জাদুকর: লেগ স্পিনের সঙ্গে দু’ধরনের অভ্রান্ত গুগলি আয়ত্ত করেছিলেন সুভাষ গুপ্তে। ছবি: গেটি ইমেজেস
সময়টা গত শতকের ষাটের দশকের গোড়ার দিক। স্বাধীন ভারতের তখন বয়স চার-পাঁচ বছর। তখন অনেক দেশই ভারতকে ক্রিকেটের মাঠে পাত্তা দিত না। বেশির ভাগ ক্রিকেট-পণ্ডিতদের ধারণা ছিল, ভারতকে হারানো মোটেই কঠিন ব্যাপার নয়। তা ছাড়া ওই সময়ে আমাদের তেমন ফাস্ট বোলারও ছিলেন না, যিনি আগুনে বোলিং করে বিপক্ষের ব্যাটিংয়ে ত্রাস সৃষ্টি করতে পারেন। ‘অ্যাটিটিউড’-এর দিক থেকেও অস্ট্রেলীয় বা ইংরেজ ক্রিকেটাররা ভারতীয়দের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। খেলা তো শুধু মাঠে হয় না, মনের ময়দানেও তো জোরদার লড়াই হয়। ইংরেজ-অজ়িরা ‘মেন্টাল গেম’-এও ভারতের থেকে বেশ কয়েক কদম এগিয়ে ছিল। আর ক্যারিবিয়ানরা তো মাঠেই দুর্দান্ত পারফর্ম করে সবাইকে মাতিয়ে রাখত।
ঠিক এই রকম পরিস্থিতিতে এক জন মিতভাষী ভারতীয় ক্রিকেটার, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটবিশ্বে ভারতের জন্য মর্যাদার স্থান পাকা করতে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। সেই খেলোয়াড়ের নাম সুভাষচন্দ্র পন্ধারীনাথ গুপ্তে। যিনি ক্রিকেটের ময়দানে সুভাষ গুপ্তে নামেই অধিক পরিচিত। তাঁর জন্ম ১৯২৯ সালের ১১ ডিসেম্বর, মুম্বইয়ে। মুম্বইয়ের শিবাজি পার্কে দিনের পর দিন ধরে নিবিড় অনুশীলন করা এই লেগ স্পিনার সুভাষের উচ্চতা বা চেহারা আহামরি কিছু ছিল না। স্বভাবে ছিল না আগ্রাসন কিংবা ডাকাবুকো ভাবটাও। কিন্তু ওঁর হাতে ছিল বিরল কিছু বোলিং অস্ত্র, যা অন্যদের ছিল না। উনি ক্রিকেট বল হাতে পেলেই সেই বলকে কথা বলাতে পারতেন। অনেক লেগ স্পিনার যেখানে একটা গুগলি রপ্ত করতেই গোটা কেরিয়ার কাটিয়ে দেন, সেখানে সুভাষের হাতে লেগ-ব্রেক ছাড়াও আরও দু’-দুটো আলাদা ধরনের অভ্রান্ত গুগলি ছিল। ওঁর বোলিংয়ে এত বৈচিত্র ছিল যে, বহু ব্যাটার ওঁকে কার্যত অন্ধের মতো আন্দাজে খেলতেন এবং ব্যর্থ হতেন! একই সঙ্গে বলের উপর ওঁর নিয়ন্ত্রণ ছিল দেখার মতো। বহু প্রতিশ্রুতিমান লেগ-ব্রেক বোলার এলোমেলো বল করে শেষ পর্যন্ত চিরকালের মতো হারিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সুভাষ গুপ্তে ছিলেন ব্যতিক্রমী। আবার বিপক্ষের ব্যাটার পর পর দুটো বাউন্ডারি মারলেও উনি বিন্দুমাত্র ঘাবড়াতেন না। উনি কখনও ওঁর অধিনায়ককে বলতেন না যে, উনি যখন বল করবেন, তখন ফিল্ডারদের বাউন্ডারি লাইনের ধারে চার-ছক্কা বাঁচানোর জন্য ছড়িয়ে দিতে হবে। উল্টে আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং সাজিয়ে ব্যাটারদের চাপে রাখতেন।
সুভাষ গুপ্তে ওঁর প্রজন্মের তিন দুর্ধর্ষ ক্যারিবীয় ব্যাটার, ‘থ্রি ডব্লিউজ়’ অর্থাৎ (স্যর ক্লাইড) ওয়ালকট, (স্যর ফ্র্যাঙ্ক) ওরেল এবং (স্যর এভারটন) উইকসের ভয়ঙ্কর আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের বিরুদ্ধেও বুক চিতিয়ে বল করে সফল হয়েছিলেন। বল হাতে নির্ভীক সুভাষের মুখোমুখি হতে ব্যাটাররা ভয় পেতেন। অধিকাংশ সময়েই ব্যাট-বলের দ্বৈরথে শেষ হাসিটা গুপ্তেই হাসতেন। শুধু শোচনীয় ঘটনা, দুর্ভাগ্যের ওভারবাউন্ডারি তাঁকে মাঠের বাইরে ফেলে দিল।
১৯৫৮-৫৯-এর মরসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ় দল ভারত সফরে এল। ভারত বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচ কানপুরে হয়েছিল। সুভাষের লেগ স্পিন এবং গুগলির কোনও উত্তর সে দিন বিশ্বসেরা ক্যারিবিয়ান ব্যাটারদের কাছে ছিল না। রোহন কানহাই, গ্যারি সোবার্স বা কনরাড হান্ট— কেউই গুপ্তের সামনে দাঁড়াতে পারেননি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের প্রথম ইনিংসে দশটা উইকেটের মধ্যে সুভাষ একাই ৯টা উইকেট পেয়েছিলেন ১০২ রানের বিনিময়ে। যদিও ওই ইনিংসে ১০ উইকেটই ওঁর প্রাপ্য ছিল। ভারতের উইকেটকিপার নরেন তামহানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের লান্স গিবসের সহজ ক্যাচ ফেলে দিয়েছিলেন! অথচ নরেন উইকেটরক্ষক হিসেবে খুবই নির্ভরযোগ্য ছিলেন। সহজ ক্যাচ কেন, কঠিন ক্যাচও চট করে মিস করতেন না। কিন্তু সুভাষের ভাগ্যেই ছিল অপ্রাপ্তির কালো ছায়া! ওই কানপুর টেস্টের ৪১ বছর পরে ভারতের অনিল কুম্বলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দিল্লি টেস্টে এক ইনিংসে ১০ উইকেট পাওয়ার নজির সৃষ্টি করেন। কিন্তু কুম্বলের প্রতি পূর্ণ সম্মান বজায় রেখেই এ কথা বলা যায় যে, ক্রিকেটীয় দক্ষতার মাপকাঠিতে সুভাষের কানপুর টেস্টের কৃতিত্ব আরও বেশি, কারণ সুভাষ যখন ক্যারিবিয়ানদের তাঁর বোলিংয়ের ঘূর্ণিতে ধরাশায়ী করেছিলেন, তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ় ওই সময়ের অন্যতম সেরা দল। ক্রিকেটের প্রতি ওঁর ‘বিউটিফুল সিরিয়াসনেস’ কানহাই-সোবার্স-হান্টদেরও মুগ্ধ করেছিল। ওঁর এই কীর্তি ভারতীয় স্পিন বোলিংয়ের আকাশে বিষাণ সিংহ বেদী নামে এক নতুন নক্ষত্রের জন্ম দিয়েছিল। আসলে কানপুরে গুপ্তের দুর্দান্ত বোলিংয়ের রেডিয়ো-ধারাভাষ্য শুনে বেদী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে উনি স্পিন বোলার হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করবেন।
ও দিকে ১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে টেড ডেক্সটারের অধিনায়কত্বে ইংরেজরা ভারতে খেলতে এল। তখন কোনও কারণে দল থেকে বাদ পড়েছিলেন সুভাষ গুপ্তে। ব্রিটিশরা যখন দেখল যে, মুম্বই টেস্টে সুভাষ খেললেন না, তখন ওরা আশ্বস্ত হল। ভেবে নিল, তা হলে বোধহয় গুপ্তের লেগ স্পিনে জং ধরে গিয়েছে! সুভাষের জায়গায় মুম্বইয়ে খেলেছিলেন চেন্নাইয়ের নতুন লেগ স্পিনার ভি ভি কুমার। কিন্তু কুমার একটাও উইকেট পেলেন না!
উপায়ান্তর না দেখে ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট গুপ্তেকে আবার ডাকতে বাধ্য হল। ইংরেজদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় টেস্টই সেই কানপুরেই হয়েছিল। সে বার কানপুরের পিচ পুরোপুরি ব্যাটিং-সহায়ক। অথচ সুভাষ ৯০ রানের বিনিময়ে ৫ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডের গর্বোদ্ধত ব্যাটিং লাইন-আপের শিরদাঁড়াটাই ভেঙে দিলেন। ইংল্যান্ড এই প্রথম বারের জন্য ভারতের বিরুদ্ধে ফলো-অন করতে বাধ্য হল। ইংরেজরা বুঝে গেল, গুপ্তে-জাদু একটুও ম্লান হয়নি। সুভাষের বল হাতে ভেল্কি দেখে ডেক্সটার-বাহিনী প্রমাদ গুনতে শুরু করল। শেষ পর্যন্ত কানপুর টেস্ট ড্র হলেও হলেও নরি কনট্রাক্টরের ভারত ওই সিরিজ় জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস সংগ্রহ করতে সক্ষম হল।
তৃতীয় টেস্টের জন্য দুই দলই দিল্লি পৌঁছে গেল। এবং এখানেই সুভাষ বুঝতে পারলেন, তাঁর দুর্ভাগ্যের ক্ষত কতটা গভীর! দিল্লি টেস্টের জন্য ভারতীয় ক্রিকেট দল ইম্পিরিয়াল হোটেলে আস্তানা গেড়েছিল। ওই হোটেলে সুভাষের রুমমেট ছিলেন এজি কৃপাল সিংহ। কৃপাল ইম্পিরিয়াল হোটেলের জনৈক মহিলা রিসেপশনিস্টকে দেখে রোমান্টিক হয়ে উঠলেন। উনি সেই রিসেপশনিস্টকে ফোন করে ঘরে ডাকলেন। আসলে কৃপালের ইচ্ছে ছিল যে উনি ওই মহিলার সঙ্গে একটু মদ্যপান করবেন, সময় কাটাবেন! স্বাভাবিক কারণেই রিসেপশনিস্ট এই অতিরিক্ত আন্তরিকতা ভাল চোখে দেখেননি। উনি তৎক্ষণাৎ ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্টকে জানালেন। কৃপাল ওঁর ঘর থেকেই রিসেপশনিস্টকে ফোন করেছিলেন। সুভাষ তখন ঘরে ছিলেন না। উনি অধিনায়ক নরি কন্ট্রাক্টরের ঘরে বাকিদের সঙ্গে তাস খেলছিলেন। সুভাষের এই বিষয়ে কোনও ভূমিকাই ছিল না।
সুভাষ এবং কৃপালের মধ্যে কে দোষী, তা নির্ধারণ করার জন্য এক তদন্ত কমিটি তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করে! কৃপাল অস্পষ্ট ভাবে নিজের কথা বললেও সুযোগ বুঝে নিরপরাধ সুভাষের ওপর যাবতীয় দোষ চাপিয়ে দিলেন। উনি বোঝাতে চাইলেন, সুভাষই ওই মহিলা রিসেপশনিস্টকে ফোন করে হোটেলের ঘরে ডেকেছিলেন! গুপ্তে টের পেলেন, কৃপাল পিছন থেকে ওঁকে ছুরি মেরেছেন। অথচ এর পরেও টিমমেটের প্রতি গুপ্তের মমত্ববোধ একটুও কমল না। গুপ্তে বললেন, কৃপাল কিন্তু ওই মহিলাকে আদৌ অসম্মান করতে চাননি, উনি মদ্যপান করার জন্য মহিলার সঙ্গ চাইছিলেন। শেষ পর্যন্ত বিচারের নামে প্রহসন হল। তদন্ত কমিটির এক কর্তা সুভাষকে বলেন, “তুমি কৃপালকে ফোন করা থেকে আটকাতে পারলে না!” অসঙ্গত অভিযোগ! তবু গুপ্তে জানিয়েছিলেন তিনি সেখানে ছিলেনই না। শান্ত ভাবে আরও বলেছিলেন, “কৃপালের মতো অত বড়সড় চেহারার মানুষকে আমি কী করে আটকাব!”
অধিনায়ক কন্ট্রাক্টরও বলেছিলেন যে, সুভাষ কোনও মতেই দোষী নন। অথচ ওই সময়ে এক জন ভারতীয় বোর্ড কর্তাও সঠিক ভূমিকা পালন করলেন না। তাঁরা কৃপাল এবং সুভাষ— দু’জনকেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ় সফরের জন্য ভারতীয় দল থেকে বাদ দিলেন! মানে কৃপালের পাশাপাশি সুভাষকেও অপরাধী বলে দাগিয়ে দেওয়া হল!
গুপ্তে অতি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে বড় কোনও রাজা বা আমলা বা কর্তাব্যক্তির পরিচয় ছিল না। সে কারণেই গুপ্তেকে প্রশাসকরা এ ভাবে মিথ্যা কলঙ্কে বিদ্ধ করার আগে দ্বিতীয় বার ভাবলেন না। কিন্তু সুভাষ এই অপমানটা সহ্য করতে পারলেন না। তিনি মানসিক যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে নিলেন। গুপ্তের বাবা কৃপালের বিরুদ্ধে মামলা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় সেটাও করে উঠতে পারলেন না। এ ভাবেই প্রতিভাধর সুভাষ গুপ্তের আন্তর্জাতিক কেরিয়ার মাত্র দশ বছরেই (১৯৫১-১৯৬১) শেষ হয়ে গেল! অথচ শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজ় বা ইংল্যান্ড কেন, সেই সময়ের অন্যান্য ক্রিকেট খেলিয়ে দেশগুলোর (যেমন, পাকিস্তান, নিউ জ়িল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া) খেলোয়াড়রাও ওঁর বোলিংয়ে সম্মোহিত হয়েছিলেন। অবসর নেওয়ার সময় ওঁর বয়স ছিল মাত্র ৩২! উনি মাত্র ৩৬টি টেস্ট খেলে ১৪৯ উইকেট সংগ্রহ করেছিলেন।
এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি না ঘটলে আন্তর্জাতিক ময়দানে তিনি আরও কয়েক বছর দাপট দেখাতেই পারতেন। এতে ভারতীয় দলও নিঃসন্দেহে উপকৃত হত।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের মহিলা ক্যারলের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়ে গুপ্তে স্বদেশভূমি ছেড়ে দিয়ে ত্রিনিদাদে পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করেন। কিন্তু ভারতের প্রতি ভালবাসা সুভাষের আমৃত্যু অটুট ছিল। কারও প্রতি কোনও অভিযোগ ছিল না। ওই ত্রিনিদাদেই ২০০২ সালের ৩১ মে তারিখে ৭২ বছর বয়সে প্রয়াত হন সুভাষ গুপ্তে।
ওঁর সম্পর্কে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার স্যর গ্যারি সোবার্স বলেছেন, সুভাষ গুপ্তে হলেন বিশ্বের সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনার। আর এক কিংবদন্তি স্যর এভার্টন উইকস এবং পাকিস্তানের অতীত দিনের চ্যাম্পিয়ন ব্যাটার হানিফ মহম্মদও একই মত পোষণ করেছেন। সোবার্সের এই কথাটা কে-ই বা ভুলতে পারবে, “ওয়ার্ন ইজ় দ্য লেটেস্ট, বাট ফার্গি ইজ় দি গ্রেটেস্ট!” ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান লেগ স্পিনার উইলফ্রেড ফার্গুসনের সঙ্গে গুপ্তের বোলিংয়ের মিল থাকায় গুপ্তেকে ‘ফার্গি’ বলেও ডাকা হত।
পরিসংখ্যানের বিচারে বিশ্বের সফলতম লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্ন টেস্টে ৭০৮টি উইকেট পেয়েছেন। তবে ওয়ার্ন যেখানে তাঁর সময়ের বিশ্বসেরা অস্ট্রেলিয়া দলে খেলতেন, সেখানে সুভাষ ছিলেন তাঁর সময়ে বিশ্বের অন্যতম দুর্বল এক দলের সদস্য। অনেক সময়েই তাঁকে গোটা দলের বোলিংয়ের বোঝা একাই বইতে হত। অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ থেকে বিশ্বসেরা হওয়া আর ভারতের মতো একটি দেশ থেকে বল হাতে প্রথম বিশ্বের ক্রিকেটারদের দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠার তফাত অনেকটাই। এই পার্থক্যের লিখিত রেকর্ড থাকে না, এর গুরুত্ব সংবেদনশীল ক্রিকেট-বোধের কাছে।
সুনীল গাওস্করের মতো ব্যক্তিত্বও বলেছেন, সুভাষ গুপ্তে যে শুধু এক জন বড় মাপের বোলারই ছিলেন তা নয়, মানুষ হিসেবেও উনি খুব উদার ছিলেন। সুভাষ সিনিয়র-জুনিয়র বিভাজনে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি দলের জুনিয়রদের জন্য খাবার, জলের বোতল এমনকি ক্রিকেটের সরঞ্জামও এগিয়ে দিতে দ্বিধা করতেন না। সুভাষ ভারতের হয়ে যখনই খেলেছেন, নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন। শরীরে ব্যথা-বেদনা থাকলেও উনি নিজের সেরাটুকু দিতে কখনও পিছপা হননি। আর এই গুপ্তের কেরিয়ারই শেষ হয়ে গেল ভিত্তিহীন অপবাদে। ভগবৎ সুব্রহ্মণ্য চন্দ্রশেখর থেকে নরেন্দ্র হিরওয়ানি, অনিল কুম্বলে হয়ে যুজবেন্দ্র চহাল পর্যন্ত ভারতী
স
ময়টা গত শতকের ষাটের দশকের গোড়ার দিক। স্বাধীন ভারতের তখন বয়স চার-পাঁচ বছর। তখন অনেক দেশই ভারতকে ক্রিকেটের মাঠে পাত্তা দিত না। বেশির ভাগ ক্রিকেট-পণ্ডিতদের ধারণা ছিল, ভারতকে হারানো মোটেই কঠিন ব্যাপার নয়। তা ছাড়া ওই সময়ে আমাদের তেমন ফাস্ট বোলারও ছিলেন না, যিনি আগুনে বোলিং করে বিপক্ষের ব্যাটিংয়ে ত্রাস সৃষ্টি করতে পারেন। ‘অ্যাটিটিউড’-এর দিক থেকেও অস্ট্রেলীয় বা ইংরেজ ক্রিকেটাররা ভারতীয়দের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। খেলা তো শুধু মাঠে হয় না, মনের ময়দানেও তো জোরদার লড়াই হয়। ইংরেজ-অজ়িরা ‘মেন্টাল গেম’-এও ভারতের থেকে বেশ কয়েক কদম এগিয়ে ছিল। আর ক্যারিবিয়ানরা তো মাঠেই দুর্দান্ত পারফর্ম করে সবাইকে মাতিয়ে রাখত।
ঠিক এই রকম পরিস্থিতিতে এক জন মিতভাষী ভারতীয় ক্রিকেটার, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটবিশ্বে ভারতের জন্য মর্যাদার স্থান পাকা করতে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। সেই খেলোয়াড়ের নাম সুভাষচন্দ্র পন্ধারীনাথ গুপ্তে। যিনি ক্রিকেটের ময়দানে সুভাষ গুপ্তে নামেই অধিক পরিচিত। তাঁর জন্ম ১৯২৯ সালের ১১ ডিসেম্বর, মুম্বইয়ে। মুম্বইয়ের শিবাজি পার্কে দিনের পর দিন ধরে নিবিড় অনুশীলন করা এই লেগ স্পিনার সুভাষের উচ্চতা বা চেহারা আহামরি কিছু ছিল না। স্বভাবে ছিল না আগ্রাসন কিংবা ডাকাবুকো ভাবটাও। কিন্তু ওঁর হাতে ছিল বিরল কিছু বোলিং অস্ত্র, যা অন্যদের ছিল না। উনি ক্রিকেট বল হাতে পেলেই সেই বলকে কথা বলাতে পারতেন। অনেক লেগ স্পিনার যেখানে একটা গুগলি রপ্ত করতেই গোটা কেরিয়ার কাটিয়ে দেন, সেখানে সুভাষের হাতে লেগ-ব্রেক ছাড়াও আরও দু’-দুটো আলাদা ধরনের অভ্রান্ত গুগলি ছিল। ওঁর বোলিংয়ে এত বৈচিত্র ছিল যে, বহু ব্যাটার ওঁকে কার্যত অন্ধের মতো আন্দাজে খেলতেন এবং ব্যর্থ হতেন! একই সঙ্গে বলের উপর ওঁর নিয়ন্ত্রণ ছিল দেখার মতো। বহু প্রতিশ্রুতিমান লেগ-ব্রেক বোলার এলোমেলো বল করে শেষ পর্যন্ত চিরকালের মতো হারিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সুভাষ গুপ্তে ছিলেন ব্যতিক্রমী। আবার বিপক্ষের ব্যাটার পর পর দুটো বাউন্ডারি মারলেও উনি বিন্দুমাত্র ঘাবড়াতেন না। উনি কখনও ওঁর অধিনায়ককে বলতেন না যে, উনি যখন বল করবেন, তখন ফিল্ডারদের বাউন্ডারি লাইনের ধারে চার-ছক্কা বাঁচানোর জন্য ছড়িয়ে দিতে হবে। উল্টে আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং সাজিয়ে ব্যাটারদের চাপে রাখতেন।
সুভাষ গুপ্তে ওঁর প্রজন্মের তিন দুর্ধর্ষ ক্যারিবীয় ব্যাটার, ‘থ্রি ডব্লিউজ়’ অর্থাৎ (স্যর ক্লাইড) ওয়ালকট, (স্যর ফ্র্যাঙ্ক) ওরেল এবং (স্যর এভারটন) উইকসের ভয়ঙ্কর আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের বিরুদ্ধেও বুক চিতিয়ে বল করে সফল হয়েছিলেন। বল হাতে নির্ভীক সুভাষের মুখোমুখি হতে ব্যাটাররা ভয় পেতেন। অধিকাংশ সময়েই ব্যাট-বলের দ্বৈরথে শেষ হাসিটা গুপ্তেই হাসতেন। শুধু শোচনীয় ঘটনা, দুর্ভাগ্যের ওভারবাউন্ডারি তাঁকে মাঠের বাইরে ফেলে দিল।
১৯৫৮-৫৯-এর মরসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ় দল ভারত সফরে এল। ভারত বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচ কানপুরে হয়েছিল। সুভাষের লেগ স্পিন এবং গুগলির কোনও উত্তর সে দিন বিশ্বসেরা ক্যারিবিয়ান ব্যাটারদের কাছে ছিল না। রোহন কানহাই, গ্যারি সোবার্স বা কনরাড হান্ট— কেউই গুপ্তের সামনে দাঁড়াতে পারেননি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের প্রথম ইনিংসে দশটা উইকেটের মধ্যে সুভাষ একাই ৯টা উইকেট পেয়েছিলেন ১০২ রানের বিনিময়ে। যদিও ওই ইনিংসে ১০ উইকেটই ওঁর প্রাপ্য ছিল। ভারতের উইকেটকিপার নরেন তামহানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের লান্স গিবসের সহজ ক্যাচ ফেলে দিয়েছিলেন! অথচ নরেন উইকেটরক্ষক হিসেবে খুবই নির্ভরযোগ্য ছিলেন। সহজ ক্যাচ কেন, কঠিন ক্যাচও চট করে মিস করতেন না। কিন্তু সুভাষের ভাগ্যেই ছিল অপ্রাপ্তির কালো ছায়া! ওই কানপুর টেস্টের ৪১ বছর পরে ভারতের অনিল কুম্বলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দিল্লি টেস্টে এক ইনিংসে ১০ উইকেট পাওয়ার নজির সৃষ্টি করেন। কিন্তু কুম্বলের প্রতি পূর্ণ সম্মান বজায় রেখেই এ কথা বলা যায় যে, ক্রিকেটীয় দক্ষতার মাপকাঠিতে সুভাষের কানপুর টেস্টের কৃতিত্ব আরও বেশি, কারণ সুভাষ যখন ক্যারিবিয়ানদের তাঁর বোলিংয়ের ঘূর্ণিতে ধরাশায়ী করেছিলেন, তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ় ওই সময়ের অন্যতম সেরা দল। ক্রিকেটের প্রতি ওঁর ‘বিউটিফুল সিরিয়াসনেস’ কানহাই-সোবার্স-হান্টদেরও মুগ্ধ করেছিল। ওঁর এই কীর্তি ভারতীয় স্পিন বোলিংয়ের আকাশে বিষাণ সিংহ বেদী নামে এক নতুন নক্ষত্রের জন্ম দিয়েছিল। আসলে কানপুরে গুপ্তের দুর্দান্ত বোলিংয়ের রেডিয়ো-ধারাভাষ্য শুনে বেদী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে উনি স্পিন বোলার হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করবেন।
ও দিকে ১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে টেড ডেক্সটারের অধিনায়কত্বে ইংরেজরা ভারতে খেলতে এল। তখন কোনও কারণে দল থেকে বাদ পড়েছিলেন সুভাষ গুপ্তে। ব্রিটিশরা যখন দেখল যে, মুম্বই টেস্টে সুভাষ খেললেন না, তখন ওরা আশ্বস্ত হল। ভেবে নিল, তা হলে বোধহয় গুপ্তের লেগ স্পিনে জং ধরে গিয়েছে! সুভাষের জায়গায় মুম্বইয়ে খেলেছিলেন চেন্নাইয়ের নতুন লেগ স্পিনার ভি ভি কুমার। কিন্তু কুমার একটাও উইকেট পেলেন না!
উপায়ান্তর না দেখে ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট গুপ্তেকে আবার ডাকতে বাধ্য হল। ইংরেজদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় টেস্টই সেই কানপুরেই হয়েছিল। সে বার কানপুরের পিচ পুরোপুরি ব্যাটিং-সহায়ক। অথচ সুভাষ ৯০ রানের বিনিময়ে ৫ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডের গর্বোদ্ধত ব্যাটিং লাইন-আপের শিরদাঁড়াটাই ভেঙে দিলেন। ইংল্যান্ড এই প্রথম বারের জন্য ভারতের বিরুদ্ধে ফলো-অন করতে বাধ্য হল। ইংরেজরা বুঝে গেল, গুপ্তে-জাদু একটুও ম্লান হয়নি। সুভাষের বল হাতে ভেল্কি দেখে ডেক্সটার-বাহিনী প্রমাদ গুনতে শুরু করল। শেষ পর্যন্ত কানপুর টেস্ট ড্র হলেও হলেও নরি কনট্রাক্টরের ভারত ওই সিরিজ় জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস সংগ্রহ করতে সক্ষম হল।
তৃতীয় টেস্টের জন্য দুই দলই দিল্লি পৌঁছে গেল। এবং এখানেই সুভাষ বুঝতে পারলেন, তাঁর দুর্ভাগ্যের ক্ষত কতটা গভীর! দিল্লি টেস্টের জন্য ভারতীয় ক্রিকেট দল ইম্পিরিয়াল হোটেলে আস্তানা গেড়েছিল। ওই হোটেলে সুভাষের রুমমেট ছিলেন এজি কৃপাল সিংহ। কৃপাল ইম্পিরিয়াল হোটেলের জনৈক মহিলা রিসেপশনিস্টকে দেখে রোমান্টিক হয়ে উঠলেন। উনি সেই রিসেপশনিস্টকে ফোন করে ঘরে ডাকলেন। আসলে কৃপালের ইচ্ছে ছিল যে উনি ওই মহিলার সঙ্গে একটু মদ্যপান করবেন, সময় কাটাবেন! স্বাভাবিক কারণেই রিসেপশনিস্ট এই অতিরিক্ত আন্তরিকতা ভাল চোখে দেখেননি। উনি তৎক্ষণাৎ ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্টকে জানালেন। কৃপাল ওঁর ঘর থেকেই রিসেপশনিস্টকে ফোন করেছিলেন। সুভাষ তখন ঘরে ছিলেন না। উনি অধিনায়ক নরি কন্ট্রাক্টরের ঘরে বাকিদের সঙ্গে তাস খেলছিলেন। সুভাষের এই বিষয়ে কোনও ভূমিকাই ছিল না।
সুভাষ এবং কৃপালের মধ্যে কে দোষী, তা নির্ধারণ করার জন্য এক তদন্ত কমিটি তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করে! কৃপাল অস্পষ্ট ভাবে নিজের কথা বললেও সুযোগ বুঝে নিরপরাধ সুভাষের ওপর যাবতীয় দোষ চাপিয়ে দিলেন। উনি বোঝাতে চাইলেন, সুভাষই ওই মহিলা রিসেপশনিস্টকে ফোন করে হোটেলের ঘরে ডেকেছিলেন! গুপ্তে টের পেলেন, কৃপাল পিছন থেকে ওঁকে ছুরি মেরেছেন। অথচ এর পরেও টিমমেটের প্রতি গুপ্তের মমত্ববোধ একটুও কমল না। গুপ্তে বললেন, কৃপাল কিন্তু ওই মহিলাকে আদৌ অসম্মান করতে চাননি, উনি মদ্যপান করার জন্য মহিলার সঙ্গ চাইছিলেন। শেষ পর্যন্ত বিচারের নামে প্রহসন হল। তদন্ত কমিটির এক কর্তা সুভাষকে বলেন, “তুমি কৃপালকে ফোন করা থেকে আটকাতে পারলে না!” অসঙ্গত অভিযোগ! তবু গুপ্তে জানিয়েছিলেন তিনি সেখানে ছিলেনই না। শান্ত ভাবে আরও বলেছিলেন, “কৃপালের মতো অত বড়সড় চেহারার মানুষকে আমি কী করে আটকাব!”
অধিনায়ক কন্ট্রাক্টরও বলেছিলেন যে, সুভাষ কোনও মতেই দোষী নন। অথচ ওই সময়ে এক জন ভারতীয় বোর্ড কর্তাও সঠিক ভূমিকা পালন করলেন না। তাঁরা কৃপাল এবং সুভাষ— দু’জনকেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ় সফরের জন্য ভারতীয় দল থেকে বাদ দিলেন! মানে কৃপালের পাশাপাশি সুভাষকেও অপরাধী বলে দাগিয়ে দেওয়া হল!
গুপ্তে অতি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে বড় কোনও রাজা বা আমলা বা কর্তাব্যক্তির পরিচয় ছিল না। সে কারণেই গুপ্তেকে প্রশাসকরা এ ভাবে মিথ্যা কলঙ্কে বিদ্ধ করার আগে দ্বিতীয় বার ভাবলেন না। কিন্তু সুভাষ এই অপমানটা সহ্য করতে পারলেন না। তিনি মানসিক যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে নিলেন। গুপ্তের বাবা কৃপালের বিরুদ্ধে মামলা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় সেটাও করে উঠতে পারলেন না। এ ভাবেই প্রতিভাধর সুভাষ গুপ্তের আন্তর্জাতিক কেরিয়ার মাত্র দশ বছরেই (১৯৫১-১৯৬১) শেষ হয়ে গেল! অথচ শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজ় বা ইংল্যান্ড কেন, সেই সময়ের অন্যান্য ক্রিকেট খেলিয়ে দেশগুলোর (যেমন, পাকিস্তান, নিউ জ়িল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া) খেলোয়াড়রাও ওঁর বোলিংয়ে সম্মোহিত হয়েছিলেন। অবসর নেওয়ার সময় ওঁর বয়স ছিল মাত্র ৩২! উনি মাত্র ৩৬টি টেস্ট খেলে ১৪৯ উইকেট সংগ্রহ করেছিলেন।
এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি না ঘটলে আন্তর্জাতিক ময়দানে তিনি আরও কয়েক বছর দাপট দেখাতেই পারতেন। এতে ভারতীয় দলও নিঃসন্দেহে উপকৃত হত।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের মহিলা ক্যারলের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়ে গুপ্তে স্বদেশভূমি ছেড়ে দিয়ে ত্রিনিদাদে পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করেন। কিন্তু ভারতের প্রতি ভালবাসা সুভাষের আমৃত্যু অটুট ছিল। কারও প্রতি কোনও অভিযোগ ছিল না। ওই ত্রিনিদাদেই ২০০২ সালের ৩১ মে তারিখে ৭২ বছর বয়সে প্রয়াত হন সুভাষ গুপ্তে।
ওঁর সম্পর্কে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার স্যর গ্যারি সোবার্স বলেছেন, সুভাষ গুপ্তে হলেন বিশ্বের সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনার। আর এক কিংবদন্তি স্যর এভার্টন উইকস এবং পাকিস্তানের অতীত দিনের চ্যাম্পিয়ন ব্যাটার হানিফ মহম্মদও একই মত পোষণ করেছেন। সোবার্সের এই কথাটা কে-ই বা ভুলতে পারবে, “ওয়ার্ন ইজ় দ্য লেটেস্ট, বাট ফার্গি ইজ় দি গ্রেটেস্ট!” ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান লেগ স্পিনার উইলফ্রেড ফার্গুসনের সঙ্গে গুপ্তের বোলিংয়ের মিল থাকায় গুপ্তেকে ‘ফার্গি’ বলেও ডাকা হত।
পরিসংখ্যানের বিচারে বিশ্বের সফলতম লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্ন টেস্টে ৭০৮টি উইকেট পেয়েছেন। তবে ওয়ার্ন যেখানে তাঁর সময়ের বিশ্বসেরা অস্ট্রেলিয়া দলে খেলতেন, সেখানে সুভাষ ছিলেন তাঁর সময়ে বিশ্বের অন্যতম দুর্বল এক দলের সদস্য। অনেক সময়েই তাঁকে গোটা দলের বোলিংয়ের বোঝা একাই বইতে হত। অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ থেকে বিশ্বসেরা হওয়া আর ভারতের মতো একটি দেশ থেকে বল হাতে প্রথম বিশ্বের ক্রিকেটারদের দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠার তফাত অনেকটাই। এই পার্থক্যের লিখিত রেকর্ড থাকে না, এর গুরুত্ব সংবেদনশীল ক্রিকেট-বোধের কাছে।
সুনীল গাওস্করের মতো ব্যক্তিত্বও বলেছেন, সুভাষ গুপ্তে যে শুধু এক জন বড় মাপের বোলারই ছিলেন তা নয়, মানুষ হিসেবেও উনি খুব উদার ছিলেন। সুভাষ সিনিয়র-জুনিয়র বিভাজনে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি দলের জুনিয়রদের জন্য খাবার, জলের বোতল এমনকি ক্রিকেটের সরঞ্জামও এগিয়ে দিতে দ্বিধা করতেন না। সুভাষ ভারতের হয়ে যখনই খেলেছেন, নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন। শরীরে ব্যথা-বেদনা থাকলেও উনি নিজের সেরাটুকু দিতে কখনও পিছপা হননি। আর এই গুপ্তের কেরিয়ারই শেষ হয়ে গেল ভিত্তিহীন অপবাদে। ভগবৎ সুব্রহ্মণ্য চন্দ্রশেখর থেকে নরেন্দ্র হিরওয়ানি, অনিল কুম্বলে হয়ে যুজবেন্দ্র চহাল পর্যন্ত ভারতীয় লেগ স্পিনের এই সফরে সম্ভবত সবচেয়ে সম্ভাবনাময় নামটিই আজ বিস্মৃত। এই ক্ষতি সুভাষের চেয়েও বেশি ক্রিকেটের। এই কলঙ্ক ক্রিকেটের সর্বকালীন ইতিহাসের।
য় লেগ স্পিনের এই সফরে সম্ভবত সবচেয়ে সম্ভাবনাময় নামটিই আজ বিস্মৃত। এই ক্ষতি সুভাষের চেয়েও বেশি ক্রিকেটের। এই কলঙ্ক ক্রিকেটের সর্বকালীন ইতিহাসের।