গণবিক্ষোভ: ১৯৪৬ সালের নৌবিদ্রোহের শরিক হয়ে গোটা বম্বে শহর নেমে এসেছিল পথে। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড করে গড়ে তুলেছিল ব্রিটিশ-বিরোধী প্রতিরোধ।
ফণিভূষণ ভট্টাচার্যর জন্ম বরিশালে। ১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি কারারুদ্ধ হন। ছাড়া পাওয়ার পর ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর ভিতরেই বিদ্রোহের আগুন জ্বালার লক্ষ্যে ফণিভূষণ যোগ দেন নৌসেনাবাহিনীতে। তাঁকে ‘রিক্রুট’ করা হয় বম্বের ক্যাস্ল ব্যারাকে— ১৯৪৬-এর ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে শেষ ঐতিহাসিক সশস্ত্র নৌবিদ্রোহের সলতে পাকানোর কাজটা শুরু হয়েছিল তার দু’বছর আগে— এই ক্যাস্ল ব্যারাক থেকেই। এই বিদ্রোহেরও প্রাথমিক কারণ ছিল নৌসেনাদের জন্য বরাদ্দ নিকৃষ্টমানের খাদ্য, গোরা সেনা-অফিসারদের কালা চামড়ার দেশি ফৌজের প্রতি অকথ্য ব্যবহার প্রভৃতি।
তবে এর সঙ্গে আর একটা কারণও ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফ্রন্টে লড়াই করা ভারতীয় সৈন্যরা সেই প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁদের শক্তির অভাব নেই। এই সময়েই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের নানা বীরত্বের কাহিনি তাঁরা জানতে পারছিলেন বিভিন্ন সূত্র মারফত। ৯ অগস্ট, ১৯৪৩ ‘অগস্ট আন্দোলন’-এর বর্ষপূর্তির দিনই নৌবাহিনীর মদনলাল সাক্সেনা, স্থলবাহিনীর চন্দ্র সিংহ গঢ়বাল আর বিমানবাহিনীর পি কোট্টায়ামের নেতৃত্বে একটি জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি তৈরি হয়। সিদ্ধান্ত হয় পরের বছর, ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪, সেনাবাহিনীর সব ক’টি শাখায় একযোগে বিদ্রোহ শুরু হবে। প্রথম ধাপে ‘নো ফুড নো ওয়ার্ক’ স্লোগান তোলা হবে, পরের ধাপে ‘ব্রিটিশ, তুমি ভারত ছাড়ো’ এই দাবিই হয়ে উঠবে মুখ্য।
নৌবাহিনীর এই প্রথম পর্যায়ের বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়ে যায়। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই খবর পেয়ে গ্রেফতার করেন দুই মহিলা নৌসেনা অনুভা সেন ও ঊর্মিলা বাইকে। তখন বিদ্রোহের দিন এগিয়ে আনা হয় এক সপ্তাহ আগে, ১১ ফেব্রুয়ারিতে।
সে দিন ব্রিটিশ ফৌজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন ভারতীয় নৌসেনারা। ক্যাস্ল ব্যারাকে ব্রিটিশ কম্যান্ডার ইনিগো জোন্সের নির্দেশে গুলি চালায় গোরা সৈন্যরা। বম্বে এবং করাচি— দুই ব্যারাক মিলিয়ে গোরা সৈন্য নিহত হন ৩৫ জন, আহত প্রায় ৩০০ জন। ভারতীয় সেনা নিহত হন ১১ জন, আহত ৬০০-রও বেশি। মোট সাড়ে পাঁচ হাজার ভারতীয় নৌসেনা গ্রেফতার হন, তাঁদের কোর্ট মার্শাল হয়। ওই দুই মহিলা ভারতীয় অফিসারের উপর নৃশংস যৌন নির্যাতন চালানোর পর তাঁদের গুলি করে মারা হয়।
মুলতান জেলে নারকীয় বন্দিজীবন কাটিয়ে ফণিভূষণ দেশজোড়া আন্দোলনের চাপে ছাড়া পান। কিন্তু তত দিনে তাঁর মানসিক শক্তি নিঃশেষিত। স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁকে বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বিয়ের রাতে স্ত্রীকে একটি চিঠি লিখে ঘর ছাড়েন। ৯ নভেম্বর, ১৯৪৫ তিনি ফের বম্বে পৌঁছন। তার পর মরাঠি পি আপ্তে ছদ্মনাম নিয়ে আবার যোগ দেন ‘এইচএমআইএস তলোয়ার’ জাহাজে। এই জাহাজই পরে হয়ে উঠেছিল ১৯৪৬-এর ফেব্রুয়ারি মাসের নৌবিদ্রোহের ঝটিকাকেন্দ্র। অনেকেই মনে রাখেন না যে, ‘তলোয়ার’ শুধু যুদ্ধজাহাজ নয়, এটি একটি নৌসেনাকেন্দ্র, যার মধ্যে ছিল যুদ্ধ-প্রশিক্ষণ স্কুল, একাধিক জাহাজ এবং সেনানিবাস।
উৎপল দত্তর ‘কল্লোল’ নাটকে ‘তলোয়ার’ জাহাজের বিদ্রোহকে কিছুটা ছোট করে ‘খাইবার’ জাহাজের বিদ্রোহীদের অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, দেখানো হয়েছে, ‘খাইবার’ জাহাজের বিদ্রোহী সেনারা কাস্তে-হাতুড়ি-চিহ্নিত পতাকা ওড়াচ্ছেন, ‘পিপলস মার্চ’ পড়ছেন— কিন্তু গোটা নৌসেনাবাহিনীর মধ্যে সে দিন কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা ছিল নামমাত্র। বরং বিদ্রোহের আঁচ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার পর বম্বে শহরে যে অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল, তার নেতৃত্বে ছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বিভিন্ন ফ্রন্টের নৌসেনারা জড়ো হলেন ‘তলোয়ার’ সিগন্যাল স্কুলে। তাঁরা দেখলেন, প্রশিক্ষণকেন্দ্র জুড়ে চূড়ান্ত অব্যবস্থা। শৃঙ্খলা নেই, চার দিক অপরিচ্ছন্ন, খাবারের মান তলানিতে ঠেকেছে। যে সেনারা সেখানে একত্র হলেন এবং নৌবিদ্রোহের সক্রিয় নেতা হয়ে উঠলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বলাইচন্দ্র দত্ত। বর্ধমানের রায়না গ্রামের এই যুবক টেলিগ্রাফিস্ট হিসেবে যোগ দেন বাহিনীতে। মালয়ের যুদ্ধফেরত সলিল শ্যামের কাছে তিনি শোনেন সুভাষচন্দ্র বসুর অকুতোভয় বীরত্বের কাহিনি। ‘তলোয়ার’ জাহাজে যোগ দিয়ে বলাইচন্দ্র টের পেলেন, নৌসেনাদের মধ্যে বিদ্রোহ আর অসন্তোষের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে। একটা ছোট্ট বিপ্লবী গ্রুপ গড়ে তুললেন বলাইচন্দ্র।
প্রথম অন্তর্ঘাতের ঘটনাটি ঘটল পয়লা ডিসেম্বর, ১৯৪৫— নৌসেনা দিবসে। আগের দিন থেকে পতাকা এবং নানা রকম সরঞ্জাম দিয়ে সাজানো হয়েছিল ‘তলোয়ার’ জাহাজ। পরের দিন দেখা গেল, প্যারেডের ময়দানে পড়ে আছে ছেঁড়া কাগজ, পোড়া পতাকার টুকরো, ঝাঁটা, বালতি ইত্যাদি। দেয়ালে বিশাল স্লোগান— ‘ব্রিটিশ, ভারত ছাড়ো’। পোস্টার লেখার পর তাড়াহুড়ো আর ক্লান্তিতে আঠার শিশিটা লুকোতে ভুলে গিয়েছিলেন বলাই। ভোরবেলা সান্ত্রিরা গ্রেপ্তার করে তাঁকে। কম্যান্ডার কিং-কে তিনি মুখের উপর জবাব দিলেন— “ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড়াতে আমি প্রস্তুত।”
বলাইচন্দ্রের গ্রেফতারের খবর বম্বের কাগজে বেরোতেই শহর জুড়ে আগুন জ্বলে উঠল। সতেরো দিন বন্দি থাকার পর ব্যারাকে ফিরে নতুন করে মিউটিনির প্রস্তুতি শুরু করলেন তিনি। সঙ্গে পেলেন এক কাশ্মীরি ব্রাহ্মণকে— কৈলাসনারায়ণ টিকু।
১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৬ আগুনের ফুলকি উড়ে এল জাহাজে। শুরু হল ‘খাদ্য বয়কট’ আন্দোলন। ফ্ল্যাগ অফিসার র্যাটট্রে এবং কম্যান্ডার কিং-কে ঘিরে ফেললেন নৌসেনারা। ঘন ঘন স্লোগান উঠছে, ব্রিটিশ সেনাদের সঙ্গে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেছে।
বিকেলের মধ্যে ‘তলোয়ার’ জাহাজ ব্রিটিশ শাসনের আওতা থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করল। নামিয়ে দেওয়া হল ইউনিয়ন জ্যাক, উড়ল তেরঙা পতাকা। গঠিত হল একটানা ধর্মঘটের জন্য সেন্ট্রাল স্ট্রাইক কমিটি। তাদের প্রতিটি দাবি রাজনৈতিক—আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দি-সহ সমস্ত রাজবন্দির মুক্তি, ইন্দোনেশিয়া থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপসারণ এবং সর্বোপরি, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ থেকে ভারতের মুক্তি। গোটা বম্বে শহর হতভম্ব হয়ে যায় এই আকস্মিক বিদ্রোহে। ফ্রি প্রেস জার্নালে ধর্মঘটের খবর বেরোতে থাকে।
ইতিমধ্যে ক্যাস্ল ব্যারাকে খবর পৌঁছে যায়, ব্রিটিশ সৈন্যরা ‘তলোয়ার’ জাহাজে ভারতীয় ফৌজের উপরে গুলি চালাচ্ছে। নৌসেনারা ‘তলোয়ার’-এর দিকে ছুটে গেল। পথে দফায় দফায় সংঘর্ষ হল গোরা সৈন্যদের সঙ্গে। তারা ব্রিটিশ দোকানপাট ভাঙচুর করল। আমেরিকান লাইব্রেরির পতাকা টেনে নামিয়ে দিল। স্লোগান তুলল—‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। বম্বের সমুদ্রতীরের সমস্ত জাহাজ, নৌবহর, সেনানিবাসে উড়ছে জাতীয় পতাকা। সর্বাত্মক ধর্মঘট। বিদ্রোহী সেনার সংখ্যা কুড়ি হাজার। স্ট্রাইক কমিটির নতুন সভাপতি হলেন সিগন্যালম্যান এম এস খান, সহ-সভাপতি টেলিগ্রাফিস্ট মদন সিংহ। মদন সিংহ ছিলেন বলাইচন্দ্রের বন্ধু। ‘রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি’-র নাম বদলে ফেললেন বিদ্রোহীরা, নিজেদের পরিচয় দিলেন ভারতের জাতীয় নৌবাহিনী রূপে। স্ট্রাইক কমিটির কেন্দ্র— ‘তলোয়ার’।
তত ক্ষণে বম্বের রাস্তায় রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে বিদ্রোহী সেনাদের সমর্থনে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ আর কমিউনিস্ট পার্টির স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল। তাদের স্লোগান— ‘হিন্দু-মুসলিম এক হো’, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। তেরঙা, চাঁদ-তারা, কাস্তে-হাতুড়ি পতাকা পাশাপাশি শোভা পাচ্ছে মজদুর-শ্রমিকদের হাতে-হাতে। ২০ ফেব্রুয়ারি এসে পৌঁছলেন গোটা নৌবাহিনীর ফ্ল্যাগ অফিসার জে এইচ গডফ্রে। তিনি নৌসেনাদের নির্দেশ দিলেন শিবিরে ফেরার। তাঁর কথায় ছিল প্রচ্ছন্ন হুমকি। এ বার নৌসেনারা বুঝতে পারলেন, ব্রিটিশ সরকার চূড়ান্ত আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আসলে গডফ্রে চাইছিলেন সেনা-ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্য সময় নিতে। দেশের একাধিক জায়গায় বায়ুসেনা এবং পদাতিক সেনাও তখন নৌবিদ্রোহের সমর্থনে এসে দাঁড়াতে চাইছেন। করাচি, পুণের সেনা-ঘাঁটিতেও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছিল। করাচির ‘হিন্দুস্তান’, ‘বাহাদুর’, ‘হিমালয়’, ‘চম্পক’ এবং ‘কাথিয়াওয়াড়’ জাহাজের নাবিকরা বিদ্রোহ করলেন। বম্বের নৌসৈনিকরা যখন তাঁদের বিদ্রোহে পরাস্ত হতে বসেছেন, তখনও করাচির নৌবন্দরে বিক্ষোভের মশাল ছিল প্রজ্জ্বলিত।
অগ্নিবাহক: ফণিভূষণ ভট্টাচার্য বিদ্রোহ করতেই যোগ দেন নৌবাহিনীতে।
২১ ফেব্রুয়ারি গুলি চলল ক্যাস্ল ব্যারাকে। গুলি চালাল ভারতীয় সেনা, ব্রিটিশ আর্মি অফিসারদের নেতৃত্বে। কিন্তু মুহূর্তেই ঘটনা বদলে গেল। ব্যারাক থেকে নৌসেনারা বেরিয়ে এসে উদাত্ত আহ্বান জানাল ভারতীয় সেনাদের প্রতি— “বন্ধুরা, আমাদের লড়াই স্বাধীনতার জন্য... তোমরাও তো এই দেশেরই সন্তান!” এই আহ্বান ম্যাজিকের মতো কাজ করল। মরাঠা রেজিমেন্ট গুলিচালনা বন্ধ করে দিল। তত দিনে ২২ ফেব্রুয়ারি বম্বে শহর জুড়ে নৌবিদ্রোহের সমর্থনে ধর্মঘট ডেকেছে কমিউনিস্ট পার্টি। বেলা এগারোটা নাগাদ গুলি চলল ‘তলোয়ার’ জাহাজে। সেনাদের একাংশ সরে গেলেন ‘নর্বদা’ নামের অন্য একটি ছোট জাহাজে। রেডিয়ো-সাঙ্কেতিক বার্তায় জাহাজে জাহাজে খবর পাঠানো হচ্ছিল। ইতিমধ্যে বম্বে শহরে রটে গেছে পুরো জাহাজঘাটা অবরোধ করে ব্রিটিশ বাহিনী ভারতীয় নৌসেনাদের না খাইয়ে মারতে চায়। বন্দরের জাহাজ থেকে পাঠানো নৌকোয় খাবারের প্যাকেট তুলে দিতে লাগলেন সাধারণ মানুষ, তাঁদের সঙ্গে হাত লাগালেন কাঁধে রাইফেল-ঝোলানো ভারতীয় সেনা। ব্রিটিশ বাহিনী অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে গোটা দৃশ্য দেখতে লাগল। ‘তলোয়ার’ জাহাজের মূল প্রবেশপথ দিয়েও ভিতরে ঢুকছিল খাবার। জাহাজের দেড় হাজার নৌসেনার জন্য মজুত হচ্ছিল খাদ্যদ্রব্য। দুপুর আড়াইটের সময় এক দিকে গডফ্রে ঘোষণা করলেন, প্রয়োজনে পুরো নৌবহর গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। পাশাপাশি স্ট্রাইক কমিটির সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে এলেন সরকারি ‘পিস পার্টির’ লোকজন। বিদ্রোহীরা কিন্তু অস্ত্র সমর্পণ করলেন না, জানিয়ে দিলেন, ব্রিটিশ সৈন্য না সরলে কোনও আলোচনা সম্ভব নয়। তত ক্ষণে অস্ত্রযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেছে। ১০ জন নৌসেনা এবং ১৫ জন ব্রিটিশ ফৌজ নিহত। কমিউনিস্ট পার্টি ধর্মঘটের সমর্থনে যে মঞ্চ বেঁধেছিল, সেখানে অন্যতম আকর্ষণ ছিল শিল্পী চিত্তপ্রসাদের আঁকা শিকল-ছেঁড়া এক নৌসেনার বিশাল ছবি। মিলিটারির গুলিতে শহিদ হলেন কমিউনিস্ট নেত্রী কমল ধোন্দে। কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি এবং ফরোয়ার্ড ব্লকও এই ধর্মঘটে যোগ দিয়েছিল।
তত দিনে অ্যাডমিরাল গডফ্রে ঘোষণা করেছেন, বম্বে শহর বিদ্রোহী জনতার থেকে দখলমুক্ত করা হবে। নৌসেনারা যেন নীল বা কালো পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পণ করেন। যখন রেডিয়োয় এই ঘোষণা হয়, তখন শহরের রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড গড়ে ব্রিটিশ সেনার বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরোধ চলছে। শ্রমিকপল্লির রাস্তা খুঁড়ে, জলের ড্রামের আড়াল থেকে লাগাতার ব্রিটিশ সেনার উপর ইট-পাটকেল ছুড়ছে জনতা। একশোরও বেশি মৃতদেহ সরিয়ে বম্বে শহর দখল করতে নামানো হয়েছিল ব্রিটিশ ট্যাঙ্ক। পরে গভর্নরের রিপোর্টে স্বীকার করা হয়, পুলিশের গুলিতে ২২৮ জন সাধারণ মানুষ মারা গেছেন, আহত ১০৪৬। কমিউনিস্ট পার্টির আলোকচিত্রী সুনীল জানা ডোম সেজে মর্গে ঢুকে মৃতদেহের স্তূপের ছবি তুলে এনেছিলেন। বম্বের রাস্তা যখন রক্তে ভেসে যাচ্ছে, নৌসেনারা কিন্তু তখন যুদ্ধবিরতির নীতি মেনে ব্যারাকে বসে আছেন। কিছু অত্যুৎসাহী সৈনিক সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে রাইফেল চালানোর কাতর আহ্বান জানালেও বাকি সেনারা সাড়া দেননি। কারণ, তেজ, সাহস থাকলেও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং পরিণত বুদ্ধির অভাব ছিল সে দিন নৌবিদ্রোহীদের। তাঁরা ছিলেন, বলাইচন্দ্র দত্তের ভাষায়—‘অনভিজ্ঞ’। তিনি লিখেছেন—“অসন্তোষকে বিদ্রোহের স্তরে নিয়ে গিয়ে আমরা বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু আমরা হেরে গেলাম। আমরা একটা অভ্যুত্থান ঘটালাম, কিন্তু তাকে পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারলাম না... আমরা শিশুর মতো কেঁদেছিলাম। আমাদের চোখের জল আগুন নেভাতে পারেনি।” ২৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ছ’টায় আত্মসমর্পণের পতাকা তোলা হয়। ‘তলোয়ার’ জাহাজে তখন জড়ো হয়েছেন ছাব্বিশটি জাহাজের নাবিক আর ব্যারাকের সেনারা। বলাই দত্তের মনে হল, তীব্র অবসাদ আর ব্যর্থতা তাঁকে গ্রাস করেছে। তিনি নিজের কাছে রাখা আন্দোলনের সব কাগজপত্র জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। ব্রিটিশ ভারতের শেষ সশস্ত্র বিদ্রোহ এই ভাবে শেষ হয়ে যাওয়ার পিছনে আসল কারিগর ছিল সে দিনের মূলধারার জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব। জওহরলাল নেহরু, মহম্মদ আলি জিন্না, মহাত্মা গাঁধী— কেউই সে দিন চাননি বিদ্রোহীদের পাশে রাজনৈতিক ভাবে দাঁড়াতে। গাঁধী এই আন্দোলনের সহিংস পন্থা সমর্থন করেননি। বল্লভভাই পটেল বলেছিলেন, ‘এগুলো কিছু মাথাগরম ছেলেছোকরার কাজ।’ সকলেই বলেছিলেন, নৌসেনাদের সুযোগ-সুবিধে, খাওয়াদাওয়ার উন্নতিতে সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু এটা যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক রক্তক্ষয়ী গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়, জাতীয় নেতারা বুঝতে চাননি। বিদ্রোহ শেষে মোট সাড়ে চার হাজার নৌসেনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
ফণিভূষণ ভট্টাচার্য স্বাধীনতার পর রেলবিভাগে চাকরি পান। রেলশ্রমিকদের জন্য পে-কমিশন তৈরির আন্দোলনে যুক্ত থাকার অপরাধে স্বাধীন ভারতের সরকার তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হন। শেষজীবন প্রাইভেট টিউশনি করে চলত। পাইকপাড়া অঞ্চলে ‘শহিদ স্মৃতি বিদ্যালয়’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। কড়া নজরদারিতে থাকলেও বলাইচন্দ্র গ্রেফতার হননি। স্বাধীনতার পর তিনি ফ্রি প্রেস জার্নালে যোগ দেন। সাংবাদিকতা এবং বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করেন। নৌবিদ্রোহে আর এক জন বাঙালির কথাও স্মরণীয়— বিশ্বনাথ বসু। এঁরা সকলেই নৌবিদ্রোহের জ্বলন্ত মশাল ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন। ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়ের এক বিস্মৃত অধ্যায় এই নৌবিদ্রোহের ৭৫ বছর পূর্তি হল এ বছর।
তথ্যঋণ: সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, অমলেন্দু সেনগুপ্ত