দিন দশেক আগের কথা। ৩১ জুলাই ২০২০। লন্ডনের ইসলিংটনের পিয়ার্স পোলকিস-এর বাড়িতে সরসর করে ঢুকে এল একটা সবুজ সাপ। পোলকিস আঁতকে উঠতে গিয়ে দেখলেন তাঁর ছেলে রিকার্স আনন্দে লাফাচ্ছে। বাড়ির দরজায় তার বন্ধু অ্যালবাস সেভেরাস পটার দাঁড়িয়ে। আজ তার বাবা হ্যারি পটারের ৪০তম জন্মদিন। রিকার্স-কে নেমন্তন্ন করতে এসেছে। এই করোনার মরশুমে কোত্থাও যাওয়া চলবে না— খ্যাঁকখ্যাঁক করে উঠতে গিয়ে পোলকিস দেখলেন, সাপটার সঙ্গে হিসহিস করে কথা বলছে অ্যালবাস। গুম মেরে গেলেন পোলকিস। ত্রিশ বছর আগে বন্ধু ডাডলে-র জন্মদিনে চিড়িয়াখানা গিয়েছিলেন তাঁরা। আর ঠিক এই ভাবে, একটা বোয়া কনস্ট্রিকটরের সঙ্গে গল্প করেছিল এই অ্যালবাসের বাবা, হ্যারি পটার।
অ্যালবাস অলস ভাবে বলল, ‘আমি পাশের বাড়িতেই থাকি। আপনি মাগল। আপনাদের চোখে তাই আমাদের বাড়িটা অদৃশ্য। তাই দেখতে পান না, আমাদের বাড়ির চার পাশে প্রায়শই একটা হাতি উড়ে বেড়ায়।’ পোলকিস-এর মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল। তাঁর কেমন মনে হল, রাস্তার বেড়ালটা তাঁদের দরজায় ঝোলানো ঠিকানাটা পড়ছে। তার মুখে মাস্ক, চোখে চশমা।
সেই অদৃশ্য বাড়িটার ভিতরে তখন হইহই করছে হ্যারি আর জিনি, রন আর হারমায়নি। কারণ, বিরাট মনের বিশাল মানুষ হ্যাগ্রিড এসে গিয়েছে। হারমায়নি জাদুদণ্ড তাক করে বলল ‘ডিসইনফেকটো’। স্যানিটাইজ় করার পর হ্যাগ্রিডকে জড়িয়ে ধরল ওরা। দেখলে কে বলবে, ওরা এখন এমন সব তালেবর। হ্যারি গণ্যমান্য অ্যরর, মিনিস্ট্রি অব ম্যাজিকের জাদু-পুলিশ দফতরের বড় কর্তা। স্ত্রী জিনি ‘ডেলি প্রফেট’ কাগজের ক্রীড়া সম্পাদক। তার ভাই রন উইজ়লি’-র কৃতিত্বেই ডায়াগন অ্যালে-তে যমজ দাদাদের ‘জোক শপ’-টা ফুলেফেঁপে উঠেছে। রনের স্ত্রী হারমায়নি গ্রেঞ্জার তো স্বয়ং মিনিস্টার অব ম্যাজিক। হ্যারির বড় ছেলে জেমস সিরিয়াস সদ্য হগওয়ার্টস থেকে পাশ করে বেরিয়েছে। হ্যারি-জিনির বাকি দুই ছেলে মেয়ে অ্যালবাস সেভেরাস, লিলি লুনা আর রন-হারমায়নি’র বাচ্চারা এখন হগওয়ার্টস-এর ছাত্রছাত্রী। স্কুলের সেশন-ব্রেকে বাড়ি এসেছে। বাবা-মায়েদের ছেলেমানুষি দেখে আহ্লাদে লুটোপুটি খাচ্ছিল। হঠাৎ সামলেসুমলে সোজা হয়ে বসল। পোলকিসের দেখা চশমা পরা বেড়ালটা তাদের দিকে কটমট করে তাকিয়েছিল যে! তখন তিনি আর নিছক বেড়াল নন। স্বয়ং হেডমিস্ট্রেস মিনার্ভা ম্যাকগোনেগল! প্রফেসর অব ট্রান্সফিগারেশন। বেশি ট্যাঁফোঁ করলেই কাছিম কিংবা করোনা বানিয়ে দেবেন! এখন অবশ্য স্মিত হেসে হ্যারিকে বার্থডে গিফটটা দিলেন। একটা টাইম টার্নার। যার সাহায্যে অতীত ও ভবিষ্যতে যাওয়া যায়। হ্যারিরা অতীতেই যেতে চাইল।
উফ্! কী বিচিত্র আর ঘটনাবহুল ছিল হ্যারির ১১ বছরের সেই জন্মদিন। সে সময় হ্যারি ভার্নন ডার্সলেদের সিঁড়ির নীচের কাবার্ডের খুপরিতে থাকত। বাপ-মা মরা রোগাভোগা ছেলে, ভাঙা চশমা। মাসি-মেসো, তুতো ভাই ডাডলে আর তার শাগরেদ পোলকিস, ডেনিসরা তাকে রোজ পেটাত। তবু এক দিন রাত বারোটার ঘরে কাঁটা ছুঁতেই ধড়াম করে দরজা খুলে ঢুকল হ্যাগ্রিড। পকেট থেকে বার করল জন্মদিনের কেক, পুরুষ্টু সসেজ। ডার্সলে’রা কাঁউমাউ করছিল বলে ডাডলে’র প্যান্টের ভিতর থেকে মাংসল লেজ গজিয়ে দিল। জম্পেশ শাস্তি। হ্যাগ্রিড জানাল, হ্যারি বিখ্যাত উইজ়ার্ড জেমস আর লিলি-র সন্তান। ভয়ঙ্কর জাদুকর ভল্ডেমর্ট তাকে মারতে এসেছিল। কিন্তু বাবা-মা প্রাণ দিয়ে হ্যারিকে বাঁচান। এক বছরের খোকাকে ঘিরে ধরে ভালবাসার বর্ম। তাই ভল্ডেমর্টের মৃত্যুবাণ হ্যারির কপালে একটা বিদ্যুৎচমকের মতো ক্ষত ছাড়া কিছুই করতে পারেনি। বরং উল্টে নিজেই ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিল অন্ধকারের অধীশ্বর। আর এ বার সময় হয়েছে, হ্যারিকে হগওয়ার্টস স্কুলে জাদুবিদ্যা শিখতে যেতে হবে। হাজার বছরের এই ইস্কুল জাদুদুনিয়ার স্তম্ভ। মাগলরা, অর্থাৎ যারা নাকি জাদু-টাদু জানে না, তারা অবিশ্যি এত গুরুত্বপূর্ণ খবর রাখে না।
‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য প্রিজ়নার অব আজ়কাবান’ ছবিতে জাদুঝাঁটা দেখে আপ্লুত হ্যারি।
আমরা, অর্থাৎ দুনিয়া জোড়া মাগলরা আলবাত উইজ়ার্ড ওয়র্ল্ড-এর খবর রাখি। আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন জোয়ান ক্যাথলিন রোওলিং। তাঁর হ্যারি পটার সিরিজ়ের প্রথম বই বেরোল ১৯৯৭-এ। আর পটার-প্লাবনে ভেসে গেল মিশিগান, লন্ডন, প্যারিস, দুবাই, টোকিয়ো। সেই স্রোত কলকাতায় এসে পৌঁছল যখন, আমাদের স্কুলে হাফ-ইয়ার্লির অঙ্ক পরীক্ষা হচ্ছিল। পিছনের বেঞ্চে হুলুস্থুলু। কে বই খুলে রেখেছে। নিশ্চয়ই টুকছে। গার্ড দিদিমণি কিছু ক্ষণ ধ্বস্তাধ্বস্তির পর জোর করে বইখানা কেড়ে, দিগ্বিজয়ীর ভঙ্গিতে উঁচু করে ধরলেন। তক্ষুনি তাঁর হাসি মিলিয়ে গেল। কোথায় কে সি নাগ? বিরাট রংচঙে বইটায় লেখা ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলসফার্স স্টোন’। বেচারি আগের দিনই উপহার পেয়েছে। পরীক্ষা হলেও হ্যারির জাদু তাকে ছাড়েনি। ক’দিন পরে আমিও সে বই পেলাম। এক সন্ধেতেই রুদ্ধশ্বাসে শেষ করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার কি কোনও চিঠি এসেছিল? হগওয়ার্টস স্কুল অব উইচক্র্যাফটস অ্যান্ড উইজ়ার্ড্রি থেকে?’ মা অবাক! ‘না তো!’ মাথা নেড়ে বললাম, ‘খেয়াল রেখো। আসবে।’
বই বেরল আরও। দ্য চেম্বার অব সিক্রেটস, দ্য প্রিজ়নার অব আজ়কাবান, দ্য গবলেট অব ফায়ার! একটার পর একটা ক্লাসে উঠছে হ্যারি। আর একটু একটু করে শরীর আর শক্তি ফিরে পাচ্ছে ভল্ডেমর্ট, যার নাম করতে নেই। আমাদের মতো ‘পটারহেড’রা তালিকা করছি, হগওয়ার্টস-এর ব্যাগে কী কী নিতে হবে। ডাইনির ছুঁচলো টুপি, কুহক তৈরির কড়াই। পেঁচা বা বেড়াল অথবা কোলাব্যাং। হ্যারি নিয়েছিল নরম ডানার শান্ত পেঁচা হেডউইগ। ওক বা ম্যাপল কাঠের জাদুদণ্ড চাই। ইউনিকর্নের লোম, ড্রাগনের কলিজার শিরা আর ফিনিক্স পাখির পালক থাকলে তাগড়াই হবে সেই জাদুদণ্ড।
সেই এগারো বছরের জন্মদিনে, হ্যারিকে হ্যাগ্রিড নিয়ে গিয়েছিল ‘লিকি কলড্রন’ সরাইখানার ইটের আড়ালে থাকা ‘ডায়াগন অ্যালে’তে। উইজ়ার্ডদের জমজমাট শপিং গলি। তার এক পাশে গবলিনদের (হুঁকোমুখো হ্যাংলার মতো দেখতে) গ্রিনগটস ব্যাঙ্ক। তার মাটির অনেক অনেক নীচের ভল্টে হ্যারির জন্য রাশি রাশি উইজ়ার্ড মানি রেখে গিয়েছেন তার বাবা-মা। জানা গেল, ১ সেপ্টেম্বর কিংস ক্রস স্টেশনের ৯ পূর্ণ ৩/৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে হগওয়ার্টস এক্সপ্রেস। সে দিন হ্যারি ৯ আর ১০ নম্বর প্ল্যাটফর্মের মাঝের থাম বরাবর ছুটে যেতেই আনলক হয়ে গেল ৯ পূর্ণ ৩/৪ প্ল্যাটফর্ম। সেখানে ভোঁ বাজাচ্ছে হগওয়ার্টস এক্সপ্রেস। জাদুকরদের পরিবার, হবু জাদুকররা পিলপিল করছে। হ্যারির সঙ্গে জমে গেল রোনাল্ড উইজ়লি আর হারমায়নির। টং লিং ঘণ্টি বাজিয়ে ট্রলি ভরে এল পেস্ট্রি, কেক, কার্ডওয়ালা চকলেট ফ্রগ, হরেক ফ্লেভারের জেলি বিন। এত আনন্দও জগতে ছিল?
মাগল দুনিয়ায়ও পটারহেডদের উত্তেজনা তুঙ্গে। যে দিন হ্যারি পটারের বই বেরোত, সে দিন যেন দ্বিতীয় হ্যালোয়িন। রাত বারোটায় ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল হ্যারির পৃথিবী, তাই বইগুলোরও ফিতে কাটা হত ঠিক মধ্যরাতে। হ্যারি-ভক্তরা উইজ়ার্ডদের কস্টিউম পরে গোটা দিন লাইন দিত দোকানগুলোর সামনে। বই পাওয়া মাত্র শুরু প্রতিযোগিতা। কে কত আগে শেষের পাতায় পৌঁছায়। কানে আঙুল দিয়ে স্কুল যেতাম। যদি কেউ রহস্য ফাঁস করে দেয়!
এরই মধ্যে এল প্রথম হ্যারি পটার সিনেমা। ফিল্টার গ্লাসে তোলা স্পেশ্যাল এফেক্টস পড়ে কল্পনাগুলো আরও কিলবিল করে উঠল। হগওয়ার্টস-এ যাওয়ার ট্রেনরাস্তাটাও এমন মায়াবী! আর হগওয়ার্টস স্কুলটা? ট্রানসিলভানিয়ায় ড্রাকুলার বাড়ির থেকেও রোমাঞ্চকর। ওখানে গেলে কোন হাউসে দেবে আমাকে কথা বলা ‘সর্টিং হ্যাট’? গভীর ঘুমে কে যেন বিড়বিড় করে ছড়া কাটে। ‘সাহসীরা যায় গ্রিফিনডোরে, চতুর চলে স্লিদারিনে, বুদ্ধিমানরা রভেনক্ল, অনুগত হাঁটে হাফলপাফ’। দেখা দেন শতবর্ষীয়ান সৌম্যদর্শন অতিবৃদ্ধ ঋজু হেডমাস্টার। অ্যালবাস ডাম্বলডোর। বিশ্বশ্রেষ্ঠ জাদুকর। ভল্ডেমর্টের পূর্বসূরি উইজ়ার্ড-মস্তান গ্রিন্ডেলওয়াল্ডকে ডুয়েলে কাত করেছেন যিনি। আমিও যে হগওয়ার্টস খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে মনখারাপের চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছি, জানতে পেরেছেন মহাজ্ঞানী। তাই এসে হাতখানি ধরেছেন। বলছেন, অন্ধকারতম কোণেও খুশির আলো খুঁজে পাবে। এক বার লাইটের সুইচটা অন করেই দেখো।
পর দিনই আলোকের পরশমণি ছুঁয়ে দেয় আমাকে। তখন আমি স্কুল টপকে সদ্য কলেজ। প্রথম বার বিশাল কলেজের গেট খুলে ঢুকলাম। দেখি গথিক দুর্গের মতো গড়ন, মোটা থাম। দুটো বিল্ডিং জুড়েছে ব্রিজ আর অদ্ভুতুড়ে ক্লাসঘর। দেখেই বুকের ভিতরে ছ্যাঁৎ। চওড়া, কার্পেট পাতা পুরনো কাঠের সিঁড়ি। পা দিতেই খটখট করে নড়ে উঠল। আমি উঠলাম, না কি নিজে নিজে ঘুরে পৌঁছে দিল উপরতলায়? উইজ়ার্ড-চক্ষে আমি দেখতে পাই কলেজের পোর্ট্রেটগুলোর মানুষ চলে-ফেরে, হাই তোলে। অভিবাদন না জানালে অভিমান করে। যাক, আমাকে গ্রিফিনডোরেই দিয়েছে। অর্থাৎ, ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট। হাউস-হেড প্রফেসর ম্যাকগোনেগল হলেন কোকিলা ম্যাডাম। মায়ের মতো আগলে রাখেন। চৈতালি ম্যাডাম ডাম্বলডোর। আমাদের গার্জিয়ান এঞ্জেল। তার পর কলেজে পড়াতে এলেন সোনালি ম্যাডাম। উল্লাসে ছিটকে উঠি আমরা। তাঁর বিচিত্র ছাতাটি যেন এক্কেবারে ‘নিম্বাস ২০০০’ মডেলের ব্রুমস্টিক, আর চেহারায় তিনি অবিকল প্রফেসর সিবিল ট্রিলনে। হ্যাগ্রিডকেও পেয়ে যাই কলেজের ড্রামা রিহার্সালে। বাংলা বিভাগের মণিদীপা ম্যাডাম। সকলের অসমবয়সি বন্ধু। এক দিন পিছু পিছু হাঁটতে থাকি তাঁর। নিশ্চয়ই তাঁর আস্তানায় বিরাট মাকড়সা, তিন মাথাওয়ালা কুকুর ফ্লাফি থাকে। পথ আটকান এসবি ম্যাডাম। বকেন। ‘ও দিকে যাওয়া নিষেধ’। তা হলে ওটাই হগওয়ার্টস-এর ফরবিডেন ফরেস্ট! যেখানে হ্যাগ্রিডের ষোলো ফুটের ক্যাবলা ভাই গ্রপ থাকে। রাতের বেলা মানুষেরা নেকড়ে হয়ে যায়! আর কলেজের সেন্টিনারি বিল্ডিংয়ের নীচে আছে ‘চেম্বার অব সিক্রেটস’। সেখানে হাজার হাজার বছর ধরে অতিকায় সর্পিণীকে লুকিয়ে রেখেছেন সালাজ়ার স্লিদারিন। তাই ওখানে গেলেও চোখ পাকান এসবি। উনিই তো স্লিদারিনদের হাউস হেড, প্রফেসর স্নেপ। সব অকুস্থলে মাটি ফুঁড়ে উদয় হয়ে প্ল্যান বানচাল করেন। নির্ঘাত ভল্ডেমর্টের ডেথ ইটার্স দলের লোক।
হ্যারির পরের বইগুলোর ভানুমতীও আমাদের কব্জা করে নেয়। দ্য অর্ডার অব দ্য ফিনিক্স, দ্য হাফ ব্লাড প্রিন্স, দ্য ডেথলি হ্যালোজ় প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব। পটার ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি-র সিনেমা দেখার আগে আর এক বার টাটকা পড়ে নিই সেই খণ্ডের উপন্যাসটা। তার পর অন্ধকার হলে বসে আমাদের মনের ‘মারাওডার ম্যাপ’ (যেখানে হগওয়ার্টস-এর প্রতিটি আনাচকানাচ দেখা যায়) খুলে সিনেমাটা মেলাতে বসি। কলেজে ‘কুইডিচ’ চালু করার প্রস্তাব আনি। বাস্কেটবল, ফুটবল আর রাগবি মিলিয়ে একটা খেলা। ঝাঁটায় চড়ে খেলতে হয়। শুনে টিচার বলেন, ‘বাবা, ঘাড়ে-মাথায় জল দিয়ে আয়।’
চিত্রবিচিত্র: হ্যারিকে তাড়া করেছে চেম্বার অব সিক্রেটস-এর ড্রাগন-সাপ ব্যাসিলিস্ক (বইয়ের ছবি)।
হ্যারিরাও বয়ঃসন্ধিতে এসে পড়ে। লাভ পোশন, ত্রিকোণ প্রেম, প্রথম চুম্বন— কত কী ঘটে চলে ভল্ডেমর্টের শয়তানির সমান্তরালেই। জিনিয়াস হ্যারি আর স্টুডিয়াস হারমায়নি-র মন জুড়বে ভেবেছিলাম। এখানে ফার্স্ট গার্ল হারমায়নি-কে ডান্স বল-এ নিয়ে যায় অলিভার ক্রাম। ঈর্ষায় সবুজ হয়ে যায় লালচুলো রন। শেষে রন-হারমায়নির বন্ধুত্বে প্রেমের আভা লাগে। ‘গবলেট অব ফায়ার’-এ মেয়েরা ছুটতে থাকে সুঠামদেহী অলিভার ক্রামের জন্য। কিন্তু আমার মন কাড়ে হগওয়ার্টস-এর চ্যাম্পিয়ন সেড্রিক। অনিন্দ্যকান্তি কিশোর, সর্বগুণসম্পন্ন। কিন্তু ভল্ডেমর্টের প্যাঁচে সে প্রাণ হারিয়ে শুয়ে থাকে কবরখানায়। প্রফেসর স্নেপ বিষয়ে হ্যারি অভিযোগ করলে, ডাম্বলডোর কড়া করে বলেন, ‘স্নেপ নয়। প্রফেসর স্নেপ বলো হ্যারি।’ আজ়কাবানের কয়েদখানা থেকে পালিয়ে এসে হ্যারির হাত ধরেন পিতৃবন্ধু, পিতৃসম সিরিয়াস ব্ল্যাক। কিন্তু ভল্ডেমর্টের দল মেরে দেয় তাঁকেও। আর এক রাতে, মারণমন্ত্র আউড়ে ডাম্বলডোরের প্রাণ কেড়ে নেন বিশ্বাসঘাতী স্নেপ। জাদুমন্ত্রকের রাশ হাতে নিয়ে নেয় লর্ড ভল্ডেমর্ট, হগওয়ার্টস-এর আকাশে বিপদ গজরায়।
বাকি গল্প কে না জানে! ডাম্বলডোর-এর অর্ডার অব ফিনিক্স, হ্যারি আর তার বন্ধুদের জোট এবং ভল্ডেমর্ট-বাহিনীর মধ্যে সেকেন্ড উইজ়ার্ডিং ওয়র বাঁধে। আগের বার শরীর মিলিয়ে গেলেও ভল্ডেমর্টের বিনাশ হয়নি। কারণ নিজের আত্মা টুকরো টুকরো লুকিয়ে রেখেছিল সে। বন্ধুরা সেগুলো একে একে খতম করে ধুলো বানিয়ে দেয় খল জাদুকরকে। অনেকটা আমাদের রাক্ষসীরানির প্রাণভোমরার গল্পের মতো।
পটার-দুনিয়া নিয়ে এমন উন্মাদনার কারণ কি কেবলই মার্কেটিংয়ের কামাল? আসলে, হ্যারির এই ভেলকির দুনিয়াটা আমাদের আশপাশেই লুকিয়ে। কেউ হগওয়ার্টস পায় লাইব্রেরিতে, কেউ পেয়ে যায় তার বোর্ডিং স্কুলে। যেমন আমি খুঁজে পেয়েছিলাম বেথুন কলেজে। নইলে, ভল্ডেমর্টের নাগিনী যখন স্নেপ-কে মেরে দিল, আর প্রফেসরের চোখের জল ধরে হ্যারি জানতে পারল তাঁর অতীত, এই ভাবে কেঁদে ফেলি? স্নেপ হ্যারির মা লিলিকে ভালবেসেছিল, আর হ্যারির বাবা জেমস তাকে বিরক্ত করত, তাই স্নেপ হ্যারিকে দেখলে দুর্ব্যবহার করতেন। ভল্ডেমর্টের দলে মিশে স্নেপই আসলে হ্যারিকে রক্ষা করেছেন আজীবন। তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে আমাদের স্নেপ এসবি ম্যামকে। পরীক্ষার খাতায় তিনিই তো সব চেয়ে বেশি নম্বর উজাড় করে দিতেন!
রোওলিং প্রতিটি অধ্যায়ে জীবন ভাঙা-গড়ার এমনই মূল্যবান মুহূর্ত গুঁজে রেখেছেন। মাগল বাবা-মার সন্তানের জাদুশক্তি থাকলে, তার কাছেও যায় হগওয়ার্টস-এর চিঠি। কয়েক জন উইজ়ার্ড মিশ্র রক্তের জাদুকরদের মাড-ব্লাড বলে ঠোকরান ঠিকই। কিন্তু তাঁরা সবাই গল্পের ভিলেন। যদিও রোওলিং পারফেক্ট-ইমপারফেক্ট, শুভ-অশুভর ভেদাভেদ করেন না। হ্যারির বাবা জেমস শৈশবে দুর্বলের উপর অত্যাচার করেছেন। আবার দোষ শুধরেও নিয়েছেন। যে নেভিল জাদুঝাঁটা থেকে পড়ে কেঁদেছিল, শেষ বেলায় অসম সাহসে ভর করে সে-ই ভল্ডেমর্টের নাগিনীর মাথাটা কাটে।
আবার, ডাম্বলডোর নিজেও প্রশ্নচিহ্ন বিরহিত নন। কেন তিনি এক সময় ক্রাইম লর্ড গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের হাত ধরেছিলেন? এ সব নিয়েই রোওলিং বুনেছেন পটার-কাহিনির আগের গল্পমালা, ‘ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস’ সিরিজ়। সবই মাগলদের জীবনের বিবিধ জটিলতার গল্প, রোওলিং সম্মোহনের রং মাখিয়ে দেখিয়েছেন। আমরা ভেবেছি, ম্যাজিক। তাই এমন বুঁদ হয়ে গিয়েছি হ্যারির জীবনে। মহাউচ্ছ্বাসে পালন করেছি রন আর হারমায়নিরও জন্মদিন। ১ মার্চ আর ১৯ সেপ্টেম্বর। ওরা আমাদের থেকে আলাদা না কি?
টাইম-টার্নার ফেরে বর্তমানে। অদৃশ্য বাড়িতে হ্যারিরা উঠে পড়ে। কেক কাটবে। কেক কাটবেন রোওলিংও। জন্মদিন যে তাঁরও। তার পর ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য কার্সড চাইল্ড’ নাটকের ঘটনাগুলো ছকবেন। অ্যালবাস, হুগোরা যে আবার হগওয়ার্টসে ফিরবে। সেপ্টেম্বর থেকে নতুন সেশন শুরু!