প্রবাদপ্রতিম: দায়ুদ খানের ভূমিকায় অভিনেতা স্বপনকুমার। মাঝে, পালাকার ব্রজেন্দ্রকুমার দে। ডান দিকে, নাটকের বইটির সাম্প্রতিক প্রচ্ছদপট।
বাঙালী’র পাণ্ডুলিপি হাতে আসার পর প্রমাদ গুনেছিল নট্ট কোম্পানি, উহুঁ, এ ‘বই’ করা যাবে না। ঝুঁকি হয়ে যাবে। ১৯৪৬-এর ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’-র পর থেকে কলকাতায় মেরুকরণের রাজনীতির পালে হাওয়া লেগেছে। এমন সময় প্রভাতী সঙ্গীতের আদলে ‘যিনি হিন্দুর ভগবান, মুসলমানের তিনি আল্লা, ক্রেস্তানের তিনি গড’ গেয়ে পালা শুরু করা যায়! ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’-এর দাগ না মিলোতে আগুন জ্বলেছে নোয়াখালি, বিহারে।
এই আগুনে ঝাঁপ দিয়ে কোনও এক ফকিরের গলায় ‘মিছে কেন ভেদাভেদ হিন্দু মুসলমান/ একই মালিক খোদা আর ভগবান’ গাওয়া যায় না কি? চণ্ডীদাসের পদাবলি কীর্তনের পাশে রাখা যায় ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’র স্বদেশি চেতনাকে? পূজা আর নমাজ মিশিয়ে ‘পূমাজ’ দ্বন্দ্বসমাস গড়া, নামের মধ্যেই সত্যপাল আর পিরমহম্মদকে সমান করে নেওয়া লোক-হাসানো চরিত্র সত্যপীরের রংতামাশা মেনে নেওয়া যায়?
সাহসে কুলোয়নি নট্ট কোম্পানির সর্বেসর্বা সূর্যকুমার দত্তর। ১৯৪০-এর দশক জুড়ে ব্রজেন্দ্রকুমার দে-র একের পর এক যাত্রাপালা আসরে গাওয়ার পরেও নয়। ১৯৪৭ সালে যুক্তবঙ্গের রাজনীতি যে খাতে বইছিল, তাতে বরিশাল থেকে সবে কলকাতায় ঘাঁটি গেড়ে বসা দলের পক্ষে এমন পালা নামানো বিপজ্জনক মনে হয়েছিল। নানা অ্যামেচার দলে টুকটাক অভিনয়ের পর হাত ঘুরে গিয়েছিল আর্য অপেরার গদিতে। প্রোপ্রাইটর অতুলকৃষ্ণ বসুমল্লিককে বুঝিয়েসুজিয়ে পয়সা জোগাড় করেছিলেন ম্যানেজার সৌরীন কুণ্ডু। আসরে এসেছিল ‘বাঙালী’। স্বাধীনতা লাভের ক’বছরের মধ্যেই। সুলতান দায়ুদ
খাঁ-র ভূমিকায় শরৎ মুখোপাধ্যায়। ব্রজেন্দ্রকুমারের ছেলে তরুণকুমারের মতে, ‘বাঙালী’ পালা
জোর করে করানোর পেছনে তাঁর ও পঞ্চু সেনের অবদান ছিল।
ফাটকা কাজে লেগেছিল। আর বাংলা যাত্রার ভোল পাল্টে গিয়েছিল। যুদ্ধ আর মন্বন্তরে ঝিমিয়ে পড়া চিৎপুরের পালে আবার হাওয়া আনার পিছনে সদর্থক অনুঘটকের ভূমিকা ছিল ‘বাঙালী’-র। প্রায় পাঁচ দশক ধরে নাড়া দিয়েছিল আপামর বাঙালিকে। অঘোরচন্দ্র কাব্যতীর্থের ‘নিমাই সন্ন্যাস’ ছাড়া আর কোনও যাত্রাপালার এত দিন ধরে জনচিত্তজয়ের নজির নেই। জনপ্রিয়তার নিরিখে ‘বাঙালী’ আরও এক কাঠি দড়, কারণ সে কাঁটাতারের বালাই
রাখেনি। আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদ্যাপনে আমরা যেন না ভুলি— ‘বাঙালী’ও পঁচাত্তরে পা দিচ্ছে এ বছর।
ব্রজেন্দ্রকুমার নিজের মুখেই বলে গেছেন, ‘কলকাতার দাঙ্গা ও নোয়াখালির মারণযজ্ঞের পরই আমি লিখেছিলাম ‘বাঙালী’ নাটক।’ কিন্তু কী নিয়ে এই পালা? বাংলার ওপর দিল্লিশাহির দখলদারি কায়েম হওয়া এর এক দিক। অন্য দিকে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বহিঃশত্রুর সামনে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান। ঘনিয়ে ওঠা বাঙালি-বিদ্বেষের জবাব দেওয়ার ডাক। এ পালার নায়ক বাংলার সুলতান দায়ুদ খাঁ। সুলতান হিসেবে হোসেন শাহ-র যে নামডাক, তার ছিটেফোঁটাও নেই দায়ুদ খাঁর। ইতিহাস বলছে, ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মসনদে বসা। বছর খানেকের মধ্যেই রাজমহলের যুদ্ধে মোগল ফৌজের কাছে হেরে তাঁর গদি উল্টে যায়। সুলতানশাহিরও বেলা ফুরোয়। আকবর বাদশার তাঁবে এসে ‘সুবে বাংলা’র জন্ম হয়। সিরাজউদ্দৌলাও কালান্তরের নায়ক। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র সৌজন্যে তাঁর কলঙ্কভঞ্জনের পর তাঁকে নিয়ে অনেক ফাল্গুনী রচেছে বাংলা রঙ্গমঞ্চ। কিন্তু দায়ুদ খাঁর আমলের মধ্যে সুলতানশাহির অবক্ষয়ের সার্বিক চেহারা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাননি জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরা। অথচ ব্রজেন্দ্রকুমার তাঁকেই ‘রাঙা ঘোড়ার ‘পরে’ বসিয়ে দিলেন। তার পর বটতলা থেকে যখন ছেপে বেরোল সেই পালা, তখন ‘বাঙলার গৌরব, স্বনামধন্য কর্মবীর— শ্রীযুক্ত আলামোহন দাস মহাশয়ের করকমলে’ সেটিকে ‘অর্পণ’ করলেন। ব্রজেন্দ্রকুমার এ পালার নাম দিয়েছিলেন ‘শেষ নমাজ’। আলামোহনের সুপারিশে নাম পাল্টে হল ‘বাঙালী’।
আসলে ‘বাঙালী’ বা ‘শেষ নমাজ’ খাতায় কলমে ‘ঐতিহাসিক নাটক’ হলেও কেতাবি ঢঙে পালা লেখার কোনও বাঞ্ছা ছিল না ব্রজেন্দ্রকুমারের। হাতের নাগালে যদুনাথ সরকার বা রমেশচন্দ্র মজুমদারের বই থাকলেও সেখান থেকে আবছা এক আদল ধার করেছিলেন কেবল। বাকিটা মনের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছিলেন। পরে এক বার লিখেছিলেন, ‘এর নায়ক দায়ুদ খাঁ উপলক্ষ মাত্র, তাকে অবলম্বন করে আমি একটি উদার অসাম্প্রদায়িক মানুষকে তুলে ধরেছি হিংসায় উন্মত্ত বাঙালীর চোখের সামনে।’
বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলন অথবা আজাদ হিন্দ ফৌজের লড়াইকে সংহতি জানিয়ে যে সব জনপ্রিয় যাত্রা সে আমলে হয়েছে, তা নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের ফাঁকফোকর চিনে নিয়ে কায়দা করে বেরিয়ে গিয়েছে। ব্রজেন্দ্রকুমার সে সময় সক্রিয় ও সজাগ। কাজেই ‘বাঙালী’ লেখার আসল উদ্দেশ্য হিসেবে যখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে চিনিয়ে দেন তিনি, আর ‘এজন্যে হিন্দুর ত্রুটিগুলো হিন্দুর মুখ দিয়ে এবং মুসলমানের কাজের সমালোচনা মুসলমানের বক্তব্যে আনা হয়েছিল’ বলে নজরটান দেন, তখন তাঁকে যুগস্রষ্টা মনে হয়। এর পরবর্তী তিন দশক ধরে ‘বাঙালী’র ধাঁচে যে কত পালা হয়েছে ইয়ত্তা নেই। ১৯৫০-এর দশকে পূর্ব বাংলা থেকে আসা উদ্বাস্তু বাঙালির ক্ষতস্থানে মলম লাগিয়েছিল যে ‘বাঙালী’, সেই ‘বাঙালী’ই খাস কলকাতার বুকে এক দিকে বিডন স্কোয়ার, অন্য দিকে মার্কাস স্কোয়ার-কেন্দ্রিক নাগরিক বিনোদনের সংস্কৃতির মধ্যে সেতু বেঁধেছিল। বাংলা-অসম-ত্রিপুরা দাপিয়ে বেড়িয়েছিল। বাঙালির স্বাজাত্যবোধের আগুনকে উস্কে দিয়েছিল। সম্প্রীতি-সমন্বয়ের সাধনার মধ্যে বাঙালিয়ানার আদি সূত্র খুঁজে ফিরেছিল। ব্রজেন্দ্রনাথের কলমের জোর এখানে পুরোদস্তুর ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রথম অঙ্কের চতুর্থ দৃশ্যে বিপদে পড়ে শরণাপন্ন পূজারি ব্রাহ্মণ গণপতিকে দায়ুদ বলেন, ‘তোমার ভগবানকে আমি ডাকব না সত্য, কিন্তু তার অপমানও আমি সইব না।’ প্রজারঞ্জক শাসকের এই ছবি ‘বুচার অব বেঙ্গল’ বদনাম বয়ে বেড়ানো হাসান শহিদ সূরাবর্দিকেও কি খানিক স্বস্তি দেয়নি?
অথচ ‘বাঙালী’র কাঠামো যাত্রার পুরনো গতের নয়, কতক এলিজ়াবেথান থিয়েটার থেকে ধার নেওয়া। অঘটন-সমাপতনের ঠাস বুনোটে বাঁধা। দীনবন্ধু-গিরিশচন্দ্র-দ্বিজেন্দ্রলাল-মন্মথ-শচীন্দ্রনাথের হাত-ফেরতা। আবার কলকাতার পাবলিক থিয়েটারে শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘সিরাজদ্দৌলা’র ঐতিহাসিক সাফল্যকে দেদার নজরানা দিয়েছিল ‘বাঙালী’। অসাম্প্রদায়িক— এই লব্জ তখনও চালু হয়নি, জাতীয়তাবাদের ঢেউয়ে চাপা পড়ে ছিল। এই জাতীয়তাবাদ খাঁটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যেতে একজোট হিন্দু-মুসলমান। বহিরাগত মোগল আগ্রাসনকে ঠেকাতে দায়ুদ খাঁ-প্রতাপাদিত্যের মিত্রশক্তিকে বাজি ধরেছিল ‘বাঙালী’। প্রাক-ঔপনিবেশিক কালখণ্ডকে রূপক ধরেছিল। ১৯৪৬-৪৭ খ্রিস্টাব্দে এই ধারণা বায়ুভূত মনে হয়নি। যত দিন গিয়েছে, নয়া দৌড়ের ভারত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক চেহারা যত জনমানসে কায়েম হয়েছে, তত ধসে পড়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নড়বড়ে ভিত। অথচ ‘বাঙালী’র জনপ্রিয়তায় চিড় ধরেনি। অন্তত তিরিশ বছর ধরে রমরমিয়ে চলেছে ‘বাঙালী’। খাস কলকাতার বুক থেকে অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়েছে সারা বাংলাভাষী এলাকায়। আর্য অপেরা, নবরঞ্জন অপেরা থেকে একাদিক্রমে এত দল এত অপেরা এর প্রযোজনা করেছে যে হিসেবে কুলোনো যাবে না। হাতিবাগান থেকে চিৎপুরগামী স্রোতের উল্টো দিকে সাঁতরে বিধায়ক ভট্টাচার্য-মহেন্দ্র গুপ্তর যোগসাজশে ‘লাল পাঞ্জা’ নামে আবির্ভূত হয়েছে রঙমহল থিয়েটারে। ১৯৬৭-তেই গ্রামোফোন কোম্পানির দামি লেবেল এইচএমভি-র মোহর এঁটে টার্নটেবলে ঘুরেছে। সবচেয়ে বড় কথা— দল-অপেরা নির্বিশেষে এত কম্বিনেশনে নাইট হয়েছে ‘বাঙালী’র যে এক ‘সোনাই দীঘি’ ছাড়া অন্য কোনও পালা তার ধারেকাছে আসবে না। শেষ স্মরণীয় কম্বিনেশন নাইট ১৯৯০-এর মাঝামাঝি, লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথচক্র এই বাংলার মাটি ছুঁয়ে ফেলার ঠিক ক’মাস আগে। বাংলার ভাগ্যাকাশে তত দিনে সিঁদুরে রং লেগেছে।
অথচ অন্তত তিনটি প্রজন্মের যাত্রাশিল্পীকে জুড়ে রেখেছিল এই পালা। যাত্রাজগতের দুই দিকপাল নট ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ আর পঞ্চু সেন, দুজনেই দায়ুদ খাঁ সেজেছেন বছরের পর বছর। কম্বিনেশন নাইটে পালা করে সেজেছেন। প্রথম তিনটে দৃশ্য ফণিভূষণের জন্য বাঁধা। পরেরটুকু পঞ্চু সেনের। চিৎপুর থেকে অল্প দূরত্বে শ্যাম স্কোয়ার। সেখানে এক বার ‘বাঙালী’ হচ্ছে। ওই ১৯৫০-এর দশকেই। দর্শকদের মধ্যে সবান্ধব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। ফার্স্ট হাফে ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ সাজলেন দায়ুদ খাঁ, সেকেন্ড হাফে পঞ্চু সেন। “এক জন দীর্ঘকায় উন্নতনাসা, অন্য জন বেঁটেখাটো গোলগাল। কেউ প্রশ্নও করেনি— এটা আবার কী করে হল? এতটাই সমঝদার দর্শক। অ্যালিয়েনেশনটা এমন পর্যায়ে যে ওটা কোনও ব্যাপারই না!” বলছিলেন যাত্রা ও প্রসেনিয়াম থিয়েটারে সমান সফল নট-নাট্যকার সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সুরজিতের ছোটমামা যাত্রার প্রবাদপ্রতিম নট স্বপনকুমার। ১৯৫১-এর মাঝামাঝি এক দিন সিধে আর্য অপেরার গদিতে গিয়ে কাজ চেয়েছিলেন তিনি। তখন রমরমিয়ে চলছে ‘বাঙালী’। পঞ্চু সেন করছেন দায়ুদ খাঁ, গোপাল চট্টোপাধ্যায় করছেন মোবারক। সাধারণ সিপাহসালার থেকে নাজির হয়ে ওঠা মোবারকই ‘বাঙালী’র সহনায়ক। নায়িকা আশমান সাজছেন ছবিরানি। মুনীম খাঁ-র ছোট ভূমিকায় দাগ কাটছেন বড় ভোলা পাল। চিৎপুরের ছাদে মাচা বেঁধে কিছু দিন রিহার্সালের পরে ‘বই ওপেন’ হচ্ছে ছাতুবাবুর বাজারে। হবি তো হ, শাহজাদা তথা খলনায়ক নাসির খাঁ যিনি করছিলেন, তিনি এলেন না। নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে আনকোরা স্বপনকুমারকে নামতে হল। তার পর ভিনি ভিডি ভিসি। মালা কাপ মেডেলের বন্যা। পরের বছর পঞ্চু সেন এলেন নবরঞ্জন অপেরায়, স্বপনকুমারকে নিয়ে। এ বার মোবারকের পার্ট পেলেন স্বপনকুমার, পঞ্চু সেনের দায়ুদের সামনে।
“তার পর থেকে দায়ুদ খাঁ মানেই পঞ্চু সেন, আর মোবারক মানেই স্বপনকুমার!” বলছিলেন সুরজিৎ। আর এক দিকপাল নট তপনকুমারও মোবারক সেজেছেন, ফণিভূষণের দায়ুদের সামনে। শোনা যায়, পুত্র তথা বিশ্বাসঘাতক নাসির খাঁ-কে হত্যার পর দায়ুদ-বেশী পঞ্চু সেন যেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হতেন। ডান চোখ থেকে পা পর্যন্ত একেবারে অবশ! রাজধর্ম পালন ও পুত্রশোক উদ্যাপনের এমন বিরোধাভাস দাউদের মধ্যে যে ট্র্যাজিক হিরোর ব্যঞ্জনা জুড়ে দিত, তা রোমান বা ইংলিশ ট্র্যাজেডি থেকে আলাদা, বাংলার নিজস্ব। ওই দৃশ্যে ফণিভূষণের অভিনয়শৈলী নিয়ে প্রভাতকুমার দাস লিখেছিলেন, “মরণোন্মুখ নাসিরের কণ্ঠে, বুকের ক্ষতচিহ্ন চেপে ধরে অসহায় আর্তনাদ, ‘পিতা’ সম্বোধন শুনে ফিরে দাঁড়িয়ে দায়ুদ খাঁ তাঁর হতভাগ্য পুত্রকে ইঙ্গিতে খোদাকে ডাকার নির্দেশ দিতেন, উপরের দিকে আঙুল তুলে। তার পর প্রস্থান করতেন।”
এ ধরনের অভিনয় সেলুলয়েডে ধরা নেই, রিপোর্ট-রিভিউতেও নয়, স্মৃতিপট থেকেও দ্রুত মুছে যাচ্ছে। চিৎপুরের যাত্রা মহল্লা থেকে এখন ১৯৫০ শুধু নয়, ১৯৬০-১৯৭০’এর মেজাজটাও উধাও হয়ে গেছে। যাত্রার পুরনো সব গড় আজ টালমাটাল। তবু ‘বাঙালী’ নিয়ে কিংবদন্তির শেষ নেই।
খুব সম্ভবত ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি খাদ্য সঙ্কটের সময় এক বার বর্ধমানের কোথাও একটা আসরে ‘বাঙালী’ গাওয়া হবে। পঞ্চু সেন দায়ুদ খাঁ সেজে মঞ্চে উঠতে যাবেন, পাশ থেকে এক রসিক দর্শক ফুট কাটলেন, ‘বাবা, নবাবটা কোন রেশনের চাল খায় রে?’ পঞ্চু সেন ওই অবস্থাতেই পাল্টা দিলেন, ‘তোর বাবা যে দোকানের কুলি ছিল!’ বলে মঞ্চে ঢুকে গেলেন। কিন্তু ব্যাপারটা ওখানেই শেষ হয়নি। ওই রসিকের ট্যাঁকের জোর ছিল। প্রকাশ্য মঞ্চ থেকে পিতৃপুরুষের অপমানের জের টেনে পঞ্চু সেনকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার মহড়া চলেছিল। বেকায়দায় পড়ে মাথা খাটিয়ে শেষটায় পঞ্চু সেনকে শাড়ি পরিয়ে বৌ সাজিয়ে বার করে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বপনকুমার। স্টেশনে পৌঁছে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন!
সে সময়ের কলকাতার থিয়েটারে কম্বিনেশন নাইট মানেই ‘সাজাহান’। যাত্রায় কম্বিনেশন নাইট মানেই ‘বাঙালী’। একটু পরের দিকে ‘সোনাই দীঘি’। সুরজিৎ প্রথম ‘বাঙালী’ দেখেছেন ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে, মহাজাতি সদনে। কম্বিনেশন নাইট। হাজার তারার আলোয় ভরা সেই রাতে কারা মঞ্চে ছিলেন? সুরজিতের মনে পড়ে, ‘বড় ভোলা পাল সেজেছেন দায়ুদ খাঁ, ছোটমামা (স্বপনকুমার) মোবারক, ছোট ভোলা পাল মুনীম খাঁ, বেলা সরকার ছবি, জ্যোৎস্না দত্ত আশমান, মিতা চট্টোপাধ্যায় বাঁদি, পান্না চক্রবর্তী বান্দা, দিলীপকুমার আলি মনসুর, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সত্যপীর, গুরুদাস ধাড়া ফকির আর নাসির খাঁ হচ্ছেন অভয় হালদার।’
এ ধরনের কম্বিনেশন নাইটে নাসির খাঁ-র ভূমিকায় অভয় হালদার ছিলেন প্রায় অটোমেটিক চয়েস। ১৯৭২-এ অভয়ের বড় ছেলে অমিয়শঙ্কর প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরোননি, অথচ যাত্রায় নেশায় বুঁদ। বাবার প্রশ্রয় মিললেই আসরে পৌঁছে যান। কানায় কানায় ভরা মহাজাতি সদনের দোতলায় বসে ‘বাঙালী’ দেখেছিলেন ছোট অমিয়শঙ্কর। তাঁর ভাসা-ভাসা মনে আছে, “প্রত্যেক সিনে হাততালি পড়ছে। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়! আর পুলিশ কর্ডন করে স্বপনকুমারকে নিয়ে আসা হচ্ছে।” এত পুলিশ কেন? খোলসা করলেন সুরজিৎ। আসলে স্বপনকুমার তখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। “তাঁর স্ত্রী গুন্ডা লাগিয়ে দিয়েছেন। কোথাও অভিনয় করতে দেবেন না। স্বপনকুমার যাত্রা করতে পারবেন না। স্বপনকুমারের অভিনয় যাত্রার মানুষ দেখতে পারবেন না, এমন একটা অবস্থা!” এই সময় গোরাচাঁদ রায় নামে ডাকাবুকো এক আয়োজক ‘দেখি কে আপনাকে টাচ করে’ মেজাজের কসম খেয়ে ‘বাঙালী’র এই কম্বিনেশন নাইটের ব্যবস্থা করেন। পুলিশ না থাকলে চলে!
এর দু’বছর বাদে, ওই মহাজাতি সদনেই পশ্চিমবঙ্গ যাত্রাশিল্পী সংসদের যাত্রা উৎসবের শেষ দিনে আবার ‘বাঙালী’র কম্বিনেশন নাইট। তাতে দায়ুদ খাঁ করলেন স্বপনকুমার। তপনকুমার মোবারক। ফুলবেগম জ্যোৎস্না দত্ত।
সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে পড়ে, ১৯৯-এর বর্ষাকালে, রবিবারের এক সকালে ‘বাঙালী’র কম্বিনেশন নাইট হয়েছিল, যাত্রাপ্রহরীর আয়োজনে। ‘বাম্পার হাউস!’ তাতে দায়ুদ খাঁ সেজেছিলেন স্বপনকুমার। বছর খানেক আগে যাত্রায় এসে সাড়া ফেলে দেওয়া সন্তু মুখোপাধ্যায় সেজেছিলেন মোবারক। শেখর গঙ্গোপাধ্যায় মুনীম খাঁ। স্বপন সেনগুপ্ত আলি মনসুর। সত্যপীর অমিতকান্তি ঘোষ। ফকির গুরুদাস ধাড়া। ফুলবেগম শর্মিষ্ঠা গঙ্গোপাধ্যায়। বর্ণালী বন্দ্যোপাধ্যায় ছবি। সুরজিৎ সেজেছিলেন বান্দা। মামা-ভাগ্নের সেই প্রথম যুগল স্টেজ অ্যাপিয়ারেন্স। এই কম্বিনেশন নাইট ঘিরে হইহই রইরই কাণ্ড হতে স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া নড়েচড়ে বসে। নজরুল মঞ্চে বিশেষ আমন্ত্রণমূলক আসর বসে। চরিত্রলিপিতে সামান্য অদলবদল হয়। শেখর, শর্মিষ্ঠার জায়গায় আসেন শিবদাস মুখোপাধ্যায়, জ্যোৎস্না দত্ত। এর কাছাকাছি সময়ে অমর গঙ্গোপাধ্যায়কে দায়ুদ খাঁ আর সন্তু মুখোপাধ্যায়কে মোবারক সাজিয়ে ‘বাঙালী’ করার তোড়জোড় হয়েছিল। দানা বাঁধেনি।
তবে হারিয়ে যায়নি ‘বাঙালী’। কম্বিনেশন নাইটের সুবাস বয়ে ‘বাঙালী’ রয়ে গেছে এক ডজন ইপি রেকর্ডের সেটে। পঞ্চু সেনের নির্দেশনায়, সবিতাব্রত দত্তর সুরযোজনায়। নাট্যশোধ সংস্থান বা একাডেমি থিয়েটারের মহাফেজখানায় তা সংরক্ষিত। তবে তা চার ঘণ্টার পালার ৩৬ মিনিটের সংস্করণ! ১৯৯০-এর কম্বিনেশন নাইটের ভিডিয়ো রেকর্ডিং করা হয়েছিল। সংগ্রাহক দেবজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন সেটি তাঁর জিম্মায় আছে।
১৯৪৬ সালের ১৬ অগস্টের পরের বাংলা আর ২০২১-এর এপ্রিলের পরের পশ্চিমবঙ্গের মিল নেহাত কম নয়। ধর্ম-জিগির বাড়ছে। ভারত তো বটেই, ভাঙা বাংলার সব টুকরোটাকরায় হিন্দু-মুসলমানকে লড়িয়ে দেওয়ার মহড়া চলছে। স্কুলের টেক্সট থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে পৈতে-টিকি-টুপি-টোপর উঁকি মারছে। হালে মালুম যে ‘সোনার বাংলা’র খোয়াবনামাতেও সাম্প্রদায়িক ফাটল ধরানো হচ্ছে। অপর পাতে ব্রজেন্দ্রনাথের ‘বাঙালী’ বলছে ‘মুসলমানেরও নয় হিন্দুরও নয়, এ রাজত্ব বাঙালীর। হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই দেশ এই সোনার বাঙলা। এর প্রতি মৃত্তিকাকণায় উভয়েরই সমান অধিকার। এ অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করবার সাধ্য নবাবেরও নেই, বাদশাহেরও নেই।’
বুঝ লোক যে জান সন্ধান!