চিত্রকাহিনিকার: নারায়ণ দেবনাথ তাঁর সৃজনকর্মে মগ্ন। নীচে, তাঁর কমিক্স বইয়ের প্রচ্ছদ।
নারায়ণ দেবনাথের ট্রাজেডি, তিনি বাঙালি ছিলেন। নইলে তাঁর মৃত্যুর পর শুধুই ‘শৈশব হারিয়ে গেল’ গোছের বিষাদযোগে লোকে সোশ্যাল ও প্রিন্ট মিডিয়ার পাতা ভরায়? বিদেশে গত কয়েক বছরে হ্যারি পটার থেকে সুপারম্যান, ব্যাটম্যান সকলকে নিয়ে নানা চমৎকার কাজ হয়েছে। হ্যারির মাসির বাড়ির ঠিকানা প্রাইভেট ড্রাইভ কেন? কারণ, তারা বেসরকারি অর্থনীতিতে বিশ্বাস করে, জ্বরজারি হলে বেসরকারি হাসপাতালে যায়। গোথাম শহরকে ভরাডুবি থেকে বাঁচাতে গিয়ে ব্যাটম্যান এবং জোকার দু’জনেই হিংসা এবং মারদাঙ্গার আশ্রয় নেয়। নায়ক এবং খলনায়ক কি তা হলে একই মুদ্রার এ পিঠ আর ও পিঠ? বাঁটুল, হাঁদাভোঁদা, নন্টে-ফন্টে-কেল্টুদাদের সমাজ, অর্থনীতি নিয়ে কেউ এ ভাবে ভাবল না।
কমিক্সগুলি ষাটের দশক থেকেই দেব সাহিত্য কুটির ও শুকতারা পত্রিকার কল্যাণে তুমুল জনপ্রিয়। সেখানে বাঁটুল কখনও গুলতি দিয়ে পাথর ছুড়ে হানাদারদের রুখে দেয়, কখনও বা বিচ্ছু দুটো ব্যাঙ্ক ডাকাতি করলে সটান শ্রীঘরে পাঠিয়ে দেয়। নারায়ণ দেবনাথ কি শুধু ওই দুই কমিক্স সিরিজ়েই পাতা ভরিয়েছেন? তাঁর ইলাস্ট্রেশনের হাত ছিল চমৎকার। শোকাকুল হট্টমেলার বাজারে অনেকেই খেয়াল রাখেননি, স্বপনকুমারের গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জি থেকে দস্যু কালনাগিনী, ড্রাগন ইত্যাদি অনেক চটি বইয়েই ছিল তাঁর আঁকা অলঙ্করণ ও প্রচ্ছদ। সে সব খুব একটা শিশুপাঠ্য ছিল না। সত্তরের দশকে আমরা যখন বড় হচ্ছি, স্কুলের পড়ার বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে পড়তে হত। সে ছিল বিরক্তিকর এক নিরামিষ যুগ। ইন্টারনেট দূর অস্ত, টিভি ছিল না। মা-বাবারা উত্তম-সুপ্রিয়ার ‘চৌরঙ্গী’ নামক অ্যাডাল্ট ছবি দেখতে গেলেও আমাদের বাড়িতে রেখে যাওয়া হত। তখন আমাদের যৌনতার আলো-আঁধারি উন্মেষ নারায়ণ দেবনাথের প্রায় ফটোগ্রাফিক দক্ষতায় আঁকা ওই সব উজ্জ্বল রঙের ছবিতে। বাঙালি ছেলেপিলে বরাবর বদের বাসা, তারা শুধু নন্টে-ফন্টের দুষ্টুমিতে তৃপ্ত হত না। এরা লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক
পাপ করেছে।
বাঙালির কমিক্সের সেটা আদিযুগ। গোয়েন্দা কৌশিককে নিয়ে নারায়ণবাবুর আর একটি সিরিজ় ছিল, সেটি বেশির ভাগ সময় শুকতারার প্রচ্ছদ হত। কমিক্স দিয়ে প্রচ্ছদ— বোঝাই তো যাচ্ছে, সে বড় সুখের সময় নয়। আসলে, অফসেটে ছাপা রঙিন ছবি তখনও আসেনি। আমার মতো অকালপক্ব ছেলেরা জানত, শারদীয়া ‘প্রসাদ’ বা ‘উল্টোরথ’-এ শুধু দ্বিবর্ণ বা ত্রিবর্ণ রঞ্জিত ছবি থাকত। মানে, বইয়ের পাতায় দু’টি বা তিনটি রং মাত্র। ক্যাপশনগুলিও তথৈবচ। পাশাপাশি গোলাপি রঙে উত্তম-সুচিত্রার ছবি, নীচে লেখা, ‘আমরা দুজনা গড়িব স্বপ্ন এই মধুর ধরণীতলে।’ এ সব বই পড়া বারণ ছিল, কিন্তু মর্নিং স্কুল শেষে মায়ের দিবানিদ্রার সুযোগে এই সব জ্ঞান আহরণ করতাম।
আর ছিল ইন্দ্রজাল কমিক্স। তারা ‘মহাবলী বেতাল’ নামে অরণ্যদেব ও জাদুকর ম্যানড্রেকের কমিক্স ছাপত। তখন আনন্দবাজারের দ্বিতীয় পাতায় কমিক্স পড়তে গিয়ে বিপন্ন বিস্ময়ও সৃষ্টি হত। এরা বেতালকে অরণ্যদেব বলে কেন? দু’জনে যে একই লোক, তা বুঝেছি অনেক পরে। অরণ্যদেব-ডায়নার বিয়ের পর, কিলাউইয়ের সোনাবেলায় তাদের হনিমুনের ছবি দেখে।
এই হাবলাগোবলা সমাজের কমিক্স তাদেরই মতো। কেল্টুদা ছাড়া নন্টে, ফন্টে, হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল সবাই হাফ প্যান্ট। পিসেমশাই ও বোর্ডিং সুপার ধুতিতে। সম্ভবত ছেলেদের হাফপ্যান্টই নারায়ণবাবুর পছন্দ ছিল। ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের পাণ্ডব গোয়েন্দা তাঁর অলঙ্করণে শুকতারায় শুধুই হাফপ্যান্ট পরেছে। বাবলু, বিলু, ভোম্বল সাবালক হয়েছে অনেক পরে। আনন্দমেলার পাতায় এসে।
এই হাফপ্যান্টের সমাজকে নানা ভাবে দেখা যায়। ইরক, আঁই ইত্যাদি ধ্বন্যাত্মক শব্দ এবং অব্যয়। শব্দই নারায়ণবাবুর তুরুপের টেক্কা। বাঁটুল শব্দটা আমরা কী ভাবে ব্যবহার করি? খর্বকায়দের নিয়ে ঠাট্টা করতে। ‘বাঁটুল দি গ্রেট’ নামটা কিন্তু ঠাট্টার জন্য নয়। ছাতি-ফোলানো বাঁটুল মুখোমুখি হতে-যাওয়া দুই ট্রেনকে অক্লেশে থামিয়ে দেয়। বাঙালির এক সময় যোগীন্দ্রনাথ সরকারের একটা ছড়া প্রায় মুখস্থ ছিল। আঁটুল বাঁটুল শামলা শাঁটুল/ শামলা গেছে হাটে। বাংলা কমিক্সের সুপারবয় তৈরি করতে গিয়ে নারায়ণ দেবনাথ কি যোগীন সরকারের ছেলেভুলোনো ছড়ার স্মৃতিকেও রেখে দিতে চেয়েছিলেন?
বাঁটুল দি গ্রেটের মোদ্দা ব্যাপারটা কী? অতিরেক। স্বাভাবিকের অতিরিক্ত জিনিসই আমাদের হাসির উদ্রেক করে। ‘খেলার ছলে ষষ্ঠীচরণ/হাতি লোফেন যখনতখন।’ অতিরেক বলেই বাঁটুল তাঁবু থেকে পালানো সিংহকে সার্কাসে ঢুকিয়ে আসে। অতিরিক্ত স্মার্টনেস দেখাতে গিয়েই হাঁদা পিছলে যাবে, পিসেমশাই পাঁইপাঁই করে বেত হাতে তার পিছনে তাড়া করবেন। মনিটর কেল্টুদা ক্ষমতার এজেন্ট হিসেবেই নন্টে-ফন্টের ওপর দাদাগিরি করবে, শেষে বোঝা যাবে তার গোটাটাই ফক্কা। সুপারও তার উপর রেগে যাবেন। এই যে বোর্ডিং স্কুল, এর মধ্যেও আছে সাহিত্যের বাঙালিয়ানা। স্বপনবুড়োর ‘বাবুইবাসা বোর্ডিং’ পরাধীন দেশে বোর্ডিংয়ের ছেলেদের দামালপনা ও দেশপ্রেম নিয়ে লেখা। হগওয়ার্টসের ঢের আগে বাংলা সাহিত্যে বোর্ডিং স্কুল ছিল। আমরা খবর রাখিনি।
বাঙালি সমাজের এই মানসভুবন থেকেই নারায়ণ দেবনাথকে ধরতে হবে। তাঁর কমিক্সে পিসেমশাই, হস্টেল সুপার সবাই বেগড়বাঁই দেখলে বেত হাতে ছুটে আসেন কেন? ওটাই ছিল বাঙালির সংস্কৃতি। গুরুমশাই তুলসী চক্রবর্তী বেত দিয়ে পিঠ চুলকোতে চুলকোতে বলবেন, এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি... বেত, হাফ চেয়ার, নিলডাউন, জুলপি টানা কত যে শাস্তি ছিল! নারায়ণ দেবনাথ আসলে আমাদের বড় হওয়ার, ষাটের দশকের নস্ট্যালজিয়া। আমাদের প্রয়াত বন্ধু, কবি জয়দেব বসু তার ছেলেবেলার পুরো বাঁটুলের সেট তার শিশুপুত্রকে উপহার দিয়েছিল। বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদারা এ ভাবেই এগোয়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
তবু সূক্ষ্ম তফাত ঘটে। হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টেদের প্রথম বৈশিষ্ট্য কী? এরা সকলেই পরস্পরকে জব্দ করার চেষ্টা করে, কিন্তু বন্ধুত্ব অমলিন। হাঁদা প্রায়ই ভোঁদার কাছে পরাস্ত হয়, তাতে সম্পর্কের হেরফের ঘটে না। কেল্টুদা এক বার নন্টেদের টাইট দেয়, পরক্ষণেই দাবার চাল উল্টো দিকে ঘুরে যায়। হেরে গিয়েও কেউ কাউকে পুরোদস্তুর নিকেশ করার কথা ভাবে না। সংসারে হাঁদার মিচকেমি, ভোঁদার সারল্য, কেল্টুদার বদমাইশি, নন্টে-ফন্টের দুষ্টুমি সবই থেকে যাবে। টিভি-বিতর্কের মতো সবাই একযোগে চিল্লিয়ে একই কথা বলবে না, অন্যকে যেন-তেন-প্রকারেণ দাবিয়ে দেবে না। প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়েই এগিয়ে যাবে।
যেমন বাঁটুল দি গ্রেট! শক্তিমান, কিন্তু নিজের শক্তি নিয়ে সচেতন নয়। সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান সবাই নিজের শক্তি সম্পর্কে অবহিত। আর বাঁটুল? দরজায় হেলান দিয়েছে, তার অজান্তে দরজাটাই ভেঙে পড়ল। নিজের শক্তির প্রতি এই ঔদাসীন্যেই সে সুন্দর।
এই বাঁটুলই এক বার দেশকে বাঁচিয়েছিল। খান সেনাদের প্যাটন ট্যাঙ্ক এগিয়ে আসছিল, সে গুলতিতে করে পাথর ছোড়ে। ট্যাঙ্ক ভেঙে চৌপাট। শুধুই মজার মাধ্যমে দেশপ্রেম। ওরা পাকিস্তানি, শত্রু দেশ ইত্যাদি কথা বলতে হয়নি স্রষ্টাকে।
বাঁটুলই দেশকে বাঁচায়। বাস্তবের ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতিওয়ালা সুপারহিরোরা টেলিপ্রম্পটার বিগড়ে গেলেও আজকাল থমকে যান। তাঁদের কোনও মুশকিল-আসান বাঁটুল দি গ্রেট নেই যে!