িক সত্যেন্দ্রনাথ বসু বা মেঘনাদ সাহার নাম শোনা গেলেও তাঁর নাম শোনা যায় না তেমন। তাই শতবর্ষ-সমাগত অ্যাপ্লায়েড ফিজ়িক্স বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ফণীন্দ্রনাথের জীবনের উপর আলোকপাত জরুরি।

ফণীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৮৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, অবিভক্ত ২৪ পরগনা জেলার মজিলপুরে। স্থানীয় স্কুলের পাঠ শেষ করে ফণীন্দ্রনাথ আসেন কলকাতায়। ১৯০৫ সালে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক স্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হন, তার পর ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। বঙ্গভঙ্গের উত্তাল সময়ে বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন তুঙ্গে। এই যুগসন্ধিক্ষণে ফণীন্দ্রনাথ স্নাতকোত্তর পদার্থবিদ্যাতেও প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পেলেন স্বর্ণপদক। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসাবে, এ বার নজরে পড়লেন স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের।

Advertisement

প্রথম থেকেই ফণীন্দ্রনাথের নজর, কী ভাবে বিজ্ঞানের গূঢ় তত্ত্বগুলোকে ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের জীবন-জীবিকায় নিয়ে আসা যায়। তাই স্নাতকোত্তরের পর সরকারি চাকরি প্রত্যাখ্যান করে জেসপ কোম্পানিতে শিক্ষানবিশি শুরু করেন। কিন্তু বেশি দিন সে কাজে টিকে থাকতে পারলেন না। পারিবারিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের সুরাহা করতে বঙ্গবাসী কলেজে পদার্থবিদ্যায় অধ্যাপনার চাকরি নিতে বাধ্য হলেন। নিজেকে তৈরি করলেন এক অদ্বিতীয় ভূমিকায়— বিশুদ্ধ ও ফলিত দুই ধরনের বিজ্ঞান চেতনা ও সাধনায় পারদর্শিতার ভূমিকা। সে যুগের ভারতবর্ষে এমন মানুষের সংখ্যা ছিল নিতান্ত হাতে-গোনা।

ও দিকে ১৯১৪ সালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং রাসবিহারী ঘোষ ও তারকনাথ পালিতের অর্থানুকুল্যে রাজাবাজারে তৈরি হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বিজ্ঞান বিভাগ। পদার্থবিদ্যায় অধ্যাপক রূপে সি ভি রামনের সঙ্গে আশুতোষ নিয়ে এলেন তাঁর প্রিয় ফণীন্দ্রকে। পরে এলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ। রসায়ন বিভাগে এলেন প্রফুল্লচন্দ্র। শুরু হল ফণীন্দ্রনাথের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। সি ভি রামনের উৎসাহে শুরু করলেন অভ্রের বর্ণালী বীক্ষণ বা ‘স্পেক্ট্রোস্কোপিক অ্যানালিসিস’-এর কাজ, এবং অল্প সময়ের মধ্যেই একাধিক গবেষণাপত্রের মাধ্যমে পেলেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয় আর আধুনিক কলকারখানা, এই দুইয়ের মেলবন্ধনেই সম্ভব পদার্থবিদ্যার ব্যবহারিক প্রয়োগ— তা ফণীন্দ্রনাথ আজ থেকে একশো বছর আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। ইংল্যান্ডে গিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে যেমন জানলেন পদার্থবিদ্যার প্রায়োগিক শাখায় সে দেশের পঠন-পাঠনের ধরন, আবার জার্মানি গিয়ে সরাসরি যোগ দিলেন বিখ্যাত সিমেন্স কোম্পানিতে। হাতে-কলমে শিখলেন ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজি।

দেশে ফিরে ১৯২৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি করলেন তাঁর স্বপ্নের ফলিত পদার্থবিদ্যা বিভাগ, যা আজও শতবর্ষের পথে একই ভাবে ফলিত বিজ্ঞান-চর্চার নানা ক্ষেত্র উন্মোচিত করে চলেছে। ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নতুন বিভাগ তৈরির মতো কাজের চাপ সহজেই অনুমেয়। স্যর আশুতোষের প্রয়াণের পর সে কাজ আরও কঠিন হয়ে উঠল। তবু অবিশ্বাস্য অধ্যবসায় ও নিরন্তর প্রচেষ্টায় তৈরি করলেন ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজি, মেজারমেন্ট টেকনোলজি আর আলোকপদার্থবিজ্ঞানের সম্মেলনে এই নতুন বিভাগ। সঙ্গে পেলেন তাঁর সুযোগ্য ছাত্র ও পরবর্তী কালে সহকর্মী পূর্ণচন্দ্র মহান্তিকে। দু’জনে মিলে ১৯২৮-এ তৈরি করলেন ২১ ফুট ব্যাসার্ধের অবতল গ্রেটিং স্পেক্ট্রোস্কোপ। সেই সময় ইউরোপ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও এত বড় মাপের বর্ণালী বিশ্লেষণ ব্যবস্থাপনা ছিল না। বড় গবেষণাগার তৈরি হল অ্যাপ্লায়েড ফিজ়িক্স ভবনের বেসমেন্টে কম্পনরোধী ব্যবস্থায়। এটাও সেই সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা এক পরিকল্পনা। এই গবেষণাগার ব্যবহার করে সেকালে বেশ কিছু গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ইংল্যান্ডের ‘নেচার’ ও অন্যান্য দেশি-বিদেশি পত্রিকায়। এই গবেষণাগারের নাম এতই ছড়িয়ে পড়ে যে, ফণীন্দ্রনাথকে পশ্চিমি দেশগুলি ‘বেস্ট মেজারিং ম্যান অব দি ইস্ট’ সম্মানে ভূষিত করে।

এ দিকে ১৯৩৮ সালে সুভাষচন্দ্র বসু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর উদ্যোগে ও জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে তৈরি হল ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি। এই কমিটির প্রধান লক্ষ্যই ছিল ভারতবর্ষের শিল্পনীতির প্রাথমিক দিশা নির্ধারণ। মূল কমিটির সঙ্গে কাজ শুরু করে একাধিক সাব-কমিটি। মেঘনাদ সাহার অনুরোধে সায়েন্টিফিক ইনস্ট্রুমেন্ট সাব-কমিটির সভাপতি রূপে বরণ করে নেওয়া হল প্রফেসর ফণীন্দ্রনাথ ঘোষকে। আবার তিনিই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন অধ্যাপক হয়েও ব্রিটিশ ভারতে বাংলার ইন্ডাস্ট্রিয়াল সার্ভে কমিটিরও সভাপতি ছিলেন। বাংলার ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ বোর্ডেরও সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি, ছিলেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অব সায়েন্স-এর ফেলো। সি ভি রামনের পর ‘কাল্টিভেশন’-এর বিখ্যাত বিজ্ঞান-পত্রিকা ‘জার্নাল অব ফিজ়িক্স’-এর সম্পাদকমণ্ডলীর প্রধান ছিলেন দীর্ঘ এগারো বছর। ১৯৩৫ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, মেঘনাদ সাহা ও আরও কয়েক জনের সঙ্গে মিলে তৈরি করলেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি, এবং নির্বাচিত হলেন এর প্রতিষ্ঠাতা ফেলো। এ ছাড়াও ছিলেন রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো। একই সঙ্গে ‘ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ় অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতির দায়ভারও সামলেছেন এক সময়।

এত কাজের ধকলে ফণীন্দ্রনাথের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। মাত্র তেষট্টি বছর বয়সে, ১৯৪৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর সাউথ এন্ড পার্কের বাসভবনে তিনি প্রয়াত হন। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে বিভাগের প্রাক্তন ও তৎকালীন শোকসন্তপ্ত ছাত্ররা তাঁর আবক্ষ মূর্তি ও তৈলচিত্র স্থাপন করেন বিভাগের দোতলার লবিতে, আজও যা এই মহান ব্যক্তিত্বের স্মৃতিসাক্ষ্য।

তথ্যসূত্র: জীবনীমূলক স্মৃতিকথা— ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ, এ কে সেনগুপ্ত, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি, ১৯৫৭; কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট রিপোর্ট, ১৯১৯, ১৯২৪, ১৯২৫, ১৯৩২

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement