ছবি: রৌদ্র মিত্র
অর্ধশতক আগের এক মহালয়ার ভোরে গঙ্গার তীরে তর্পণাদি সমাপনের পর শীতলাকান্ত ভট্টাচার্য যজমানকে একটি সুসংবাদ দিয়েছিলেন। সঙ্গে লেটারপ্রেসে ছাপা হলুদ হ্যান্ডবিল। তিনি সপ্তাহখানেক আগে কাকভোর-স্বপ্নে ক্যানসারের ওষুধ পেয়েছেন। স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী আবিষ্কারও করে ফেলেছেন কর্কটদলনী চূর্ণ আর কর্কটারি মলম। হ্যান্ডবিলে সে সবই ছাপা। পরবর্তী বছরখানেক সব যজমান-বাড়িতেই শালগ্রাম শিলার পাশাপাশি এক গোছা হলুদ হ্যান্ডবিল নিয়েই পুজো করতে যেতেন শীতলাকান্ত। দুর্ঘটনাচক্রে শীতলাকান্ত ক্যানসারেই প্রয়াত হন। উত্তর-শীতলাকান্ত পর্বে হ্যান্ডবিলগুলির কী গতি হয়েছিল, জানা যায় না।
সম্ভবত স্বপ্নেই করোনার ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন ভারতখ্যাত যোগগুরু। গোমূত্রপানের নিদানের পাশাপাশি বিঘোষণা হয়েছিল, ‘করোনিল’ এবং ‘শ্বাসরি’ নামের সেই মহৌষধ করোনা সারিয়ে তুলবে মাত্র সাত দিনে। একই ভাবে গ্রহশান্তির দায়িত্বপ্রাপ্ত টিভি চ্যানেলগুলিরও দাবি, অমুক রতির তমুক পাথর ধারণে করোনা কুপোকাত হবে।
করোনা-ভ্যাকসিনের স্বপ্ন দেখছেন রাষ্ট্রনায়করাও। তাঁরা অবশ্য সরাসরি গবেষণায় যুক্ত নন। কিন্তু স্বপ্ন দেখছেন এবং হুকুম করছেন। কারণ, হুকুম করাই হবুচান্দ্রেয় ক্রিয়া। তাঁরা সময় বেঁধে দিচ্ছেন বিজ্ঞানীদের। যেন ভ্যাকসিন নাবালকের হাতের মোয়া। যেন গাছে দোদুল্যমান আতাফল, শুধু তোতার ঠুকরে নেওয়ার অপেক্ষা! রাষ্ট্রনায়কদের এই তাড়ার কারণও আছে। রোগভোগ, ভয় এবং বিশ্বাস সব সময়ই পালতোলা বাণিজ্যপোতের মতো লক্ষ্মীমন্ত। সুযোগ পেলেই বাজার তৈরি করে।
বাজার তৈরি হওয়ারই কথা। কারণ, করোনা যে-সে রোগ নয়। দাদ-হাজা-চুলকানির মনোরম মলম বাজার গড়তে পারলে করোনা পারবে না? বিলক্ষণ পেরেছে। যে ভ্যাকসিন আবিষ্কারই হয়নি, তার সূচ বাজারে চলে এসেছে। বেদনাবিহীন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নিডল। সঙ্গে মাস্ক-স্যানিটাইজ়ার তো আছেই। যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব! রণদুন্দুভি বাজিয়েছেন রাষ্ট্রনায়কেরা। সেই করোনার মুখেভাতের সময় থালা বাজিয়ে, প্রদীপ জ্বালিয়ে শুরু। পরে আরও কত মন-কি-বাত! ‘পুজোয় চাই নতুন মাস্ক’ ক্যাচলাইন এল বলে! পোশাকের সঙ্গে ‘ম্যাচ’ করে মাস্ক! আজ ক-জাতীয় মাস্ক সর্বোত্তম বিবেচিত, তো কাল খ-জাতীয় মাস্ক মহিমময়। সে সব মাস্ক এতই দৈবগুণসম্পন্ন যে, গোটা মুখে পরতেও হয় না। দুলের মতো কানে ঝোলালে, বকলসের মতো গলায় বাঁধলে, রুমালের মতো হাতে রাখলেই অবিশ্বাস্য সুফল। বন্যা বইছে স্যানিটাইজ়ারেরও। পাড়ার তাস-পেটানো ক্লাবও উত্তমগুণসম্পন্ন স্যানিটাইজ়ার প্রস্তুত করছে। রতনের বাগানের পুঁইশাকের মতো পাড়ার ঘরে ঘরে তা ছড়িয়ে পড়ছে সস্তায়। গ্রাম-গ্রামান্তে ধর্মপ্রাণ জনগণ তা গঙ্গাজলের মতো হাতে ছিটিয়ে পবিত্র আচমন সারছেন। শহরে বিকোচ্ছে দামি স্যানিটাইজ়ার, ডিসইনফেকট্যান্ট। শুরুর দিন থেকেই সে সব আবার ৯৯.৯ শতাংশ জীবাণু মারতে সক্ষম। বাকি দশমিক এক শতাংশ অক্ষমতাজনিত সততার সুবাদে বাজার তাদের ঝিঙ্কাচিকা। আর নির্মাণ করে তোলা এই আবহের মধ্যেই লকডাউন পেরিয়ে আনলক। অ্যাবনর্মাল পেরিয়ে নিউ-নর্মাল। আতঙ্ক পেরিয়ে হাটবাজারের খোলা দখিনদুয়ার। বন্দিদশা পেরিয়ে শপিং মল, সিনেমা-থিয়েটার, শারদোৎসব। সংস্কৃতিরক্ষা জরুরিও। মাথা খাটিয়ে বার করা শব্দবন্ধ বটে এই ‘নিউ-নর্মাল’! যেন কিছুই হয়নি!
হবুচন্দ্রের আদেশে নানা নিদান বার করেছিলেন গবুচন্দ্রেরা। ‘মলিন ধুলা লাগিবে কেন পায়/ধরণিমাঝে চরণ-ফেলা মাত্র?’ সনির্দেশ প্রশ্ন মহারাজের। ‘শীঘ্র এর করিবে প্রতিকার’— উপায় খুঁজতে গিয়ে ঘুম ছুটল সবার। গবু তবু বললেন, ‘যদি না ধুলা লাগিবে তব পায়ে/পায়ের ধুলা পাইব কী উপায়ে?’ বিজ্ঞানীরাও বলেছেন নিশ্চয়ই— ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি বুঝে নিতে সময় চাই, জাঁহাপন! প্রতিষেধক, প্রতিরোধ আর পলিটিক্স শুধুমাত্র ‘প’ বর্ণজাত বলেই এক নয়, লর্ডশিপ! লাভ হয়নি। ‘লগ্ন’ মহারাজের হাতে, তাই নির্ধারিত। রাজযুক্তি অকাট্যও। গবুচন্দ্রের ‘পদধূলির তত্ত্ব’ উড়িয়ে হবুচন্দ্র বলেছেন, ‘ধুলা-অভাবে না পেলে পদধুলা/তোমরা সবে মাহিনা খাও মিথ্যে/কেন বা তবে পুষিনু এতগুলা/উপাধি-ধরা বৈজ্ঞানিক ভৃত্যে?’
নবরত্নসভায় সব রত্নই রাজার ভৃত্য। বিজ্ঞানীও। তাই উনিশ পিপে নস্য ফুরোয়। সাড়ে সতেরো লক্ষ ঝাঁটা কেনা হয়। সম্মার্জনী-চালনায় ‘করিতে ধুলা দূর/জগৎ হল ধুলায় ভরপুর!’ তখন পিপে পিপে জল। ‘মশক কাঁখে একুশ লাখ ভিস্তি’! ‘সর্দিজ্বরে উজাড় হল দেশটা’! করোনা-ক্যারিশমা থামাতে হাত ধুতে ধুতে হাজা!
ঘাড়ে ঠেকানো অদৃশ্য অস্ত্র। হীরকরাজার দেশে কাজ করে চলেছেন গবেষক গবুচন্দ্র জ্ঞানতীর্থ জ্ঞানরত্ন জ্ঞানাম্বুধি জ্ঞানচূড়ামণি এ কে এ বিজ্ঞানী। গোটা দেশ চামড়ায় ঢেকে দিলে রাজার পায়ে ধুলো লাগবে না, এই অনিন্দিত ভাবনায় জোরকদমে কাজ শুরু। কিন্তু অত চামড়া কোথায়! তেমনই এখন বিশ্বজুড়ে চলছে হাঙর খোঁজা। হাঙরের যকৃতে আছে স্কুয়ালিন তেল, যা ওষুধকে চাঙ্গা করে। করোনা ভ্যাকসিনেও স্কুয়ালিন রাখতে হবে। বিশ্বজোড়া করোনা-রোগীকে দু’ডোজ় করে ভ্যাকসিন দিতে হলেই পাঁচ-ছ’লক্ষ হাঙর মারতে হবে। কিন্তু হাঙর তো হাতেগোনা। তা হলে! লগ্ন যে নির্ধারিত!
মনুর টীকাকারেরাও এত সমস্যায় পড়েননি, যতটা পড়তে হচ্ছে করোনার টিকাকারেদের। মাথায় রাখতে হচ্ছে, কোন টিকা মানবতাবাদী, কোন টিকা পরিবেশবান্ধব, কোন টিকা বাজারবৎসল, কোন টিকা ভোটপ্রদায়ী, কোন টিকা কূটনীতিবাগীশ, কোন টিকা শাস্ত্রসম্মত। গুচ্ছ দেশ গবেষণার মহড়ায়। মহলাকক্ষ থেকে ভেসে আসছে নানা সংলাপ। এক রাষ্ট্র বলছে, আবিষ্কার করে ফেলেছে। আর এক রাষ্ট্র আবিষ্কারের আগাম সাল-তারিখ ঘোষণা করে দিচ্ছে। যেমন, গুঞ্জন ছিল ভারতেও। ১৫ অগস্ট নাকি করোনার টিকা বাজারে আসবে। হই-রই কাণ্ড। চিন প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ত্রাতার ভূমিকায় অবতরণকামী। শোনা যাচ্ছে, নিরীক্ষার আগেই নাকি মানবদেহে গণহারে টিকা প্রয়োগ করছে গণপ্রজাতন্ত্রী। ডোনাল্ড ট্রাম্প চাইছেন ভ্যাকসিনে ভোট-বৈতরণি পেরতে এবং অস্ত্রের পাশাপাশি টিকা-ব্যবসায় নামতে। রাশিয়াও বিশ্বযুদ্ধকালীন শাক্ত পদাবলির পুনরুজ্জীবনের স্বপ্নে। ব্রিটেন ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে অক্সফোর্ডের পানে। বিশ্ব জুড়ে বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত শ্রমের মধ্যেই অবশ্য সারা হয়ে গিয়েছে কালনেমিদের লঙ্কাভাগও। ধরাশায়ী লক্ষ্মণের জন্য হনুমান বিশল্যকরণীর সন্ধান করছেন জেনে রাবণ, মামা কালনেমিকে বললেন, হনুমানকে মারতে পারলেই অর্ধেক লঙ্কা তাঁর। কালনেমি তখন লঙ্কার কোন অংশটি নেবেন, তা নিয়ে থিসিস লিখে ফেললেন। যদিও আনন্দরসচিন্তামগ্ন কালনেমিকে পবনপুত্র ছুড়ে ফেলে দিলেন। কালনেমি পতিত রাবণের আসনতলে। স্বপ্ন চুরমার। তেমনই ভ্যাকসিন কত-বাঁওয়ে না জানলেও লঙ্কাভাগ সেরে রেখেছে রাষ্ট্রগুলিও। কোন দেশ কোন দেশের ভ্যাকসিন নেবে বা সেই ফর্মুলা ব্যবহার করবে, কোন দাদা-দেশ কোন ভাই-দেশকে ভ্যাকসিন দেবে, তেল-বাণিজ্যের ক্ষয় ভ্যাকসিনে মেটানোর জন্য কোন দেশকে করিডর করা যাবে— সব স্থির হয়ে গিয়েছে। শুধু ভ্যাকসিন আসার অপেক্ষা! জীবজগতে যেমন দেখা যায়। সিংহ বা বাঘ হরিণ ধরে হিঁচড়ে টেনে আনছে আর খানিক দূরে শিয়ালের দল ঘুরঘুর করতে করতে ভাবছে, হরিণের কোন অংশটি খাবে। শেষ পর্যন্ত উচ্ছিষ্ট হাড়-চামড়াই মিলবে। স্বপন তবু মধুর এমন!
চাপে করোনাভাইরাসও। বুঝে উঠতে পারছে না, সময়টা ঠিক বাছা হয়েছে কি না! করোনাভাইরাসের যে অংশ ট্রাম্প-বিরোধী, তারা মনে করছে, আমেরিকার নির্বাচনের পরেই আসা উচিত ছিল। তা হলে হয়তো তাদের ন-হন্যতে ভাবটা অসম্মানিত হত না। কারণ, তাদের চ্যালেঞ্জ তো বিজ্ঞানীদের প্রতি, কিন্তু ক্ষীর খেতে চাইছেন রাজা-উজিরেরা! করোনাভাইরাসের একাংশ ভারত নিয়েও ভাবিত। আসন্ন বিধানসভা ভোটে তাদের কী করণীয়, বুঝে উঠতে পারছে না। থালাবাদ্যে হাফ-করোনা গায়েব। এ বার ইভিএম-বাদনে ফুল-করোনা হাওয়া!
ভারত নিয়ে অবশ্য বাড়তি চিন্তা নেই। ভ্যাকসিন আবিষ্কার হওয়া আর না-হওয়ায় কার্যত যায়-আসে না এ দেশে। কারণ, ভারতে স্বাস্থ্য পরিষেবা এতটাই মজবুত যে, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টিটেনাস ভ্যাকসিনও মেলে না। কিন্তু উত্তেজনার একটা গুরুত্ব আছে। প্রতীক্ষার আছে মোহনমায়া। এই যে রোজনামচার পরিসংখ্যানে কত আক্রান্ত, কত মৃত, কত সুস্থ জাতীয় হিসেব মুখস্থ করার নেশা, এর মধ্যে বিশ্বজনীন হয়ে ওঠার মহত্ত্ব আছে। কলেরা বা ডেঙ্গুতে ঢের বেশি মরলেও নতুন রোগের আলাদা আকর্ষণ। চায়ের দোকানে করোনা নিয়ে আদানপ্রদান। টিভি সিরিয়ালে করোনা ঢুকেছে। করোনা মোবাইল-গেম এল বলে। লকডাউনে বাড়িতে বসে ইউটিউব খুলে যাঁরা নানা খাদ্যপদ বানাতে শিখে গিয়েছেন, তাঁরা ভাবছেন, ভ্যাকসিনটাও বানিয়ে ফেলবেন। সহজ মাসিক কিস্তিতে করোনা ভ্যাকসিন কেনার প্রকল্প নিশ্চিত ভাবিত হচ্ছে। আবিষ্কার যখন হবে হবে, জিরো পার্সেন্ট সুদে আগাম বুকিং শুরু হল বলে।
তরুণ মজুমদারের ‘কুহেলি’ ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে লতা মঙ্গেশকরের একটি গান আছে— ‘…আসছে, সে আসছে’। মুহূর্তে গা-ছমছমে ভাব তৈরি করে দেয়। তেমনই একটা ভ্যাকসিন-ভ্যাকসিন পরিবেশ তৈরি হয়ে গিয়েছে। হয়তো ও-দেশে প্রেসিডেন্ট-ভোটের বিতর্কে, এ-দেশে প্রধানমন্ত্রীর আশাবরী ভাষণে। নিউ-নর্মাল আবহে সব বদলে যাচ্ছে। আরও বদলাবে। বিজ্ঞাপনে লেখা হবে— ‘করোনাহীন মনোরম পরিবেশে ফ্ল্যাট’। বাসে কুমতলবে গায়ে পড়লেই শুনতে হবে— ‘বাড়িতে অক্সিমিটার-নেবুলাইজ়ার নেই!’ লোকাল ট্রেনে শুকনো কাশলেই ‘পাঁড় করোনা কোথাকার’ বলে পরের স্টেশনে নামিয়ে দেওয়া হবে। বিমানসেবিকা বলবেন— ‘করোনায়িত যাত্রীরা শ্বাসকষ্ট হলে এই ভাবে শ্বাস নেবেন এবং আসনের সারির মধ্যবর্তী স্থানে লাল শালু পেতে পাঁচ মিনিট কপালভাতি করবেন। সচিত্র পদ্ধতি আপনার আসনের সামনে এবং শালু আসনের ডান দিকে’। নাইট্যকলা আরও ছড়ালে হয়তো সদ্যোজাত পুত্রের নাম রাখা হবে ‘করোনাসূদন’, কন্যার নাম ‘করোনারি’। বাংলা ছবির নতুন গান হবে— ‘খোকাবাবু যায়, লাল মাস্কায়...’। পিএইচ ডি-র বিষয় হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব পাবে ‘রবীন্দ্রনাথ, কবিরাজি ও করোনা’ গোছের ভাবনা।
প্রথম সারির মেডিক্যাল জার্নাল ‘দ্য ল্যানসেট’ অতিরিক্ত আশাবাদের জন্য বকে দিয়েছে ভারতকে। ভ্যাকসিন নিয়ে ইঁদুরদৌড় বিষয় হয়ে উঠেছে এইচবিও সিরিজের, যার উপজীব্য ব্রেন্ডান বরেলের গ্রন্থ ‘দ্য ফার্স্ট শট’। বহু করোনা টিকার নিরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে এবং তিন শতক আগে এইচআইভি ভাইরাস শনাক্ত করা গেলেও আজও তার টিকা অধরা। তবু করোনা-ভ্যাকসিনের জন্য প্রতীক্ষা থাকবেই। ‘ওয়েটিং ফর গোডো’র মতো হলেও থাকবে। কারণ, মৃত্যুভয়ের পাশাপাশি করোনা বদলে দিয়েছে মানুষের লাভস্টোরিও। ‘চুম্বন’ শব্দটি অর্থ হারিয়েছে। অতীত চুম্বনের স্মৃতি রোমন্থনে বা নেটফ্লিক্সে মিলন দেখে কি আর পিরিতি বাঁচে! কল্পনা করতে সাধ হয়, কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো বাজারে কনট্রাসেপটিভের মতো চুম্বন-সহায়ক এবং ড্রপলেট-নিরোধক অধরাবরণ এসে যাবে। চটুল একটি জোক আছে। এক শিশু দিদার কাছে জানতে চেয়েছে, ‘আমি কী করে হলাম?’ দিদার উত্তর, ‘তোমার মা আর বাবা এক রাতে সাদা চাদর পেতে ঘুমোলেন আর তুমি হয়ে গেলে!’ শিশু আবার প্রশ্ন করল, ‘তুমি কী করে হলে?’ দিদার উত্তর, ‘আমার বাবা আর মা সাদা চাদরে শুলেন আর আমি হয়ে গেলাম!’ শিশুটি তবু বুঝে উঠতে পারছে না। আরও অনেকের নাম করে জানতে চাইল, তারা কী করে হল। উত্তর সেই সাদা চাদর। শুনেটুনে চিন্তিত শিশু অন্যমনস্ক ভাবে বলল, ‘দেশ থেকে কি সঙ্গম উঠে গেল!’ শিশুটি অবশ্য সঙ্গমকে চলতি অবভাষাতেই উল্লেখ করেছিল। কিন্তু ব্যাপারটি প্রায় একই। বিশ্ব থেকে স্বাভাবিক সম্পর্ক, প্রেম, যৌনতা সব কার্যত উঠে গিয়েছে। সে জায়গা থেকেও তো ভ্যাকসিনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। হবুচন্দ্র-গবুচন্দ্রেরা তা নিয়ে ভাবছেন কি না, বলে যাননি রবীন্দ্রনাথ।
ভ্যাকসিন চাই। কিন্তু তাকে ঘিরে অকারণ বীররস কাঙ্ক্ষিত নয়। চিন্তা আরও একটি বিষয়ে, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পর তা প্রয়োগ করার পরিকাঠামো লাগবে না? এবং একাধিক ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হলে পরিস্থিতি কেমন হবে? মানবিক কারণে তো সব রাষ্ট্র কূটনীতির উর্দি ছেড়ে এক সঙ্গে কাজ করতে পারত! কী হবে চিকিৎসা-বিভ্রাট হলে? পরশুরামের ‘চিকিৎসা-সঙ্কট’ গল্পে হগসাহেবের বাজার থেকে বাড়ি ফেরার সময় ট্রাম থেকে নামতে গিয়ে পড়ে যান নন্দবাবু। তবে তাঁর ‘কিছুমাত্র চোট লাগে নাই’। কিন্তু বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলেন, নন্দবাবুর শরীর কাহিল। তাঁরা কেউ অ্যালোপ্যাথ, কেউ হোমিওপ্যাথ, কেউ কবিরাজ, কেউ হাকিম দেখানোর পরামর্শ দিলেন। নন্দবাবু একে একে সবাইকেই দেখালেন। অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার তরফদার বললেন, ‘সেরিব্রাল টিউমার উইথ স্ট্র্যাঙ্গুলেটেড গ্যাংলিয়া’, মাথায় ‘শর্ট-সার্কিট’ হয়ে গিয়েছে, ‘খুলি ফুটো করে অস্ত্র করতে হবে’। হোমিওপ্যাথ নেপাল ডাক্তার বললেন, ‘আগে শরীর থেকে অ্যালোপ্যাথিক বিষ তাড়াতে হবে’। তারিণী কবিরাজ রোগীর কী কী সমস্যা, নিজেই সিদ্ধান্ত করে বললেন, এ সবই হয়, ‘zানতি পার না’। ‘জিয়ন্ত’ ওযুধ দিয়ে ব্যারামটি আবিষ্কার করলেন, ‘যারে কয় উদুরি। ঊর্ধ্বশ্লেষ্মাও কইতি পার।’ এবং হাজিক-উল-মুল্ক্ বিন লোকমান নুরুল্লা গজন ফরুল্লা অল হকিম য়ুনানি নামের হাকিম নন্দবাবুর ব্রহ্মতালুর দু’ইঞ্চি ‘সমচতুষ্কোণ কামাইয়া’ সেখানে ‘বব্বরী সিংগির মাথার ঘি’ লেপে দিলেন। কারণ, মাথার হাড় ‘পিল্পিলায় গয়া’। মানে, নরম হয়ে গিয়েছে। নন্দবাবুকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করেছিলেন লেডি ডাক্তার বিপুলা মল্লিক। তাঁকে বিয়ে করে।
সবার আগে খুব জরুরি ওই ‘হিউমেন টাচ’টাই। তার চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। টিকা আবিষ্কার এবং তার সফল প্রয়োগ সবই সম্ভব হবে। কোনও এক দেশ হয়তো আগে করবে। অন্য সব দেশের গবুচন্দ্রেরাও বলবেন, ‘আমারও ছিল মনে/কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে’। কিন্তু সেই উক্তিতেও প্রচ্ছন্ন থাকবে অমানবিকতাই।
ছবি: রৌদ্র মিত্র