সময়টা ২০১৭। নভেম্বরের শেষ। কালিম্পঙের এসপি ছুটিতে। তাই দার্জিলিং ছেড়ে কালিম্পঙে এসেছি। পাহাড় তোলপাড় করে খুঁজছি কয়েক জনকে। উঠেছি ত্রিবেণীর কাঠ-বাংলোয়। জায়গাটা গ্যাংটকগামী এন এইচ ১০-এর গায়ে তিস্তা নদীর ধারে। ইচ্ছাকৃত অজ্ঞাতবাস। বাংলোর উল্টো পারে জঙ্গলের বুক চিরে বয়ে চলেছে রঙ্গিত। রাত নামে নিঃশব্দে। কুয়াশায় আবছা দূরের পাহাড়। হালকা নীল আলোয় দুধ-সাদা বিছানায় গড়িয়ে পড়তেই মোবাইল বাজল।
‘হ্যালো’ বলতেই কালিম্পং থানার ওসি পালডেন ভুটিয়ার উত্তেজিত গলা, ‘‘স্যর, আমাদের থানার লেডি হোমগার্ড ভাবনা তামাং সন্ধে থেকে নিখোঁজ। মাস দেড়েক আগে বিয়ে হয়েছিল। আজ দুপুরে কালিম্পঙে একটা অনুষ্ঠান সেরে হাজ়ব্যান্ডের সঙ্গে বাড়ি ফিরছিল। রম্বি-তে। সন্ধে ছ’টা নাগাদ ওর হাজ়ব্যান্ড তিস্তা ব্রিজের কাছে গাড়ি থামিয়ে সিগারেট কিনতে যায়। ফিরে এসে দেখে গাড়িতে ভাবনা নেই। কোথাও খুঁজে পায়নি। ভাবনার মোবাইল পড়ে আছে গাড়ির সিটে।’’
‘‘সে কী? ওটা তো সিকিমের লাইফ লাইন, সারা ক্ষণ গাড়ি চলে! আমি আসছি’’, বলে ফোন ছাড়লাম।
ত্রিবেণী থেকে ঋষি রোড ধরে কালিম্পং। পালডেন থানার বাইরে অপেক্ষা করছে। ওসির চেম্বারে গিয়ে বসতেই বলল, ‘‘স্যর, ভাবনা শুধু হোমগার্ড ছিল না, খবরির কাজও করত। ওর খবরেই গল্ফ কোর্সের এনকাউন্টারটা হয়েছিল গত জুলাইয়ে। আপনি তো জানেন স্যর, বেশ ক’টা চাঁই নিকেশ হল।’’
‘‘হুম, হাজ়ব্যান্ডকে ডাকো।’’
সঞ্জয় সুব্বা ঠিক মঙ্গোলয়েড নয়। টিকোলো নাক আর বড় বড় চোখ। ঝকঝকে চেহারা। সে বলল, তিস্তার পাড়ে ফল-সব্জির দোকানগুলো ছাড়িয়ে ত্রিশ মিটার দূরে বাঁ দিকে তিস্তার পাড়ে গাড়ি দাঁড় করিয়েছিল, ব্রিজের দিকে হেঁটে গিয়ে সিগারেট কিনে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ফিরে দেখে, ভাবনা নেই।
‘‘ভাবনার ফোটো আছে? তোমাদের আজকের প্রোগ্রাম ডিটেলে বলো।’’
সঞ্জয় ওর মোবাইলের গ্যালারি খুলে দেখাল। কয়েক ঘণ্টা আগেই তোলা ফোটো। পাহাড়ি সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, ভাবনা তাই। ডেনিম জিন্সের উপর কালো পুলওভার পরা আকর্ষক চেহারা। কানে লম্বা ঝোলা দুল আর গলায় মোটা চেনে হার্ট-শেপের হিরের পেন্ডেন্ট, অনেকগুলো ছোট ছোট হিরে, মাঝে বড় একটা, আট-দশ ক্যারাট হবেই। পনেরো-কুড়ি লাখ তো হবেই! কালো পুলওভারের উপর ফ্ল্যাশের আলো হিরের দ্যুতি বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
সঞ্জয়ের পিসতুতো বোনের এনগেজমেন্ট ছিল কালিম্পঙে ডাম্বার-চকের কাছে গুরুং লজে। ওরা একটায় পৌঁছয়, অনুষ্ঠান শেষে সাড়ে পাঁচটায় বেরিয়ে আসে। বিভিন্ন অতিথিদের সঙ্গে ফোটো। সব ফ্রেমেই ভাবনা মধ্যমণি। গ্যালারি ঘাঁটতে গিয়ে আগে তোলা কয়েকটা অন্তরঙ্গ ফোটো পেলাম সঞ্জয়ের সঙ্গে। ভাবনা সাবলীল, তবে সঞ্জয় যেন আড়ষ্ট।
‘‘তিস্তা বাজারে তখন ভাবনার চেনাজানা কাউকে দেখেছিলে? কোনও গাড়ি তোমাদের ফলো করছিল? এনি সাসপেক্ট?’’ সঞ্জয়ের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলাম।
‘‘স্যর, তিস্তা বাজারে ওর অনেক চেনাজানা, প্রায়ই ওখানে ডিউটি পড়ত। রাস্তায় যেমন গাড়ি চলে, তেমনই চলছিল। আমার কিছু মাথায় আসছে না স্যর, ভাবনার সঙ্গে কার কী দুশমনি থাকবে! সবে পঞ্চাশ দিন বিয়ে হয়েছে, কারও সঙ্গে দুশমনির কথা তো বলেনি! আপনাদের ডিপার্টমেন্টে কাজ করত...’’
‘‘এনগেজমেন্টে যারা এসেছিল, কারও সঙ্গে শত্রুতা ছিল?’’
‘‘স্যর, রাকেশ সুব্বা আমার কাজ়িন, রম্বি-তেই থাকে, আমার বাড়ির পাশেই। গরুবাতানে টি-গার্ডেন নিয়ে ওর সঙ্গে তিন বছর কোর্টে কেস চলছে, কিন্তু ও হেরে যাবে। আমাকে দেখতে পারে না। ও-ও ছিল আজকের পার্টিতে। আমাদের আধ ঘণ্টা আগেই বেরিয়ে এসেছে।’’
‘‘ওর ছবি আছে?’’ পালডেন জিজ্ঞাসা করে।
সঞ্জয় গ্যালারি খুঁজে ফোটো বের করে পালডেনকে দেখায়। পালডেন দেখে আমাকে দেখায়। পোজ দিয়ে তোলা ফোটো নয়, বাই চান্স ফ্রেমে এসে গিয়েছে। রাকেশের চেহারা সঞ্জয়ের চেয়ে ভাল। মুখটা গোমড়া। পোশাক সাদামাটা।
‘‘ওকে। খোলা কমপ্লেন লিখে দাও। শিয়োর না হয়ে কোনও সাসপেক্টের নাম লিখো না।’’
সঞ্জয় বেরিয়ে যেতেই পালডেন বলল, ‘‘ভাবনা এএসআই শরণকে বলে তিস্তা ব্রিজে হামেশা পিকেট-নাকা ডিউটি নিত।’’
শরণকে ডাকা হতে সে বলল, ‘‘ভাবনা নিজেই ওখানে ডিউটি চাইত। ওর অনেক অ্যাডমায়ারার ছিল তিস্তা বাজারে। বছর দুয়েক বিক্রম গুরুং বলে একটি ছেলের সঙ্গে ভাব ছিল। পরে আকাশ রাই বলে একটি ছেলের সঙ্গে গোয়া না কোথায় বেড়াতে গিয়েছিল। এই নিয়ে বিক্রমের সঙ্গে আকাশের এক বার মারপিটও হয়, আমিই মিটমাট করে দিয়েছিলাম। পরে ও আর একটি ছেলের প্রেমে পড়ে, নাম নিশ্চল ছেত্রী।’’ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘‘ভাবনা খুব মিশুকে ছিল স্যর, আর চটপট প্রেমে পড়ত। তার পর হঠাৎ এই সঞ্জয়কে বিয়ে করল।’’
জানতে চাইলাম, ‘‘এটাও কি প্রেম করে?’’
‘‘না স্যর, সঞ্জয় ওকে এই তিস্তা ব্রিজে দেখে পছন্দ করে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল, ভাবনা লুফে নেয়। কোটি কোটি টাকার মালিক সঞ্জয়, অনেকগুলো চা বাগানে শেয়ার, রিসর্ট, নর্থ-ইস্টে সাপ্লাইয়ের ব্যবসাও আছে।’’
‘‘এত টাকার মালিক, দেখতেও স্মার্ট, হোমগার্ডকে বিয়ে করল কেন?’’ একটু অবাক লাগল।
‘‘স্যর, হোমগার্ড হলেও ভাবনা অত্যন্ত সুন্দরী আর ফিগারটাও দারুণ, ওর সৌন্দর্যের জন্যই সঞ্জয় ওকে বিয়ে করেছিল, ভাবনা আমাকে তাই বলেছিল স্যর।’’
‘‘হুম, তা হলে তিস্তা বাজারেই ওর দুশমন তিন জন!’’
‘‘না স্যর, পুরা একগন্ডা,’’ শরণ বলে, ‘‘তিস্তা বাজারের সব চেয়ে বড় মুদিখানার মালিকের ছেলে দীনেশ শর্মাও ওকে বিয়ে করার জন্য পাগল ছিল, তবে ভাবনা পাত্তা দিত না!
পালডেনের দিকে ফিরে বললাম, ‘‘ভাবনাকে খুঁজে বার করাটাই আমাদের প্রথম কাজ, তিস্তা ব্রিজে চলো, জায়গাটা দেখব।’’
থানার বাইরে বেরোতেই আমাদের পিছন-পিছন সঞ্জয়ও নেমে এসেছে রাস্তায়। সঞ্জয়ের ধূসর রঙা গাড়িটাও সেখানে। সঞ্জয় বলল, ‘‘স্যর, আমি গাড়ি চালাচ্ছিলাম আর ভাবনা পাশের সিটেই বসেছিল।’’
সঞ্জয়কে বলে গাড়ি খোলাতেই নাকে লাগল পারফিউমের গন্ধ। বেলা বারোটা-একটার গন্ধ এখনও রয়েছে! সন্দেহ হতেই, ড্যাশবোর্ড খুললাম, আমার সন্দেহটা ঠিক, ভিতরেই রয়েছে পারফিউমের শিশিটা। ড্যাশবোর্ডের জিনিসপত্র একটু নাড়াচাড়া করে বন্ধ করে দিলাম। গাড়ির পিছনের সিটে পড়ে আছে ভাবনার ছোট্ট ভ্যানিটি ব্যাগ। মেয়েদের ব্যাগে হাত না দেওয়ার শিক্ষা কিডন্যাপিং-এর ক্লু খুঁজতে গেলে মনে রাখা যায় না। চেন খুলতেই দেখলাম ভিতরের ছোট পকেট। ওটার চেন টানতেই দেখলাম মোবাইল সিম কার্ড। সবার অলক্ষ্যে সিম-কার্ডটা ব্লেজ়ারের পকেটে পুরে নিলাম। বাকি জিনিসের মধ্যে এক বান্ডিল টাকা, রুমাল, হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ার, খুচরো পয়সা, কয়েকটা সেফটি-পিন, চিরুনি, লিপস্টিক, মেকআপের কিছু জিনিস। গাড়ির সিটেই ব্যাগ রেখে মাথাটা বার করে আনলাম।
ভাবনার পনেরো হাজার টাকা মাইনেয় নিশ্চয়ই এ সব হয় না। সঞ্জয় তার বৌয়ের পিছনে ভালই খরচ করত। ভালবাসত নিশ্চয়ই। যদি দুষ্কৃতীর আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়, তাই ওই গাড়িটা বন্ধ করে রেখে সঞ্জয়কে নিয়ে উঠলাম বড়বাবুর গাড়িতে। গন্তব্য তিস্তা ব্রিজ। ঘটনাটা রিকনস্ট্রাকশন করে দেখা দরকার।
তিস্তা ব্রিজ পেরিয়ে বাঁ হাতে সারি সারি সব্জি-ফল-পান-সিগারেটের গুমটি। ওগুলো পেরিয়ে সঞ্জয়ের গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় এলাম। ওকে নিয়ে হেঁটে ফিরলাম সিগারেট গুমটির কাছে। পালডেনকে ইশারায় সঞ্জয়ের সঙ্গে একটু এগোতে বললাম ব্রিজের দিকে। সারা রাত গাড়ি চলে এই রাস্তায়, পান-সিগারেটের গুমটি তখনও খোলা। আমাদের দেখতে পেল দোকানদারও। সঞ্জয়ের সঙ্গে কি একটু চোখাচোখি হল?
ওর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘ইয়ে যো সাবকো অভি দেখা, উনোনে শামকো ইঁহাসে সিগারেট লিয়া থা?’’
‘‘জি স্যর’’, ছোট্ট উত্তর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে দোকানদার।
‘‘কিতনা লিয়া থা?’’ আবার জানতে চাইলাম।
‘‘এক হি স্যর, ইঁহাহি মাচিসসে জ্বলায়া অউর চলা গিয়া।’’
‘‘সিধা পিছে গিয়া?’’
‘‘ম্যায়নে ধ্যান নহি দিয়া সঞ্জয়বাবুকে উপর,’’ দোকানদারের চটজলদি উত্তর।
‘‘পহেচানতে হো উনকো? শামকো ইধার উনকে সাথ কেয়া হুয়া মালুম হ্যায়?’’
‘‘সঞ্জয়বাবুকো কওন নহি পহেচানতা? লেকিন কোই ঘটনাকে বারেমে মুঝে পতা নহি।’’
দোকানদারকে ছেড়ে এগিয়ে গেলাম, ভাবনা যেখানে ডিউটি করত সেখানে। পালডেন, সঞ্জয় আর বাকিরা ওখানে দাঁড়িয়ে।
আমাদের দেখে কয়েক জন জড়ো হয়ে গিয়েছে। চোখে কৌতূহল।
আলাদা করে শরণকে বললাম, ‘‘ভাবনার অ্যাডমায়ারার বা প্রাক্তনরা কে কোথায় আছে খোঁজ নাও, আমরা এক বার রম্বিতে সঞ্জয়বাবুর বাড়ি ঘুরে আসি।’’
শরণ ঘাড় নাড়তে, আমরা রওনা দিলাম রম্বি। সঞ্জয়ের বাড়ির বৈভব চোখে পড়ার মতো, দুর্মূল্য এবং দুষ্প্রাপ্য জিনিস দিয়ে সাজানো সঞ্জয়ের ড্রইং রুম।
আমার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে সঞ্জয় বলে, ‘‘আচ্ছা চিজকা মেরা বহত শওখ হ্যায় স্যর।’’ একটা দিকের দেওয়াল জুড়ে বড় একটা ফ্রেমে বহু সুন্দর যুবক-যুবতীর ফোটো সাজানো। ফ্রেমের কাছে এগিয়ে গিয়ে চোখ বুলিয়ে নিলাম, সবই প্রায় চব্বিশ-ছাব্বিশ বছরের ছেলে-মেয়ে।
‘‘এরা কারা?’’ কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করলাম।
‘‘স্যর, এরা আমার কোনও না কোনও ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে, ওদের ফোটো আমার ড্রইং রুমে দেখলে ওরা এনকারেজড হবে, তাই রেখেছি স্যর।’’
এর মধ্যেই ফোন এল শরণের। জানা গেল তিস্তাবাজারে ওই তিন জনের কেউ নেই। সকলেরই কিছু না কিছু অজুহাত আছে। শরণকে জানিয়ে দিলাম, ওরা বাড়ি ফিরলেই যেন থানায় দেখা করতে বলে দেয়।
সঞ্জয় আমাদের বেডরুমে নিয়ে গেল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম ভাবনার জিনিসপত্র, ওর লেখা ডায়েরি, অনেকগুলো পেজে ছোট ছোট লেখা। পালডেনকে বললাম, ‘‘নিয়ে নাও, থানায় অবসরে পড়বে।’’
সঞ্জয় উসখুস করছে। বলল, ‘‘স্যর, টেনশন হচ্ছে খুব, এত রাতে যদি খারাপ কিছু হয়? প্লিজ় কিছু করুন স্যর’’, কাতর মিনতি সঞ্জয়ের গলায়।
একটু পরে সঞ্জয় বেরিয়ে যায় সিগারেট খেতে। সঞ্জয় ফিরে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘দাঁতে ব্রাউন ছোপ পড়ে গিয়েছে, ক’টা সিগারেট খাও রোজ?’’
‘‘স্যর, মারাত্মক নেশা আমার, ত্রিশ-চল্লিশটা হয়ে যায়...’’
‘‘দেখো, আমরা চেষ্টা করছি। কোনও খবর পেলে বা সন্দেহজনক কিছু মনে হলে খবর দিয়ো’’, সঞ্জয়কে সান্ত্বনা দিয়ে ওদের বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি, সঞ্জয় হাত বাড়িয়ে রাকেশের বাড়ি দেখাল একটু দূরেই। বাড়ির বাইরে একটা সেডান পার্ক করা রয়েছে। তার মানে রাকেশ বাড়িতেই আছে।
‘‘পালডেন, এনগেজমেন্টে কারা কারা এসেছিল, কারও সঙ্গে ভাবনা কিংবা সঞ্জয়ের দুশমনি ছিল কি না খুঁজে বার করো। দেখবে সঞ্জয়ের কোনও ব্যবসায় কারও সঙ্গে শত্রুতা ছিল কি না। ওর কাজ়িন রাকেশের ব্যাপারটাও খোঁজ নেবে লোকালি। তা ছাড়া ভাবনার পুরনো ব্যাপারগুলোও ভাল করে দেখে নাও। কিছু পেলে জানিয়ো।’’
নানা ব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেল পরের দিনটা, ভাবনার খোঁজ নেই। তার পরের দিন সকালে রওনা দিয়েছি জলঢাকার জন্য। করোনেশন ব্রিজ পেরিয়ে চালসা পর্যন্ত চলে এসেছি ন’টার মধ্যেই। হঠাৎ মোবাইলে রিং হতেই ফোন ধরলাম। পালডেনের উত্তেজিত গলা, ‘‘স্যর ভাবনার বডি পাওয়া গিয়েছে মংপং পার্কের গায়ে, তিস্তার জলে। আমাদের ফাঁড়ির অফিসার গিয়েছিল। সম্ভবত গলায় ফাঁস লাগিয়ে মার্ডার। জামাকাপড়ের অবস্থা দেখে বিফোর স্ট্রাঙ্গুলেশন সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আমি রওনা দিয়েছি, আপনি কি আসবেন স্যর?’’
‘‘নাহ, যেতে পারলে ভাল হত, কিন্তু বড় একটা কাজ আছে এ দিকে, তুমি ভিভিডলি ফোটো তুলে হোয়াটসঅ্যাপ করো। ভ্যাজাইনাল সোয়াব প্রিজ়ার্ভ করতে বলবে। রেপ হয়েছে কি না, প্রেগন্যান্ট ছিল কি না জানবে অটোপ্সি সার্জেনের থেকে।’’
চা খেয়ে বেরিয়ে গেলাম চালসা থেকে।
মাল পেরিয়ে খুনিয়া মোড়ের কাছে পৌঁছতেই ফের পালডেনের ফোন, ‘‘স্যর, একটা সাদা এসইউভি দেখা গিয়েছে। ছ’মাইল দূরে এক ডাক্তারের বাড়ির বাইরের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে। ওটা সঞ্জয়ের গাড়ির মিনিট পাঁচেক পরে কালিম্পং থেকে নামছিল, রেজিস্ট্রেশন নাম্বার থেকে শিলিগুড়ির প্রধাননগরের নাম-ঠিকানা পেয়েছি, স্যর।’’
‘‘তুমি এসইউভি-র নাম্বার, নাম-ঠিকানা এসএমএস করে দাও, দেখছি!’’ বললাম আমি।
দুপুরের আগেই পৌঁছে গেলাম জলঢাকা থানা। ওখানকার ওসি জ্যোতি রাইকে নিয়ে বিন্দুর কাছে ডায়মন্ড রিসর্ট রেড করলাম। ভিতরের গ্যারেজে সাদা রঙের এসইউভি, সামনে নাম্বার প্লেট নেই। আমার অনুমান বলছে, এটাই সেই এসইউভি। আমি যাদের খুঁজছি, রেজিস্টারে তাদের নাম না থাকারই কথা, তবুও চেক করলাম। নাম নেই। খুঁজতে খুঁজতে পাশাপাশি দু’টো কটেজে পেয়ে গেলাম আদিত্য থাপা, ভানু রাই আর বাগিরা প্রধানকে।
সেই মুহূর্তে পালডেনের ফোন, ‘‘স্যর, ভাবনার মৃত্যুর খবর পেয়ে সঞ্জয় একেবারে ভেঙে পড়েছে, কান্নাকাটি করছে, আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে...’’
‘‘কথা বলব, ওকে নিয়ে এসো জলঢাকা। বেশি ভেঙে পড়লে বলো, আমি ডায়মন্ড রিসর্টে রয়েছি, দেখবে কেমন সোজা হয়ে যায়!’’
‘‘সমঝ গিয়া স্যর’’, উচ্ছ্বসিত পালডেন।
সঞ্জয়কে নিয়ে পালডেন যখন জলঢাকা থানায় পৌঁছল, তখন বিন্দুর জঙ্গলে বুনো-ময়ূররা শেষ বিকেলে গিরগিটি-পোকামাকড়ের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছে। থানায় বিধ্বস্ত আদিত্যদের দেখে চমকে ওঠে সঞ্জয়।
‘‘চমকে আমিও উঠেছিলাম সঞ্জয়, যখন দেখলাম তোমার গাড়ির ড্যাশবোর্ডে দু-দু’টো সিগারেটের প্যাকেট থাকার পরও তুমি সিগারেট কিনতে তিস্তা-ব্রিজের দিকে হেঁটেছিলে!
‘‘কাল সকালেই রাকেশের ফোন পেয়ে জানলাম, তুমি বাইসেক্সুয়াল। রাদার মেয়েদের চেয়ে যুবক ছেলেদের বেশি পছন্দ করো। তোমার পার্টনারদের ফোটো তোমার ড্রইং রুমের ফ্রেমে। আদিত্য থাপার ছোট ভাই বদ্রীনারায়ণ তোমার পার্টনার ছিল। ভাবনার দেওয়া খবরে বদ্রী এনকাউন্টারে মারা যায় আর বদলা নিতে খেপে ওঠো তুমি। তাই ভাবনার প্রেমিক আছে জেনেও তুমি প্রায় জোর করে ওকে বিয়ে করলে!’’
পালডেনকে বললাম, ‘‘আদিত্যদের গ্যাংটা আমাদের বড্ড জ্বালাচ্ছিল, ওদের ধাওয়া করেই আমার দার্জিলিং পাহাড় থেকে কালিম্পং আসা। হন্যে হয়ে খুঁজছিলাম এই গ্যাংটাকেই, ভাবনার ইস্যুতে জড়িয়ে না পড়লে এরা আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকত। আসলে সঞ্জয় এদের অনেক টাকাপয়সা দিত। ও বদ্রীর মৃত্যু মানতে পারছিল না। সঞ্জয়ের মোবাইলের পুরনো কল ডিটেলস ঘাঁটলেই বদ্রীর ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।
‘‘কাল শিলিগুড়ি থেকে ফিরে শরণের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে নিশ্চল ছেত্রী ফোন করেছিল আমায়। ভাবনা দু’মাসের প্রেগন্যান্ট, বিয়ের সময় জানত না, টাকার লোভে সঞ্জয়কে বিয়ে করেছিল। ওর ব্যাগে একটা মোবাইল সিম ছিল, ওটা দিয়ে সঞ্জয়কে লুকিয়ে শুধু নিশ্চলকেই ফোন করত। ওর কল ডিটেলস আমার ইমেলে আনিয়েছি।’’
পালডেনকে বললাম, ‘‘প্রধাননগর থানায় ফোন করো, আমার নাম করে বলো এদের আর এক পার্টনার বিনয় থাপা গিয়েছে এলিট অ্যাপার্টমেন্টে ৮০২ নম্বর ফ্ল্যাটে। ওখানে আছে সঞ্জয়ের প্রেমিকা সারিতা, এই এসইউভি-টা সারিতা রাইয়ের নামে, তাই তো?’’
পালডেন ঘাড় নাড়ে।
‘‘আমার হিসেব ঠিক হলে, ভাবনার গলার ডায়মন্ডের পেন্ডেন্টটা এখন ওই সারিতারই হেফাজতে আছে। ডেডবডির কানে লম্বা ঝোলা দুল দু’টো থাকলেও গলার পেন্ডেন্টটা ছিল না। তিস্তা ব্রিজে ভাবনাকে তোলার পর চার-মূর্তি ভাবনাকে করোনেশন ব্রিজে নিয়ে আসে,
হিরের চেনটা নিয়ে বিনয় নেমে যায় ওখানে। তার পর এরা তিন জনে ভাবনাকে নিয়ে যায় মংপং পার্কে, রেপ করে গলায় ফাঁস লাগিয়ে মেরে ফেলে দেয় তিস্তায়।’’
পালডেন উঠে গিয়ে হাতে হাতকড়া পরাতেই সঞ্জয় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে হাতকড়ার দিকে।