Rivers

রাগী নদীর অভিশাপ

কারও জল ছুঁলে দুর্ভাগ্য। কেউ রুষ্ট হলে অসুখবিসুখ। নানা উপচারে তুষ্ট করতে হয় তাকে। বহমান জলধারাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সভ্যতা, উৎপন্ন হয় শস্য। কিন্তু সবাই সর্বংসহা নয়।

Advertisement

সুপ্রতিম কর্মকার

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৪:২২
Share:

সন্ধ্যা নামছে পশ্চিম আকাশে। তাল গাছের ওপর বসে একটা কাক কর্কশ স্বরে খুব ডাকছে। অশুভ ইঙ্গিত। বার বার কানে হাত দিচ্ছিল সতীশের সত্তর বছরের নানি। তাঁর স্বামীর শ্বাস উঠেছে। শমন অপেক্ষারত দুয়ারে। কাকটা যেন সেই কথাই জানাচ্ছে। এমন করে আরও প্রহর কাটল। চাঁদবিহীন অমাবস্যার রাত। দূর আকাশের মিটিমিটি তারাগুলো যেন জোনাকি পোকা। এর মধ্যেই জোরে হেঁচকি। দেহের খাঁচা থেকে উড়ে গেল অচিন পাখি। স্বামীর শরীর জড়িয়ে অঝোরে কাঁদল নানি। তার পর নিজেকে সামলে নিয়ে আঠাশ বছরের সতীশের দিকে চেয়ে বললেন, “নানাজিকো লে যা বেটা।”

Advertisement

বুক দুরদুর করে উঠল সতীশের। ভয় শ্মশানকে নয়, যে নদী পেরিয়ে শ্মশানে যেতে হবে, তাকে। এ পারের গ্রামের মৃতদেহ নৌকোয় ফেলে নিয়ে যাওয়া হয় ও পারে। নৌকো পেতে সমস্যা নেই। কিন্তু নদীর জলের ছোঁয়া কারও গায়ে লাগলেই সর্বনাশ।

নদীর নাম কর্মনাশা। সর্বনাশের আর এক নাম। এমনই বিশ্বাস আজও ঘুরে বেড়ায় অশরীরীর মতো। বিহারের কৈমুর জেলা। গঙ্গার বুকের ভেসে আসা জলে সেও জলের জোগান দেয়। তাই সে গঙ্গার উপনদী। সারোদাগের ৩৫০ মিটার উঁচু কৈমুর পাহাড় থেকে নদীটার জন্ম। তার পর উত্তরপ্রদেশ ও বিহার সীমান্ত বরাবর বয়ে চলল তার ধারা। বাঁ দিকে সে ছুঁয়ে গেল উত্তরপ্রদেশের শোনভদ্রা, চাঁদুরিয়া, বারাণসী। আর বিহারের কৈমুর ও বক্সা জেলাকে ছুঁল ডান দিকে। ১৯২ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে কর্মনাশা মিশল গঙ্গার সঙ্গে। এই ভারতভূমিতে গঙ্গা মহত্ত্বে ও মাহাত্ম্যে পতিতপাবনী। কিন্তু কর্মনাশা তোয়া গঙ্গার বুকে জল ঢাললেও পবিত্র হয়ে উঠতে পারেনি মানুষের বিশ্বাসে। এই লোকবিশ্বাসের পেছনে রয়েছে এক লোকগাথা।

Advertisement

দ্বাপর যুগে রাজা হরিশ্চন্দ্রের পিতা সত্যব্রতর ইচ্ছে ছিল সশরীরে স্বর্গে যাবেন। এই বাসনা তিনি জানালেন গুরুদেব বশিষ্ঠকে। কিন্তু এই ব্যবস্থা করতে বশিষ্ঠ রাজি হলেন না। কিন্তু সত্যব্রতও ছাড়ার পাত্র নন, তিনি জুড়ে দিলেন তর্ক। শান্তস্বভাব বশিষ্ঠরও এক সময় ধৈর্যচ্যুতি হল। তিনি সত্যব্রতকে চণ্ডাল হওয়ার অভিশাপ দিলেন। অভিশপ্ত সত্যব্রত গেলেন বিশ্বামিত্রর কাছে। সত্যব্রত জানতেন, বিশ্বামিত্র ও বশিষ্ঠর শত্রুতার কথা। সত্যব্রত বিশ্বামিত্রর কাছে গিয়েই নিজের অভিলাষ যেমন জানালেন, তেমনই বশিষ্ঠ যে তাঁর ইচ্ছের মর্যাদা রাখেননি, সে কথাও জানিয়ে দিলেন। কিন্তু জানালেন না অভিশাপের কথা। বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠের নাম শুনে জ্বলে উঠলেন এবং বসলেন তপস্যায়। তপস্যাবলেই সত্যব্রতকে সশরীরে পৌঁছে দিলেন স্বর্গে।

এই ঘটনা মানতে পারলেন না দেবরাজ ইন্দ্র। তিনি রাজা সত্যব্রতকে পা উপরের দিকে তুলে মাথা উল্টো করে ঝুলিয়ে পৃথিবীতে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন। রাজার এই অবস্থা দেখে বিশ্বামিত্র তাঁর তপোবলে স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝখানে স্থির করিয়ে রাখলেন। এই অবস্থাতে রাজা সত্যব্রতর মুখ দিয়ে লালারস গড়াতে আরম্ভ করল। আর সেই রস প্রবল বেগে পড়তে আরম্ভ করল পৃথিবীর বুকে। আর সেই লালারস থেকেই তৈরি হল এই নদী। অভিশপ্ত চণ্ডাল রাজার লালারসের নদী হয়ে গেল এক অভিশাপের নদী, কর্মনাশা। এই জল কেউ স্পর্শ করে না। যে এই নদীর জল ভুলবশতও ছুঁয়ে ফেলে, তার জীবনেই নেমে আসে অভিশাপ। এই বিশ্বাস মানুষ এখনও মেনে নেয়। সমাজবিজ্ঞানীরা দেখেছেন, দুর্গাবতী, চন্দ্রপ্রভা, করোন্তি প্রভৃতি উপনদীদের নিয়ে ১১,৭০৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তন কর্মনাশা নদী অববাহিকার। অতীত কালে বর্ষার সময় কর্মনাশা নদী যখন কানায় কানায় ভরে উঠত, তখন সে বন্যা আনত। বন্যার জল নামতে দেরি হলে ফসল ঘরবাড়ি গৃহপালিত প্রাণীর ক্ষতি হয়, মারাও যায় অনেকে। তাই কোনও এক অতীতে মানুষের কাজকর্ম নাশ করে নদী হয়ে ওঠে কর্মনাশা। আর যখন বন্যা নেই, তখন তার স্পর্শেই অমোঘ দুর্ভাগ্য। যে সশরীরে স্বর্গে যেতে চেয়ে পারেনি, সে মরপৃথিবীর মানুষের ভাল চাইবে কেন! নৌকো পারাপারকারীরাও অতি সন্তর্পণে এড়িয়ে চলেন জলের স্পর্শ।

বাংলার নদীরাও অভিশাপ দেয়। দক্ষিণবঙ্গ ছাড়িয়ে চলুন উত্তরবঙ্গের দিকে, টোটোপাড়ায়। নৃতাত্ত্বিকরা টোটোদের বলেন, ‘পোর্টার ট্রাইব’ বা ভারবাহী জনজাতি। জুম-চাষ পদ্ধতিতে কৃষিকর্ম ছিল এই জনজাতির অন্যতম জীবিকা। নদী যেমন তাদের কাছে পথের কাজ করত, তেমনই নদীই হয়ে উঠত তাদের পথের কাঁটা, বিশেষ করে বর্ষার সময়। প্রবল বর্ষায় নদীর বুকে জল বাড়ত। আর সেই জলের বেগেই ধেয়ে আসত বড় বড় বোল্ডার। আবার যখন গরম কালে সূর্য তার তেজ বাড়াত, নদীর বুক শুকিয়ে যেত। পাহাড়ি নদীর ধর্মই এই। সে কখনও বন্যা, কখনও নদীর গতিপথ পরিবর্তন, আবার কখনও জল হীনতায় রুখাশুখা। আর এই কারণেই নদী তাদের পক্ষে স্থায়ী সুখের কারণ হয়ে উঠত না। টোটোপাড়ায় ছোট ছোট বেশ কয়েকটি নদী। টোটোদের বিশ্বাস, নদীরা প্রতিহিংসাপরায়ণ। প্রতিটি নদীই এক-একটি আত্মা। তারা রুষ্ট হলে মানুষের জীবনে আসে দুঃখ।

পাহাড়ি উপজাতির ভাষায় ‘তি’ মানে নদী। জি ‘তি’ ও তার পুত্র ‘মাবেই কন্যা-চেস-বেই’ রুষ্ট হলে সাধারণ অসুখ হয়। মাংসে ‘তি’ ও লেপা ‘তি’ রুষ্ট হলে স্ত্রীর প্রথম সন্তান জন্মের আগেই মারা যায়। গোয়া তি রুষ্ট হলে মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়। টুংকা তি রেগে গেলে মাথা ঘোরে। চুয়া তি রেগে গেলে পেটের অসুখ হয়। ডিপ তি ও দাতিং তি রেগে গেলে প্রবল জ্বর আসে। পানে তি ও উইদিং তি রেগে গেলে মানুষ পাগল হয়। আতপ চাল, মাখন, আদা ও মুরগি দিয়ে নদীকে পুজো দিলেই নদীর রাগ কমে। কোনও নদীর পুজোয় দিতে হয় মদ্য, কাউকে আবার পাঁচ রকম ফুল।

এই সব লোকবিশ্বাস মানুষকে মনে করায়, প্রকৃতি সব সময় সর্বংসহা নয়। তার অভিশাপ ও আশীর্বাদ দুই-ই মাথায় নিয়ে বয়ে চলে জনজীবন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement