Satinath Mukherjee

নতুন শিল্পী বলে গিটারও পাননি সঙ্গতে

উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেব তাঁর রাগাশ্রয়ী গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তবু আধুনিক বাংলা গানের দরদি উপস্থাপনায় চিরকালই অনন্য সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। গত বুধবার পূর্ণ হল তাঁর জন্মশতবর্ষ।

Advertisement

অভীক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০২৩ ০৯:৩২
Share:

জন্মশতবর্ষে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়।

এক বার এক আসরে গাইতে এসেছেন উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেব। তাঁর অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে এক তরুণ গায়ক গাইলেন কয়েকটি রাগপ্রধান বাংলা গান। কণ্ঠে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দারুণ দক্ষতা, কিন্তু পরিবেশনায় দরদভরা আবেশও মন ছুঁয়ে গেল শ্রোতাদের। কোথাও অতিরিক্ত কারিকুরি দেখানোর প্রবণতা নেই। গান শেষ করার পর, উস্তাদজি তাঁর নাম জিজ্ঞেস করলেন। নাম ‘সতীনাথ’ শুনে খাঁ সাহেবের মন্তব‍্য, “তু সতীনাথ নেহি, শিউনাথ হ‍্যায়। কেয়া গানা গায়া বেটা!”

Advertisement

মরমী কণ্ঠশিল্পী ও সুরকার সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের আবির্ভাব আধুনিক বাংলা গানের জন্মলগ্নের কয়েক বছর পরেই। ১৯৪০ দশকের গোড়ার দিকে প্রথম বার তাঁর গানের রেকর্ড বেরোয়। তবে জনপ্রিয়তা আসে অনেক পরে। সতীনাথ মুখোপাধ‍্যায়ের জন্ম ১৯২৩ সালের ৭ জুন। ডাকনাম বাদল। হুগলির চুঁচুড়া শহরের ছেলে। সেখানেই বেড়ে ওঠা। এ শহর বহু পুরনো আমল থেকেই শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে ঐতিহ‍্যমণ্ডিত, যার মধ্যে সঙ্গীতেরও বিরাট জায়গা রয়েছে। এ ছাড়াও খানদানি সঙ্গীতে ভরপুর শহর লখনউ-এর প্রভাবও ছোটবেলায় সতীনাথের ওপর পড়েছিল। সেখানে ছিল তাঁর বাবার মামারবাড়ি। ওখানে গিয়ে বড়দের সঙ্গে হাজির হতেন বিভিন্ন বাড়ির গানের আসরে। এর ফলে, তখন থেকেই গজল ঠুংরি খেয়ালের মুর্ছনায় মজে গিয়েছিলেন। অন্তর ক্রমশ পাগল হয়ে উঠল গান শেখার জন‍্যে। সহায়তা পেলেন দাদুর। তাঁরই উৎসাহে সতীনাথের গান শেখার শুরু। তখন তিনি ক্লাস থ্রি।

বাড়িতে সঙ্গীতের পরিবেশ। সতীনাথের বাবা প্রাচীন বাংলা গান, শ‍্যামাসঙ্গীত খুব ভাল গাইতেন। দাদু তন্ময় হয়ে বেহালায় বাজিয়ে যেতেন রাগরাগিণী। মায়ের গানের গলাও ছিল সুমধুর। সব মিলিয়ে প্রথম থেকেই সতীনাথের মধ্যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রবেশ ঘটছিল। তাঁর নিজের ছিল ভাবপ্রবণ মন। পরবর্তী কালে দেখা গেল এই দুইয়ের অপূর্ব সমন্বয় তাঁর গান ও সুরনির্মাণের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠল।

Advertisement

সতীনাথের সঙ্গীতশিক্ষার শুরু প্রবোধ ঘোষালের কাছে। তিন বছর তাঁর কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখার পর, তিনি প্রয়াত হলে, ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৮ অবধি সতীনাথ খেয়াল, ধ্রুপদ, টপ্পা, ঠুংরি, ধামারের তালিম নেন শ‍্যামবাজারের গুণী সঙ্গীতজ্ঞ ধীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য-র কাছে। ইনিই সতীনাথের সঙ্গীতের ভিত গড়ে দেন। এর পর তিনি গিয়ে পড়লেন পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়ীর হাতে। যত দিন চিন্ময়বাবু বেঁচে ছিলেন, তত দিন সতীনাথ তাঁর তালিম-ছাড়া হননি। বোঝাই যাচ্ছে, সতীনাথ মুখোপাধ‍্যায়ের শিক্ষার সবটাই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে। অথচ নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে তিনি হয়ে উঠলেন বাংলা আধুনিক গানের অন‍্যতম উজ্জ্বল শিল্পী।

খুব কম বয়স থেকেই রেকর্ড-রেডিয়োয় গাওয়ার তীব্র ইচ্ছে ছিল সতীনাথের। বেতারে অডিশন দিলেন। কিন্তু পর পর দশ বার পাশ করতে পারলেন না। বার বার এ রকম হওয়ার কারণ জানতে এক দিন নিজেই ফোন করলেন স্টেশন ডিরেক্টরকে। পরের অডিশনে উপস্থিত রইলেন ডিরেক্টর নিজে। এ বারে আর হতাশ হতে হয়নি। সময়টা ১৯৪৮। তার পর থেকে সতীনাথ নিয়মিত গাইতে লাগলেন রেডিয়োয়। কিন্তু এর অনেক আগেই রেকর্ডে গাওয়া হয়ে গেছে। তখন তিনি হুগলি কলেজের (পরে হুগলি মহসীন কলেজ) ছাত্র। সময়টা ১৯৪০-এর দশকের গোড়ার দিক। নিজেই চিঠি লিখে রেকর্ড করার আবেদন জানালেন গ্রামোফোন কোম্পানিতে। তার পর কিছু কাঠখড় পুড়িয়ে, তাঁর প্রথম রেকর্ড হল। দু’টি গান ছিল,‘ভুল করে যদি ভালোবেসে থাকি’ এবং ‘এইটুকু শুধু জানি’। গোপেন মল্লিকের সুরে গানদু’টির রচয়িতা যথাক্রমে কাজী নজরুল ইসলাম ও সুবোধ পুরকায়স্থ। রেকর্ডে গায়কের নাম লেখা ছিল ‘সতীনাথ মুখোপাধ‍্যায় (মাস্টার বাদল)’। এ গান তেমন জনপ্রিয় না হলেও বন্ধুদের মধ্যে হিরো হয়ে উঠলেন তিনি।

১৯৫০-এ ‘যুগদেবতা’ ও ‘পথহারার কাহিনি’ ছবিতে রামচন্দ্র পালের সুরে প্লে-ব‍্যাক, ১৯৫০ ও ১৯৫১ সালে যথাক্রমে ‘মর্য্যাদা’-য় রামচন্দ্র পালের সঙ্গে যুগ্ম ভাবে এবং ‘অনুরাগ’ ছবিতে একক ভাবে সঙ্গীত পরিচালনা ইত‍্যাদি সত্ত্বেও সতীনাথের পায়ের তলার জমিটা শক্ত হচ্ছিল না। ১৯৫২ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি প্রকাশিত একটি রেকর্ডে শ‍্যামল গুপ্তের কথায়, নিজের সুরে ও বিশিষ্ট সঙ্গীত পরিচালক দুর্গা সেনের পরিচালনায় সতীনাথ গাইলেন, ‘আমি চলে গেলে, পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম’ এবং ‘এ জীবনে যেন আর’। শ্রোতাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল এই রেকর্ড। বিশেষ করে প্রথম গানটি গেঁথে গেল সবার মনে। এ গানে তাঁর বিষাদময় ভাবধর্মী পরিবেশন আজও জীবন্ত। এর পর আর পিছনের দিকে তাকাতে হয়নি এই শিল্পীকে। প্রসঙ্গত, এই রেকর্ডটি করার সময়েও সতীনাথের তেমন কদর ছিল না। রেকর্ডিংয়ের জন‍্যে কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি এক জন গিটারশিল্পী চাইলে, তাদের মন্তব্য ছিল, “সে কী! তুমি নতুন আর্টিস্ট, তুমি গিটার নেবে?” অগত‍্যা, ম‍্যারাকাস আর তবলায় কাঠি দিয়ে এক ধরনের এফেক্ট মিউজ়িক ব‍্যবহার করা হল, যা সুন্দর খাপ খেয়ে গেল। এই রেকর্ড বেরোনোর পরেই বলা যায়, আধুনিক বাংলা গানের জনপ্রিয় শিল্পীতালিকায় জুড়ে গেল সতীনাথ মুখোপাধ‍্যায়ের নাম। এর পর একের পর এক জনপ্রিয় গানের জোয়ার বইতে শুরু করল। নিজের সুরে, ‘বালুকাবেলায় কুড়াই ঝিনুক’, ‘না যেও না’, ‘আজও তো এলো না সে’, ‘আজ মনে হয় এই নিরালায়’, ‘ভেবেছো তোমাদেরই একার আছে জলসাঘর’, ‘যদি সহেলী আমার কানে কানে কিছু বলে’, ‘জীবনে যদি দীপ জ্বালাতে নাহি পারো’, নচিকেতা ঘোষের সুরে ‘ঐ দূর আলেয়ার একটু আলো’, ‘সূর্যমুখী আর সূর্য দেখবে না’, সুধীন দাশগুপ্তের সুরে ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন’, ‘এলো যে বরষা সহসা’, ‘আকাশ এত মেঘলা’, শ‍্যামল মিত্রের সুরে ‘রাতের আকাশ তারায় রয়েছে ঘিরে’, সহধর্মিণী ও গায়িকা উৎপলা সেনের সুরে ‘এলে তুমি সেই তো এলে’, ‘শুধু তোমার জন‍্যে ঐ অরণ্যে’ প্রভৃতি। গানগুলির সুরগঠনের বৈচিত্র‍্যের সঙ্গে জনপ্রিয়তাকে মেলালে বোঝা যায়, সতীনাথের গানে শুধুমাত্র বিষাদেরই প্রাধান্য ছিল না, নানা ধরনের চলনবৈশিষ্ট‍্যে তা ছিল সমৃদ্ধ।

কণ্ঠশিল্পীর পাশাপাশি সুরকার হিসেবেও সতীনাথ মুখোপাধ‍্যায় অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজের তো বটেই, তাঁর সুরে অন্যান্য শিল্পীর গাওয়া বহু গানও চিরকালীন। সতীনাথের সুর করার প্রবণতা খুব কম বয়স থেকেই। ফুটপাত থেকে কেনা হিন্দি গানের বইয়ে থাকা ভজনে সুর দিয়ে গাইতেন শুরু থেকেই। পরে এক জন বিশিষ্ট সুরকার হিসেবে নিজেকে চেনালেন। ১৯৫৭ সালে লতা মঙ্গেশকর প্রথম বার যে দু’টি নন-ফিল্ম বেসিক আধুনিক বাংলা গান গাইলেন রেকর্ডে, তার সুরকার ছিলেন সতীনাথ মুখোপাধ‍্যায়—‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’ ও ‘কত নিশি গেছে নিদহারা’। পবিত্র মিত্রের লেখা গানদু’টির সম্পূর্ণ দু’রকম সুরচলন। সতীনাথের অনবদ্য কম্পোজ়িশন! প্রথমে ‘আকাশ প্রদীপ’ গাওয়াবেন ভেবেছিলেন পান্নালাল ভট্টাচার্যকে দিয়ে। কিন্তু উৎপলা সেনের কথায় গাওয়ালেন লতাকে দিয়ে। একটি সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে সতীনাথ বলেছিলেন, “পান্না খুবই বড় শিল্পী ছিল কিন্তু উৎপলার পরামর্শ অনুযায়ী লতাকে গানটা দিয়ে বুঝেছিলাম ওই গানটা লতাকে না দিলে ঘোর অন‍্যায় হত, তারপর যা হয়েছে তা তো ইতিহাস।” এ ছাড়া, হেমন্ত মুখোপাধ‍্যায়ের ‘তোমার আমার কারো মুখে কথা নেই’, শ‍্যামল মিত্রের ‘তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর’, উৎপলা সেনের ‘ঝিকমিক জোনাকির দীপ জ্বলে’, ‘কিংশুক ফুল হিংসুক ভারী’, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য-র ‘আমি চেয়েছি তোমায়’, সুপ্রীতি ঘোষের গাওয়া ‘যেথায় গেলে হারায় সবাই’, শৈলেন মুখোপাধ‍্যায়ের ‘এত যে শোনাই গান’, মানবেন্দ্র মুখোপাধ‍্যায়ের ‘তুমি ফিরায়ে দিয়েছো’-র মতো একের পর এক সোনার গান সৃষ্টি হয়েছে সতীনাথের সুরে। গায়ক ও সুরকারের পাশাপাশি সতীনাথ মুখোপাধ‍্যায় সফল সঙ্গীতশিক্ষকও। তাঁর কাছে শিখেছেন দীপক মৈত্র, জটিলেশ্বর মুখোপাধ‍্যায়, রবীন বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়, অরুণ দত্তের মতো গুণী শিল্পীরা। সতীনাথের সুরে রেকর্ডে গাওয়া দু’টি গান অকালপ্রয়াত শিল্পী দীপক মৈত্রকে স্মরণীয় করে রেখেছে শ্রোতাদের কাছে। ‘এ তো নয় শুধু গান’ এবং ‘কত কথা হল বলা’। নিজের শহর চুঁচুড়ায় এক বন্ধুর বাড়িতে, ওই শহরেরই একটি ছেলের গান শুনে সতীনাথ তাঁকে গান শেখাতে শুরু করেন। এ ভাবেই তাঁর হাতে তৈরি হয়েছিলেন শিল্পী জটিলেশ্বর মুখোপাধ‍্যায়ের। পরবর্তী কালে তাঁর এই ছাত্রের লেখা কয়েকটি রাগপ্রধান গান নিজের সুরে রেকর্ড করেছিলেন সতীনাথ। যেমন, ‘না গো না যেও না’, ‘লগন যে গেল চলে’ ও ‘এ বেদনা কেমনে সহি’।

ছায়াছবিতেও গেয়েছেন ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন সতীনাথ। অন‍্যের সুরে বিভিন্ন ছবিতে তাঁর বেশ কিছু প্লেব‍্যাকের মধ্যে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ (১৯৫৪) ছবিতে অনুপম ঘটকের সুরে ‘জীবননদীর জোয়ার ভাঁটায়’ বা ‘অতিথি’ (১৯৬৫) ছবিতে তপন সিংহের কথায় সুরে ‘মাঝে নদী বহে রে’ (সহশিল্পী উৎপলা সেন) যথেষ্ট জনপ্রিয়। এ ছাড়াও অন‍্যের সুরে গেয়েছেন ‘রাতভোর’ (১৯৫৫), ‘রানী রাসমণি’ (১৯৫৫), ‘অসমাপ্ত’ (১৯৫৬), ‘সাগরিকা’ (১৯৫৬), ‘মায়াবিনী লেন’ ইত্যাদি আরও কিছু ছবিতে। নিজের সঙ্গীত পরিচালনায় কয়েকটি ছবির মধ‍্যে ‘বনপলাশীর পদাবলী’ (১৯৭০)-তে লোকসঙ্গীতের সুন্দর প্রয়োগ ঘটালেন তাঁর ও উৎপলা সেনের গাওয়া যথাক্রমে ‘এই তো ভবের খেলা’ ও ‘বহুদিন পরে ভ্রমর’ গানদুটিতে (এ ছবিতে আরও চার জন সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন)। আবার ‘ভাগ‍্যচক্র’ (১৯৮০) ছবিতে উৎপলা সেনের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গাওয়া ‘ভাগ‍্যের চাকাটা যে ঘুরছে’ গানের সুরচলনে আনলেন মনকাড়া ছন্দময়তা।

রাগপ্রধান গানের ক্ষেত্রেও সতীনাথ মুখোপাধ‍্যায় একটি স্মরণীয় নাম। কিন্তু তাঁর পরিবেশনে কখনও রাগরাগিণীর প্রকট প্রকাশ ঘটেনি, প্রাধান্য পেয়েছে ভাব। পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে শেখা ‘নন্দকোষ’ রাগের একটি খেয়ালকে আশ্রয় করে ‘কোথা তুমি ঘনশ‍্যাম’ গানটি তাঁর অন‍্যতম অনবদ‍্য সৃষ্টি। টোড়ি রাগে শুদ্ধ মধ‍্যম স্বর যোগ করে, নিজের তৈরি ‘মাধব টোড়ি’ রাগে করেছিলেন ‘কে যেন ডাকে’ গানটি। রাগের নামটি নিজের দীক্ষাগুরু মাধবানন্দজির নাম অনুসারে রেখেছিলেন সতীনাথ। এ রকম আরও অনেক গানের কথা বলা যায়। তাঁর রাগপ্রধান গান সম্পর্কে জটিলেশ্বর মুখোপাধ‍্যায় লিখেছিলেন, ‘রাগপ্রধান গানকে যে আঙ্গিকে উনি উপস্থিত করেছেন, তাকে বাংলা গানের ধারায় এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন বলা যায়।... রাগাশ্রয়ী গানকে কোনও সময়েই তিনি ভারী করে তোলেননি; বরং নিজস্ব কায়দায় তাকে সুখশ্রাব‍্য করে তুলে শ্রোতৃকুলের মধ্যে রাগপ্রধান গান শোনার আগ্রহ বাড়িয়েছেন।’ সতীনাথ মুখোপাধ‍্যায়ের গাওয়া যে ক’টি নজরুলগীতি আছে, সেখানেও এই একই কথা প্রযোজ‍্য। প্রসঙ্গত, রেডিয়োতে উৎপলা সেনের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে দু’টি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন সতীনাথ, ‘সর্ব খর্বতারে দহে’ ও ‘আমি ভয় করব না’।

সতীনাথ মুখোপাধ‍্যায়ের নিজের ও অন‍্যের সুরে গাওয়া কিছু নন-ফিল্ম ও ফিল্মি হিন্দি গানেরও রেকর্ড আছে। যেমন, নন-ফিল্ম গানের মধ্যে অনুপম ঘটকের সুরে ‘উমিদ এ বসল্ মে হম জিন্দগি’ (গজল), ‘সুনায়ে যা ও পেয়ারে’ (ভজন), জ্ঞান দত্তের সুরে ‘পিঞ্জরে কে পঞ্ছি’ (ভজন), নিজের সুরে ‘বীত গ‍্যয়ে দিন ভজন বিনা রে’ (ভজন), ‘হর য‍্যায়সা রে মান’ (ভজন) ইত্যাদি। এ ছাড়া, ‘গৃহলক্ষ্মী’ (১৯৪৯), ‘ফয়সালা’ (১৯৪৭), ‘আজাদি কে বাদ’ (১৯৫১) হিন্দি ছবিগুলিতে যথাক্রমে শৈলেশ দত্তগুপ্ত, কমল দাশগুপ্ত ও কালীপদ সেনের সুরে সতীনাথ-কণ্ঠ শোনা গেছে। হিন্দি গান গেয়েছেন রেডিয়োতেও। তা ছাড়া, তখনকার রীতি অনুযায়ী, বেশ কিছু হিন্দি ভারশন গানেরও রেকর্ড আছে সতীনাথ মুখোপাধ‍্যায়ের। এর মধ্যে অধিকাংশই বিভিন্ন ছবিতে গাওয়া তালাত মামুদের গান।

শিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ‍্যায় এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষে পূর্ণ করলেন। অনেক আগে নিজের সুরে তিনি গেয়েছিলেন,‘জানি এক দিন আমার জীবনী লেখা হবে/ সে জীবনী লিখে রেখো তোমাদের গানের খাতায়’। শিল্পীর যে আত্মবিশ্বাসী আবেদন সে দিন এই গানের মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছিল, তার উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া আজ অত‍্যন্ত জরুরি। সতীনাথ মুখোপাধ‍্যায়ের প্রয়াণের (১৩ ডিসেম্বর ১৯৯২) পর, তাঁকে নিয়ে একটি লেখায় জটিলেশ্বর মুখোপাধ‍্যায় যথার্থই লিখেছিলেন, “এই শিল্পীর পরিচয় পরবর্তী প্রজন্ম যত তাড়াতাড়ি পায় ততই মঙ্গল।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement