প্রতিভাসম্মেলন: ডি জে কিমারের অফিস। বৃত্ত চিহ্নিত ডি কে, উল্টো দিকে টেবিলে বসে সত্যজিৎ রায়
বাধ্য ছাত্রের মতো পাশাপাশি বসে শক্তি–সুনীল। রীতিমত গলা ছেড়ে সা–রে–গা–মা সাধতে হচ্ছে। তাঁদের গানের ‘মাস্টারমশাই’ বটুকদা। কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। যাঁর নির্দেশে দুই কৃত্তিবাসীকে গানের তালিম নিতে হচ্ছে তিনি ডি কে। দিলীপকুমার গুপ্ত। সিগনেট প্রেসের কর্ণধার ডি কে তখন শৌখিন নাটকের দল খুলেছেন। নাম দিয়েছেন ‘হরবোলা’। কলকাতার বাঘা বাঘা বুদ্ধিজীবীরা এই নাটুকে দলের পৃষ্ঠপোষক। পরিচালনার দায়িত্বে কমলকুমার মজুমদার। সাজসজ্জার ভার নিয়েছেন ভাস্কর সুনীল পাল। অভিনেতাদের দলে ডি কে–র ইয়ং ব্রিগেড— শক্তি, সুনীল, উৎপলকুমার। দলের সভাপতি কবি অমিয় চক্রবর্তী।
ডি কে মানেই কোনও উদ্যমে ফাঁকি চলবে না। তাই সবাইকেই গলা ছেড়ে গান শিখতে হচ্ছে। বটুকদা ছাড়াও গানের আর এক শিক্ষক আছেন— সন্তোষ রায়। রিহার্সাল চলত প্রতিদিন। হঠাৎ কখনও এসে পড়তেন সৈয়দ মুজতবা আলী কিংবা সুভাষ মুখোপাধ্যায়। একটা গান সুনীলরা গাইতেনই— ‘জগতে আনন্দ যজ্ঞে’। গানটা এই দলের জাতীয় সঙ্গীত হয়ে উঠেছিল।
সুকুমার রায়ের ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ মঞ্চস্থ হবে। ৪ জানুয়ারি ১৯৫২। খুঁতখুঁতে ডি কে ভাবছেন রাবণের কুড়িটা হাত এবং দশটা মাথা হবে ফোল্ডিং কিংবা কোলাপসিবল। অর্ডার দিয়ে বানাবেন। ‘রাবণ’ বুডঢা বেঁকে বসলেন। ডি কে–র শ্যালক। ডি কে এই কাজে বুডঢাকে রাজি করাতে না পারলেও হনুমানের ল্যাজখানি নিজের মনের মতোই হয়েছিল। প্রথমে সুনীল পাল যে ল্যাজ বানান, ডি কে–র পছন্দ হয় না, ‘ল্যাজ স্ট্যাটিক হলে চলবে না, তার মোবিলিটি চাই। চলতে–ফিরতে নড়বে–চড়বে, পাক খাবে, তবেই না হনুমানের ল্যাজ।’ শেষ পর্যন্ত স্প্রিং–এর কাঠামোয় ভেলভেট জড়িয়ে ল্যাজ–নির্মাণ হল। পূর্ণেন্দু পত্রী লিখছেন, “এই জাতীয় প্রায় পাগলামির জন্যে এদিকে যে জলস্রোতের মত টাকা খরচ হচ্ছে তার জন্যে ডি কে–র কোনও খেদ নেই। তিনি চান নিখুঁত শিল্প।”
একটা চাকরির আশায় দিলীপ গুপ্তর সঙ্গে দেখা করতে তাঁর রামময় রোডের বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। সিঁড়ির পাশে খাঁচা–বদ্ধ বিশাল অ্যালসেসিয়ানকে পাশ কাটিয়ে তাঁকে দোতলায় উঠতে হয়েছিল। কিন্তু সমরেশ বসু যখন এলগিন রোডের বাড়িতে এক রবিবার ডি কে–র সঙ্গে দেখা করতে গেলেন তখন তাঁর বিবরণে কোনও ‘কুকুর’ নেই: ‘নির্জন পাড়ায় বড়লোকের অভিজাত বাড়ি, গেটে অবশ্যি ‘বি ওয়্যার অফ্ ডগ’ লেখা ছিল না। যা ঐ রকম বাড়িতে থাকবার কথা’। সত্যজিৎ দোতলায় প্যাসেজের শেষ প্রান্তে বৈঠকখানায় বসে অপেক্ষা করেছিলেন। মিনিট খানেকের মধ্যেই চটির ভারী শব্দের সঙ্গে–সঙ্গে ডি কে–র প্রবেশ। পরনে হাফশার্ট ও পায়জামা, চোখে পাওয়ার সম্বলিত টিনটেড চশমা, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন দশাসই চেহারা। কিমার কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ডি কে–র পছন্দ হয়ে গেল তরুণ শিল্পীকে। চাকরির প্রতিশ্রুতি দিলেও একটা কথা বলে সত্যজিৎকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন– ‘দ্য স্যালারি উইল ব্রেক ইওর হার্ট।’
সত্যজিৎ কাজে যোগ দেওয়ার বছর খানেকের মধ্যেই সিগনেট প্রেসের যাত্রা শুরু। উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার আর অবনীন্দ্রনাথের শিশু সাহিত্য প্রকাশ করবেন তাঁরা। প্রচ্ছদ আর অলঙ্করণের ভার দিলেন সত্যজিৎকেই। দুজনের মতের অমিলও হত। বিশেষত বানান সংস্কার নিয়ে দুজনের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। সুকুমার রায় লিখেছেন ‘বেড়াল’, সিগনেটের বইয়ে সেই বানান দাঁড়াল ‘বেরাল’। সত্যজিতের বক্তব্য: ‘‘তাঁকে কিছুতেই বোঝাতে পারিনি যে দু–য়ের মধ্যে ব্যঞ্জনার পার্থক্য আছে, এবং হযবরল–র ক্ষেত্রে বেরালের চেয়ে বেড়াল বেশি সংগত।’’
দু’জনে: নন্দিনী-ডি কে
ডি কে–র শাশুড়ি নীলিমা দেবীর থিয়েটার রোডের বাড়িতে সিগনেট প্রেসের উদ্বোধনী উৎসব হয়েছিল। ১৯৪৩–এ। উপস্থিত ছিলেন প্রফুল্লকুমার সরকার, সজনীকান্ত দাস, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শিবরাম চক্রবর্তী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুপ্রভা রায় প্রমুখ। খাতায় স্বাক্ষর আছে ছেচল্লিশজন অতিথির। সুকুমার রায়ের বই ছাপা হবে, সেই আসরে তাঁকে নিয়েই আলোচনা চলল। যে–মুহূর্তে তাঁর ‘খাই খাই করো কেন এসো বোসো আহারে’ পড়া শুরু হল, ঠিক তখনই সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভোজবাজির মতো প্লেটে–প্লেটে উত্তম সব আহার্য এসে পৌঁছতে লাগল নিমন্ত্রিতদের কোলের কাছে।
১৯৪৪ থেকে ১৯৭৫, এই চার দশকে ১৩১টি বই বেরিয়েছে সিগনেট থেকে। এর মধ্যে আটটি বই মুদ্রণ, বাঁধাই বিভাগে সর্ব ভারতীয় পুরস্কার জিতেছে। ১৯৪৫-এ জহরলাল নেহরুর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ প্রথম ছেপেছিল সিগনেট। বই ছাপার কাজ তখন চলছে, ১০/২ এলগিন রোডের বাড়িতে হঠাৎ এসে হাজির জহরলাল। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে সোজা উঠে এলেন দোতলায়। নীলিমা দেবী তখন স্নান ঘরে। নেহরুকে গ্যালি প্রুফ দেখিয়েছিলেন কিশোরী নন্দিনী। পরে তিনিই ডি কে–র সহধর্মিণী হবেন।
সিগনেটের প্রথম দুটি বই ইংরেজিতে। একটি নীলিমা দেবীর ইংরেজি কবিতার সংকলন, আর একটি নীলিমা দেবীর অনুবাদে, ডি কে–র সম্পাদনায় Best Stories of Modern Bengal। প্রথম বছর বারোটা, দ্বিতীয় বছরে পনেরোটা বই প্রকাশ করে সাড়া ফেলে দিল সিগনেট। দ্বিতীয় বছরের প্রথম বইটাই ‘আম আঁটির ভেঁপু’, বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’র ডি কে-র লেখা কিশোর সংস্করণ, সঙ্গে সত্যজিতের অসাধারণ অলঙ্করণ। সত্যজিতের স্বীকারোক্তি, ‘আমি আঁটির ভেঁপু’ আমাকে চিত্রনাট্যের কাঠামো নির্ধারণ করতে অনেকটা সাহায্য করেছিলো।’
সিগনেটের প্রকাশনা সৌষ্ঠব প্রত্যেককে মুগ্ধ করেছিল বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না। রাজশেখর বসু তাঁর মুগ্ধতা জানিয়ে চিঠি লিখেছেন ডি কে-কে। ৮ আগস্ট ১৯৫৬ যামিনী রায় লিখছেন, ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ বইখানির বাহ্য রূপ দেখে প্রথমেই চোখে পড়ে ছাপার পরিচ্ছন্নতা ও বাঁধাইএর সুষ্ঠু, গুরুত্বপূর্ণ রূপ।’ জীবনানন্দ দাশ ১৯৫২-র ৭ সেপ্টেম্বর লিখছেন, ‘‘বনলতা সেন’ বইটি পেয়ে খুবই আনন্দিত হয়েছি। খুবই চমৎকার বই হয়েছে।… সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস যে নতুন যুগে এনে দাঁড় করিয়েছে আমাদের- তা আগাগোড়া সিগনেটের স্বাক্ষরে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।’
অভিনব নানা রকম পরিকল্পনা ডি কে–র চিন্তায় সর্বদা ঘুরপাক খেত। কলেজ স্ট্রিট আর রাসবিহারী এভিনিউতে সিগনেটের দুটো দোকানেই পনেরো দিন পর পর পালটে যেত পুস্তকসজ্জা। কখনও লেখকদের ফটোগ্রাফ, কখনও পেইন্টিংস, কখনও বা শৌখিন ফুলদানি। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন উপলক্ষে পনেরো দিনের ‘কবিপক্ষ’ শব্দটির জন্য বাঙালি ঋণী হয়ে থাকবে ডি কে–র কাছে। ওই পক্ষে সিগনেট কাউন্টার সাজানো হত সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ দাশ এবং অমিয় চক্রবর্তীর ফটোগ্রাফ দিয়ে।
যে বছর অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘পরমপুরুষ’ বেরলো, গোটা দোকানটাকে সিল্কের দামি নামাবলি দিয়ে মুড়ে দেওয়া হত। বুক–সেলফে প্রতিটি বইয়ের ফাঁকে ফাঁকে কাগজের লাল জবা। ‘পরমাপ্রকৃতি শ্রীশ্রীসারদামণি’ প্রকাশিত হলে দোকান সাজানো হয়েছিল পুরানো আমলের কাঠের তৈরি লম্বা সিঁদুর কৌটো, শাঁখা আর লাল রুলি দিয়ে। আর যে বারে আবু সইয়দ আইয়ুব সম্পাদিত ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’ এল, প্রত্যেককে, দোকানে ঢুকলেই, উপহার দেওয়া হয়েছিল একটি করে কাগজের গোলাপফুল। তাতে সত্যিকারের গোলাপের গন্ধ। কলেজ স্ট্রিটের দোকান থেকে ওই রকম একটা গোলাপ পেয়ে শিবরাম চক্রবর্তী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ‘‘কী মুশকিল বলো তো, এমন গোলাপটি উপহার দেবার জন্য আমি তেমন সুন্দরী মেয়ে খুঁজে পাই কোথায়?’’
এসবের সঙ্গে যুক্ত হল ডি কে পরিকল্পিত এবং নরেশ গুহ রূপায়িত ‘টুকরো কথা’। সাহিত্যের ইতিহাসে এমন একটি সংকলন এর আগে বা পরে আর কখনও হয়েছে কিনা গবেষণা সাপেক্ষ। পূর্ণেন্দু পত্রী তাঁর গুরুত্বকে বুঝিয়ে দিয়েছেন ঠিক এই ভাবে: ‘টুকরো কথা চালু হ’লো যখন, সিগনেট বুক শপ হয়ে উঠলো বাংলা সংস্কৃতির কেন্দ্র। ...বাংলাদেশে এক নজিরবিহীন ঘটনা।’
১৯৫৪ সালে কলেজ স্কোয়ারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে ডি কে যে কবিসম্মেলনটির আয়োজন করেছিলেন, সেটিই বঙ্গদেশে প্রথম কবিতা পাঠের আসর নয় কি? পাঁচ হাজার লোক ধরত ওই হলে। কবিতা শুনতে আসবে নাকি অত লোক! অথচ শেষ পর্যন্ত হলের বাইরে ট্রামরাস্তা পর্যন্ত ভিড় জমে গেল। অনুষ্ঠানের কয়েক দিন অাগে রীতিমত রিহার্সাল দিতে হয়েছিল। ডি কে–র স্পষ্ট বক্তব্য: ‘কবিতা–পাঠও একটা আলাদা শিল্প এবং লোক ডেকে এনে যেমন–তেমন ভাবে কবিতা শুনিয়ে দেওয়া অন্যায়।’ সেই কবিসম্মেলনের প্রথম দিন জীবনানন্দ দাশ পড়েছিলেন পর পর আটটি কবিতা, কাউকে অনুরোধ করার সুযোগ পর্যন্ত দেননি; ঝড়ের বেগে কবিতাগুলো পড়ে হঠাৎ থেমে গেলেন। তার পর শ্রোতাদের শত অনুরোধেও আর কর্ণপাত না করে হঠাৎ প্রস্থান।
ডি কে বর্ষাকালটাকে খুব ভালবাসতেন। কবি, বিরহী অথবা ময়ূর যে–কারণে ভালবাসে, সে–কারণে নয়। বর্ষাকালে অ্যানটিক কাগজ সেঁতিয়ে থাকে কিছুটা, ফলে ছাপার সময় কালিটা জমে ভাল। ডি কে বলতেন, কবিতার বই ছাপার পক্ষে এটাই হল উপযুক্ত সময়। ছাপাছাপির বিষয়ে সাংঘাতিক গোঁয়ার ছিলেন তিনি। যে কাগজে ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’–র প্রথম কিছু সংস্করণ ছাপা হয়েছিল, বাজারে সেই কাগজ নেই বলে বছরের পর বছর বইটা ছাপেননি। অথচ তিনি জানতেন, ছাপা হলে পাঁচ হাজার বিক্রি হয়ে যেত এক মাসে। ডি কে প্রসঙ্গে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ‘‘আধুনিক কবিদের এত বড় শুভার্থী আর হবে না। আর্থিক ক্ষতির কথা না ভেবেই সিগনেটের পক্ষ থেকে একের পর এক কবিতার বই প্রকাশ করেছেন।’’
কল্লোল–যুগের দুই দিকপাল দিলীপকুমারের গৃহশিক্ষক ছিলেন। প্রথম জন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। চাকরি পেয়ে দূরে চলে যেতে হবে, টিউশনিটা দিয়ে গেলেন বুদ্ধদেব বসুকে। তিনি তখন লেখক–জীবন কাটাবেন বলে ঢাকা থেকে সদ্য কলকাতায় এসেছেন। রামময় রোড, সেখানেই পিতৃহীন দিলীপের মামার বাড়ি। ডাকনাম খোকন। বুদ্ধদেব বসু সেই নামেই অভ্যস্থ হয়ে গেলেন: ‘‘খুবই সজীব ও সপ্রিতভ ছেলে খোকন বয়সোচিত ভাবে সিনেমা মুগ্ধ, ছবি তোলে ক্যামেরায়, মোটর গাড়ির চেহারা দেখে নির্মাতার নাম বলতে পারে।’’ একদিন বুদ্ধদেব খোকনের রচনার খাতা খুলে দেখেন অন্তমিলে লেখা রয়েছে দুটি লাইন: ‘শুক্রবার এম্পায়ারে ‘ট্রপিক অব ক্যানসার’ ও /শনিবার গ্লোব সিনেমায় ‘ইস্ট অব বোর্নিও।’ শিক্ষকমশাই এর পর প্রিয় ছাত্রের দু-একটি গল্প ‘রামধনু’ পত্রিকায় ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। ডি কে-র কলেজের সহপাঠী অচুৎ বসু লিখেছেন: ‘দিলীপ প্রায়ই আমাকে লম্বা–লম্বা চিঠি লিখতো, আর একখানা পত্রিকা ছাপিয়ে বার করবার ইচ্ছা প্রকাশ করত...’
পত্রিকা করার এই ‘ইচ্ছে’ ডি কে নানা ভাবে ফলপ্রসূ করেছেন। ‘খেয়ালী’ নামে একটি চলচ্চিত্র পত্রিকা করেছিলেন। সত্যজিৎ যখন ‘পথের পাঁচালী’ তুলছেন, বাঙালি দর্শকের আগাম রুচি নির্মাণের তাগিদে প্রকাশ করলেন ‘চলচ্চিত্র’ পত্রিকা। সত্যজিৎ ছাড়াও সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলেন কমলকুমার মজুমদার, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, নরেশ গুহ। আবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন: ‘তাঁর প্ররোচনা বা পরিকল্পনায় আমরা প্রকাশ করি কবিতার পত্রিকা ‘কৃত্তিবাস’। যেমন তেমন ভাবে কিছু রচনা ছাপিয়ে মলাটে মুড়ে বাজারে ছাড়ার নাম যে পত্রিকা সম্পাদনা বা প্রকাশ করা নয়, একথা তিনি বুঝিয়েছিলেন আমাদের।’ অমরেন্দ্র চক্রবর্তী তাঁর ‘কবিতা পরিচয়’ পত্রিকার জন্য বিজ্ঞাপন চাইতে গিয়েছিলেন ডি কে–র কাছে। তার পর? ‘‘...এক জাঁদরেল পাবলিসিটি ম্যানেজারের ঘরে বিজ্ঞাপন আনতে গেলাম, আর আমার ফেরা হলো না। আট মাস পর বেরিয়ে এলাম বটে, কিন্তু তত দিনে আমরা ‘সারস্বত’ পত্রিকার জল্পনা–কল্পনার মধ্যে ঢুকে পড়েছি। তাঁর বয়স তখন পঞ্চাশ, আমার পঁচিশ–টচিশ।’’ সুনীল–শক্তির ‘কৃত্তিবাস’–এর প্রথম দিকের অনেকগুলো সংখ্যার জন্য কাগজ কিনে দিয়েছিলেন ডি কে। কমলকুমার মজুমদারের ‘তদন্ত’ নামের গোয়েন্দা পত্রিকার পিছনে তিনিই ছিলেন সব চেয়ে বড় মূলধন। বিমল রায়চৌধুরী ‘দৈনিক কবিতা’ বার করছেন শুনে ডি কে খুব খুশি। পূর্ণেন্দু পত্রীর বয়ান অনুসারে: ‘‘সেই ‘দৈনিক কবিতা’ যখন মাসিক হলো, তার প্রচ্ছদপটের দায়িত্ব নিলেন ডি কে। আমাকে হুকুম দিলেন, দারুণ করে এঁকে দিন। সে বারে বিমলের কাগজই ম্যাগাজিন বিভাগে ‘মার্গ’–কে হারিয়ে প্রাইজ পেলো।’’
বুদ্ধদেব–প্রতিভার বিবাহ হল, দিলীপ গুপ্তর মা নববধূকে ‘জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ’ বলে বরণ করলেন, অথচ ‘খোকন’কে প্রতিভা দেখতে পান না। দুই বাড়ির লোকেদের মধ্যে অবাধ যাতায়াত, যোগাযোগ, শুধু খোকনের চেহারাটি দেখা হয়ে ওঠে না প্রতিভা বসুর। এই ভাবে কেটে গেল বছর পাঁচ! এক সন্ধেয় দরজায় টোকা শুনে প্রতিভা দরজা খুলে দেখেন এক বিশালাকায় পুরুষ। প্রতিভাকে দেখে তাঁর সহাস্য প্রশ্ন: ‘‘আপনিই হচ্ছেন বউদি, বলুন ঠিক কিনা? কিন্তু এত রোগা কেন? ওভালটিন খান না?’’ খোকন ওরফে দিলীপকুমার নিজের বিশাল চেহারার সমস্ত কৃতিত্ব ওভালটিনকে দিয়ে পরামর্শ দিলেন: ‘‘নিজে খাবেন, স্বামীকে খাওয়াবেন, বাচ্চাদের খাওয়াবেন, ধরে ধরে কাজের লোকদেরও খাইয়ে দেবেন।’’ দুই–এক দিনের মধ্যেই ‘কবিতাভবন’–এ ওভালটিনের প্রবেশ: ‘‘...সেটা এসে গেল সকালের চায়ের টেবিলে। কন্যা ওভালটিন খেল, কাজের লোকেরা ওভালটিন খেল, আমিও সলজ্জ ভঙ্গিতে আস্বাদ গ্রহণ করলুম, শুধু বুদ্ধদেবকেই দীক্ষিত করা গেল না।’’
সিগনেট প্রেসের অফিস ঘরে বসে যাঁরাই কাজ করেছেন তাঁদের জন্য দামি সিগারেটের টিন সাজানো থাকত টেবিলের উপর। সুভাষ মুখোপাধ্যায় কাজ করতেন না, কিন্তু তিনি যে সিগনেট থেকে ফিরছেন তা বোঝা যেত তাঁর পাতলা পাঞ্জাবির পকেট দেখেই। সেখানে উঁকি মারত গোটা চারেক দামি সিগারেট। অতিথি আপ্যায়নে উত্তম খাদ্য আর সুগন্ধী চা– সিগনেটের ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছিল। সমরেশ বসু প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’–এর জন্য ডি কে–র কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন দুই খণ্ড ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’ আর একটি জার্মান কলম। উৎসব অনুষ্ঠানে ডি কে খুব একটা যেতেন না, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বউভাতের অনুষ্ঠানেও যাননি, কিন্তু নববধূকে উপহার পাঠিয়েছিলেন ক্ষীরের তৈরি এক কেজি ওজনের একটি মাছ, একটি কড়ি বসানো লাল লক্ষ্মীর ঝাঁপি, তার মধ্যে একটি রূপোর টাকা এবং একটি সোনালি মলাটের ‘বাংলার ব্রতকথা’।
ডি কে-র জন্ম ১৮ এপ্রিল ১৯১৮। ষাট পূর্ণ হওয়ার আগেই লোকান্তরিত হয়েছিলেন তিনি। ঠিক চার দশক আগে। চলে গেছেন পরিবারের আরও অনেকেই। বাবার স্মৃতি নিয়ে একটি বই লিখেছেন বড় মেয়ে ইন্দ্রাণী দত্ত— ‘অা ক্যালকাটা পাবলিশার’স ডটার’। সেখানে কিছুটা অভিমান আছে। তবু খুব ছোটবেলায় ডি কে-র লন্ডন ভ্রমণের সময় সেখান থেকে অজস্র খেলনা পাঠানো, ভাই–বোনদের নিয়ে মোটরগাড়িতে চড়ে বাবার সঙ্গে কলকাতা ভ্রমণ কিংবা চিড়িয়াখানা, সার্কাস, বিশেষ করে গঙ্গার ধারে জাহাজ দেখতে যাওয়ার স্মৃতি আজও সোনালি রূপকথার মতো দু’চোখে লেগে আছে ইন্দ্রাণীর।
তবে সে সব যে আজ নিছকই ধূসর, বিবর্ণ অতীত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তা না হলে এমন কিংবদন্তী প্রকাশকের শতবর্ষ এইভাবে এত উপেক্ষায় অতিক্রান্ত হয়?