চুল দেবেন, চুল?

বাসে করে কলকাতায় এসে তাঁরা ছড়িয়ে পড়েন পার্ক সার্কাস, তপসিয়া, রাজাবাজার, বউবাজার। ডুগডুগি বাজান, সঙ্গে মুখে লব্জ ‘চুল...ল...ল, বা...স...ন। চুল দিন, বাসন নিন।’মিলিটারিতে চাকরির ‘ফেয়ারওয়েল’-এর দিনে গোমড়া অধস্তনকে ওপরওয়ালা বললেন, তোমায় এত মনমরা লাগছে কেন? অধস্তন বললেন, ফেয়ারওয়েল তো হয়ে গেল, এ বার কাজটা কী করব স্যর? ‘ঠিক আছে। একটা ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি, সেখানে গিয়ে যোগাযোগ কোরো।’ কয়েক দিন পরে অবসরপ্রাপ্ত ভদ্রলোক ‘বস’-এর দেওয়া ঠিকানায় দেখা করলেন। শুনলেন, ‘চুল সাপ্লাই করতে হবে।’

Advertisement

বিকাশ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৫ ০০:০৩
Share:

মিলিটারিতে চাকরির ‘ফেয়ারওয়েল’-এর দিনে গোমড়া অধস্তনকে ওপরওয়ালা বললেন, তোমায় এত মনমরা লাগছে কেন? অধস্তন বললেন, ফেয়ারওয়েল তো হয়ে গেল, এ বার কাজটা কী করব স্যর? ‘ঠিক আছে। একটা ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি, সেখানে গিয়ে যোগাযোগ কোরো।’ কয়েক দিন পরে অবসরপ্রাপ্ত ভদ্রলোক ‘বস’-এর দেওয়া ঠিকানায় দেখা করলেন। শুনলেন, ‘চুল সাপ্লাই করতে হবে।’
মানে? মেয়েদের কাছ থেকে তাঁদের মাথা থেকে ওঠা চুল সংগ্রহ করতে হবে। বিনিময়ে দিতে হবে বাসনপত্তর কিংবা নগদ পয়সা।
ভদ্রলোক গ্রামে ফিরে এলেন। অসম্ভব মনের জোর। প্রথমে একা, তার পর লোক দিয়ে কাজ শুরু করে দিলেন। আরও কয়েক জন ব্যবসায়ী লাইনে এলেন। আর আস্তে আস্তে শুধু তাঁর গ্রামই নয়, পাশাপাশি আরও কয়েকটা ব্লকের অর্থনৈতিক অবস্থা বদলে গেল।
জেলার নাম পূর্ব মেদিনীপুর। গ্রামের নাম বাজকুল। ভদ্রলোকের নাম প্রফুল্ল কুমার নাজির। প্রায় তিন দশক আগের সেই ঘটনা এখনও লোকের মুখে-মুখে ফেরে। ব্লকগুলোর ঘরে ঘরে এখন চুল ঝাড়াই-বাছাইয়ের কুটিরশিল্প। রফতানির জন্য আছে বড় বড় কোম্পানি।
তবে সেই ঘর ঘর কি ‘কেশ কহানি’ শোনানোর আগে আমরা এখন রাস্তায় যাব। যেখানে ডুগডুগি বাজিয়ে এলাকায় এলাকায় ‘চুল দিন, বাসন বা টাকা নিন’ বলতে বলতে ঘুরছেন কিছু মানুষ। এঁদের সঙ্গে আমার আলাপের যোগসূত্র সমাজকর্মী, পার্ক সার্কাসের কাশ্মীরা হোসেন। ‘ডুগডুগি শুনে বাঁদর খেলা হচ্ছে ভেবে দেখতে গিয়েছিলাম। ওদের সঙ্গে কথা হল। বেশির ভাগই গরিব মুসলমান। মুর্শিদাবাদ মালদহ ইত্যাদি জায়গা থেকে আসেন। একসঙ্গে দশ-বারো জনের দল। ‘কমিউন’ করে থাকেন। শহরের মধ্যে থাকার রেস্ত নেই, তাই কোনও দল ভোজের হাট, কেউ ব্যারাকপুর, কেউ বাসন্তীর কাছাকাছি।’

Advertisement

এক সন্ধেয় এক কমিউনে পৌঁছলাম।

বাসস্টপ থেকে এঁদের থাকার জায়গা একটু ঢুকে। ‘চুলওয়ালা’ বলতেই সবাই দেখিয়ে দিল। কাছাকাছি পৌঁছতেই গানের আওয়াজ কানে আসে। বুঝলাম ঠিক জায়গায় পৌঁছেছি। কাশ্মীরা এক সুফি গায়কের কথা বলেছিলেন, বয়স সত্তর পেরিয়ে গেলেও এখনও ‘চুল’-এর কাজ করেন। শেখ দাদা। তাঁকে ঘিরে আছেন কুড়ি থেকে চল্লিশ বছর বয়সি জনা ছয়েক পুরুষ। আর পরিবেশ ঘিরে আছে কড়া রসুন-পেঁয়াজের গন্ধ, মাংস রান্না হচ্ছে।

Advertisement

সবার পদবি শেখ। মনিরুল, শাহিল, আবদুস, হিঙ্গল আর কাজল। কাজল একটু বেশি লেখাপড়া জানা। তার জন্যে একটু চাপা গর্ব ও হতাশা দুটোই আছে। তাঁর প্রথম প্রেমিকা সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল, তার কারণ, ‘যা আমরা আঙুলে পেঁচিয়ে থুতকুড়ি দিয়ে আদাড়ে-বাদাড়ে ফেলে দিই, তার ব্যবসা, ম্যাগো!’ পাশ থেকে মনিরুল বললেন, ‘ওকে সতীপনা দেখাতে কে বলেছিল? কলকাতায় এসে আমরা কী করছি না-করছি তা দেশে বলার দরকার কী?’

‘আপনি বাড়িতে বলেননি?’

‘বলেছি। কেউ কিছু বলেনি। লেখাপড়া শিখিনি। বেলডাঙার বাজারে সবজির ‘মোট’ মাথায় তুলে লরিতে ওঠাতাম। এমন ঘাড়ে লাগল, তিন মাস ঘরে শোওয়া। তার পর এ লাইনে। তবে বাড়ির কাছের ব্যবসায়ীদের কাছে যাইনি, এখানে চলে এসেছি।’

হ্যঁা, বেলডাঙাতে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে পর পর চুলের কোম্পানি।

‘এতে লাভ বেশি? অন্য ব্যবসাও তো করতে পারতেন।’

‘এটা বিনা পুঁজির কাজ। তবে খাটনি, ঘোরাঘুরির ঝক্কি আছে। তা ছাড়া বাড়ির বাইরে থাকা।’ আবদুস জানান।

‘বাড়ি ছেড়ে থাকতে ভাল লাগে?’

‘কিন্না সোনা তেনু রব নে বনায়া, জি করে দেখতা রওয়া’— শেখ দাদার দু’কলি শুনে আমার ফ্যালফ্যাল তাকানোর পালা।

‘সবে বিয়ে করেছে আবদুস। কোথায় ঘরে বসে বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে, না, এখানে পড়ে আছে। রাতে ফুক্কুড়ি (বিড়বিড়) কাটে।’ আবদুস মুখ নামান।

‘আপনি তো বিন্দাস আছেন।’ আমি শেখ দাদাকে বলি।

‘বিশ বছর হয়ে গেল।’

ভোর-ভোর বাস ধরতে বেরিয়ে আসেন সবাই। সঙ্গে অ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্তর, ছোট ও মাঝারিই বেশি, বেশ কয়েকটি ‘বেবি ড্রেস’-এর কাগজের বাক্স, কয়েকটির মধ্যে ছোট বাটি রেকাবি ভরা আছে। বাসে করে কলকাতায় এসে তাঁরা ছড়িয়ে পড়েন পার্ক সার্কাস, তপসিয়া, রাজাবাজার, বউবাজার, কলাবাগান, আরও জায়গায়। এলাকায় নেমে ডুগডুগি বাজানো, সঙ্গে মুখে লব্জ ‘চুল...ল...ল, বা...স...ন। চুল দিন, বাসন নিন।’

আওয়াজ শুনে মহিলারা বাড়ির বাইরে আসেন। সঙ্গে ঠোঙায় চুল। প্রতি দিন আঁচড়ে বেরনো চুলগুলো ‘গুলি’ করে রাখা। সাধারণ হিসাবে এক জন মহিলার মাথা থেকে মাসে ষাট গ্রাম চুল ওঠে। আর যে মহিলা ন্যাড়া হন (নানা কারণে তা হতে পারেন, তবে প্রধানত তিরুপতি মন্দিরে গেলেই হন), তাঁদের মধ্যে লম্বা অথচ মাঝারি-ঘন চুলের মালকিনদের মাথায় ২৮৪ গ্রামের মতো চুল থাকে, যার সঙ্গে এই আঁচড়ে বের করা চুলের কোনও হিসেবই মিলবে না। দাম ১৭৯০০ টাকা। আর সবচেয়ে ঘন ও লম্বা চুলের মহিলাদের মাথায় ৪৫৪ গ্রাম চুল থাকে, যার দাম ২৯৯০০ টাকা।

চুল-ব্যবসায়ীদের কাঁধের ব্যাগে থাকে ১ কিলো থেকে ৫ গ্রাম অবধি বাটখারা। সাধারণত ২০ গ্রামের গুলি পাকানো চুলের পরিবর্তে ২০ টাকার বাসন, ৫০ গ্রামে ৫০ টাকা দামের। তবে একটা শর্ত আছে। চুলের মাপ অন্তত ১০ ইঞ্চি লম্বা হতে হবে। এই ব্যবসায় চুলের মাপটা বড় ব্যাপার। চুলের পাঁচটা রকম। ৩১ ইঞ্চির লম্বা, ১৬ থেকে ৩০ ইঞ্চি, ১০-১৫ ইঞ্চি, ৫ থেকে ৯ ইঞ্চি, ৫ ইঞ্চির তলায়ও আছে। তা দিয়ে কোটের লাইনিং তৈরি হয়। এ সব অবশ্য বড় ব্যবসায় কেনাবেচার হিসাব। সাহিলদের এই সব রকম চুল কেনার রেস্ত নেই। তাঁরা যাঁদের দেওয়া টাকা ও মালে ব্যবসা করেন, তাঁরা হলেন মিড্‌লম্যান। এঁদের পুঁজিও বিশাল নয়। এমন এক জন হলেন মানোয়ার শেখ, তাঁর ঘর দেখলে মনে হবে বাসনপত্তরের গোডাউন। এক পাশে থাক-থাক করে রাখা কাগজের বাক্স, যার মধ্যে চুল ভরা আছে।

চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই মানোয়ার সবজির ব্যাপারী ছিলেন, পরে এই লাইনে এসেছেন। প্রথম প্রথম ভীষণ ঘেন্না করত, পরে অভ্যেস হয়ে গেছে। নিজের ছেেলরা এই লাইনে আসুক, চান না। চুল কেনেন ‘গ্রাম’-এর হিসেবে, বেচেন কিলো-তে। মেদিনীপুর থেকে লোক এসে নিয়ে যায়।

মেদিনীপুরে মানোয়ার ও অন্য ব্যবসায়ীরা চুলের যোগান দেন, তা ছাড়াও কলকাতা ও আশপাশের বিভিন্ন বিউটি পার্লার থেকে চুল নিয়ে সেখানে পাঠান আরও কিছু ব্যবসায়ী। পার্লারে চুলের বদলে বাসন দেওয়া হয় না, একেবারে নগদ।

এখান থেকে চুল কেনেন এমন কয়েক জনের সঙ্গে আলাপ করলাম। মাঝবয়সি সিরাজ শেখ, সাকিন পলাশি, যেখানে আদ্ধেক পুরুষের নাম সিরাজ। চুলের সিরাজ গর্ব করে বললেন, ‘যেখানটায় যুদ্ধ হয়েছিল, আমার বাড়ি সেখানটায়।’ সিরাজ সাইকেলে চড়ে, ব্যাগে কাগজের বাক্স নিয়ে মোটামুটি কলেজ স্ট্রিট থেকে হাতিবাগান পর্যন্ত বিউটি পার্লারগুলোতে ঘোরেন। তাঁর মতে, এই এলাকা তাঁর নিজের। কেননা, তাঁর লেখাপড়া জানা ভাই শ্যামবাজার পাঁচমাথায় ট্রাফিক পুলিশ। ইনি কেনেন কিলো প্রতি দুই থেকে তিন হাজার টাকায়। চুল অন্তত বারো ইঞ্চি লম্বা হতে হবে, এই কড়ারে। এঁদের দাঁড়িপাল্লায় নাকি সোনা মাপা যায়, এমন দাবি করলেন আরও দুই ব্যবসায়ী রহিত শেখ আর পিন্টু শেখ। যে পার্লারে তাঁদের সঙ্গে আলাপ, সেখানকার মালকিন বললেন, ‘একেবারে বকওয়াস, আমার পার্লারের মেয়েরা বলেছে, এদের হাতসাফাই মারাত্মক।’

হাজার-দু’হাজারের কাহিনি ছেড়ে, কোটি-তে যাই। তিরুপতি মন্দিরে বছরে গড়ে ২০০ কোটি টাকার চুল বিক্রি হয়। সারা বছর ধরে মন্দিরে এসে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে ন্যাড়া হন। মন্দিরে ৬৫০ জন নরসুন্দর, যার মধ্যে ৬০ জন মহিলা ঘণ্টা প্রতি গড়ে দশটা মাথা হিসেবে কাজ করে যান। এর মধ্যে মেয়েদের বড় কালো চুলের চাহিদা ইউরোপ, আমেরিকায়। চিন কেনে ছোট চুল, তা-ই দিয়ে তারা কম খরচে পরচুলা তৈরি করে আমেরিকা, আফ্রিকায় পাঠায়। বলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মন্দিরের চুলের পরচুলা ভীষণ পছন্দ করেন। কিন্তু বিদেশের মহিলাদের একই চুল পছন্দের কারণ, এ চুলে কোনও রাসায়নিক মাখা থাকে না। যা থাকে, তা হল তেল।

চিনা ব্যবসায়ীরা তিরুপতির চুল নিলামেও থাকেন, আবার ছোট ‘ঠেক’গুলোতেও আসেন। যেমন আসেন বাজকুল ও অন্যান্য ব্লকগুলোয়।

সেখানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েদের কাছে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের লোকেরা চুল দিয়ে আসেন। মেয়েরা প্রথমে কাঁটা দিয়ে গোলাগুলো ছাড়ান, তার পর সাবানজলে পরিষ্কার করেন। শুকিয়ে কাঁটায় আটকে সোজা করে আবার গুছি করেন। কাঠের ওপর পেরেক আটকানো ইঁদুরকলের মতো কিছু মেশিনও আছে। সেগুলো দিয়েও চুল সাইজ করা হয়। আট ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকায় কোম্পানিগুলোর ‘টার্নওভার’ কোটির হিসেবে। চুলের দৌলতে এলাকায় বেকারত্বও কম। ‌

তাই এ বার থেকে আঁচড়ানোর সময় চুল উঠে গেলে, দুঃখু না করে, দৌড়ে বারান্দায় যান। কোথায় কোথায় লক্ষ্মী বসে আছেন, কে বলতে পারে?

mallikabikash@yahoo.co.in

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement